সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পেনসিলের কথা

আমার নাম নীলু। আমি নীল রঙের একটা পেনসিল। তবে আমি সাধারণ কাঠের পেনসিল নই। আমার গাটা প্লাস্টিকের তৈরি আর ভিতরে পাতলা শিস ভরে দেওয়া যায়। সেই জন্যেই আমাকে শার্পনার দিয়ে ছুলতে হয় না, আমি সব সময় সুন্দর লেখা লিখতে পারি। আমি আর আমার ভাই লালু দুজনে একটা সুদৃশ্য বাক্সে থাকতাম। নন্টেবাবু তার দোকানের কাঁচের শোকেসে আমাদের সাজিয়ে রেখেছিলেন। আমরা একটু দামি আর এক বাক্সে দুজনে ছিলাম বলে বাচ্চাদের জন্যে কেউ কিনছিল না আমাদের। ভালই ছিলাম আমরা দুই ভাই নন্টেবাবুর স্টেশানারি দোকানে। যারা দোকানে আসত তারা আমাদের ভালই চেনা হয়ে গিয়েছিল। পিন্টু, পাপাই, আলো, রন্টু, এরা সবাই তাদের মা বাবার সাথে আসত প্রায়ই পেনসিল কিনতে।

নন্টেবাবু এদের সবাইকে আমাদের দেখিয়ে বলতেন, "কাঠের পেনসিলের চেয়ে এই পেনসিল অনেক ভাল। এগুলো একবার কিনলে আর অনেকদিন পেনসিল কিনতে হবে না। নিয়ে দেখুন না।"

ওদের মা বাবারা কিন্তু মাথা নাড়তেন, বলতেন, "না, নন্টেবাবু! আপনি জানেন না এরা কী হারে পেনসিল হারায়! দামি পেনসিল এদের কিনে দিয়ে কোন লাভ নেই। একদিনেই হারিয়ে ভূত করে দেবে! এদের জন্যে ওই সস্তার কাঠের পেনসিলই ভাল!"

ওদের কথা শুনে নন্টেবাবু দমে যেতেন আর আমরা ভারি খুশি হতাম। রাত হলে নন্টেবাবু যখন দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে তালা দিয়ে বাড়ি চলে যেতেন তখন লালু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলত, "যাক নীলু! আরেকটা দিন আমরা একসাথে থাকতে পারলাম!"

লালুর ওই এক ভয়! কবে আমরা আলাদা হয়ে যাব সেই ভয়েই ও সব সময় জড়সড় হয়ে থাকত! দোকানে কেউ এসে আমাদের দিকে তাকালেই ওর বুক ধুকপুক! এই বুঝি কেউ আমাদের একজনকে কিনে নিল!

ভয় যে আমার একেবারেই নেই তা নয়। তবে আমি নিজের ভয় প্রকাশ করতাম না। সত্যি বলতে কী আমি আমার মনের কথা খুব একটা বলতাম না। মাঝে মাঝে অবশ্য লালুকে সান্ত্বনা দিতাম, "দুর বোকা! আমরা দুজনে মিলে একটা সেট না! আমাদের আলাদা করে কখনই বিক্রি করবেন না নন্টেবাবু!"

লালু তাও বলত, "কী জানি বাপু! আমার খুব ভয় করে!"

এমনি করে কেটে যাচ্ছিল দিন এমন সময় একদিন গুড়িয়া ওর মামার সাথে নন্টেবাবুর দোকানে এসে হাজির হল। গুড়িয়াকে আমরা চিনি। সে মাঝে মাঝে নন্টেবাবুর দোকানে খাতা, পেনসিল, রবার ইত্যাদি কিনতে আসে।

ওর মামা নন্টেবাবুকে বললেন, "আমি ভূপালে থাকি। কয়েকদিনের জন্যে এখানে এসেছি তাই গুড়িয়াকে ভাল কিছু একটা কিনে দিতে চাই। ওকে কিনে দেওয়ার মতন ভাল কিছু থাকলে দেখান।"

নন্টেবাবু সুযোগ পেয়ে চট করে আমাদের বাক্সটা শোকেস থেকে বার করে কাউন্টারে রাখলেন।

"এই দেখুন উপহার দেওয়ার জন্যে খাসা জিনিস! একটা লাল আর একটা নীল মজবুত পেনসিল! আমি শিসের বাক্স ফ্রি দেবো এই সেটটা কিনলে!"

"কি রে গুড়িয়া তোর পছন্দ?" মামা জিজ্ঞেস করলেন।

গুড়িয়া লাজুক ভাবে মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলল।

ব্যস বলা নেই কওয়া নেই ওমনি দুম করে আমরা গুড়িয়ার হয়ে গেলাম!

গুড়িয়া এমনিতে ভাল মেয়ে। আমাদের যত্ন নেয় খুবই। পাছে আমরা হারিয়ে যাই সেই ভয়ে আমাদের স্কুলেও নিয়ে যায় না। স্কুল থেকে ফিরে যখন হোমওয়ার্ক করে তখন আমাদের ব্যবহার করে। কোনদিন লালুকে কোনদিন আমাকে। গুড়িয়ার কাছে আমরা খুশিই ছিলাম শুধু সে যখন লালুকে নিয়ে হোমওয়ার্ক করত তখন আমার ভারি হিংসে হত! আমি চাইতাম গুড়িয়া যেন সব সময় আমাকে নিয়েই তার হোমওয়ার্ক করে! ভুলে যেতাম লালু আমাকে কত ভালোবাসে!

তারপর একদিন গুড়িয়ার কাকা কাকিমা মন্টিকে নিয়ে এলেন। মন্টি খুব দুষ্টু ছেলে! সে এসেই গুড়িয়াদের বাড়ি তোলপাড় করতে শুরু করে দিল! গতবার ও যখন এসেছিল তখন নাকি গুড়িয়ার বেশ কয়েকটা পুতুলের মাথার চুল কেটে দিয়েছিল তাই এবারে গুড়িয়া আগে থেকেই নিজের প্রিয় খেলনাগুলো লুকিয়ে রেখেছিল। মন্টি ঘরে এসে খেলনা দেখতে পেল না কিন্তু আমাদের দেখতে পেল।

"এগুলো কী?"
"পেনসিল।"
"বাহ! পেনের মতন দেখতে পেনসিল! ওই লাল পেনসিলটা আমার চাই!"
গুড়িয়া শুকনো মুখ করে বলল, " ওটা মামা আমাকে উপহার দিয়েছেন!"
অমনি মন্টি হাত পা ছড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে বসল। ওর কান্না শুনে গুড়িয়ার মা ছুটে এলেন। উনি এসে গুড়িয়াকে বকলেন, "ছিঃ! গুড়িয়া অমন করতে নেই! ছোট ভাই চাইছে! তোমার তো দুটো রয়েছে ওকে একটা দাও!"

গুড়িয়ার মার কথা শুনে লালু প্রায় কেঁদে ফেলল। সে বেচারা এখনও আমাকে ভীষণ ভালবাসে! ওকে চলে যেতে দেখে আমার টনক নড়ল, আমার বুকটা হু হু করে উঠল! আমি আর লালুকে হয়তো কোন দিন দেখতে পাব না! আমি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম, "লালুকে নিও না! আমি আর কোনদিন ওকে হিংসে করব না!" কিন্তু আমার কথা কেউ শুনল না। মন্টি বীর দর্পে লালুকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল।

তিনদিন গুড়িয়াদের বাড়িতে ঝড় বইয়ে দিয়ে মন্টি নিজের বাড়ি ফিরে গেল। আমার জীবন চিরকালের মতন বদলে দিয়ে গেল। আমি বাক্সে লালুর ফাঁকা জায়গাটা দেখে দেখে কাঁদতাম! তখন মনে হত লালুকে ছাড়া আমি কি করে থাকব। এটাও ভাবতাম মন্টির খপ্পরে পরে লালুর কি দশা হচ্ছে কে জানে! বিধাতা আমার ওই হিংসের যোগ্য শাস্তি দিয়েছিলেন আমাকে।

মন্টি চলে যাওয়ার পরের দিন গুড়িয়া বাইরের ঘরে আমাকে নিয়ে হোমওয়ার্ক করছিল হঠাৎ আমি শুনলাম কে যেন আমাকে ডাকছে, "নীলু, এই নীলু!"

আমি চমকে তাকিয়ে দেখলাম বাইরের ঘরের একটা চেয়ারের তলায় পড়ে রয়েছে লালু! মন্টি ওকে নিয়ে যেতে ভুলে গেছে! ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল আমার লালুকে দেখে কিন্তু গুড়িয়া তো ওকে দেখতে পায়নি! আমাকেই কিছু একটা করতে হবে যাতে গুড়িয়া ওকে দেখতে পায়! কী করব? কী করব? ভেবে আমি ধাঁ করে গুড়িয়ার হাত থেকে লাফ দিয়ে ছিটকে চেয়ারের তলায় লালুর কাছে গিয়ে পড়লাম। খুব ব্যথা লাগল, শিসটাও কিছুটা ভেঙে গেল কিন্তু আমার তখন ভ্রুক্ষেপ নেই! আমি লালুকে খুঁজে পেয়েছি যে!
"উফফ!" বলে গুড়িয়া ঝুঁকে পরে আমাকে তুলতে গিয়ে লালুকে দেখতে পেল! কী যে আনন্দ হল তার কি বলব! আমাদের দুজনকে তুলে নিয়ে সে মার কাছে ছুটল, "মা দেখো! আমি আমার লাল পেনসিলটা খুঁজে পেয়েছি!"

গুড়িয়া লালুকে জড়িয়ে ধরে কত আদর করছিল কিন্তু আমার এতটুকু হিংসে হচ্ছিল না! আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন ও আমাদের আবার বাক্সে ভরবে তখন আমি লালুকে নিজের সব মনের কথা খুলে বলব।

-----
পেনসিলের কথা

পেনসিল জিনিসটাকে আমরা সবাই চিনি। ছোটবেলায় লেখার জন্যে পেনসিল কে না ব্যবহার করেছে! কাগজের গায়ে ঘ্ষলেই পেন্সিল দিয়ে লেখা বের হয়! পেনসিলের ভিতরের ওই কালো ভুসো সিসটা, মানে যেটা দিয়ে দাগ পড়ে সেটা গ্র্যাফাইট আর কাদা মাটির মিশ্রণ। তবে যে দাগটা পড়ে কাগজে সেটাকে সহজেই রবার/ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা যায়, সেটাই পেনসিলের সুবিধা। কিছু ভুল হলেই চট করে মুছে ঠিক করে নেওয়া যায় কারণ পেনসিল দিয়ে কাটা দাগ চিরস্থায়ী নয়।

পেনসিল আবিষ্কারের আগে রোমানরা ধাতুর কাঠি দিয়ে প্যাপাইরাস বা মোমের তৈরি ট্যাবলেটে আঁচড় কেটে লিখত। ওই ধাতুর কাঠিকে বলা হত স্টাইলাস।

গ্র্যাফাইট কী ভাবে প্রথম আঁক কাটার জন্যে ব্যবহার হয়েছিল সেই নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। ঘটনাটা ১৫০০-থেকে ১৫৬০য়ের মাঝামাঝি ঘটেছিল বলে ধরে নেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের বরোডেল নামের এক জায়গায় একবার একটা ভয়ঙ্কর ঝড় আসে। বেশ কিছু গাছ টাছ পড়ে যায় সেই ঝড়ে। সেই সব পরিস্কার করতে গিয়ে একদল রাখাল ছেলে গ্র্যাফাইটের একটা খনির সন্ধান পায়। ওরা দেখে ভেবেছিল বুঝি বা কয়লা। তাই ভেবে বেশ কিছু চাঁই বাড়ি বয়ে নিয়ে এসেছিল কিন্তু আগুন জ্বালাতে গিয়ে দেখা গেল সেই জিনিসটা কয়লার মতন দেখতে হলে কী হবে সেটা মোটেই কয়লার মতন ভালো করে জ্বলছে না। তারপর তারা দেখল জিনিসটা দিয়ে ভালো দাগ কাটা যাচ্ছে। তার আগে অবধি তারা সিসে দিয়ে ছাগল ভেড়াদের গায়ে দাগ দিত কোনগুলো কার বোঝার জন্যে (সেই জন্যে পেনসিল কে অনেকেই এখন লেড পেনসিল বলে- সিসা থেকে সিস)। সেই থেকে গ্র্যাফাইট দাগ কাটার জন্যে ব্যবহার হতে লাগল। যদিও শুধু গ্র্যাফাইট কিন্তু খুবই নরম আর ভুসভুসে। কিছুকাল দড়ি দিয়ে বেঁধে সেটার ব্যবহার চলেছিল।

১৫৬০এ সিমোনিও আর লিডিয়ানা বার্নাকোটি নামে ইটালিয়ান এক দম্পতি জুনিপার গাছের একটা ডালকে অর্ধেক করে কেটে ভিতরটা খালি করে সেখানে গ্র্যাফাইটের কাঠি বসিয়ে অর্ধেক দুটোকে জুড়ে ফেলে ডালটাকে পেনসিল হিসেবে ব্যবহার করেন। এখনও কাঠের পেনসিল যে ভাবে তৈরি হয় ঠিক সেই ভাবেই!

পেনসিলের কথা

১৭৯৫তে ফ্রান্সের নিকোলাস জেক কোন্টি গ্র্যাফাইটের সঙ্গে কাদা মিশিয়ে সেটাকে আগুনে পুড়িয়ে সেটার থেকে পেনসিলের সিস তৈরি করেন। কতটা গ্র্যাফাইট আর কতটা কাদা সেটার অনুপাত বদল করে পেনসিলের সিস কতটা শক্ত বা নরম হবে সেটা ঠিক করা যেত। জোসেফ হার্ডমুথ নামে এক ব্যবসায়ী যিনি কোহ-ই-নূর কম্পানি খুলেছিলেন তিনিও ওই একই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৮৩৮এ ইংল্যান্ডের হেনরি বেসমার গুঁড়ো গ্র্যাফাইটকে চাপ দিয়ে শক্ত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, তাতে গ্র্যাফাইটকে মাটির সঙ্গে মেশাতে সুবিধা হল। তবে আমেরিকাতে বহুদিন পর্যন্ত (১৭২৯) পেনসিল ইউরোপ থেকেই আনা হত। ক্রমে পৃথিবীর সর্বত্রই পেনসিল তৈরি শুরু হয়ে যায়।

পেনসিলের কথা

১৮৫৮-এ প্রথম পেনসিলের পিছনে রবার লাগানো হয়। হাইমেন লিপম্যান নামের এক ভদ্রলোক নিজেকে সেটার আবিষ্কারক বলে দাবি করেন।

এর পর অনেক রকমের পেনসিলের আবির্ভাব ঘটে। খুব শক্ত সিস (9H, 10H) থেকে খুব নরম সিস (8B,9B) সব রকমের পেনসিলই পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারের জন্যে। পেনসিলের গাটাও কাঠ থেকে বদলে এখন নানা রঙের বা রকমের হয়েছে। লালু-নীলুর মতন প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি গা আর তার ভিতর পাতলা সিসের পেনসিলও পাওয়া যায়। রঙ পেনসিলের ভিতরের সিস তো কত রকম রঙের। নানা ধরনের পেনসিল জমানো এখন শখ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের।

এবার যখন পেনসিল হাতে নেবে তখন একবার ভেবে দেখো ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে পেনসিল বলে কিছু ছিলই না! সেই সময় থেকে কত দূর চলে এসেছি আমরা।


ছবিঃ পিক্সাবে

অনন্যা দাশ কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। নেশা বই পড়া আর গল্প লেখা। শিশুদের জন্যে সামাজিক গল্প ও কিশোরদের জন্যে রহস্য গল্প লিখতে ভালবাসেন। বাংলাতে প্রকাশিত অধিকাংশ শিশু কিশোর পত্রিকাতেই লিখেছেন কোন না কোন সময়ে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা