তখন কিছু উৎসাহী যুবক বাচ্ছাদের নিয়ে খেলাধুলার ব্যবস্থা করে আনন্দ পেতেন। বাচ্ছাদের জন্য রুমাল চোর, সামরেস, দড়ি টানাটানি, এ ধরণের অনেক রকম খেলার ব্যবস্থা করতেন। ঐ যুবক থাকতেন খেলা পরিচালনার কাজে। খেলাধুলার সাথে শরীর গঠন, ব্যায়াম ও নানারকম শিক্ষামুলক কাজও করানো হ’ত। আমাদের পাড়ায় সনতদা এইসব খেলাধুলার ব্যবস্থা করতেন। বিকাল হতেই, আমাদের ছোট্ট মাঠটায় যাবার নেশায় পেয়ে বসতো। সনতদা ছিলেন আমার বোনের বন্ধুর দাদা। ফলে তার ওপর আমার, বা আমার ওপর তার, হয়তো আলাদা একটা স্নেহ, ভালবাসা বা অধিকার ছিল।
সে যাহোক্, কোথাও কোন পাখির ব্যবস্থা করতে না পেরে, শেষে সনতদাকেই ধরলাম একটা পাখি দেবার জন্য। তিনি “পাখি কোথায় পাব? আমার কী পাখির ব্যবসা আছে”? ইত্যাদি অনেক কিছু বলে, শেষে বললেন তাঁদের বাড়ির ভেন্টিলেটারে একটা শালিক বাচ্ছা পেড়েছে। শালিক পাখি পুষলে তিনি দিতে পারেন।
হাতে যেন চাঁদ পেলাম। শালিক পাখি যদি লোকে না পুষবে, তাহলে পুষবেটা কী? সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলাম। পারলে তখনই তাঁর সাথে তাঁর বাড়ি গিয়ে পাখি নিয়ে আসি। কিন্তু সনতদা ছিলেন খুব ডিসিপ্লিনড্। সন্ধ্যাবেলা পড়ার সময়, কাজেই ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
পরের দিন সকাল থেকে বিকালের জন্য অপেক্ষা করে রইলাম। জুতোর বাক্স ভালভাবে পরিস্কার করে রাখতেও ভুললাম না। রুমাল চোর খেলার থেকে পাখি হাতে পাওয়াটা সেদিন আমার কাছে অনেক বেশী জরুরী বলে মনে হ’ল। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটলাম পাশের ছোট্ট মাঠটাতে। বাচ্ছারা সব এসে গেছে, কিন্তু সনতদার টিকি দেখা গেল না। শেষে তিনি মাঠে এসেই আমাদের খেলার ব্যবস্থা করলেন। আমি পাখির কথা বলতেই তিনি বললেন “একদম ভুলে গেছিরে, কাল ঠিক নিয়ে আসবো। এখন জায়গায় গিয়ে বোস্”।
পরদিনও পাখি এল না। এইভাবে চার পাঁচ দিন কাটার পর, শালিকের আশা ছেড়ে দিলাম। বুঝলাম এ জগতে কেউ কারো নয়। নিজের পাখি নিজেকেই জোগাড় করতে হবে। এই জন্যই বলে— সেল্ফ্ হেল্প্ ইজ দি বেষ্ট হেল্প্।
দিন দুয়েক পরে, সেদিন টেনিস বলে ফুটবল খেলা চলছে। সনতদা রেফারী। খেলা বেশ জমে উঠেছে। আমাদের সাথে সনতদাও গলায় বাঁশী ঝুলিয়ে, সারা মাঠ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকক্ষণ খেলা চলার পর হঠাৎ সনতদা বাঁশী বাজিয়ে খেলা বন্ধ করতে বলে আমায় ডাকলেন। আমি কাছে যেতেই বললেন “একদম ভুলে গেছিলাম রে, ছি ছি ছি”। বলেই প্যান্টের পকেট থেকে একটা শালিক বাচ্ছা বার করলেন। পাখিটার অবস্থা তখন খুব খারাপ। ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করলে বোধহয় ভাল হয়।
আমি আর এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে, পাখি নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটলাম। বাড়ি এসেই একটা কাপে একটু দুধ নিয়ে, ড্রপারে করে খাওয়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সব দুধ তার ঠোঁটের পাশ দিয়ে বার হয়ে আসলো। জুতোর বাক্সে কাপড় পেতে পাখিটাকে রেখে দিলাম। এবারও এক নম্বর শত্রুর ভূমিকা বাবা নিজেই নিলেন। কড়া গলায় হুকুম হ’ল, “পাখি রেখে বই নিয়ে এস”। কী আশ্চর্য, পড়াশোনার জন্য সারা জীবন পরে আছে, কিন্তু এই পাখিতো আর ততদিন বাঁচবে না। জীবনে এত সহজে দ্বিতীয়বার পাখি পাওয়ার ভাগ্য আর নাও আসতে পারে। কোনটার গুরুত্ব আগে? এই সহজ তথ্যটা কেন তিনি বুঝতে চান না বুঝি না।
রাতের পড়াশোনার পাট শেষ করে, ছাতু মেখে, ছোট ছোট গুলি তৈরী করে, পাখিটার ঠোঁট ফাঁক করে, একটা একটা করে ছাতুর গুলি ওর গলার মধ্যে দিতে শুরু করলাম। পাখিটাও আজ এই “মুখে ছাতুর” শুভ রাতে পরমানন্দে সেগুলো খেতে শুরু করলো। ভাবলাম তাহলে বোধহয় শালিকপাখি গরুর দুধ খায় না। খুশী হয়ে একটা একটা করে অনেকগুলো ছাতুর গুলি, ঠোঁট ফাঁক করে করে, তার গলায় ফেললাম। কিছুক্ষণ পরে মনে হ’ল পাখিটা যেন খুব সুস্থ নয়, কী রকম নেতিয়ে পড়েছে। ঠোট ফাঁক করে নতুন গুলি গলায় দিতে গিয়ে দেখি, গোল গোল ছাতুর গুলি তার প্রায় ঠোঁট পর্যন্ত জমে আছে। অবস্থা খারাপ বুঝে, ছোট একটা ঝাঁটার কাঠির টুকরো দিয়ে গেঁথে গেঁথে, একটা একটা করে উল্টো প্রক্রিয়ায় তার গলা থেকে বার করতে শুরু করলাম। ঠোঁটের কাছটা টিপে ধরে ঠোঁট ফাঁক করে দেখি, গলার ভিতর আরও অনেক ছাতুর গুলি আছে। একই প্রক্রিয়ায় আরও অনেক ছাতুর গুলি বার করে, রাতের মতো পরিষেবা শেষ করে, তাকে বাক্সে রেখে দিলাম।
রাতে শুতে যাবার আগে দেখলাম পাখিটা মাথা নীচু করে চোখ বুঁজে বসে আছে। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই জুতোর বাক্সের কাছে গিয়ে দেখি, আদরের পাখি পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমচ্ছে। ভাতঘুমের মতো ছাতুঘুম তার আর কোনদিন ভাঙ্গে নি।
শুরু হল নতুন পাখির সন্ধান। একদিন দিদির বাড়ি গিয়ে দেখি, সেখানে একজন একটা পাখি ধরেছে। কী পাখি জানি না, জানার প্রয়োজনও নেই। অনেক অনুরোধ করে, বোধহয় ভিক্ষা করে বললে ঠিক বলা হয়, পাখিটাকে হস্তগত করে, একটা কাগজের ঠোঙায় করে নিয়ে, হাসিমুখে বাড়ি ফিরে এলাম। অনেকে দেখে বললো ওটা চাতক পাখি। চাতক পাখি আমি চিনি না। চিন্তা হ’ল— চাতক পাখি তো বৃষ্টির জল ছাড়া জল খায় না শুনেছি, সারা বছর রোজ তো আর বৃষ্টি হবে না, অন্তত এখন তো হচ্ছে না, তাহলে পাখিটা কী জল না খেয়ে মরে যাবে?
শুরু হল নতুন উদ্দমে পাখির পরিচর্যা। চাল দিলাম খেল না। গম দিলাম, তাও খেল না। টমেটো, আপেল, পেয়ারা, ফুলকপির টুকরো, কিছুই খেল না। পিঁপড়ে ধরে দিলাম, তাও খেল না। সারারাত না খেয়ে থাকলো। পরদিন পুকুর পাড়ে মাটি খুঁড়ে কেঁচো এনে দিলাম, না ইনি তাও খান না। ছোট মাছ খেতে দিলাম, তাও তার না পসন্দ্। শেষ পর্যন্ত সে দিনটাও সে কী খায়, আবিস্কার করার চেষ্টায় কেটে গেল। পরদিন তিনি আমাকে এত বড় একটা আবিস্কারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে, ইহলোক ত্যাগ করলেন।
আবার জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, যদি কোন পাখি দয়া করে। কিন্তু আমার সেই “বিভীষণ”, আবার শত্রুতা করলেন। বাবা বদলী হয়ে কলকাতা চলে এলেন। আমরা হাওড়ার কাছাকাছি একটা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে বাড়িভাড়া নিয়ে বসবাস করতে লাগলাম। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।
স্টেশন থেকে রেল লাইনের পাশ দিয়ে একটা ইঁটপাতা রাস্তা গেছে। রাস্তার পাশে রেলের ঝিল। ঝিল আর রাস্তার মধ্যের ঢালু অংশটা, ছোট ছোট গাছপালা জঙ্গলে ভরা। সেখানে কত বিচিত্র সব পাখির আনাগোনা লক্ষ্য করতাম। স্কুল যাতায়াতের পথে সজাগ দৃষ্টিতে পাখির বাসার সন্ধান করতাম। একদিন ঐ পথ দিয়ে যাবার সময়, রাস্তার পাশে ঝিলের কাছাকাছি জঙ্কলের মধ্যে, হঠাৎ আমি পরশমণির সন্ধান পেলাম। একটা বেশ বড়সড় পাখি, বড় মানে বেশ বড়, জটায়ুর বংশধর হলেও হতে পারে। জঙ্গল ভেঙ্গে কাছে গিয়ে দেখি, একটা বেশ বড় পাখি পড়ে আছে। দুটো ডানা আছে, তাই পাখি বলে বুঝতে সুবিধা হ’ল। নয়তো কোন জন্তু ভাবলেও, দোষ দেওয়া যেত না। যাহোক্, কাছে গিয়ে পাখিটাকে ধরতে যেতেই, কী রকম একটা আওয়াজ করে ঠোকরাতে গেল। আবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তার কাছে যাবে কার সাধ্য।