সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ম্যাজিকযানের বাস্তবায়ন: হাইপারলুপ
(১)

"কী করছো টুবাই? এখানে চুপচাপ কেন বসে?"
টুবাই কোনো উত্তর দেয় না। টুবাইয়ের মা মিতুল একটু অবাক হন। টুবাই আজ স্কুল থেকে এসে নিজেই ব্যাগ রেখে, গুছিয়ে, জামাকাপড় পাল্টে সোফায় এসে বসে আছে। অন্য দিনগুলোর মতো মায়ের কাছে এসে আবদার নেই, খেতে চাওয়ার বায়না নেই। সবসময় কথা বলতে থাকা টুবাই আজ একটু বেশিই চুপচাপ। মা ছেলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, " কী হয়েছে বাবু? "

" মা, আমি কেন বাইরে খেলতে যাই না? আমার কেন বন্ধু নেই মা? "
মা টুবাইয়ের মাথাটা বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেন। টুবাই এক্সেপশনালি ব্রিলিয়ান্ট। যে বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে, তার গভীর অব্দি চিন্তা করে। এই ছোট বয়স থেকেই কোনো বিষয়ে তলিয়ে ভাবার স্বভাব আছে ওর। ওর কৌতূহল না মিটলে ও প্রশ্ন করতেই থাকে। স্কুলের গতানুগতিক সিলেবাসেও মন বসে না। কিছু বিষয়ে আগ্রহ হলে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হয়তো পাঠ্যবইয়ের বাইরের কিছু এমন প্রশ্ন করে যা আপাতভাবে স্বাভাবিক নয় আর তখনই সমস্যা হয় বাকিদের চোখে। মা কোনোভাবেই চান না, টুবাইকে এই পৃথিবী আলাদাভাবে দেখুক। তিনি পারলে সব মানুষের মন পাল্টে দিতেন, বুঝিয়ে দিতেন সবাই আসলে সমান, কেউ যদি আর পাঁচটা বাচ্চার চেয়ে একটু আলাদা হয়, তাহলেই তা খারাপ কিচ্ছু নয় ... বাইরের লোকের কাছে টুবাইয়ের যে দুটো সমস্যা ধরা পড়ে তা আসলেই কোনো সমস্যা নয়।

এক, ও কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়, বিশেষত যেকোনওরকম উত্তেজনা হলে কথা আরও অস্পষ্ট হয়ে যায়। আর, ভালো লাগার মানুষ না পেলে ও কথাই বলে না।
দুই, টুবাইয়ের ভাবনার আধার, শুরু, শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই যেমন সেদিন টুবাইয়ের বাবা সমরের বন্ধুর পরিবারের সামনে হঠাৎই টুবাই বলে ফেলল, "কাকু, তুমি নিশির ডাক শুনতে পাও? তোমায় যদি এলিয়েনরা ওদের গ্রহে উঠিয়ে নিয়ে যায়? ফিরে আসতে চাইবে না, না? যদি ওরা বলে ফিরতে গেলে তীর্থকে পাঠিয়ে দিতে হবে ওখানে, তাহলে? জানো কাকু, আমার মনে হয় নিশির ডাক আসলে এলিয়েনদের ডাক।"
সমরের বন্ধু অসিত, তার স্ত্রী মিত্রা আর ছেলে তীর্থ হঠাৎ এইসব প্রশ্নে খুব অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আর তেমন আড্ডা জমে না। মা-বাবা অনেক চেষ্টা করেও লাভ হয় না, তালটা কেটে যায়। তখন মা কিছুটা বাধ্য হয়েই টুবাইকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে যান। টুবাই ঘরের মধ্যে গেলে মাকে জিজ্ঞেস করে, "মা তোমার সঙ্গে এলিয়েনরা এরকম করলে কী করবে? আমায় তুমি ছেড়ে যাবে না কোথাও। আমায় নিয়ে যাবে তোমার সঙ্গে।"
"আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না, টুবাই।"

এরকম আরো নানা ঘটনার সাক্ষী হতে হয় মাকে। বাবা বাইরে যাওয়ার পর থেকে আরো বেশিই হতে হয়। তবে মা বোঝেন, যা টুবাই ভাবতে পারে বাকিদের পক্ষে তা হয়তো কল্পনাতীত। এই ভাবনাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তাই টুবাইয়ের সবটুকু কথা তিনি মন দিয়ে শোনেন, বুঝে ওর মতো উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এই এখন যেমন তিনি আবার চেষ্টা করেন ছেলের প্রশ্নের একটা বাস্তবসম্মত উত্তর দেওয়ার।
"আচ্ছা টুবাই, আমার ক'জন বন্ধু আছে? "
টুবাই সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে বললো,
"রিনিতা মাসি। "
" ঠিক বলেছো। কিন্তু আমার আর কোনো বন্ধু নেই কেন? আরো তো অনেক বন্ধু থাকতেই পারতো। "
"আর বন্ধু নেই... কেন? রিনিতা মাসি খুব ভালো। আমায় খুব ভালোবাসে। "
" হ্যাঁ, খুব ভালো। আর রিনিতা ছাড়া আমার তেমন কোনো বন্ধু কোনোকালে হয়নি। সবাই সবার বন্ধু হয় না টুবাই। সবাই যে সবাইকে বুঝতে পারে না। আর যখন একজন আরেকজনকে বুঝে যায়, ভালোবাসে, তখনই বন্ধুত্ব হয়, সারাজীবনের মতো বন্ধুত্ব। হয়তো ছোটবেলায় অনেকের সঙ্গে মেলামেশা হয়, কিন্তু বন্ধু ঐ এক বা দুজন বা গুটিকয়েকই হয়। একদিন তোমারও খুব ভালো ক'জন বন্ধু হবে, যারা তোমায় তোমার মনের মতো করে বুঝবে, তোমায় ভালোবাসবে। ততদিন তো একটু অপেক্ষা করতে হবে টুবাই। টুবাইয়ের, মায়ের মতো সারাজীবনের বন্ধু চাই না কিছুদিনের? "
"সারাজীবনের বন্ধু চাই। আমি খুব ভালোবাসবো বন্ধুকে, দেখো মা।"
" আমি তো জানি সোনা। তো এখন টুবাইয়ের মন ভালো হয়েছে? "
টুবাই চট করে একবার হেসে নিয়ে আবার মুখ গোমড়া করে ফেলে।
" কী হয়েছে টুবাই? "
"বাবার কাছে যাবো মা। এক্ষুণি যাব, ইচ্ছে করছে বাবার কাছে যেতে, বাবা কত খেলে আমার সঙ্গে! খেলেটেলে ফিরে এসে পড়তে বসব। মা আর আমি। "
চট করে এই বিষয় পরিবর্তনে মা একটু ঘাবড়ে যান। তারপর সামলে নিয়ে বলেন,
"কিন্তু যাবো কী করে? বাবা তো অনেকদূরে থাকে, প্রায় ছ'শো কিলোমিটার। চট করে তো ঘুরে আসা ..."
" যেতে পারবো না?"
টুবাইয়ের মুখ ঝুলে যায়। মায়ের খারাপ লাগে, তিনি চটজলদি ভেবে নেন একবার।
"হ্যাঁ, পারবে তো। হাইপারলুপ আছে তো। হাইপারলুপে একবার চড়ে বসলেই ব্যস, বাবার কাছে। আবার খেলাধুলো করে ফিরে আসা, হাইপারলুপ করে। "
"হাইপারলুপ কী মা? প্লেন? আকাশে ওড়ে?"
"না টুবাই, হাইপারলুপ হলো ট্রান্সপোর্টের একটি নতুন ফর্ম যা যাত্রীদের প্রায় সাতশো থেকে আটশো মাইলস প্রতি ঘন্টায় নিয়ে যাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। এটা অনেকটা ট্রেনের মতো। তবে ঠিক ট্রেন নয়, দেখতে অনেকটা বিশালাকার ক্যাপসুলের মতো, এগুলোকে বলা হয় পড। আর এগুলো মাটির ওপরে বা নিচে চলবে। "
" মানে মেট্রো ট্রেন? বাবার কাছে গিয়ে চড়লাম, সেইটা তো? কিন্তু মেট্রো ট্রেন তো এত তাড়াতাড়ি যায় না! সেবার বাবার কাছে যেতে গিয়ে একবেলা লেগে গেল, প্রায় সারা রাত। তাহলে? "
"হ্যাঁ, ঠিক কথাই। এ তো আর ট্রেন নয়, এ হলো স্বপ্নের যাত্রা। দশ-বারো ঘন্টার যাত্রাপথ মাত্র পঞ্চাশ মিনিটে পৌঁছে দেবে।"
" পঞ্চাশ মিনিট? এরোপ্লেনের থেকেও ফাস্ট? "
" হ্যাঁ তো। "
" কিন্তু ট্রেনের মতো এই যান কী করে এত জোরে ছুটবে? "
" মাটির ওপর যেসব যানবাহন ছুটে চলে যেমন ট্রেন, বাস, গাড়ি সবকিছুরই গতি কম হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ঘর্ষণ এবং বায়ুর প্রতিরোধ। ঠিক এই কারণেই এরোপ্লেন আকাশে থাকা কম ঘনত্বের বায়ুর মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে। আর ঠিক এই একই অবস্থা তৈরি করা হবে হাইপারলুপের ক্ষেত্রে, যেখানে বায়ুর প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং চাকার ঘর্ষণ নামমাত্র হয়। "
" কী করে মা? আর এটা ট্রেনের থেকে আলাদাই বা কী করে? এগুলো কি ট্র্যাকের ওপর দিয়ে চলবে না বুলেট ট্রেনের মতো? "
" ট্রেনের এক কামরা বা দুই কামরার সাইজের এই পডগুলো লো প্রেসার টিউবের মধ্যে চলবে। ট্রেনের সঙ্গে এর প্রধান দুই পার্থক্য রয়েছে।
এক, এই পডগুলো টিউব বা টানেলের মধ্যে দিয়ে চলবে। বায়ুর চাপ কমানোর জন্য বায়ু বের করে নেওয়া হবে এই টানেলগুলোর মধ্যে থেকে। প্রায় ভ্যাকুম বা শূন্য অবস্থা সৃষ্টি করা হবে টানেল বা টিউবগুলোর মধ্যে।
দুই, ট্রেন, বাস, গাড়ির মতো চাকার ব্যবহার না করে হাইপারলুপ চলবে বা ভাসবে এয়ার স্কি-র ওপর। গেমস পার্লারে গিয়ে আমরা যে এয়ার হকি খেললাম, অনেকটা সেইরকম। ঐ খেলার জন্য যে টেবিলগুলো ব্যবহার করা হয়, আর গোল চাকতিটা যেভাবে এয়ার হকির টেবিলগুলোর ওপর ভাসতে থাকে বা চলতে থাকে, সেই একইরকম ভাবে এই পডগুলো ভাসবে বা চলবে। এছাড়াও ম্যাগনেটিক ফিল্ডও ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ঘর্ষণ কমানোর জন্য।
তাই এক্ষেত্রে ট্র্যাক ব্যবহার করা হবে না, পরিবর্তে এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা এয়ার স্কির ওপর এটা চলবে।"

ম্যাজিকযানের বাস্তবায়ন: হাইপারলুপ
এলন মাস্ক

" কীভাবে এটা চলবে? টিউবের মধ্যে এই পডগুলো কীভাবে কাজ করবে যখন সেখানে চাকা নেই? এটাও কি ইলেকট্রিকেই চলবে? "
" খুব ভালো প্রশ্ন টুবাই। তোমায় তাহলে প্রথম থেকে বলি, ২০১৩ সালে ইনোভেটর এলন মাস্ক পুরো ব্যাপারটার ভাবনা সবার সামনে আনেন। তিনি তাঁর ‘হাইপারলুপ আলফা পেপার'-এ পুরো ব্যাপারটি দেখান। তিনি একটি রুটের উদাহরণ দেন। লস এঞ্জেলেস থেকে সান ফ্রান্সিসকো। এই রাস্তায় তখন একটি বুলেট ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা হচ্ছিল। তখন তিনি বলেন, এই রাস্তায় যদি হাইপারলুপ চলে, তা হবে ঐ বুলেট ট্রেনের থেকে অনেক কম খরচে, অনেক বেশি সুরক্ষিতভাবে এবং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য । পনেরোশো কিলোমিটার বা ন'শো মাইলের দূরত্বের মধ্যে যেকোনো দুটি স্থানের মধ্যে হাইপারলুপ চালানো উচিত হবে। এর থেকে বেশি দূরত্ব হলে এয়ারলাইন্স ব্যবহার করাই ভালো, তিনি বলেন। তিনি মজা করে বলেন, যতদিন না সত্যিকারের টেলিপোর্টেশন আবিষ্কার হচ্ছে ততদিন সবচেয়ে দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাওয়ার জন্য মাটির ওপরে বা নিচে একটি প্রায় ভ্যাকুম টিউব তৈরি করাই হলো একমাত্র উপায়। "
"টেলিপোর্টেশন কী মা?"
মা হেসে ফেলেন। "মুহূর্তের মধ্যে এক জায়গা থেকে আরেক যাওয়াকে বলে টেলিপোর্টেশন। ঐ যে গুপী গাইন এবং বাঘা বাইন করতো তালি মেরে!"

ম্যাজিকযানের বাস্তবায়ন: হাইপারলুপ
হাইপারলুপের পডের ভেতর যেমন দেখতে হবে

ছোট্ট টুবাই খুব মজা পায় গুপী-বাঘার নাম শুনে। ও গুপী-বাঘার সব মুভি দেখেছে। "গুপী-বাঘা সত্যিকারের থাকলে কী মজাই না হতো! ওরা সব পারে।"
"একদম ঠিক বাবু। তা যেটা বলছিলাম, টিউবের মধ্যে কৃত্রিমভাবে এমন এক অবস্থা তৈরি করতে হবে যার ফলে টিউবের মধ্যে বায়ুর চাপ মঙ্গল গ্রহের বায়ুর চাপের ওয়ান-সিক্সথ হবে। তার মানে টিউবের মধ্যে সমুদ্রতল বরাবর এমন এক অবস্থা তৈরি করা হবে যা মাটি থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার উপরে বায়ুর চাপের সমান, মানে টিউবের মধ্যে বায়ুর চাপ নামমাত্র থাকবে, নেই বললেই চলে।
মাস্কের মডেল অনুযায়ী, পডগুলো এই টিউবের মধ্যে আঠাশটি এয়ার বিয়ারিং স্কির ওপর দিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ট্র্যাক নয়, পডগুলোই একটা এয়ার কুশন তৈরি করবে যাতে টিউবটির মধ্যে দিয়ে ফ্রিলি যেতে পারে এবং টিউবগুলো কম খরচে রক্ষণাবেক্ষণ করা যেতে পারে।
পডগুলো যাত্রা শুরুর আগে প্রথমে বাইরে অবস্থিত একটি ইলেকট্রিক মোটর থেকে পাওয়ার নিয়ে চালু হবে, যা অত্যন্ত বেশি একটি গতিবেগ পেতে পডগুলোকে ত্বরান্বিত করবে। প্রতি সত্তর মাইলে এই ইলেকট্রিক মোটর পডগুলোর গতিবেগকে বুস্ট করতে সাহায্য করবে। এক একটি পড বা ক্যাপসুল আঠাশজন বা সর্বোচ্চ চল্লিশজন যাত্রী নিয়ে যেতে পারবে সম্ভবত। তবে আরো বিভিন্ন কারণের জন্য এগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, অসুস্থ রোগীকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দ্রুত নিয়ে যাওয়া, সহসা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে সত্বর  ত্রাণ পাঠানো, এমনকি কম ওজনের মালবাহী ট্রেনগুলোর বিকল্পও এটি হতে পারে।
এই পডগুলো প্রতি দুই মিনিট অন্তর এবং পিক টাইমে প্রতি তিরিশ সেকেন্ড অন্তর ছাড়া যেতে পারে।"
" মা, হাইপারলুপ চালু হয়ে গিয়েছে? আমাদের এখানে কোথায় চলে? "
" আমাদের এখানে ..."
এইসময়ই হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। মা টুবাইকে ছেড়ে উঠে পড়েন। দরজার দিকে যেতে যেতে তাঁর খুবই ভালো লাগে। ছেলের এই নতুন ব্যাপারে আগ্রহ সবসময় ওঁকে আনন্দ দেয়। পরে ওকে সবটা বলতে হবে আর নিজেকেও একটু পড়াশোনা করে নিতে হবে এই ব্যাপারে।


ভার্জিন হাইপারলুপ ওয়ান সংস্থার তৈরি এই ছোট্ট ভিডিও দেখলে হাইপারলুপের সম্ভাব্য গতি এবং কাজ সম্পর্কে একটা ধারনা পাওয়া যাবে

এরপর কিছুদিন টুবাই তেমন কথা বললো না, মানে সে নিজের মনেই বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকলো, শুধু স্কুল থেকে আজকাল কিছুটা দেরি করে ফেরে। তবে স্কুল থেকে ফিরেই মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া, নিজের ফেভারিট কার্টুন দেখা, দুমদাম প্রশ্ন করা ছিলই। মা একটানা অনেকদিন এভাবে ছেলেকে খুশি দেখেননি। কী ব্যাপার সেটা জানার একটা উৎসাহ তৈরি হলো।
" টুবাই, কী ব্যাপার? স্কুল কেমন চলছে? "
"ভালো। কেউ তেমন আমার সঙ্গে কথা বলে না, ক্ষ্যাপায়। আমিও ওদের আর পাত্তা দিই না। তবে আজকাল ..." বলে হঠাৎ চুপ করে যায় টুবাই।
"তবে আজকাল?" মা জিজ্ঞেস করেন।
"আমার একটা বন্ধু হয়েছে। স্কুলের বাইরে রতনদার চায়ের দোকানে কাজ করে, সেই খোকন। স্কুল ছুটির পর ওর সঙ্গে গল্প করি, তারপর রিকশায় উঠি। ও যদি দেখতে পায়, কেউ উল্টোপাল্টা বলছে তখন ও পাল্টা বলে দেয় তাদেরকে। আমি ওকে আমার বই পড়তে দিই। আমি ওকে একদিন অনেক পড়াবো। ওর বাবার শরীরটা ঠিক হয়ে গেলে আমি ওকে স্কুলে নিয়ে আসবো। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। "
সরল মনের স্বীকারোক্তি শুনে মায়ের চোখ ভরে যায়।

(২)

"খোকন, এই দেখ, বাবা এই বইটা আমায় জন্মদিনে দিয়েছিল। "
" কী বই টুবাই? "
" ফেলুদা। তুই নে এটা। "
" আমি কেন? এটা তো তোর জন্মদিনের উপহার। "
"পুরোটা পড়ে নে, তারপর ফেরত দিস, দেখবি পড়তে ইচ্ছে করবে বারবার, ফেরত দিতেই ইচ্ছে করবে না। "
বইটা হাতে নিয়ে খোকন উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে। মুখে ছড়িয়ে যায় হাসি। এই সময় মোড় থেকে একটা ছেলেকে হন্তদন্ত হয়ে দোকানের দিকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়।
" খোকন, তোর বাবার খুব শরীর খারাপ করেছে হঠাৎ করে। এক্ষুনি চল। "
খোকন বইটা রেখে বেরিয়ে আসে।
"রতনদা, আমি আসছি। "
" হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই যা। আমিও আসছি দোকান বন্ধ করে। "
খোকন বেরিয়ে যায়। টুবাইও বইটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

(৩)

খোকনের বাবার সত্যি খুব শরীর খারাপ। ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু মফস্বলের এই তল্লাটের হাসপাতালে লোক খুব শরীর খারাপ নিয়ে ভর্তি হলে আর সেরে উঠে বাড়ি ফেরে না। শহরে যেতে হবে। কিন্তু খোকনদের সেই ক্ষমতা নেই যে গাড়ি ভাড়া করবে। টুবাই সব শুনে বলে ওঠে,
" খোকন, তুই চল আমার সঙ্গে মায়ের কাছে। একটা ট্রেনের মতো গাড়ির খবর মা জানে, ওটায় উঠলে পাঁচ-সাত মিনিটে সবাই শহরের হাসপাতালে পৌঁছে যাবো। "
খোকন জানে, টুবাই মিথ্যে বলে না। কিন্তু এটা কী বলছে? "টুবাই, তা কী করে হয়? এটা তো সম্ভব না।"
"মা মিথ্যে বলে না টুবাই, চল মায়ের কাছে। বিশেদা কাকু-কাকিমাকে একটা রিক্সায় তুলে দাও। আমরা আসছি।"

ঘনঘন বেল বেজে ওঠায় মা দৌড়ে দরজা খুলতে যান। টুবাইয়ের আসার সময়। তবে এত উতলা হয়ে কেন বেল বাজাচ্ছে? ও কি জেনে গেল আজ বাবা এসেছে? মা দরজা খুলতেই টুবাই আছড়ে ঘরে ঢোকে।

"মা, হাইপারলুপ কোত্থেকে ছাড়ে? খোকনের বাবার খুব শরীর খারাপ। শহরের ভালো হাসপাতালে যেতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। "
মা হকচকিয়ে যান। টুবাইয়ের কথাগুলোকে বুঝতে একটু সময় নেন। তারপর সহসা বুঝে যান কোথায় ভুল হয়েছে।
" হ্যাঁ, টুবাই। আপনারা আসুন।" বলে মা ধরে বসান খোকন আর তার মা-বাবাকে।
" সমর, সমর শুনছো? "
" বাবা এসেছে? "
বাবা ততক্ষণে ড্রয়িংরুমে। "সমর ইনি হচ্ছেন টুবাইয়ের বন্ধু খোকনের বাবা। খুব সম্ভবত হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট বা হার্ট অ্যাটাক … ঠিক জানি না … তুমি একটু দেখো। "
টুবাইয়ের বাবা ডাক্তার সমর রায় তৎক্ষণাৎ প্রাথমিক পরীক্ষা করে নীচে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললেন।
বাবা খোকনের মায়ায় ভরা মুখটা দেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

" খোকন, তুমি টুবাইয়ের সঙ্গে থাকো। বাবার কিচ্ছু হবে না, চিন্তা কোরো না। আমি তোমার মা-বাবাকে নিয়ে নার্সিংহোমে যাচ্ছি। "
বাবা ধীরে সুস্থে খোকনের বাবাকে ধরে ধরে নিয়ে নিচে নামলেন, গাড়িতে করে রওনা দিলেন।

(৪)
ম্যাজিকযানের বাস্তবায়ন: হাইপারলুপ
নেভাডার মরুভূমিতে পরীক্ষা-নিরিক্ষার জন্য হাইপারলুপ টানেল

"মা, কী হলো? আমি যে খোকনকে বললাম, হাইপারলুপ করে আমরা তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবো শহরে। ও যে আমায় মিথ্যেবাদী ভাবলো! "
মা খোকনের গায়ের চাদরটা ঠিক করে টেনে দিয়ে টুবাইয়ের পাশে এসে বসলেন। টুবাইয়ের পাশে খোকন ঘুমিয়ে পড়েছে।
" তুমি কোনো মিথ্যে কথা বলোনি। সেদিন আমিই তোমায় সবটা বলে উঠতে পারিনি।
আসলে হাইপারলুপ এখনো পাইলট ফেজ-এ। ইঞ্জিনিয়াররা নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন টিউবটি নিয়ে। কিছু টেস্ট রান হয়েছে, তবে তা কোনোটাই মানুষ বা ভারী আসবাবপত্র নিয়ে হয়নি বা বলতে পারো প্রকৃত সিচুয়েশনে এখনো টেস্ট হয়নি। এই টেস্ট, নানা পরীক্ষা, ব্যর্থতা, সাফল্য এসব করতে করতে আরো তিন চার বছর লেগে যেতে পারে। সবকিছু ঠিকঠাক চললে হয়তো ২০২১-২২ নাগাদ প্রথমবার সাফল্যের সঙ্গে এটি চলবে। তবে এখানে নয়, আমেরিকায়। ভারতে হাইপারলুপ তৈরি করে চালু হতে আরো সাত-আট বছর লেগে যাবে। ভারতে দুটো জায়গায় এই পড চালু হওয়ার কথা হচ্ছে। মুম্বাই থেকে পুনে এবং অমরাবতী থেকে বিজয়ওয়াড়া। তবে সাফল্যের সঙ্গে একবার চললে হয়তো পৃথিবীর ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেমই পাল্টে যাবে। কারণ তোমায় যে ইনোভেটর এলন মাস্কের কথা বলেছিলাম, তিনি বলেছেন এটি পৃথিবীর আর সমস্ত গতিবহুল যানবাহনের থেকে কম খরচে মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। আর যেহেতু একটি টিউবের মধ্যেই সমস্ত ট্রান্সপোর্টেশনটি হবে তাই এটি হবে ওয়েদারপ্রুফও। মেইনটেনেন্স করার খরচও হবে খুব কম। নানা কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। ভার্জিন হাইপারলুপ ওয়ান, হাইপারলুপটিটি, এরাইভো … আর এখন এলন মাস্কের নিজের কোম্পানিও কাজ শুরু করেছে। এমনকি হাইপারলুপটিটি ইতিমধ্যে মানুষদের ক্যারি করার মতো একটি ক্যাপসুল বা পড বানিয়ে ফেলেছে। খুব শিগগিরই হয়তো আমরা এক অত্যাশ্চর্য জিনিসের সাক্ষী হবো। "

" কিন্তু মা, আমি যে ভুল বলে ফেললাম খোকনকে!"
"তুমি তো এবার অনেকটা জেনে গেলে, সবটা খোকনকে বলে দিও। দেখবে ওরও জেনে ভালো লাগবে। আর আজ তুমি সঠিক সময়ে ওদের বাড়িতে না নিয়ে এলে যে বড় ক্ষতি হতে পারতো। বাবা ডাক্তার বলেই সবটা চট করে বুঝে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করে দ্রুত নার্সিংহোমে যেতে পারলো, ওখানেও চিকিৎসা অনেক দ্রুত হলো। তোমার যদি হাইপারলুপের কথা মনেই না থাকতো, তুমি হয়তো ওদের বাড়িতে আনতেই না আর কিছু ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো। তাই না টুবাই? তুমি সবটা ভালো করেছ। আর বাবা তো নার্সিংহোম থেকে জানালো যে খোকনের বাবা এখন ভালো আছে। তাই তুমি আর এই নিয়ে ভেবো না।"
টুবাই ঘন হয়ে জড়িয়ে ধরে মাকে।
"মা, এখানে যখন হাইপারলুপ চালু হবে, আমাদের সঙ্গে খোকনের পরিবারকেও নিয়ে উঠবো ঐ পডগুলোর মধ্যে।"
"একদম বাবু, একদম। নাও, এবার ঘুমিয়ে পড়ো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।"

ছবিঃ হাইপারলুপ ওয়ান ডট কম এবং উইকিপডিয়া

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা