আমার ছেলেবেলার পুরোটাই কেটেছে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে । বলতে গেলে আমি আপাদমস্তক এক গ্রামের মেয়ে । এই সুবাদে আম গাছে উঠে আম পাড়া , কুল গাছে ঢিল ছুঁড়ে কুল পাড়া এসব কিছুই ছিল আমার নখদর্পণে । তাই সরস্বতী পুজো হওয়ার আগেই আমার আর আমার বন্ধুদের অত্যাচারে গ্রামের সব কুলগাছই প্রায় ফাঁকা হয়ে যেত । তবে আমি দুরন্ত হলেও আমাদের গ্রামটি ভীষণ শান্ত। গঞ্জের সামান্যতম কোলাহল টুকুও এখানে অনুপুস্থিত । হাট বাজার তো দুরের কথা এমনকি আগে একটা চায়ের দোকানও এখানে ছিল না, তাই প্রথম যখন একটা চা আর চপের দোকান হল তখন সেই দোকানটিকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ আর আনন্দের অন্ত ছিল না । এখান থেকে দামোদর নদী বেশি দূর নয়। প্রতিবছর বর্ষাকালে ডিভিসি জল ছাড়ার পর নদী একেবারে টইটম্বুর হয়ে পড়ে তাই তখন আবার আলাদা করে গ্রামগুলোকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে হয়। এই হুজুগে জল দেখবার জন্য সেখানে বহুলোকের ভিড় হয়। বলতে গেলে একপ্রকার মেলা বসে যায়। কি থাকে না সেখানে ! বাদামভাজা , জিলাপি, ঝালমুড়ি সবকিছুরই দোকান বসে । আমিও আমার বাবার সাথে অনেকবার দামোদরের সেই ভয়াল রূপ দেখতে গিয়ে বাদামভাজা কিনে খেয়েছি। তাই বলা যায় প্রতিবছর এইসময় বানভাসি হওয়ার ভয় মানুষ যত না পায় তার থেকেও বেশি আনন্দ করে নেবার একটা সুযোগ পেয়ে যায় । বর্ষাকালে এখানে আর একটা জিনিস খুব বিখ্যাত সেটা হল পাহাড়পুরের কাদা। না, না, পাহাড়পুর কোন একপ্রকার মাটির নাম নয় ------- আমাদের গ্রামের নাম। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় প্রচুর কাদা হয় আর সেই প্যাচপেচে কাদা মাড়িয়ে স্কুল যাবার মজাটাই ছিল আলাদা ।
ছোট থেকেই দেখতাম বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের ছোঁয়া সবসময় এখানে লেগেই আছে। আজ নবান্ন তো কাল পৌষপার্বণ আর পরশু হয়ত গ্রামের শীতলা পুজো । তাই আমিও স্কুল না যাবার হাজার একটা বাহানা পেয়ে যেতাম । কার্ত্তিক মাসের সংক্রান্তিতে আমাদের গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বাড়ির গৃহিণীরা মাটির সড়াতে মাটির ভাঁড় রেখে তাতে ধানগাছ , শুশুনি শাকের গাছ, কলমি শাকের গাছ আর পাঁচ রকম কলাই দিয়ে ইতু পাতে। একমাস ধরে প্রতি রবিবার রবিবার সেটা পুজো করা হয় যার নাম ইতু পুজো । মনে আছে একবার মায়ের কাছে বায়না করেছিলাম আমি নিজে ইতু পাতব বলে আর পেতেওছিলাম। একমাস ধরে পুজো করার পর পৌষমাসের দুই তারিখে সেটা বিসর্জন করেছিলাম। অগ্রহায়ণ মাসে প্রত্যেক বাড়িতে গোলাভর্তি নতুন ধান হবার পর নবান্ন অনুষ্ঠান হয়। যখন ছোট ছিলাম তখন নবান্নের দিন সকালবেলা ঠাম্মা চাল বেটে দিত আর সেই চাল বাঁটা খাওয়ার স্বাদ আমি আজও ভুলতে পারিনা । এরপর দুপুরবেলা নয়রকম ভাজাভুজি আর তরকারি দিয়ে অতিথি সেবা করা হত। এই পদ্গুলির মধ্যে নারকেল ভাজা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। তখন পৌষমাসে আমাদের গ্রামে আর একটা মজার পার্বণ হত । মাটির ভাঁড়ে বিভিন্ন গাছগাছড়া আর কলাই দিয়ে ঘরের কলঙ্গিতে রেখে দিতাম। এর একটা মিস্টি নামও ছিল --' তোসোলা' । প্রতি রবিবার এটাতে আমরা জল দিতাম। একমাস জল দেবার পর একদিন এটাকে নদীতে ভাসিয়েও দিয়ে আসতাম আর ভাসিয়ে দিয়ে নদীর পাড়ে বসে দুধ পিঠে খেতাম। এই পার্বণটা এখন গ্রাম থেকেও প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। তাছাড়া প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিন আমাদের গ্রামে প্রত্যেক বাড়িতে তিনরকম পিঠে, কলাইয়ের ডাল আর নয় রকম তরকারি হাঁড়িতে রেখে খড় দিয়ে বাউনি বাঁধা হয় । পিঠে খাবার আনন্দে সেদিন আর সারারত ঘুম হত না আমার।
ওই দিন আর একটি দারুন উৎসব হত আমাদের গ্রামে যেটা এখন আর একদমই হয় না , সেটা হল টুসু ঠাকুর নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরানো । গ্রামের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজন ওইদিন ওদের টুসু ঠাকুর নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরত। আমাদের বাড়িতেও আসত । আমরা ওদের মিস্টি জল খেতে দিতাম। ওরা অনেক সুন্দর সুন্দর গান করত। একটা গান আমার এখনও কানে বাজে - ' গাঁদাফুলটি থোপনা থোপনা হলুদ বলে বেটেছি / ও শাশুড়ি গাল দিও না গো ...।' এরপরের দিন মানে পয়লা মাঘ বিকেলে গ্রামের সবাইয়ের বাড়িতে ধানের মড়াইএর তলায় উঠোন লক্ষ্মীর পুজো হয়। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের সকলে মিলে এই পুজোটিতে খুব আনন্দ করতাম। আমি আর আমার অন্য ভাই বোনেরা মিলে সেখানে আলপনা দিতাম । উঠোন লক্ষ্মী পুজোর প্রধান উপকরণ হল সর্ষেফুল । ছেলেবেলায় আমি আর আমরা দিদি অন্যের জমিতে এই সর্ষেফুল তুলতে গিয়ে অনেকবার জমির মালিকের তাড়া খেয়েছি ।