আমাদের এক চাইনিজ বন্ধু চার্লির ডাটসন নি্সান গাড়ি করে আমরা নিউইয়র্ক থেকে নায়গ্রা পাড়ি দিয়েছিলাম এক ভোরে। নায়গ্রা বলি আমরা, চার্লির ভাষায় তা "নিগাড়া" আর স্থানীয় ট্রাইবাল ভাষায় নায়াগারা । সেই জলকন্যার নাম ভূগোল বইতে নায়গ্রা আমাদের কাছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে Niagagarega নামে এক আদিম আদিবাসীর নামে নামকরণ হয়েছিল স্থানীয় নদী নায়াগ্রার । কারো মতে নায়গ্রা নাম দিয়েছিল স্থানীয় আমেরিকান ইন্ডিয়ান আদিবাসীরা যার অর্থ হল "নিউট্রাল" বা নিরপেক্ষ । প্রথম কারণ নায়গ্রা নদী কানাডা ও আমেরিকার ঠিক মাঝবরাবর । আর দ্বিতীয়তঃ দুটি লড়াকু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা করত যে নিরপেক্ষ আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের নামে এই নায়গ্রা। কানাডা ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক সীমানার সেতু বন্ধন করেছে এই জলপ্রপাত। জলের আয়তন, প্রপাতের গভীরতা এবং সার্বিক সৌন্দর্যের বিচারে নায়াগ্রার স্থান বিশ্বের মধ্যে বাইশ। ( ওয়ার্ল্ড ওয়াটারফলডেটাবেস ডট কমের সমীক্ষা অনুযায়ী )
বড় থেকে ছোট তিনটে ফল্স আছে এই নায়গ্রা গর্জের মধ্যে। তারা যথাক্রমে হল হর্স শ্যু, আমেরিকান এবং ব্রাইডাল ভেইলস ফল্স। মাঝে নদী নায়গ্রা। এপারে আমেরিকার নিউইয়র্ক আর ওপারে কানাডার অন্টেরিও। যেমন সুন্দর জল প্রপাত তেমনি কাজেরও। আমেরিকা ও কানাডা উভয় দেশের জলবিদ্যুতও তৈরী হচ্ছে সেই বিপুল জলরাশি থেকে। পাঁচটি হ্রদ, সুপিরিয়র, মিশিগন, ইরি, হিউরন ও অন্টেরিওর অবিরত জলধারার একসাথে আত্মসমর্পণ এই নায়গ্রা নদীতে।
আমরা তিন বন্ধু মিলে চার্লির গাড়ি করে নিউইয়র্ক শহর থেকে যাত্রা করলাম এক ভোরে নায়গ্রার দিকে। প্রায় সাত-আট ঘন্টা লেগেছিল আমাদের গাড়ী চালিয়ে নিউইয়র্ক থেকে নায়গ্রা পাড়ি দিতে।
ঠিকমত নিয়ম মেনে গাড়ি পার্ক করে এবার প্রবেশ নায়গ্রা ফল্স স্টেট ভিজিটিং সেন্টারে অর্থাত আমরা যাকে বলি ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার। তারপর খুঁটিনাটি সব খোঁজখবর নিয়ে যাওয়া হল অবজারভেশন টাওয়ারে। টিকিট কেটে এবার লম্বা কিউতে দাঁড়িয়ে দূর থেকে জলবজ্র বা থান্ডার ওয়াটারের তর্জন গর্জনের আভাস। লিফটে নেমে চড়ে বসলাম 'মেইড অফ দ্যা মিস্ট' বোট রাইডে। টিকিটের সাথে প্রত্যেক যাত্রীর হাতে ছিল নীল রংয়ের সূক্ষ্ম পলিথিনের রেনকোট। মাথা থেকে পা অবধি মোরব্বা করে রেনকোটে মুড়ে সেই 'মেইড অফ দ্যা মিস্ট' বোট রাইডের জন্য প্রস্তুত হলাম আমরা। রেনকোট বা ওয়াটারপ্রুফ বলি আমরা যাকে আমেরিকায় তার নাম "পঞ্চ"। নীল "পঞ্চ" পরে যেতে হয় মেইড অফ দ্যা মিস্ট রাইডে । যন্ত্রচালিত নৌকাবিলাস। ঢেউয়ের প্রতিকূলে জলপ্রপাতের আঙিনায় পা বাড়ানো। যত কাছে যাই তত উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে। আর বাড়ে জলবজ্রের শব্দ। একটা জায়গায় গিয়ে অনুভব করলাম জলপ্রপাতের জলকণার চাদর আমাদের রেনকোটের ওপর। আর তার গম্ভীর গর্জন। দুরন্ত ও দুর্দান্ত ঢেউয়ের উথালপাথাল জলরাশিতে দোদুল্যমান নৌকাবিলাস তাও আবার বিদেশের বুকে। জলপ্রপাতের নীচে জলকণার অবাধ পতন ও সাথে সাথে লাফিয়ে তার উত্তরণের ফলে এক মায়াবী কুয়াশা রচিত হয় যার রং ধোঁয়াটে আবার হালকা গোলাপীও । এক আধিভৌতিক অনুভূতি হয় যেন।
এতক্ষণে বোঝা গেল ঐ দোতলা নৌকার রাইডের নাম কেন মেইড অফ দ্যা মিস্ট! মনে মনে ভয়ের উদ্রেক হল। সেই মুহূর্তে ঘোষণা হল লাইফ জ্যাকেট কোথায় আছে ও কেমন করে তা পরে নিতে হবে যদি বিপদ আসে। দুগ্গা দুগ্গা বলে সে যাত্রায় নদী বেয়ে এগুতে থাকলাম প্রকান্ড সেই হর্স-শ্যু বা অশ্বখুরাকৃতি ফল্স এর কাছে। জলটা সেখানে সত্যিই ঘুরে গিয়ে পড়ছে ঘোড়ার খুরের মতন। দোতলা নৌকার এক প্রান্তে আমেরিকার ফ্ল্যাগ অন্যপ্রান্তে কানাডার ফ্ল্যাগ। অশ্বখুরাকৃতি ফলস এর গা ঘেঁসে ইউ-টার্ন দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এল কানাডার সীমানা ছুঁয়ে। অশ্বখুরাকৃতি প্রপাতটি কানাডার দিকে। আর আমেরিকান ও সর্বাপেক্ষা ছোট ব্রাইডাল ভেইল প্রপাতটি আমেরিকার দিকটায়। আমরা তিনজনে ততক্ষণে ভিজে টইটম্বুর। রীতিমত মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজছি। বেশ শীত শীত করছে। আর অত উঁচু থেকে জলের সেই আছড়ে পড়া আর সেই সাথে ভয়ঙ্কর আওয়াজ যে মনের মধ্যে কি রোমাঞ্চের সৃষ্টি করে তা বলে বোঝানো যায়না। সেই মূহুর্তে মনে হয় মনুষ্যজন্ম সার্থক এই পৃথিবীতে।
দুশো ফুট নীচে নদীর খাত। আর কি তীব্রগতিতে জল পড়ছে সেই অশ্বখুরাকৃতি ফল্স থেকে। এবার কেনেডিয়ান ফল্সের ধারে গিয়ে দূর থেকে ওপারের টরন্টো শহরকে একঝলক দেখে নেওয়া। এবার যাত্রা কেভ অফ দ্যা উইন্ডস- এর দিকে। হলুদ "পঞ্চ" পরে কেভ অফ দ্যা উইন্ডস এ যায় । সেটা জলপ্রপাতের পেছন দিকে। গুহার মত একটা জায়গা দিয়ে ঢুকে এলিভেটরে নেমে গিয়ে আবার উঠে যেতে হবে সিঁড়ি বেয়ে । জলপ্রপাতের কুড়ি ফুট কাছাকাছি যাওয়া যায়। প্রচন্ড বাতাসিয়া সেই স্থান। একে বলে কেভ অফ দ্যা উইন্ডস। প্রত্যেক জায়গায় যেতে গেলে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। । আবারো সেই ভয়ঙ্কর গুরুগম্ভীর রূপ। শুধু জল আর জল। জলের আয়তনের দিক থেকে নায়াগ্রা ফলস হল বিশ্বের মধ্যে একাদশতম জলপ্রপাত।