সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আমার এক মাসতুতো ভাই একই বাড়ির অন্য অংশে ভাড়া থাকতো। সে আমার থেকে বছর খানেকের বড় ছিল। কিন্তু সে ছিল আমার প্রাণের বন্ধু। বাড়ি ফিরে তাকে সব কথা বলে, তাকে সঙ্গে নিয়ে আবার পাখির কাছে ফিরে এলাম। মনে বড় ভয় ছিল, পাখিটা না পালিয়ে যায়। আমার প্রাণের ভাইটির কিন্তু পাখির প্রতি কোন উৎসাহ দেখলাম না। তাই হয়, দুনিয়ায় ভাল জিনিসের কদর ক’জন করতে জানে? যাহোক্, সেও কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে পাখিটাকে দেখে, কী পাখি চিনতে পারলো না। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাখিটা কিন্তু দাঁড়িয়ে বা বসে নেই। শুয়ে থাকার মতো কাত হয়ে পড়ে আছে। এবার পাখিটা কিছু করার আগেই, মূহুর্তের মধ্যে তার ডানা ধরে এক ঝটকায়, ওপরের রাস্তার দিকে ছুঁড়ে ফেললাম। ওঃ, মনে হ’ল এক মণ ওজনের কিছু একটা তুলে ফেললাম। পাখিটা একবারে ইঁটের রাস্তার ওপর গিয়ে পড়লো। কিন্তু উড়ে চলে না গিয়ে, আগের মতোই শুয়ে থাকলো। পাখিকে কখনও শুয়ে থাকতে দেখি নি। পাখিটা শুয়ে শুয়ে মুখ দিয়ে একটা হিংস্র আওয়াজ বার করতে লাগলো।

একটু আগে হাওড়া থেকে একটা আপ ট্রেন স্টেশনে এসে পৌঁছেছে। তখনও ই.এম.ইউ. কোচ চালু হয় নি। প্রচুর লোক অফিস ফেরৎ, ঐ ইঁটপাতা রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। তারা আমাদের কাছে আসলে, পাখিটাকে দেখে একজন মুখ বেঁকিয়ে বলতে শুরু করলো— “ছি ছি ছি খোকা, শকুন ধরেছো? তোমার সাহস তো কম নয়, শকুন কেউ ধরে? রাস্তা থেকে নামাও। বাড়ি ফিরে ভাল করে স্নান করে নেবে”। একটু থেমে আবার শুরু হ’ল “তোমার কী পড়াশোনা, খেলাধুলা বলে কিছু নেই? নামাও, নামাও”। এবার রীতিমতো আদেশের সুর।

এতক্ষণে পাখিটার বংশ পরিচয় জানতে পারলাম। পাখি রাস্তায় তুলেছি আমি, কাজেই রাস্তা থেকে নামানোর দায়িত্বও আমার ওপর বর্তালো। কিন্তু তখন আর পাখি, পাখি নেই, সে প্রায় সিংহ হয়ে গেছে। আমি তার ডানার কাছে একবার হাত নিয়ে যাই, আর তার ভয়ঙ্কর চিৎকারে পিছিয়ে আসি। আশপাশে অনেক লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, এবং কী ভাবে তাকে ধরতে হবে, আমাকে গাইড করছে। আর তার সাথে সমান তালে চলছে, জ্ঞান ও কটুক্তি। এইভাবে হঠাৎ যে কায়দায় ওটাকে রাস্তায় তুলেছিলাম, সেই ভাবেই আবার এক ঝটকায় জঙ্গলে ফেরৎ পাঠালাম। জনগনের মুখেই জানলাম শকুনটা নাকি অসুস্থ। অসুস্থ হয়ে শকুন মাটিতে পড়ে গেলে, সে নাকি আর বাঁচে না। আমার আর তার বাঁচা-মরায়, কোন আগ্রহ নেই। বিফল মনোরথে বাড়ির রাস্তা ধরলাম।

তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। অনেক নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে। গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, ফুটবল, ক্রিকেট, সাতগুটি, হুস্-হুস্, শীরগিজ, এইসব নিয়েই সারাদিনের অবসর সময় কাটে। একদিন একটা দেবদারু গাছের বেশ ওপরের ডালের একটা কাকের বাসা থেকে, একটা কোকিল ছানা নামিয়ে আনলাম। গায়ে সাদা ছিট্ ছিট্ দাগ। বন্ধুরা জানালো ওটা স্ত্রী কোকিল, ডাকে না। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত এ কোকিলও পোষা হ’ল না। কিন্তু কোকিলের নেশা আমায় পেয়ে বসলো।

একটা বড় পুকুরে আমরা স্নান করতাম। রোজ দেখতাম দু’তিনটে কাক যাতায়াতের পথে আমার মাথার ওপর দিয়ে ছোঁ মেরে ঠুকরে দেবার চেষ্টা করতো। অথচ আর কোন ছেলেকে তারা এটা করতো না। সেই দেবদারু গাছটার পাশ দিয়ে পুকুরে যেতে হ’ত। কাকগুলো বোধহয় আমাকে চিনে রেখেছিল। শেষে একটা গামছা দিয়ে পাগড়ীর মতো মাথায় জড়িয়ে যাতায়াত শুরু করলাম।

পাখি

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন কাকের বাসার সন্ধান পাওয়া গেল। বাড়ির পাশেই, একটু দুরে একটা মঠ ছিল, শঙ্করাচার্যের মঠ। শঙ্করমঠ নামেই পরিচিত। চারিদিকে মাঠ, খোলা জমি, আম, জাম, জামরুল, নারকেল, আরও চেনা অচেনা প্রচুর বড় বড় গাছ। মাঠের ধারে একটা বেল গাছের ডালে কাক-কাকীনীর ছোট্ট বাসা। বেল গাছটার একটা জায়গা থেকে ইংরাজী ওয়াই(Y) অক্ষরের মতো, দুটো ডাল দু’দিকে বেঁকে গেছে। আর ঠিক সেই জায়গাটার একটা ডালে তাদের সুখের সংসার। একদিন, তখন বেশ গরম, ভরদুপুরে মাঠ ঘাট ফাঁকা দেখে, বেলগাছে উঠে কাকের বাসায় উকি দিলাম। তিন-চারটে বাচ্ছা আমায় দেখে ঠোঁট ফাঁক করে, বোধহয় খাবারের আশায় হাঁ করে রইলো। আমি ওয়াই এর মতো দুটো ডালের সংযোগ স্থলে দাঁড়িয়ে, আলু বাছার মতো, বাচ্ছাগুলোর মধ্যে থেকে বহুকাঙ্খিত পুরুষ কোকিল ছানা বাছছি। আর ঠিক তখনই তাদের বাবা-মা কোথা থেকে এসে হাজির হ’ল। দু’জনে ওয়াই এর মতো দুটো ডালের দু’দিকে বসলো। বাঁ দিকেরটাকে তাড়াতে গেলে, ডান দিকেরটা মাথায় ঠোক্কর মারে, আর ডান দিকেরটাকে তাড়াতে গেলে, বঁ দিকেরটা। এই ভাবে ঐ গরমে, চড়া রোদের মধ্যে, বেল গাছের মগডালে দাঁড়িয়ে, কয়েকটা মিঠেকড়া ঠোক্কর খেয়ে, দেখি মাথা থেকে রক্ত বেরতে শুরু করেছে। অথচ কাঁটার জন্য বেল গাছ থেকে এক নাগাড়ে কাক তাড়িয়ে, চটপট্ নেমে আসতেও পারছি না।

এরমধ্যে আবার তাদের এরকম চরম বিপদ দেখে, অল্ ইন্ডিয়া কাক এসোসিয়েশনের মেম্বাররা এসে, গাছের চারপাশে চিৎকার করে ডেকে ডেকে উড়ে বেড়াতে লাগলো। ঘাড় বেয়ে রক্ত পড়তে দেখে, রাগে একে একে সবক’টা বাচ্ছাকে ওপর থেকে মাটিতে ফেলে দিলাম। ফলে তারা অবস্থাটাকে আরও উত্তপ্ত করে তুললো। কাকের চিৎকার ও আকাশে ঘুরপাক খাওয়া দেখে, দু’চারজন গাছতলায় এসে উপস্থিত হ’ল। তারা সকলেই আমাকে চেনে। বাচ্ছাগুলোকে ঐ ভাবে মেরে ফেলায়, তারা আমায় তিরস্কার করতে শুরু করলো। একজন আবার আমাকে সঙ্গে করে আমার বাড়ি নিয়ে গিয়ে, নালিশ করার প্রস্তাবও পেশ করলো। কপালে দুঃখ আছে বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে, মাথা নীচু করে মাঠ ছেড়ে বাড়ির পথ ধরলাম। আমার বিপদের সময় কিন্তু এদের একজনকেও সাহায্যের হাত বাড়াতে দেখি নি।

ছোটবেলা থেকে মাঠে, ঘাটে, জলাজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফড়িং, প্রজাপতি, মাছ, পশুপাখি, গাছের সাথে সখ্যতা। একটু বড় হয়ে স্কুল, এবং তারপরে কলেজ পালানোর নেশায় এর ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন ও অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে ও ভ্রমণের নেশায় আরও বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিচিত্র সংস্কার, বিচিত্র জায়গা দেখার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সুবীর কুমার রায় কর্ম সুত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। নেশা ভ্রমণ ও লেখা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা