সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

অনেকদিন আগেকার কথা। ব্রহ্মগিরিতে লুব্ধক নামে এক ভয়ানক হিংস্র প্রকৃতির ব্যাধ বাস করত। সে শুধু যে পশুপাখি শিকার করত, তাই নয়, কি ব্রাহ্মণ, কি সাধু, সকলকেই হত্যা করত। তাকে দেখতেও ছিল উগ্র, ভীষণাকার। একদিন সেই ব্যাধ বনে বনে সারাদিন ঘুরে পশুপাখি শিকার করল, মৃত পশুগুলো সে থলেয় ভরে নিল আর জীবিত পাখিগুলো খাঁচায় বন্দী করল। বাড়ির ফেরার সময় পথে সন্ধ্যা হয়ে বনের মধ্যে আঁধার ঘনিয়ে এল। কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে অঝোরে বৃষ্টি আরম্ভ হলো। কড়কড় শব্দে বাজ পড়তে লাগল। ব্যাধ খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তার সমস্ত শরীর কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল, ঠাণ্ডায় সে থরথর করে কাঁপছিল। লুব্ধক ভাবল, এই অবস্থায় ঘরে ফেরা অসম্ভব। অবশেষে এক বিরাট বটগাছের নীচে সে তার শ্রান্ত, অবসন্ন শরীর এলিয়ে দিল। ঘরে স্ত্রী ও শিশুপুত্র তার ফেরার পথ চেয়ে বসে আছে—একথা চিন্তা করে তার মন আকুল হয়ে উঠল। কিন্তু তার আর একটুও নড়ার শক্তি ছিল না। ঐ গাছেই বাস করত এক কপোত-দম্পতি। কপোতী তখনও দানা খুঁটে ঘরে ফেরেনি, তাই তার কপোত স্বামী চিন্তিত হয়ে অনুচ্চ স্বরে বলতে লাগল, "তাই তো, সন্ধ্যা হয়ে গেল দেখছি, প্রিয়া তো এখনও ফিরল না! তার কি কোনও বিপদ হলো? সে আমার সুখদুঃখের সাথী। আমার সুখে সে সুখী হয়, আমি দুঃখিত হলে সে আমাকে কত ভাবে সান্ত্বনা দেয়। তার মতো পতিগতপ্রাণ স্ত্রী অতি ভাগ্যে মেলে! হায় হায়, এখন আমি কোথায় তাকে খুঁজব?" তার বিলাপ শুনে কপোতী ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠল, "নাথ, আমি এখানে, ব্যাধের খাঁচায় বন্দী হয়ে আছি! তুমি আমার জন্য চিন্তা কোর না। আমার কর্মফলে আমার এই দশা হয়েছে।  ব্যাধের উপর তুমি ক্রুদ্ধ হয়ো না। ব্যাধ এখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। সে যখন আমাদের গৃহে সন্ধ্যার সময় এসেই পড়েছে, সে আমাদের অতিথি। তুমি তোমার অতিথি ধর্ম পালন কর। শ্রান্ত অতিথির রূপ ধরে সকল দেবতা ও পিতৃপুরুষের আগমন হয়—শাস্ত্রে এমন কথাই বলে। অতিথি সেবা করলে দেবসেবারই ফল হয়। আর অতিথি নিরাশ বা রুষ্ট হয়ে ফিরে গেলে সমস্ত দেবতা অপ্রসন্ন হন। তুমি একথা ভেবে অতিথির দোষ দেখো না যে, সে তোমার স্ত্রীকে আটকে রেখেছে। কারণ উপকারের প্রতিদান দেওয়া মানুষের ধর্ম, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু অপকারী ব্যক্তির প্রতিও যে দ্বেষ না করে সুন্দর ব্যবহার করে, সেই আসল পুণ্যের ভাগীদার হয়"।

নিজের স্ত্রীর এই অপূর্ব ত্যাগ ও আদর্শের কথা শুনে কপোতের মনের কষ্ট দূর হয়ে গেল। তার ধর্মবোধ জাগ্রত হলো। সে ব্যাধের সামনে উপস্থিত হয়ে হাতজোড় করে বলল, "আপনি আমার অতিথি। আমার কর্তব্য সাধ্যমত আপনার সেবা করা। এই সময় আপনি ক্ষুধার্ত ও শীতে কষ্ট পাচ্ছেন। একটু অপেক্ষা করুন"। এই বলে সে উড়ে গিয়ে কোথা থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠি ঠোঁটে করে এনে শুকনো কাঠকুটোর স্তুপে ফেলে দিল। ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল। ব্যাধের শীত দূর হলো। এবার সেই কপোত ব্যাধকে পরিক্রমা করে প্রণাম জানাল। বলল, "আপনার খাবারের বন্দোবস্ত করছি"। তারপর সেই জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই ব্যাপার দেখে ব্যাধ প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল, সে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিয়ে কপোতীকে খাঁচা থেকে মুক্তি দিল। মুক্তি পাওয়া মাত্র কপোতী তার স্বামীর পথ অনুসরণ করে আগুনে ঝাঁপ দিল। মুহূর্তের মধ্যে ব্যাধ দেখল, কপোত ও কপোতী জ্যোতির্ময় দেহ ধারণ করেছে এবং তাদের স্বর্গলোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জ্যোতির্ময় রথ এসেছে। ব্যাধ আত্মগ্লানিতে কাঁদতে লাগল। বলল, "কি করলে আমার উদ্ধার হবে?" কপোত তাকে বলল, "আপনি গোদাবরী তীরে গিয়ে বাস করুন, জীবহিংসা ত্যাগ করে প্রত্যহ গোদাবরী নদীতে স্নান করুন"। ব্যাধ কপোতের নির্দেশ অনুসারে গোদাবরী তীরে গিয়ে অহিংস ভাবে বাস করতে শুরু করল এবং একমাস ধরে প্রতিদিন গোদাবরীতে স্নান করতে লাগল। অবশেষে একমাস পর তার সব পাপ ক্ষয় হয়ে গেল এবং সে স্বর্গলোকে গমন করল। গোদাবরী তীরে সেই স্থান আজও কপোত-তীর্থ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।

(উৎস—ব্রহ্মপুরাণ, অধ্যায়-৮০, শ্লোক সংখ্যা-৬-৯৩)

 

ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

প্রাণীবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা; শিক্ষিকা হিসেবে কাজ বিভিন্ন স্কুলে। বর্তমানে একমাত্র নেশা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা। 'উদ্বোধন' (রামকৃষ্ণ মিশনের একমাত্র সাংস্কৃতিক বাংলা মাসিক পত্রিকা) পত্রিকার 'চিরন্তনী' বিভাগের পুরাণ-কাহিনীর নিয়মিত লেখিকা । এছাড়াও রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠের অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন এবং বই অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা