সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

অনেক দিন আগে তিব্বতের স্নালং নামে এক শহরে বাস করতেন সে দেশের রাজা জেন্ডং। রাজার মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে গেনচগ সেই রাজ্য শাসন করতে থাকলেন। দরবারে তাঁর দু'জন প্রধান মানুষ ছিল। একজন চিত্রশিল্পী আরেকজন কাঠমিস্ত্রী বা ছুতোর। রাজা এদের দুজনের সূক্ষ্ম হাতের কাজের খুব পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। অথচ এই শিল্পী এবং ছুতোর মোটেও পরস্পরের বন্ধু ছিল না।  দুজনকেই রাজামশাই ভালোই পারিশ্রমিক দিতেন। কিন্তু ছুতোরটি ছিল মিতব্যায়ী এবং বুদ্ধিমান আর চিত্রশিল্পী ছিল বড় ফন্দীবাজ। তার কেবল লক্ষ্য ছিল কী করে আরও উপার্জন করা যায়। তাই বলে সে যে খুব সঞ্চয়ী ছিল তা নয় কিন্তু। তবে সে ছিল অর্থলোভী।  

একদিন সেই চিত্রশিল্পী রাজা গেনচগ কে গিয়ে বলল

"গতকাল রাতে আমি এক স্বপ্ন দেখেছি রাজামাশাই। আপনার বাবা রাজা জেন্ডং স্বর্গ থেকে এক পরীকে পাঠিয়ে আমাকে সেখানে ডেকে পাঠিয়েছেন।আর  আমিও গেছি আপনার বাবার কাছে সেই পরীর সঙ্গে। গিয়ে দেখি আপনার বাবা আরও ধনী হয়ে গেছেন স্বর্গে গিয়ে। এলাহি সেখানকার ব্যাপারস্যাপার।  উনি আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বলছেন আপনাকে দিতে। এই নিন রাজামাশাই, এই সেই চিঠি। "

রাজা গেনচগ বললেন, বেশ। এবার পড় দেখি চিঠি তে কী লিখেছেন বাবা।
চিত্রশিল্পী পড়ে বলল
"চিঠিখানি ঐ ছুতোর মিস্ত্রী কে নিয়ে,"  
সেই শুনে রাজা বললেন, দেখি দাও আমার হাতে। চিঠি খুলে রাজা পড়তে লাগলেন। সেখানে লেখা ছিল...

"গেনচগ, শুনতে পাচ্ছ? আমি, তোমার বাবা। স্বর্গে এসে আমি খুব বড়লোক হয়ে আবার নতুন জীবন যাপন করতে শুরু করেছি। আগের জীবনে যা কিছু পাইনি সব পেয়েছি এখানে এসে। শুধু আমার একটি ইচ্ছে এখনো পূর্ণ হয়নি। আমি ভেবেছিলাম স্বর্গে একটি সুন্দর মন্দির তৈরি করব। সব দেবদেবীরা বাস করবেন সেই মন্দিরে। কিন্তু এখানে তেমন সুদক্ষ ছুতোর নেই যে বানাবে অমন এক মন্দির। সুতরাং শহরের সবচেয়ে নিখুঁত সেই কাঠমিস্ত্রি কে এই চিত্রশিল্পীর সঙ্গে যদি তুমি পাঠিয়ে দাও এখানে। তাই এর হাত দিয়ে তোমাকে আমি চিঠি পাঠালাম ।"
   
গেনচগ ভাবলেন, এ আমার বাবার লেখা চিঠি হতে বাধ্য! বাবা চিরকাল একটা সুন্দর মন্দির বানানোর চেষ্টায় থাকতেন। অতএব আমার এ ব্যাপারে শীঘ্রই কিছু করা উচিত।  
এই ভেবে তিনি তাঁর প্রিয় ছুতোর মিস্ত্রি কে ডেকে তাঁর বাবার ইচ্ছার কথা জানালেন। বল্লেন, আমার বাবার ইচ্ছা পূর্ণ করতে তুমি শীঘ্র স্বর্গের পথে পা বাড়াও। ছুতোর ভাবল, এ কী আজব কথা বলছেন রাজামশাই!বাস্তবে সে কখনো সম্ভব? এ নিশ্চয়ই ঐ চিত্রকরের  কোনও কুমতলব।আমার সঙ্গে ওর কোনও মতের মিলও হয়না। তাই আমাকে ও এই রাজ্য থেকে সরিয়ে দিতে চাইবার ফন্দী আঁটছে।

ছুতোর রাজার সামনে কিছু প্রকাশ করল না তবে বলল, বেশ তাই হবে রাজা মশাই। কিন্তু সেখানে আমি পৌঁছব কেমন করে? সে তো শুনেছি অনেক দূর। সাধারণ মানুষ যেতে পারেনা সেখানে।

তখন রাজা গেনচগ তলব করলেন সেই চিত্রশিল্পীর। বল্লেন, "কেমন করে ছুতোর কে আমার বাবার কাছে পাঠানো যায়?"
দুষ্টু চিত্রকর বলল, "তার সব যন্ত্রপাতি সব নিয়ে আসুক তবে। একটা কাঠের পাটাতনে সব রেখে তার ওপরে তাকে বসাতে হবে। এবার সেই কাঠে অগ্নি সংযোগ করলেই সেই ধোঁয়ায় ছুতোরও ক্রমশঃ ধোঁয়ার সঙ্গে আকাশের দিকে উঠতে থাকবে। আর আকশের দিকেই তো স্বর্গের পথ শুনেছি। "    
ছুতোর সব শুনে বলল, "বাহ! এ তো দেখি দারুণ প্রস্তাব! কিন্তু একটা কথা আছে ভায়া। আমি আমার নিজের জায়গা অর্থাৎ আমার বাড়ি থেকেই যাত্রা শুরু করব কিন্তু । আমাকে সাতদিন সময় দেওয়া হোক। "
রাজা বললেন, বেশ তাই হবে।
ছুতোর বাড়িতে ফিরে তার বৌ কে সব কথা খুলে বলল।
তার বৌ বলল, "আমি জানতাম ঐ দুষ্টু লোকটা একদিন ঠিক তোমার ক্ষতি করার ফন্দী বের করবে। "
ছুতোর বলল, "আজ থেকেই কাজ শুরু করে দিতে হবে, বুঝেছ? এই বলে নিজের ঘরের নীচ থেকে একট সুড়ঙ্গ কেটে ফেলে তকে যে স্থানে পোড়ানো হবে সেইখান অবধি তার নির্গমন পথ রাখল।"
সাতদিন কেটে গেল। তারপর রাজা গেনচগ ছুতোর কে খবর দিলেন। আর তার লোকজনদের বললেন কাঠের গুঁড়ি, জ্বালনের তেল সব জোগাড় করে রাখতে। একটি চারকোণা আকৃতির জিনিষ বানানো হল সেই কাঠ দিয়ে। মধ্যিখানে হবে ছুতোরের বসার জায়গা। আর তার চারকোণায় স্তূপীকৃত কাঠকুটো রাখা থাকল। যথাসময়ে ছুতোর নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা সেই সুড়ঙ্গের মত নির্গমন পথ ধরে সেখানে বসে পড়ল তার সব যন্ত্রপাতি নিয়ে। এবার সেখানে তেল ঢেলে দিল রাজার লোকজনেরা। সেই চালাক চিত্রকরেরর তখন মনে আনন্দ আর ধরে না।

এবার যেইমাত্র সেখানে অগ্নি সংযোগ করা অমনি পিছলে ছুতোর ঝাঁ করে সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে পড়ে গেল। আর সোজা মাটির পথ দিয়ে তার ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ল। চিত্রকর জোরে হাততালি দিয়ে বলল, এবার দেখ সকলে, এই ধোঁয়া কেমন আমাদের ছুতোর বন্ধুকে স্বর্গের দিকে নিয়ে চলে। আর ততক্ষণে সেই ছুতোর নিজের ঘরের মধ্যে বানানো আরেকটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়েছে।

আর রাজ্যের সেই স্থান অর্থাৎ যেখানে ছুতোরকে পোড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছিল তা ভীষণ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। চোখের জ্বালার চোটে, নিঃশ্বাসের কষ্টের জেরে রাজ্যের সব মানুষ ততক্ষণে ঘরে ফিরে গেছে যে যার মত।

এদিকে ঘরে যেতেই ছুতোরের ব‌উ বলল, কী গো এত নোংরা মেখে এসেছ, এবার স্নান করে কাচা জামাকাপড় পরে নাও।
তারা বেশ নিশ্চিন্ত তখন।

এভাবে সেই অন্ধকার ঘরে তিনমাস ধরে থাকতে থাকতে ছুতোর ধবধবে ফর্সা হয়ে গেল। তিনমাস পরে সে একদিন নিজের সবচেয়ে দামী, চকমকে পোষাক, গয়না সব পরে রাজার দরবারে এল। রাজবড়ির ছুতোর বলে কথা। তারও কিছু দামী পোষাক, গয়না বানানো ছিল। সে কী আর ঐ দুষ্টু চিত্রশিল্পীর মত? টাকাপয়সা জমানোয় যার কোনও নজরই ছিল না। শুধু কুমতলব ফাঁদতে তার জুড়ি মেলা ভার।

সুবেশী ছুতোর হাতে করে রাজার জন্য একটি চিঠি নিয়ে রাজ দরবারে প্রবেশ করল।     
    
রাজা বললেন, "বাহ! এই তো তুমি ফিরে এসেছ বেশ! এবার পড় দেখি বাবা কী লিখে পাঠিয়েছেন তোমার হাতে।"
 
ছুতোর পড়তে লাগল,
"স্নেহের গেনচগ,
তোমাকে সকলে সুশাসক বলে জানে। তুমি ভালই দেশ পালন করছ। তুমি আমার কথামত যে ছুতোরটি কে মন্দির বানানোর জন্য পাঠিয়েছিলে সে তার কাজ সুষ্ঠু ভাবে শেষ করেছে। অপূর্ব সুন্দর মন্দির নির্মাণ করেছে সে আমার জন্য । এবার তুমি দেখ, সে পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে ঠিক এর জন্য তার পুরষ্কার পাবে। এবার আরেকটি কাজ বাকী আছে। মন্দিরের গায়ে চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলার জন্যে তোমার রাজ্যের দক্ষ চিত্রশিল্পীকে আমার কাছে পাঠাতে হাবে বাবা। নয়ত এ মন্দিরের কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ঠিক যেমনি ভাবে তুমি ছুতোরকে এখানে পাঠিয়েছিলে। ঠিক তেমন করেই চিত্রশিল্পী কে পাঠিয়ে দিও কিন্তু।
ইতি তোমার বাবা"

চিঠি পড়ে ফেলেই ছুতোর  বলল, "রাজামশাই, কী অপূর্ব জায়গায় থাকেন আপনার বাবা আর কী বিশাল বড়লোক উনি। আপনি আর কী। ওঁর ধন দৌলত, প্রভাব প্রতিপত্তি চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। ওঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমি পূর্ণ করেছি বলে আমাকে উনি কত কিছু উপহার দিয়েছেন।"  এই কথা বলে নিজের গলার মহামূল্য প্রবালের হার, কোমরের রংবেরঙের মীনাকারির কোমরবন্ধ সব দেখাল।

এদিকে ছুতোরের গায়ের চামড়ার অভাবনীয় রঙ  দেখে চিত্রশিল্পীর বেশ সন্দেহ হল। সে ভাবল, আগুনে পুড়ে গিয়ে কারো এমন হয় না কি? সে নিশ্চয়ই স্বর্গ অবধি যেতে পারেনি। অর্ধেক রাস্তা গিয়ে সে ফিরে এসেছে। তবে ছুতোরের গলায় প্রবালের মালা, কোমরের গয়না আর তার রাজকীয় পোশাক দেখে মনে হল, এসব ছুতোর আর কোথায় পাবে? নিশ্চয়ই গেছিল রাজা জেন্ডং এর কাছে। একবার চেষ্টা করলেই হয়। ও ব্যাটা কী সব পোশাক পরে আছে আর আমি সাদামাটা পোশাক পরেই কাটিয়ে দিলাম সারা জীবন।

রাজা গেনচগ তাকেও সাতটা দিন সময় দিলেন। । আগের বারের মত কাঠ, তেল সব একত্রে জড়ো করল রাজার লোকজনেরা।

যখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল। কাঠের পাটাতনে অগ্নিসংযোগের ঠিক পূর্বমূহুর্তে ছুতোর বলল, "এবার আমাদের একটু গান শোনা যাক।  আমাদের রাজ্যের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী স্বর্গের দিকে যাত্রা করবেন।"  এই বলে সকলে মিলে ড্রাম, হর্ণ, ট্রাম্পেট, ট্যাম্বুরিন নিয়ে গান শুরু করে দিল।

অগ্নিসংযোগ করতেই সেই দুষ্ট অতি চালাক চিত্রকর নিমেষের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এত নাচাগানার মধ্যে কেউ শুনতেও পেলনা তার চিৎকার। আর আগুনের কালো ধোঁয়ায় চারিদিক অন্ধকার তখন। কেউ কিচ্ছু দেখতেও পেলনা। চোখের জ্বালা নিয়ে ততক্ষণে সকলেই নিজের নিজের ঘরের দিকে প্রস্থান করেছে।

প্রকৃত পক্ষে সেদিন সত্যি সত্যি সেই দুষ্ট চিত্রকরের ভয়ানক স্বর্গবাস হল বটে! তবে সে মৃত্যু তাকে চিরদিনের মত শাস্তি দিল। পুড়তে পুড়তে কেবলই তার মনে হতে লাগল কেন সে বেশী লোভ করতে গেল। তাই বুঝি আজ এমন বেঘোরে শাস্তি পেয়ে মরতে হল তাকে। এর নামই বুঝি দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন।

ঈশ্বরের কাছে সে প্রার্থনা করল, পরের জন্মে আর সে কার ক্ষতি করবে না।

ছবিঃ ঈশিতা ছেত্রী

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা