সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
হানুকা উৎসবের কথা

২৫শে ডিসেম্বর কোন উৎসব জিজ্ঞাসা করলে ছেলে বুড়ো সবাই লাফিয়ে উঠে বলি সেদিন তো বড়দিন। তার আগের দিন রাতে সান্তাবুড়ো এসে ছোটদের উপহার রেখে যান। পরের দিন আমরা কেক খাই। আমার ছোড়দি তো প্রতি বছর বড়দিনের দিন কমলালেবু, কেক আর জয়নগরের মোয়া দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতো। মূলতঃ খ্রীষ্টানদের উৎসব হলেও আমরা সবাই বড়দিন পালন করতে ভালোবাসি, কারণ এই উৎসব আলোর, আনন্দের, ছোটদের আর অনেক অনেক উপহারের। কিন্তু এই সময়ে আরো এক উৎসব পালিত হয়, হানুকা। এটি ইহুদিদের একটি উৎসব। হানুকা শব্দটি হিব্রু, অর্থ হল নিজেকে উৎসর্গ করা। এই উৎসবও ডিসেম্বরেই হয়, অনেক সময়ই বড়দিনের দিনও। আটদিন ধরে এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসব আলোর উৎসব, জয়ের উৎসব।

হানুকা উৎসব শুরুর একটি দারুণ গল্প আছে।

হানুকা উৎসবের কথা
রাজা চতুর্থ অ্যান্টিওকাস

বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত একটি দেশ, সিরিয়াতে ১৭১ খ্রীষ্টপুর্বাব্দে একজন গ্রীক রাজা রাজত্ব করা শুরু করেছিলেন। এই রাজার নাম ছিল চতুর্থ অ্যান্টিওকাস (Antiochus IV Epiphanes), তিনি গ্রীক ধর্মাবলম্বী ছিলেন। গ্রীক ধর্মাবলম্বী মানে গ্রীক দেবদেবীদের বিশ্বাস করা। গ্রীকরা অনেক দেবদেবীর মুর্তি পুজো করতেন। তাঁদের বারোজন প্রধান দেবতা ছিলেন, এঁরা হলেন জিউস, হেরা, পোসেইডন, ডিমেটর, এথেনা, অ্যাপোলো, আর্টেমিস, এরিস, অ্যাফ্রোদিতি, হেপাস্টাস, হারমিস, হেস্টিয়া এবং ডায়োনিসাস. রাজাকে অ্যান্টিওকাস এপিফ্যানেস নামেও ডাকা হত, যার অর্থ অ্যাণ্টিওকাস, দৃশ্যমান ঈশ্বর (অনেকে তাঁকে পাগল রাজাও বলেন)। তিনি তাঁর সম্পুর্ণ রাজ্যে গ্রীক ধর্ম প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিলো সবাই গ্রীকধর্ম অনুসরণ করেই জীবনযাপন করবেন। কিছু ইহুদী ব্যক্তি গ্রীক রীতিনীতি মেনে চলতে চাইতেন; কিছু ইহুদী আবার শান্তিতে ইহুদী রীতিনীতি পালন করতেই চাইতেন। ইহুদিধর্ম আবার গ্রীক মূর্তিপূজার একদম বিপরীত একটি ধর্ম ছিলো। ইহুদী মতানুসারে ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। তাঁকে দেখা যায় না। মাঝে মাঝে কিছু কিছু বাণীপ্রবর্তক আসেন ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতেন। এইরকম একজন বাণীপ্রবর্তক হলেন মোজেস বা মুশা। ইহুদীমতে যেহেতু ঈশ্বরকে দেখা যায় না তাই এঁদের মন্দিরে কোনো মূর্তি থাকে না। শুধু ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে বাতিদানে বাতি জ্বালানো হয়। এই বাতিদানকে মেনোরা বলা হয়।

ইতিমধ্যে বর্তমান ইহুদি প্রধান পুরোহিতের ভাই গ্রীক রীতিনীতি অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। প্রধান পুরোহিত হওয়ার ইচ্ছেও তাঁর ছিলো ষোলআনা। তাই তিনি প্রধান পুরোহিত হওয়ার জন্য অ্যান্টিওকাসকে বেশ কিছু সোনাদানা উপহার দেন। এই ঘটনার তিন বছর পরে মেনেলাউস নামে একজন ব্যক্তি প্রধান পুরোহিত হতে চেয়ে অ্যান্টিওকাসকে আরো বেশি সোনাদানা উপহার দেন, এমনকি তিনি ইহুদি মন্দির থেকে কিছু সোনার জিনিস চুরিও করেন উপহার দেওয়ার জন্য।

একবার এক যুদ্ধ থেকে হেরে গিয়ে পিছু হটার সময় অ্যান্টিওকাস জেরুজালেম শহরে আসেন। এই শহরটি তখন সিরিয়া রাজত্বের অন্তর্গত হলেও বর্তমানে ইজরায়েল দেশের অংশ। যুদ্ধ হেরে যাওয়ার জন্য তিনি এমনিতেই রেগে ছিলেন। জেরুজালেমের মত একটি সাজানো ইহুদি শহর দেখে তাঁর আরো রাগ হল। তখন তিনি সেনাদের আদেশ দিলেন, জেরুজালেম থেকে ইহুদিধর্ম মুছে ফেলে সবকিছু গ্রীক করে দেওয়া হোক। এই যে আমাদের রবিবার ছুটির দিন, একে স্যাবাথ বলা হত, অর্থাৎ সপ্তাহে একটি বিশ্রামের দিন। সেই স্যাবাথ, ইহুদিদের অন্যান্য ধর্মীয় ছুটির দিনগুলি সব নিষিদ্ধ করা হল। দলে দলে ইহুদিদের জোর করে গ্রীক করা হতে লাগল। যারা রাজী হল না তাদের হয় মেরে ফেলা হল, না হলে দাস বানিয়ে নেওয়া হল। মেনেলাউস নামের সেই ব্যক্তিকে ইহুদিদের প্রধান পুরোহিত ঘোষণা করা হল, সে ইহুদি কম আর গ্রীক বেশি ছিলো। জেরুজালেমকে গ্রীক জামাকাপড়, গ্রীক জীবনযাত্রা, গ্রীক ভাষা এবং গ্রীক নামে ভরিয়ে দেওয়া হল। ইহুদি ধর্মপালন এক্কেবারে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল, ধরা পড়লেই সপরিবারে হত্যা করা হত। এমনকি জেরুজালেমের সবথেকে সুন্দর ইহুদি মন্দিরটিতে গ্রীক প্রধানদেবতা জিউসের একটি বিরাট মূর্তি বসানো হল।মূর্তি জিউসের হলেও, মূর্তির মুখটি কিন্তু রাজা অ্যান্টিওকাসের মত ছিল। জিউসের মূর্তির সামনে শুয়োর বলি দেওয়ার আর কিছু উপঢৌকন দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয় সবাইকে। শুয়োর বলি দেওয়ার ফলে এবং মূর্তির বসানোর ফলে ইহুদিদের মন্দিরটি অপবিত্র হয়ে গেলো।

জেরুজালেমের কাছে একটা গ্রামে ছিলেন ম্যাটাথিয়াস নামক এক ইহুদি ধর্মপ্রাণ প্রাক্তন পুরোহিত। জিউসের মূর্তির সামনে শুয়োর বলি দিতে বা মূর্তিকে কিছু উপহার দিতে তিনি প্রথম অস্বীকার করেন।কথাকাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ে তিনি একজন সিরিয় সৈনিককে মেরেও ফেলেন । তবে তিনি বৃদ্ধ ছিলেন এবং এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান। তাঁর পাঁচ ছেলে ছিলো। যোহান, সিমন, এলাজার, জোনাথন এবং জুডা। এই পাঁচজন তখন রাজা অ্যান্টিওকাস এবং গ্রীকধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বিদ্রোহের মূল নেতা ছিলেন ছোটভাই জুডা। তাঁর ডাকনাম ছিল ম্যাকাবি, অর্থাৎ হাতুড়ি। তিন বছর ধরে তাঁরা লুকিয়ে চুরিয়ে গ্রীকদের আক্রমণ করতে থাকেন।সংখ্যায় তাঁরা অনেক কম ছিলেন, তবে তাঁদের ইচ্ছাশক্তি ছিলো অনেক বেশি । প্রতিদিনই কিছু ইহুদি লুকিয়ে এসে তাঁদের দলে যোগ দিতে লাগল। তিন বছর পর একবার সামনাসামনি যুদ্ধ হয় ইহুদি এবং গ্রীক সৈন্যদের। গ্রীকরা শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন। ইহুদিরা সবার আগে জিউসের মন্দির দখল করে সেটিকে আবার ইহুদি মন্দির বানান। মন্দিরে ঢুকে তাঁরা অবাক হয়ে দেখেন যে মার্বেলের মেঝেতে ফাটল ধরেছে, আর সোনার কোনো জিনিসই আর নেই। তবু মন্দিরটি ইহুদি মতানুসারে শুদ্ধ করা হয়।

হানুকা উৎসবের কথা
মেনোরা

মন্দিরটি পরিষ্কার করে ইহুদি বিশ্বাসে প্রতি রাতে একটি করে প্রদীপ জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রদীপে একমাত্র একটি বিশেষপ্রকার তেলই ব্যবহার হতে পারত। সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ জলপাইয়ের তেল, প্রধান পুরোহিতের অনুমোদিত এবং তাঁর আংটির সিলছাপযুক্ত। একমাত্র সেই তেলেই প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি ছিলো। কিন্তু যুদ্ধের পর অনেক খুঁজেও এক বোতলের বেশি এই তেল পাওয়া গেলো না। এই তেল মাত্র এক রাতের জন্য যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে আটরাত আটদিন ধরে সবকটি প্রদীপ জ্বলেছিলো। সেই সময়ের মধ্যে ইহুদিরা আরো অনেক তেল বানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। এই আশ্চর্য ঘটনাকে মনে রেখেই আটরাত ধরে হানুকা পালন করা হয়।

এবার প্রশ্ন হল হানুকাতে কী কী করা হয়? খ্রীসমাসের মতই হানুকাও এক পারিবারিক উৎসব। পরিবারের সবাই একসাথে হয়ে এই উৎসব পালন করেন। একটি বিশেষ ধরনের বাতিদান বা মেনোরা এই উৎসব পালনের মূল প্রতীক। হানুকার আট দিনের স্মৃতিতে এই বাতিদানে প্রতিদিন একটি করে মোম বা বাতি জ্বালা হয়। হানুকার জন্য আলাদাভাবে তৈরি এই বিশেষ মেনোরার নাম হল হানুকিয়া, অর্থাৎ হিব্রু ভাষায় আটদিন। প্রতি বাতিদানে একটি করে অতিরিক্ত বাতি বা মোমবাতির জায়গা থাকে। তার নাম শামাশ, শামাশকে হয় খানিকটা উপরে না হলে খানিকটা নীচে আলাদা করে রাখা হয়। এখানে যে বাতিটি থাকে তার কাজ অন্য মোমবাতিগুলি জ্বালানো। কারণ শুধুমাত্র হানুকাকে স্মরণ করাই অন্য প্রধান মোমগুলির কাজ। অন্য মোম জ্বালাতে এই মোমগুলিকে ব্যবহার করা হয় না। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদ অনুসারে প্রতি রাতে একটি করে বাতি জ্বালানো হয়। তবে অনেকে একসাথে আটটি বাতিই রোজ রাতে জ্বালান। হানুকিয়াকে রাস্তার দিকের জানলার কাছে রাখা হয় যাতে পথচারীরা যেতে আসতে বাতিগুলি দেখতে পান, এবং হানুকা উৎসবকে স্মরণ করতে পারেন।

হানুকা উৎসবের কথা
হানুকা পালনের জন্য সাজানো টেব্‌ল্‌

খ্রীসমাসের মতই এখানেও সবাইকে নানারকম উপহার দেওয়া হয়, বিশেষত ছোটদের।

হানুকা উৎসবের কথা?
হানুকার খাওয়াদাওয়াঃ বাঁদিক থেকেঃ ব্রিস্কেট, লাটকে, সুফগানিয়া

দারুণ খাওয়াদাওয়া হয় এই ক'দিন। ইহুদি প্রধান ধর্মীয় খাদ্য ব্রিসকেট, লটকে নামের আলুর একরকম ভাজা প্যানকেক আর সুফগানিয়া নামের একরকম জেলি ডোনাট হানুকায় খেতেই হবে। মেনোরা বা বাতিদানের তেলের কথা মনে রেখেই সব খাদ্য তেলে ভাজা হয়ে থাকে।

হানুকা উৎসবের কথা
ড্রিডেল

হানুকায় অনেক মজার মজার পারিবারিক খেলাও খেলা হয়ে থাকে। সবথেকে প্রচলিত হল সেভিভন বা ড্রেডেল নামের এক চৌকো লাট্টু, এই লাট্টুর চারদিকে চারখানি অক্ষর থাকে। এই চারটি অক্ষর এক হিব্রু বাক্যের চারটি শব্দের প্রথম অক্ষর। বাক্যটি হল 'নেস গাদোল হায়া শাম'। অর্থাৎ 'এইস্থানে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিলো'। একটি পাত্রে একজন একটি কয়েন বা একটি বাদাম বা একটুকরো চকোলেট রাখবেন, তারপর লাট্টুটি ঘোরাবেন। প্রথম অক্ষর এলে কিছুই হবে না, যদি দ্বিতীয় অক্ষর আসে তাহলে পাত্রের মধ্যে যা রাখা আছে তা তিনি পাবেন, যদি তৃতীয় অক্ষর আসে তাহলে পাত্রে যা আছে তার অর্ধেক পাবেন আর যদি চতুর্থ অক্ষর আসে তাহলে তাঁকে আরেকটি কয়েন বা বাদাম বা চকলেট পাত্রে রাখতে হবে এবং এবার ঘোরানোর অধিকার পাবেন পরের জন। সেভিভন বা ড্রিডল কেন খেলা হয়, সে নিয়ে নানারকমের গল্পও প্রচলিত আছে ইহুদিদের মধ্যে, তবে এই মজার খেলার সঙ্গে হানুকা উৎসবের সরাসরি কোনোও যোগাযোগ নেই।


খ্রীসমাসের রঙ বলতে আমরা যেমন লাল আর সবুজ বুঝি, তেমনই হানুকার রঙ হল নীল আর সাদা বা রুপোলী। ইজরায়েলের পতাকার রঙ অনুসারেই এই রঙের ব্যবহার বলে মনে করা হয়।


এইভাবে হানুকা ইহুদিদের এক প্রধান উৎসব হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।


ছবিঃ উইকিপিডিয়া

কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করে বেশ কিছুদিন বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিতে কাজ করেছেন। বর্তমানে বোবোর মা হিসাবেই বেশি পরিচিত হতে ভালোবাসেন। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখালিখি করতে খুব পছন্দ করেন।বিভিন্ন পুরাণ, রূপকথা, উপকথা ইত্যাদি পড়তে আর তাই নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। 

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা