সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

'টিন ক্যান' থেকে স্মার্টঃ টেলিফোনের বিবর্তন

"তমাল কই রে?বাবানদাই বা কোথায়?"
"বাবানদা জানি না। তবে তমাল কি আজ আসবে?"
"কেন? শরীর খারাপ?"
"আরে না না, ওর দাদা কাল নতুন মোবাইল ফোন কিনেছে। সেই ফোনের নাকি ঝকঝকে ক্যামেরা। তমাল সকাল থেকে সেলফি তুলে যাচ্ছে।"
"ঐ দেখ, তমালের দাদা বাইক নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে এবার আসবে ছেলেটা।"
"হ্যাঁ, বলতে না বলতেই।"
"কি বলতে না বলতেই রে পল্টু?"– এক গাল হাসি নিয়ে তমালের আবির্ভাব।
"এই তুই কখন আসবি আর কি। যাক গে, তোর দাদার ফোনটা কেমন?"
"উফ কি ফোন রে, ভাবতে পারবি না। যা ঝকঝকে সেলফি ওঠে না। এই, বাবানদা কই রে? দেখছি না তো।"
"পিছনে ঘোর, দেখতে পারবি" –বাবানদার গলা শোনা গেল।
"আরে বাবানদা, এস, এস। জান আমার দাদা যা একখান ফোন কিনেছে না, দারুণ ঝকঝকে ছবি ওঠে।"
"ধুর।"
"কি ধুর, টি ভিতে দেখিয়েছে। আর সকাল থেকে আমিও তো তুললাম।"– রেগে গেল তমাল।
"সেসব না, টেলিফোন শুনলেই আমার এলিশা গ্রের জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায়।"
"সেটা কে গো বাবানদা?"– এবার রানার প্রশ্ন।
"বল দেখি টেলিফোন কে আবিষ্কার করেছে?"
"এটা সবাই জানে। আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল।"
"ওখানেই তো গন্ডগোল রে রানা। অনেকের মতে গ্রে আগে তৈরি করেছিলেন। বেল নাকি ওনার থেকে পরিকল্পনাটা চুরি করেছিলেন।"
"সেকি গো? সত্যি কি তাই নাকি?"
"আমি কিভাবে জানব বল।গ্রে, বেল, মেউচ্চি কে তৈরী করেছিলেন সঠিক ভাবে বলা খুব শক্ত। ভেবে দেখ, বেল সেই ১৮৭৬ সালে টেলিফোন আবিষ্কার করেছিলেন বলে আমরা জানি। অথচ এই বিভ্রাট নিয়ে ২০০২ সালে পর্যন্ত মার্কিন সেনেটে তর্ক-বিতর্ক চলেছে।"
"আচ্ছা বাবানদা, টেলিফোন আবিষ্কার হল কিভাবে? তুমি গল্পটা জানো?"–কৌতূহলী প্রশ্ন পল্টুর।


'টিন ক্যান' থেকে স্মার্টঃ টেলিফোনের বিবর্তন
প্রথম টেলিফোন- টিন ক্যান ফোন

"হা হা, আমি কি না জানি? তবে শোন। সেই ১৬৭৭ সালে বিখ্যাত ইংরেজ বৈজ্ঞানিক রবার্ট হুক একটা তারের মধ্যে দিয়ে শব্দ পাঠাতে শুরু করেন। মোটামুটি বলতে পারিস সেটাই প্রথম টেলিফোন। অনেকে সেই টিনের বাক্সের ভিতর দিয়ে কথা বলা শুরু করেছিল। মানে দুটো টিনের কৌটো, মাঝে একটা তার। বুঝতেই পারছিস তারের দৈর্ঘের উপর নির্ভর করত কতটা দূর অবধি কাজ করবে সেই টেলিফোন। এগুলোকে বলা হত টিন ক্যান ফোন। "

"হ্যাঁ হ্যাঁবাবানদা, মনে আছে 'ওরা থাকে ওধারে' তে এটা দেখিয়েছিল।"– হাত তুলে বলে উঠল রানা।
"একদম। তারপর তো এল টরেটক্কা বা টেলিগ্রাফ। সেটা তোরা দেখেছিস কি?"
"হ্যাঁ বাবানদা, দেখেছি। 'ঝিন্দের বন্দী"-তে।"


'টিন ক্যান' থেকে স্মার্টঃ টেলিফোনের বিবর্তন
জোহান রাইস এবং তাঁর তৈরি দূরভাষ যন্ত্র

"রাইট রানা। তারপর থেকেই লোকে ভাবতে লাগল কিভাবে শুধু লেখা না, কণ্ঠস্বরও পাঠানো যায়। এই ভাবনা থেকেই জার্মানির জোহান রাইস বা আমেরিকার এলিশা গ্রে, এঁরা আবিষ্কার করতে থাকলেন কথা বলার মাধ্যম, যাকে আমরা বলি টেলিফোন। ১৮৬০ সালে রাইস জার্মানিতে বসে আবিষ্কার করলেন এক যন্ত্র যার মধ্য দিয়ে একশ মিটার অবধি শব্দ বা কথা চলাচল করতে পারে। বুঝতেই পারছিস, এই যন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এটি মাত্র একশ মিটার অবধি কাজ করত। তা ছাড়াও এই যন্ত্রে শব্দ যেত ঠিক-ই, কিন্তু কথা যেত না। মানে কথা পরিষ্কার করে শোনা যেত না। এলিশা গ্রের ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত। শব্দ নিয়ে এনার গবেষণা খুবই নামকরা। আজ তোরা যে মিউজিক সিন্থেসাইজার বাজাস, তার আবিষ্কর্তা কিন্তু এই গ্রে। সত্তরটির উপর পেটেন্ট আছে ভদ্রলোকের। ১৮৭৬ সালের মধ্যে উনিও একটি টেলিফোন আবিষ্কার করেন। ১৪-ই ফেব্রুয়ারি ১৮৭৬ উনি এই টেলিফোনের নামে একটি পেটেন্ট জমা দেন মার্কিন দেশে। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই দিন-ই গ্রাহাম বেল-ও নিজের পেটেন্ট জমা দেন ঐ একই বিষয়ে। শোনা যায়, যেহেতু বেলের পেটেন্ট আগে জমা পড়েছিল, তাই ওনারটাই গ্রাহ্য করা হয়। যদিও গুজব আছে, বেল নাকি গ্রের থেকে এই টেলিফোনের আবিষ্কারটি নকল করেছিলেন, তবে তার কোন প্রমাণ নেই।


'টিন ক্যান' থেকে স্মার্টঃ টেলিফোনের ক্রমোন্নতি
( বাঁদিক থেকে ডান দিকে ) আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল, এলিশা গ্রে, আন্তোনিও মেউচ্চি

যাই হোক, সেটা ১৮৭৬ সাল। তার ঠিক এক বছর বাদে প্রথম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ তৈরি হয় আমেরিকার বস্টন শহরে। আরও অনেক বছর বাদে ১৯১৫ সালে প্রথম ফোন শুরু হয় আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে, মানে নিউ ইয়র্ক থেকে স্যানফ্র্যান্সিস্কো অবধি।"

"তো ২০০২ সালে মার্কিন সেনেট কি করল?"
"সে আর এক গল্প। ১৮৭১ সালে আন্তোনিও মেউচ্চি নামক এক ইতালীয় বৈজ্ঞানিক এক টেলিফোন আবিষ্কার করেন নিউ ইয়র্কে বসে। মেউত্তি পেটেন্ট জমা দিলেও তাতে কোথাও শব্দতরঙ্গের কথা বলেননি। তাই, তাঁকে টেলিফোনের আবিষ্কারক বলা হয়নি। ২০০২ সালে মার্কিন সেনেট সেটা শুধরে নেয়। মেউচ্চির অবদানকেও তার উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হয়।"


'টিন ক্যান' থেকে স্মার্টঃ টেলিফোনের বিবর্তন
গত শতকে ব্যবহার হওয়া ডায়াল টেলিফোন

"এ তো তুমি আমেরিকার গল্প বলছ, আমাদের দেশে কবে টেলিফোন এল?"
"আমাদের ভারতবর্ষ কিন্তু খুব পিছিয়ে ছিল না। ১৮৮২ সালের ২৮শে জানুয়ারী কলকাতা, বম্বে বা মুম্বাই আর মাদ্রাজ বা চেন্নাই-এ প্রথম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ চালু হয়। বিলেতের ওরিয়েন্টাল টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেড এই কাজের দায়িত্বে ছিল। কলকাতার টেলিফোন এক্সচেঞ্জের নাম হয় 'সেন্ট্রাল এক্সচেঞ্জ'। প্রথম দিকে মাত্র ৯৩ জন গ্রাহক ছিল এই টেলিফোন পরিষেবার। প্রথম ট্রাঙ্ক কল হতে যদিও অনেক সময় লাগে। ১৯৬০ সালে লখনৌ আর কানপুরের মধ্যে প্রথম ট্রাঙ্ক কল হয়। এগুলি সবই যাকে বলে ল্যান্ডলাইন তার কথা বললাম। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ল্যান্ডলাইনবসানোর অনুমতি ছিল না। এখনো দেশের ৭০ শতাংশের উপর ল্যান্ডলাইন কিন্তু সরকারি।"

"বলছি বাবানদা, সেদিন একটা সিনেমায় দেখছিলাম যুদ্ধের মধ্যে টেলিফোন ব্যবহার করছে সৈনিকরা। সেটা কি?"
"বাহ, ভালো প্রশ্ন পল্টু। ঐ ফোনটিকে বলে ফিল্ড টেলিফোন। ওদের নিজস্ব ব্যাটারি থাকে। ওনেক টেলিফোনে আবার তাও থাকে না। শব্দতরঙ্গকে শক্তিতে পরিণত করে এরা কাজ করে। ১৮৭০ সাল থেকেই ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসকেরা এর ব্যবহার করতে থাকে। যদিও এদের প্রচলন ব্যাপক প্রকারে শুরু হয় ১৯০৪ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধ থেকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফিল্ড টেলিফোন যে দু-পক্ষই ব্যবহার করে, তা বলাই বাহুল্য।"


'টিন ক্যান' থেকে স্মার্টঃ টেলিফোনের বিবর্তন
মোটোরোলা কোম্পানির তৈরি প্রথম হাতে ধরা মোবাইল ফোন

"বাবানদা, মোবাইল ফোন কবে আবিষ্কার হয়? আমাদের দেশেই বা কবে আসে?" "বলছি বলছি, এত ছটফট করিস না রানা। রেডিও তরঙ্গের সাহায্যে কথা বলা কিন্তু বহুদিন ছিল, যদিও খুবই ছোট দূরত্বে। মূলত রেল কোম্পানি বা সৈন্যবাহিনীতে এর ব্যবহার ছিল। এরপর আস্তে আস্তে অনেকেই মোবাইল ফোন তৈরি করতে লাগলেন, যদিও সেটা আজকের এই তোর দাদার ফোনের থেকে অনেক আলাদা ছিল। সেই ফোন ছিল গাড়ীতে লাগানো। হাতে নিয়ে চলাফেরা করা যেত না। ১৯৭৩ সালে মোটোরোলা কোম্পানি প্রথম হাতে ধরা মোবাইল ফোন বানালো। বেশ বড় একটা ফোন হলেও সেটা এই আজকের মোবাইল ফোনের পূর্বপুরুষ।

আমাদের দেশে প্রথম মোবাইল ফোনে কল করেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু তৎকালীনকেন্ত্রীয় টেলিকম মন্ত্রী শ্রী সুখরামকে। শুনে অবাক হবি, আমাদের দেশ কিন্তু মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যায় বিশ্বে দু'নম্বরে। ২০১০ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০ শতাংশ হারে মোবাইল গ্রাহক বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদের দেশে । এখন প্রায় ৯৩ কোটি গ্রাহক। যদিও ল্যান্ডলাইনের মত এখানে সরকারি ফোন কিন্তু খুব বেশী নেই। বরং বেসরকারি টেলিফোনের গ্রাহক-ই বেশী।"


'টিন ক্যান' থেকে স্মার্টঃ টেলিফোনের বিবর্তন
বাঁদিকে মোবাইল ফোনের চেহারার বিবর্তন; ডান দিকে একটি আধুনিক স্মার্টফোন

"আচ্ছা আগে তো মোবাইলে শুধু কথা বলা যেত। এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় যে?"
"হ্যাঁ, প্রথম যে মোবাইল ফোন গুলো আসে, সেগুলো হয় অ্যানালগ। তাদের বলা হত ওয়ান জি, তারপর ১৯৯০-র দশকে আসে টু জি। সেই ফোনগুলি সব ডিজিটাল। ২০০০-র মাঝামাঝি নাগাদ ফোনে ইন্টারনেটের সুবিধাও যুক্ত হল। এগুলির নাম হল থ্রি জি বা মোবাইল ব্রডব্যান্ড। এরপর এখন আসে হাল আমলের ফোর জি, যাতে থ্রি জি-র চেয়ে দশগুণ গতিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়।"

" আর এই যে সবাই বলে মোবাইলে অ্যাপ। সেটা কি?" "অ্যাপ কথাটা এসেছে অ্যাপলিকেশন থেকে। যে কোন কাজকে সহজ ভাবে করার জন্য এই অ্যাপের ব্যবহার। যেমন ধর আমি দেখতে চাই ইন্ডিয়ার ক্রিকেট খেলার স্কোর কত। সেরকম অ্যাপে গিয়ে হাত রাখলেই এক পলকে দেখতে পাব খেলার খবর। এরকম আজকাল ব্যাঙ্কিং, টিকিট কাটা, জিনিসপত্র কেনা সব কিছুরই অ্যাপ বেরিয়েছে। তাই তো এই ফোনগুলিকে বলা হয় স্মার্টফোন।"

"এই অ্যাপের ফলে আমাদের জীবন অনেক আরামের হয়ে গেছে তাই না?"
"তা ঠিক, কিন্তু কিছু গন্ডগোলও দেখা দিয়েছে। যেমন ধর আজ তুই মোবাইলে তোর ব্যাঙ্কে কত টাকা আছে দেখলি। এবার কেউ যদি তোর ফোন চুরি করে তাহলে সেও জানতে পেরে যাবে তোর ব্যাঙ্কের খবর। এমনকি সে চাইলে তোর টাকা চুরিও করতে পারে।প্রাইভেসির ক্ষেত্রে এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই স্মার্ট ফোন।"
"আর সেলফি?"
"তুই থাম এবার তমাল। সেলফির সঙ্গে টেলিফোনের ইতিহাসের কোন সম্পর্ক নেই। ওটা তোদের একটা হবি।"
"কিন্তু দাদা বলছিল একটা সেলফিস্টিক কিনবে..."
"এবার গাঁট্টা খাবি। বাড়ি চল। সন্ধ্যে হয়েছে। পড়তে বসতে হবে তোদের।"


ছবিঃ উইকিপিডিয়া এবং পিক্সাবে

কণাদ বসুর শৈশব কেটেছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে; অধুনা ব্যাঙ্গালোর নিবাসী। বাঙলা বই পড়তে, বাঙলা গান শুনতে আর বাঙলা সিনেমা দেখতে ভীষণ ভালোবাসেন। অবসর সময়ে স্মৃতির মণিকোঠার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা