সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

কোকিল ছেড়ে আবার অন্যান্য পাখির সন্ধান শুরু হ’ল। রোজ স্কুল যাবার পথে একটা সরু, ভীষণ উচু নারকেল গাছের প্রায় পাতার কাছাকাছি একটা গর্তে, টিয়া পাখিকে ঢুকতে বেরতে দেখি। একদিন গাছটায় উঠে প্রায় গর্তের কাছাকাছি পৌঁছেছি, ততক্ষণে নীচে বেশ ভিড় জমে গেছে। হাওড়া ব্রীজে ওঠা পাগলের মতো আমি গাছ জড়িয়ে বসে আছি। গাছের তলার লোকগুলোর ধারণা ছিল, আমি নারকেল চুরি করতে গাছে উঠেছি। পরে তারা যখন শুনলো আমার নারকেলের প্রতি কোন আসক্তি নেই, আমি টিয়াপাখির সন্ধানে গাছে উঠেছি, তখন তারা জানালো পাখির গর্তে সাপের উপদ্রব হয়। তাদের আপত্তিতে ও নির্দেশে, শেষ পর্যন্ত দু’হাত দুরের পাখির ছানা ছেড়ে, আমায় গাছ থেকে নেমে আসতে হ’ল। আমাকে এতক্ষণে হাতের কাছে পেয়ে, তারা খুব চিৎকার চেঁচামাচি করতে শুরু করলো। আমার মনে হয় না এদের একজনও ঐ গাছের মালিক। মনের দুঃখে প্রায় দেড়-দু’ মাইল পথ হেঁটে বাড়ি ফিরে এলাম।

বাস স্ট্যান্ড থেকে যে রাস্তায় আমাদের বাড়ি যেতে হয়, তার এক জায়গায় একটু ফাঁকা মতো। সেখানে একটা মাটির বাড়িতে, বাঁশের খুঁটিতে একটা বড় গোল দাঁড়ে, বেশ বড় একটা টিয়া পাখি ঝোলানো থাকতো। একটা বিধবা বুড়ি ঐ বাড়িতে একা থাকতো বলেই জানতাম। তখন শীতকাল, সন্ধ্যার মুখে কী রকম একটা ধোঁয়াশা গোছের হয়ে আছে। চারিদিক একবারে ফাঁকা। মাটির বাড়িটার কাছে এসে হঠাৎ মনে হ’ল, এ বাড়িতে এই পাখি মানায় না। টপ্ করে পাখিটা দাঁড় সমেত খুলে নিয়ে চলে গেলে, কেউ জানতেও পারবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রাস্তার পাশে বাড়িটার বারান্দা থেকে, দাঁড়টা একটানে ওপর দিকে উঠিয়ে নিয়ে চলে আসতে গিয়েও পারলাম না। সেটা বোধহয় কোন তার দিয়ে বাঁধা আছে। মাঝ থেকে পাখিটা ভয় পেয়ে, শিকল সমেত দাঁড়ের চারদিকে ঘুরপাক খেতে লাগলো। আমিও বিপদের গন্ধ পেয়ে, খুব দ্রুত আমার রাস্তা ধরলাম।

পাখি

দু’তিন দিন পরেই সুযোগ পেয়ে দাঁড়টা খুলে নিয়ে পাখি সমেত মনের আনন্দে বাড়ির পথ ধরলাম। ভগবান এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। বাড়ি গিয়ে কী গল্প বলা যায়, ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে চলে এলাম। বাড়ি ফিরে এসে হাসি মুখে জানালাম এক বন্ধুর পাখি, তারা নতুন এক জোড়া টিয়া খাঁচা সমেত কিনেছে, তাই এই পাখিটা আমাকে দিয়ে দিল।

দু’টোর জায়গায় তিনটে পাখি রাখতে তাদের কী অসুবিধা ছিল, আমাকেই বা পাখিটা কেন দিল, এ সব নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুললো না। নিজের বুদ্ধির তারিফ নিজে না করে পারলাম না। কী আনন্দ, এতদিনে আমি একটা গোটা টিয়ার মালিক, তাও আবার দাঁড় সমেত। সন্ধ্যা থেকে প্রায় মাঝ রাত পর্যন্ত পাখি সেবা চললো। পরদিন স্কুলে যাবার ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হ’ল। ফিরে এসে কিছুক্ষণ পাখি নিয়ে কাটলো। এর মধ্যে এক বন্ধু এসে খবর দিল কিছুটা দুরে, লেভেল্ ক্রসিং এর কাছে দুটো মোষ একসাথে রেলে কাটা পড়েছে। সবাই দেখতে গেছে। আমিও তার সাথে ঘটনা স্থলে গেলাম। গিয়ে দেখি বেশ ভিড়। দুটো মোষ রক্তাক্ত অবস্থায় রেল লাইনের ওপর পড়ে আছে। আমরা খুব বিজ্ঞের মতো, মোষের মালিকের মোষ বেঁধে রাখা উচিৎ ছিল, কী ছিল না, রেল কোম্পানী মোষের দাম দিয়ে দিতে বাধ্য কী না, পুলিশ মোষের মালিককে হাজতে পুরবে কী না, এই সব গুরুত্ত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

হঠাৎ পরিচিত একটা ছেলে আমায় জানালো, যে আমাকে একজন খুঁজছে। কে খুঁজছে জিজ্ঞাসা করায়, সে জানালো যে, একজন বুড়ো মতো লোক আমাদের বাড়ির কাছে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমায় আবার কোন বুড়ো মতো লোক খুঁজতে পারে, ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে এসে, বাড়িতে ঢোকার মুখে ধুতি পাঞ্জাবী পরা এক বৃদ্ধ, চোখে কাচের গ্লাশের পিছনের অংশের মতো মোটা কাচের চশমা, আমাকে ডাকলেন— "এই খোকা শোন"।
এই বৃদ্ধকে রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখি। "আমায় ডাকছেন"?
"হ্যাঁ বাবা, তোমাকেই বলছি"।
"বলুন।"
"বাবা, পাখিটা কোথায়?"
শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তার মানে সাক্ষী রয়ে গেছে। “কোন পাখির কথা বলছেন”?
"তুমি জান বাবা, কোন পাখির কথা বলছি। দেখ, বিধবা বুড়ির আর কেউ নেই। ঐ পাখিটাকে সন্তানের মতো মানুষ করেছে। বহুদিনের পাখি, ওটা দিয়ে দাও। বাবা-মাকে বল, তাঁরা নিশ্চই তোমায় পাখি কিনে দেবেন।" বৃদ্ধের মুখ থেকে কথাগুলো যেন বিনয়, ভদ্রতা ও করুণা ধারায় সিক্ত হয়ে বার হয়ে এল।
এই সব কথা বলতে বলতে, তিনি ক্রমশঃ আমাদের বাড়ির দরজার কাছাকাছি এগিয়ে এসেছেন। তাঁকে আর এগতে দেওয়া যায় না। এত জোরে কথা বলছেন, যে বাবার কানে যাবার উপক্রম।
আপনি একটু অপেক্ষা করুন বলে পাখিটা নিয়ে আসতে গেলাম। চটপট্ একটা গল্পও তৈরী করে ফেললাম। মা কে বললাম, “যে বন্ধু পাখিটা দিয়েছিল, সে তার বাবাকে না বলে আমাকে পাখিটা দিয়েছিল। তার বাবা এখন পাখিটা ফেরৎ চাইছেন”। আর কথা না বাড়িয়ে, পাখিটা নিয়ে এসে বৃদ্ধকে ফেরৎ দিয়ে দিলাম। বৃদ্ধ পাখি নিয়ে ফিরে যাবার আগে, আবার বাবা-মা’র কাছে পাখি কিনে দেবার কথা বলতে বলে গেলেন।

আমি আবার পাখিহারা হয়ে গেলাম। যাতায়াতের পথে দেখতাম আমাকে নিঃস্ব করে, পাখি তার নিজস্ব ভিটেয় নির্বিঘ্নে অবস্থান করছেন।

আমার সাথে শ্যামা নামে একটা ছেলে, আমার স্কুলে একই শ্রেণীতে পড়তো। তার বাবা ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী। সে আমার বাড়ির প্রায় পাশেই থাকতো। শ্যামার চেহারার সাথে আমার চেহারার খুব মিল ছিল। গায়ের রঙও প্রায় একই রকম। একদিন শ্যামা স্কুল যাবার পথে, হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করে বসলো— “কী ব্যাপার বলতো, ষষ্ঠীতলা দিয়ে গেলেই, দলে দলে বাচ্ছা ছেলে আমার পিছন পিছন হাততালি দিয়ে, পাখি চোর, পাখি চোর বলতে বলতে যায়”?

শুনে আঁতকে ওঠার মতো কথা হলেও, বোকার মতো মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যেন কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম, প্রায় আমার মতোই দেখতে এ জগতে আরও একজনকে প্রায় একই সময় সৃষ্টি করে, আমার বাড়ির কাছাকাছি পাঠাবার জন্য। এ লান্ছনা তো আমারই প্রাপ্য ছিল।


ছবিঃচন্দ্রিমা ঘোষ

ছোটবেলা থেকে মাঠে, ঘাটে, জলাজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফড়িং, প্রজাপতি, মাছ, পশুপাখি, গাছের সাথে সখ্যতা। একটু বড় হয়ে স্কুল, এবং তারপরে কলেজ পালানোর নেশায় এর ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন ও অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে ও ভ্রমণের নেশায় আরও বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিচিত্র সংস্কার, বিচিত্র জায়গা দেখার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সুবীর কুমার রায় কর্ম সুত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। নেশা ভ্রমণ ও লেখা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা