সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
বন্ধুত্ব

অনেক, অনেক বছর আগে চিন দেশে কি-ইয়ু আর পাও-শু নামে দুই বন্ধু থাকত। এই দুজন অল্পবয়েসি মানুষ দামন আর পিথিয়াসের মতো পরস্পরকে ভালোবাসত এবং সবসময়ে একসঙ্গে থাকত। তারা কেউ কাউকে খারাপ কথা বলত না; কোনো কু-চিন্তা তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারেনি। তাদের এই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব আর পরিরা তাদের এই গুণের জন্য কীভাবে তাদের সত্যিকারের পুরস্কার দিয়েছিল, সে-সম্বন্ধে অনেক গল্পই চালু ছিল। যাইহোক, তাদের ভালোবাসা কতটা জোরদার ছিল সেটা একটা গল্প শোনালেই বোঝা যাবে।

বসন্তের গোড়ায় একটা সুন্দর, ঝলমলে দিনে শহরের ক্লান্তিকর, কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ থেকে একটু নিস্তার পেতে কি-ইয়ু আর পাও-শু একসঙ্গে হাঁটতে বেরোল।

কি-ইয়ু আপনমনে বলল,"চলো, পাইনের জঙ্গলের একদম গভীরে যাই।" ওখানে আমরা সমস্ত উৎপাতগুলো ভুলে থাকতে পারব; ওখানে আমরা ফুলের সুন্দর গন্ধটা বুক ভরে নিতে পারব আর শ্যাওলায় ঢাকা মাটিতে শুয়ে থাকতে পারব।"

"বাঃ!" বলল, পাও-শু,"আমিও ক্লান্ত। জঙ্গলটাই বিশ্রাম নেওয়ার উপযুক্ত জায়গা।"

একটা ছুটির দিনে, দূরের গাছগুলোর মাথার দিকে চোখ রেখে দুই পরম বন্ধু আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। তারা যতই বনের কাছে আসতে লাগল , ভাল সময় কাটানোর উত্তেজনায় তাদের হৃৎস্পন্দন তত দ্রুত হতে লাগল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কি-ইয়ু বলল,"গত তিরিশ দিন ধরে আমি প্রচণ্ড পড়াশোনা করেছি। এই তিরিশ দিন আমি কোনো বিশ্রাম পাইনি। আমার মাথার মধ্যে এত তথ্য গিজগিজ করছে, যে, চিন্তায় আছি, মাথাটা না ফেটে যায়। উফ, সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া টাটকা বাতাস বুক ভরে নেব।"

"আর আমি," দুঃখের সঙ্গে বলল পাও-শু,"ক্রীতদাসের মতো আমার মালিকের দোকানে কাজ করেছি। তোমার লেখাপড়ার কাজটার মতোই আমার কাজটাও খুব ম্যাড়ম্যাড়ে। মালিক আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেন। তাঁর হাতের নাগালের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারাটা সত্যিই খুব ভালো ব্যাপার।"

কথা বলতে বলতে তারা ছোটো বনটার সীমানায় চলে এল, একটা ছোটো নদী পেরোল আর তারপর সামনের লম্বা লম্বা গাছ আর ঘন ঝোপের মধ্যে হারিয়ে গেল। বেশ কয়েক ঘণ্টা তারা এদিক-ওদিক এলোমেলো ঘুরে বেড়াল, গল্প করল,মজার গল্প করে হাসতে লাগল। হঠাৎ এক সময় রাশি রাশি ফুলে ঢাকা ঝোপ পেরোতে গিয়ে তারা দেখতে পেল, তাদের সামনেই রাস্তাটার ওপর এক টুকরো সোনালি মত কি যেন চকচক করছে।

"দেখো! দেখো!" টুকরোটার দিকে আঙুল দেখিয়ে দুজনে একসঙ্গে বলে উঠল।

তাদের নাকবরাবর, রাস্তার ওপর এক টুকরো সোনা চকচক করছে।

কি-ইয়ু ঝুঁকে সোনার টুকরোটা কুড়োল। সেটা প্রায় একটা লেবুর মতো গোল আর বড়ো আর সূর্যের আলোয় ঝলমল করছিল। তার গায়ে ছিল খুব সুন্দর কারুকার্য।"বন্ধু, এটা তোমার," বলে পাও-শুর হাতে সেটা দিয়ে সে বলল,"তোমার, কারণ তুমিই এটা প্রথম দেখতে পেয়েছ।"

পাও-শু অমনি বলে উঠল,"না,না, তুমি ভুল করছ ভাই, তুমিই তো প্রথম বললে। এখন তুমি আর বলতে পারবে না যে, মন দিয়ে পড়াশোনা করার জন্য পরিরা তোমাকে কোনো পুরস্কার দেয়নি।"

"আমার পড়াশোনার পুরস্কার! কেন? হতেই পারে না। জ্ঞানী মানুষরা কি সবসময় বলেন না, যে, পড়াশোনা করলে আপনাআপনিই তার পুরস্কার পাওয়া যায়? না ভাই, সোনাটা তোমার; আমি বলছি, তোমার। দিনের পর দিন যে তুমি কঠিন পরিশ্রম করেছ সেকথাটা একবার ভাবো— খাটিয়ে খাটিয়ে মালিক তোমার হাড়মাস কালি করে দিল! তার চেয়ে এটা অনেক ভালো। নাও,'' এই বলে সে হাসতে লাগল।''এটা সেই লক্ষ্মীর ঝাঁপি হতেও তো পারে যা দিয়ে তুমি তোমার ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে।"

তারা এভাবেই কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা করল, দুজনেই সেই দামি জিনিষটা নিজের কাছে নিতে অস্বীকার করল। এ ওকে আর ও একে জিনিসটা নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগল। শেষমেষ, যেখানে তারা সোনার টুকরোটা প্রথম দেখেছিল সেখানেই সেটা পড়ে রইল আর দুই বন্ধু চলে গেল। সোনার টুকরোটাকে ফেলে যাওয়ার জন্য তাদের একটুও দুঃখ ছিল না, কারণ এই জগতে অন্য কোনো কিছুর চেয়ে তাদের কাছে তাদের বন্ধুত্ব অনেক দামি ছিল। আর তাই কোনোরকম ঝগড়াঝাঁটিও তাদের কাছ ঘেঁষতে পারেনি।

"আমরা কিন্তু সোনা পাব বলে শহর ছাড়িনি," কি-ইয়ু আন্তরিকভাবে বলল।
"না," তার বন্ধু উত্তর দিল,"এই জঙ্গলে একটা দিন কাটানোটা হাজার হাজার সোনার টুকরোর সমান।"

কি-ইয়ু প্রস্তাব দিল,"চলো, ঝরনাটার কাছটায় যাই, পাথরের ওপর একটু বসি। গোটা বনটার মধ্যে এই জায়গাটাই সবচেয়ে ঠান্ডা।"

তারা যখন ঝরনাটার কাছে পৌঁছোল, দুঃখের সঙ্গে দেখল যে জায়গাটা ইতিমধ্যেই দখল হয়ে গেছে। গ্রাম থেকে আসা একটা লোক মাটির ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।

বন্ধুত্ব

পাও-শু চেঁচিয়ে বলল,"এই যে হে, উঠে পড়ো! খুব কাছেই তোমার জন্য ধনসম্পদ পড়ে আছে। ওইখানে রাস্তার ওপর একটা সোনার আপেল অপেক্ষা করছে, কখন কে গিয়ে তাকে তুলে নেবে।"

তারপর তারা সেই অবাঞ্ছিত আগন্তুককে বুঝিয়ে দিল ঠিক কোনখানটায় সোনার টুকরোটা ছিল। আর সেকথা শুনে লোকটাও ছুটল সেই দিকে। তাই না দেখে দুই বন্ধু খুব মজা পেল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক তারা একে অন্যের সঙ্গে আনন্দে কাটাল, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার কথা আলোচনা করল, মাথার ওপর ডাল থেকে ডালে উড়ে যাওয়া পাখিদের গান শুনল।

অনেকক্ষণ পরে তারা একটা রাগী গলার আওয়াজে চমকে গেল। এটা সেই লোকটারই গলা, যে সোনার টুকরোটা কুড়োতে গিয়েছিল।"বাবুরা, আমাকে নিয়ে এই রগড়টা তোমরা কেন করলে? এমন গরমের দিনে আমার মতো একটা গরিব মানুষকে কেন নাহক দৌড় করালে?"

"কী বলছ, হে?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কি-ইয়ু।"আমরা তোমাকে যে ফলটার কথা বললাম সেটা খুঁজে পাওনি?"

রাগ-চাপা গলায় সে বলল,"না। কিন্তু তার জায়গায় ছিল একটা রাক্ষুসে সাপ, আমার তলোয়ারটা দিয়ে আমি যেটা দু-টুকরো করে ফেলেছি। ভগবান এবার বনের প্রাণী মেরে ফেলার জন্য আমায় অভিশাপ দেবেন। তোমরা যদি ভেবে থাক যে ওরকম একটা কৌশল করে তোমরা আমাকে এখান থেকে তাড়াবে, তাহলে তোমরা ভুল ভেবেছ, কারণ আমি এখানে আগে এসেছি; আমাকে ভুল কথা বলে এখান থেকে সরানোর অধিকার তোমাদের কে দিল বাবুরা?"

"এই যে হে, বকবক থামাও। তোমার হয়রানির জন্য একটা পয়সা নাও। আমরা ভেবেছিলাম আমরা তোমার একটা উপকার করলাম। এখন, তুমি যদি অন্ধ হও, সেজন্য একমাত্র তুমিই দায়ী। পাও-শু, চলো আমরা ফিরে যাই। সোনার টুকরোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই আজব সাপটার দিকে একবার দেখি।"

গ্রাম থেকে আসা লোকটাকে ফেলে রেখে তারা দুই বন্ধু গল্পগুজব করতে করতে সেই সোনার টুকরোটার খোঁজে চলে গেল।

"আমি যদি ভুল না করি,'' ছাত্রটি বলল,''ওই যে গাছটা কেটে রাখা আছে, তার পেছনে সোনাটা আছে।"

"একদম ঠিক; খুব শিগগিরি আমরা মরা সাপটা দেখতে পাব।"

মাটির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে তাড়াতাড়ি তারা বাকি রাস্তাটা পেরোল। যেখানে তারা সেই চকচকে জিনিসটা ফেলে রেখে গিয়েছিল সেই জায়গাটায় পৌঁছে অবাক হয়ে তারা দেখল, একটা সোনার টুকরো নয়, ভবঘুরের বর্ণনা মতো কোনো মরা সাপও নয়, তার বদলে দুটো সুন্দর সোনার টুকরো, প্রত্যেকটা, তারা প্রথমে যেটা দেখেছিল তার থেকে আকারে বড়ো। দুজনেই একটা করে টুকরো তুলে নিল আর আনন্দের সঙ্গে বন্ধুর হাতে দিল।

"শেষ পর্যন্ত পরিরা তোমাকে তোমার স্বার্থহীনতার পুরস্কার দিল!" বলল কি-ইয়ু।
"হ্যাঁ," উত্তর দিল পাও-শু,"তোমাকে তোমার প্রাপ্যটা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে।"

(চীনের উপকথা )

ছবিঃঐন্দ্রিলা মুখার্জি

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র অনমিত্র রায়ের পথ চলার সঙ্গী গানের সুর,ছবির রং আর চারপাশ ঘিরে থাকা চেনা-অচেনা মানুষজন, পশুপাখি, গাছপালা—বিচিত্র জীবনধারা। কলম দিয়ে ছবি আঁকেন বাইরের জগৎ, মনের জগৎ-- দুইয়েরই। কখনো কবিতায়, কখনো গদ্যে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা