সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

সপ্তমীতে ভিড় সামলাতে জেরবার অবস্থা হল নীলুদের। ভিড় যে ভালোই হবে সেটা বুঝেছিল, কিন্তু এতটা হবে ভাবে নি। ভোর রাতের দিকে মণ্ডপ ফাঁকা হল। নীলু আর ওর বন্ধুরা তখন খুব ক্লান্ত। কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্যে যে যার বাড়ি গেল। ভোর থেকেই তো আবার অষ্টমী পুজোর জোগাড় শুরু হবে। মণ্ডপে পাহারা রয়েছে, একটা এজেন্সি থেকে নেওয়া হয়েছে দুজনকে। তাছাড়া পাড়ার বিল্টুদা আছে। ওদের ভরসাতেই নীলুরা বাড়ি গেল।

সকাল হতে না হতেই পুজোর জোগাড়ে পাড়ার মা কাকীমারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পিসিমণিও আছেন। আর তখনই ব্যাপারটা সবার নজরে পড়ল। ছোটো প্রতিমার গলা থেকে সোনার হার উধাও! সবাই চেঁচামেচি করে উঠলেন, একজন থেকে দশজন জানল, মিসেস সরকার হায় হায় করে কপাল চাপড়াতে লাগলেন। শুধু এক পিসিমণিরই কোনো তাপ উত্তাপ নেই।

"বড়দি, আপনি যে কিছু বলছেন না! দেখেছেন মার হার চুরি হয়ে গেছে," বললেন একজন।

"তুমি যা দেখছ, আমিও তাইই দেখছি ভাই। হার যে মার গলাতে নেই সে তো ভালোই দেখতে পাচ্ছি," অঞ্জলির জন্যে ফুল বেলপাতা ঠিক করে রাখতে রাখতে পিসিমণি উত্তর দিলেন।

দেখতে দেখতে মণ্ডপে সবাই এসে গেল, সবাই খুব উত্তেজিত, কী করা যায় তাই নিয়ে সবাই নিজের মতামত দিচ্ছে।

"বড়ো প্রতিমার গলায় হারটা থাকলে এটা হত না। চোর সাহসই করত না। ছোটো ঠাকুরের গলায় রয়েছে, একপাশে ঠাকুরটা রয়েছে, কারুর খেয়ালই হয় নি। এই সুযোগটাই চোর নিয়েছে," নীলুর এক বন্ধু বলল।

"বছরে পাঁচদিনের জন্যে মা আসেন। কিন্তু তোমরা তাঁকে পোড়োবাড়িতে বাদুড় চামচিকের মধ্যে রাখবে, অনাদরে মলিন বানাবে, যে মূর্তির পুজো হবে না তাকেই সবাই ধন্যি ধন্যি করবে – এরপরেও কি আর মার গয়না পরার ইচ্ছে থাকে বাছা?" পিসিমণি আড়চোখে একবার নীলুদের দেখে নিয়ে বললেন।

ইতিমধ্যে পুরুতমশাই এসে গেছেন, পুজোর সময় হয়ে গেছে। তিনি আসনে বসতেই পিসিমণি ওনার বটুয়াটা খুলে একটা সোনার হার বার করে পুরুতমশাই-এর হাতে দিয়ে বললেন,"এই নিন ঠাকুরমশাই, হারটা মাকে আবার পরিয়ে দিন তো।" সবার তো চক্ষুস্থির। এটা তো সেই হারটাই! কিন্তু এটা পিসিমণির কাছে এল কী করে? জোর গুঞ্জন উঠল মণ্ডপের ভেতরে।

"তবে যে বললে হারটা চুরি হয়ে গেছে!"

"বড়দি পেলেন কোথা থেকে ওটা?"

"বড়দি তো কিছু বলছেনও না। চুরিই যদি হয়............"

পিসিমণি এতক্ষণ বসে বসে কাজ করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এবার তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।

সটান উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে জোরেই বললেন, "চুরি তো হয়েছিল। মার গলা থেকে হার খুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিভারানি বামনীর নাকের ডগা দিয়ে সে হার নিয়ে চোর পালাবে - এ তোমরা ভাবলে কী করে? যদ্দিন আমি বেঁচে আছি সেটি হচ্ছে না ভাই। তবে আমার সন্তুও খুব কাজের ছেলে। হার নিয়ে যে চোর পালাতে পারে নি যে কৃতিত্ব ওরও।"

সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকায়। কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। কী যে বলছেন পিসিমণি এসব, পুরো হেঁয়ালি! চোর নাহয় পিসিমণি আগেও ধরেছেন, তিনি অনেক কিছুই পারেন, কিন্তু এর মধ্যে সন্তু আসছে কোথা থেকে? সে আবার কী করল?

সবার অবস্থা দেখে অগত্যা পিসিমণিকেই সব খোলসা করতে হয়। নীলুরা সব বাড়ি ফিরে আসার পর ওই ভোর রাত্তিরেই পিসিমণি মণ্ডপের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। বাড়ি তো মণ্ডপের একদম কাছেই।

"এবারের এই পাহারাদার ছেলেগুলোকে আমার মোটে পোষায় নি। একটা তো সেদিন সন্ধ্যেবেলা আমাদের কথা গিলছিল একেবারে," বললেন পিসিমণি।

"কিন্তু বিল্টুদাও তো ছিল এখানে," নীলু বলল।

"তোমার বিল্টুদার কথা আর বোলো না বাছা। এসে দেখি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। কী আওয়াজ নাক ডাকার! বিকাশের ঢাকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে! আরেকটা ছেলেও দিব্বি চেয়ারের ওপর গা এলিয়ে ঘুমোচ্ছে! এর নাম পাহারা দেওয়া!" পিসিমণি দৃশ্যতই খুব বিরক্ত, "ভাগ্যিস আমার সন্তু ছিল। ও আর আমি দুজনে মিলেই তো চোর ধরলাম।"

"সন্তু!" সবাই একসঙ্গে বলে উঠল।

"রাত্তিরেও সন্তু ওরকম হুটহাট প্যাণ্ডেলে চলে আসে। দেখিস নি ষষ্ঠীর রাতে? মাঝরাতেও চলে আসছিল?" একজন বলল।

তা সত্যি। সন্তু এরকম অভিনব মণ্ডপ দেখে এতই অবাক হয়েছে যে নড়তে চাইছে না। মণ্ডপের গায়েই ক্লাবঘরে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, তাই সুযোগ পেলেই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে চলে আসছে।

"আমি প্যাণ্ডেলে ঢুকতেই দেখি সন্তু তোমাদের ওই ভাঙা ইঁটের পাঁজার আড়ালে রয়েছে। বাছার মুখখানা কীরকম যেন ফ্যাকাশে। আমাকে ইশারা করে ঠাকুরের দিকে দেখাল। আমি সেদিকে যেতেই দেখি তোমাদের আরেক পাহারাদার ভেতর থেকে বেরোচ্ছেন। একটা হাতের মুঠোয় কিছু আছে। আমাকে দেখেই শর্মা পালাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় আমার সন্তু ইঁটের পাঁজার ওই প্লাস্টিকের সাপ ছুঁড়ে মেরেছে ব্যাটার গায়ে। তাতে যেই একটু হকচকিয়ে গেছে আমি অমনি গালে সপাটে এক চড় কষিয়েছি। চড় খেয়ে হাতের মুঠো খুলে হার গেল পড়ে, সন্তু দৌড়ে এসে কুড়িয়ে আমার হাতে দিল। দুজনে মিলে তাকে টেনে এনে বাঁধলাম পোড়োবাড়ির থামে। বাছাধন তখন চোখে সর্ষেফুল দেখছেন। আরেকটা পাহারাদার ছেলেকে ধাক্কাধাক্কি করে ডেকে তুলে ফোন করালাম ওদের অফিসে। ফোনেই এমন দাবড়ানি দিলাম যে মালিক দৌড়তে দৌড়তে এল আরেকটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। তখন আবার একটা পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছিল, চোরটাকে সেই গাড়িতেই তুলে দিলাম। তা তারা বেশ খাতিরযত্ন করে নিয়ে গেল, হাজার হোক অতিথি বলে কথা! কিন্তু নীলু, এত কিছু হয়ে গেল, তোর বিল্টুদার ঘুম তো ভাঙল না! শেষে আমি এসে ডেকে তুলে বললাম, 'যাও বাছা, বাড়ি গিয়ে ঘুমোও।' সেও কোনো কথা না বলে চোখ রগড়াতে রগড়াতে চলে গেল।"

"কিন্তু আপনি আমাদের কিছু জানালেন না কেন বড়দি? একটা হাঁক দিলেই তো আমরা সব চলে আসতাম," পুজো কমিটির এক কর্মকর্তা বললেন।

"এই একটা চোরের জন্যে এত হাঁকডাকের কী দরকার ভাই? এর জন্যে এই নিভারানি বামনীই যথেষ্ট। তাছাড়া আমার সন্তু তো ছিলই সঙ্গে," এত কাণ্ড করেও পিসিমণি একেবারে নির্বিকার।

"সাক্ষাৎ মা দুর্গা আমাদের বড়দির ওপর ভর করেন। নাহলে কী আর একবার নয় দু দুবার বড়দি চোর ধরতে পারেন!" ভিড়ের মধ্যে কে যেন একজন বললেন।

"পোড়া কপাল আমার! কী কথার ছিরি!" প্রশংসায় গলবার পাত্রী পিসিমণি নন, "তবে একটা কথা বলি শোনো। সামনের বছর থিম থিম করে নাচার আগে মনে রেখো ভালোভাবে, সুষ্ঠুভাবে পুজো সম্পন্ন করাটাই আসল থিম। পোড়োবাড়ি হবে না ঝাঁ চকচকে প্রাসাদ – সেটা পরের কথা। নিন ঠাকুরমশাই, পুজো শুরু করুন। গোলমালে অনেক সময় নষ্ট হল।"

সন্তু অনেক কিছু পেল সেবার। পুজো কমিটি থেকে তো দিলই, পিসিমণিও নতুন জামা প্যান্ট কিনে দিলেন। খাতির যত্ন তো বেড়ে গেছিলই। একটা পুঁচকে ছেলের বুদ্ধি আর সাহসের কথা জানতে কারুর বাকি রইল না।

পুজো শেষ হয়ে যাবার পর সন্তুরা যখন চলে যাচ্ছে, পিসিমণি ওর বাবাকে ডেকে বললেন, "শোনো বিকাশ, সন্তুকে পড়াশোনা করিয়ো। ওর পড়াশোনা যেন বন্ধ না হয়। ছেলের আমার খুব বুদ্ধি। ওকে যত্ন করে বড়ো কোরো। কিছু দরকার হলে আমাকে জানিয়ো।"


ছবিঃত্রিপর্ণা মাইতি

অদিতি সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কর্মসূত্রে আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। বই পড়তে ভালোবাসেন। ভ্রমণ,ছবি তোলা,এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি লেখালিখিতেও সমান উৎসাহী। নানান ওয়েব ম্যাগাজিন ও পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা