সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
 চড়াই রানীর গল্প

সে বহুকাল আগের কথা, জাপানের এক পাহাড়ের কোলে একটা ছিম্‌ছাম্‌ শান্ত গ্রামে এক বুড়ো তার বুড়িকে সঙ্গে নিয়ে থাকতে এসেছিল। বুড়ো ছিল খুবই সরল, সোজা আর শান্ত স্বভাবের। কিন্তু বুড়ি ছিল খুবই ঈর্ষাকাতর স্বভাবের, সুযোগ পেলেই সকলের সঙ্গে ঝগড়া করে বেড়াত। তাই বুড়ো গ্রাম থেকে একটু উঁচুতে পাহাড়ের কোলে নিরিবিলি জায়গা দেখে ঘর বানিয়েছিল। তাতে গ্রামের সকলের সঙ্গেও থাকা হল,কিন্তু খুব একটা গা মাখামাখিও হল না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হত, তারা সেখানে বেশ সুখে-শান্তিতেই দিন কাটায়। কিন্তু আসলে যা হত, তা হল, বুড়ি কেবলই ঝগড়া করার ছুতো খুঁজে ফেরে। তাই যে কোন তুচ্ছ কারণেই সে বুড়োর সঙ্গে অতি কুৎসিতভাবে ঝগড়া করত। কি করে অন্যের ক্ষতি করা যায়, সেটাই ছিল তার সর্বক্ষণের চিন্তা। কিন্তু গ্রাম থেকে একটু দূরে থাকার দরুণ সে তো অন্য কাউকেই পেত না, তাই তার সবটুকু প্রচণ্ডতা বুড়োকেই সহ্য করতে হত। একদিন দুপুরের খাওয়া শেষ হলে বুড়ো তার বাড়ির সামনে একটা বড় গাছের তলায় বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ সে দেখল, একটা বিশাল বাজপাখি একটা ছোট্ট চড়াইকে তাড়া করেছে। চড়াইটা প্রাণপনে উড়ছে, কিন্তু সে অতবড় বাজপাখির সঙ্গে পেরে উঠবে কি করে? বাজটা প্রায় ধরে ধরে, এমন অবস্থায় চড়াইটা ঝুপ করে বুড়োর কোলে এসে পড়ল। ভয়ে ক্লান্তিতে বেচারা থর্‌থর্‌ করে কাঁপছিল। অবস্থা দেখে বুড়ো বাজপাখিটাকে তাড়িয়ে দিয়ে চড়াইটাকে হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে আসল। সেদিন থেকে ছোটো পাখিটাকে সে নিজের পুষ্যি করে নিল। কদিনের মধ্যেই সে পাখিটাকে এত ভালবেসে ফেলল যে প্রায়ই সে তাকে হাতে বসিয়ে ঘুরতে বেরোত; তার পালকের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে তাকে চুমু খেত। আর এইসব দেখে বুড়ি মনে মনে হিংসায় জ্বলে যেত।

একদিন বুড়োকে একটা জরুরী কাজে বাড়ির বাইরে যেতে হল। দূরের জায়গায় গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ কাটাতে হবে। তাই সাত-পাঁচ ভেবে সে চড়াইএর খাঁচার দরজাটা খুলে রেখে গেল। দরজা খোলা পেয়ে চড়াই বাবাজি তো মহা খুশি। সে খোলা দরজা দিয়ে একপা দুপা করে বেরিয়ে এল, ফুর্‌ফুর্‌ করে চারপাশে উড়ে বেড়ালো। কিন্তু সেই সঙ্গে ঘরটাকে বেজায় নোংরা-ও করে দিল। তোমরা তো জানোই, বুড়িটা চড়াইটাকে একেবারেই পছন্দ করত না। তাই ঘরের এই অবস্থা দে-খে- সেতো রেগে অগ্নিশর্মা। কাছে একটা ঝাঁটা ছিল, সেইটা তুলে সে চড়াইটার গায়ে ধাঁই করে ছুড়ে মারল। পাখিটা ফুরুৎ করে সরে গেল আর ঝাঁটাটা গিয়ে পড়ল একটা ফুলদানির উপর। ফল কি হল বলতো?

ফুলদানিটা যেই ভেঙে চৌচির হয়ে গেল, বুড়ি গেল আরও খেপে। ঝাঁটাটাকে আবারও তুলে নিয়ে সে আরো জোরে পাখিটার দিকে ছুঁড়ে দিল। এবার কিন্তু সে আর ফস্কাল না। যদিও চড়াইটা মারা গেল না, তার একটা পা ঝাঁটার ঘায়ে ভেঙে গেল। আহত হয়েও কোনরকমে সে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসে জঙ্গলের দিকে উড়ে পালাল।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যখন বুড়ো ফিরল, তখন বুড়ির চিৎকার আবার শুরু হল। কেন যে এইরকম নোংরা পাখিকে বুড়ো পুষেছে, সেজন্য তাকে এই মারে তো সেই মারে। সেটাকে তাড়াতে গিয়ে ঝাঁটার ঘায়ে বুড়ির সাধের ফুলদানি ভেঙেছে, সেজন্য গলা ফাটিয়ে কেঁদে নিল খানিকটা। তারপর একটু শান্ত হয়ে জানাল, যদিও চড়াইটাকে সে প্রাণে মারতে পারেনি, কিন্তু দিয়েছে একটা পা ভেঙে।

বুড়োর তো মাথায় হাত। এইটুকু সময়ের মধ্যেই এত তুলকালাম কান্ড! তার আর মুখ হাত ধোয়া হল না। সে দৌড়াল বনের দিকে পাখিটার খোঁজে। জঙ্গলের গভীরে গিয়ে সে চড়াইটাকে খুঁজতে লাগল। বারবার নাম ধরে আর শিষ্‌ দিয়ে ডাকতে লাগল তাকে। কিন্তু হায়!তার সব চেষ্টাই বিফলে গেল। পাখিটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।

এরপর থেকে বুড়ো রোজ বনে গিয়ে চড়াইটাকে খুঁজত, আর রোজই হতাশ হয়ে ফিরে আসত। মাসের পর মাস কেটে গেল এভাবেই। কিছুই হল না, কিন্তু এটা তার নিত্যকার নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। এরকমই সেদিন সে বনের একটু বেশি গভীরে ঢুকেছিল। ফেরার সময় অন্যমনস্কভাবে একটা বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে হঠাৎ দেখল, কে যেন সেখানে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর বানিয়েছে। চারপাশে কি সুন্দর সবুজ বাগানও আছে। দেখে বুড়োর চোখ জুড়িয়ে গেল। এত গভীর বনে বাড়ি! একটু কৌতূহলও হল জানার জন্য। সে একপা দুপা করে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। একটা সুন্দরী মেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল আর কি অবাক কান্ড! মেয়েটা আনন্দে চেঁচিয়ে ডেকে বলল, " আরে, প্রিয় বন্ধু, এস এস, কতদি--ন তোমার সাথে দেখা হয়নি। তুমি আমায় চিনতে পারছ না? আমি তোমার সেই প্রিয় চড়াইপাখি। মনে নেই, তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে, আর কত যত্ন করে থাকতে দিয়েছিলে? তখন কিন্তু তুমি জানতে না যে আমি চড়াইদের রানী। " মেয়েটি মুচ্‌কে হাসল।

 চড়াই রানীর গল্প

আনন্দে বুড়োর চোখে জল এসে গেল। মেয়েটি তার হাত ধরে ঘরে নিয়ে বসাল, কত যত্ন আদর করল। খুব সুন্দর সুন্দর পাত্রে তার জন্য সেবকরা অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার নিয়ে আসল। খেতে আর গল্প করতে করতে কখন যে রাত ভোর হয়ে গেল, কেউই টের পেল না। সকালের আলো ফুটতে বুড়ো পরিতৃপ্ত মনে উঠে দাঁড়াল। এবার যে বাড়ি ফিরতে হবে। মেয়েটি বলল, " তুমি আমায় যে এত যত্ন করেছিলে, তার দাম দেবার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আমিও তোমায় কিছু উপহার দিতে চাই। " তার ডাকে সেবকরা দুটো ঝকমকে বাক্স নিয়ে এল।মেয়েটি তাকে যে কোন একটা বাক্স নিতে অনুরোধ করল। বুড়োর মনে কোন লোভ ছিল না। সে লজ্জিত হয়ে বন্ধুকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট বাক্সটাই তুলে নিল।

বাড়ি যত কাছে আসছে, বুড়োর পা যেন আর চলছে না। সত্যি বলতে কি, ভয়ে তার বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। ঘরে ঢুকলেই তো বুড়ির চিৎকার আর মারধোর শুরু হবে। গত রাতে সে কোথায় ছিল, কেন ছিল প্রভৃতি অসংখ্য প্রশ্নবানে জর্জরিত হবে। কোন উত্তরই বুড়িকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। বাড়ি ঢোকা মাত্র ঠিক এই ঘটনাগুলিই শুরু হয়ে গেল।

বুড়ো জানত, এই সময় কোন শব্দ করলেই চিৎকার আরও সপ্তমে উঠবে। তাই সে চুপ করে চেয়ারে বসে তার পাইপটা ধরিয়ে ধূমপান করতে লাগল। একটু পরেই বুড়ির নজরে এল সেই ছোট্ট বাক্সটা। ধাঁ করে বাক্সটা বুড়োর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে খুলে ফেলল সেটা। আরে বাপ্‌রে! ভিতরে রয়েছে অনেকগুলি খুব দামী উজ্জ্বল হীরা, মণি মুক্তো প্রভৃতি রত্ন; তার ছটায় বুড়ির চিৎকার একদম বন্ধ। এরকম দামী পাথর তো সে কস্মিনকালেও দেখেনি। ঝাঁপিয়ে পড়ে বুড়োর কাছ থেকে সব খবর জোগাড় করে ফেলল। জানল যে সেখানে আরো বড় একটা বাক্স ছিল। কিন্তু বুড়ো ছোটটাই এনেছে।

 চড়াই রানীর গল্প

বুড়ি তো ভীষণ লোভী। এসব শুনে তার গা পিত্তি জ্বলে গেল। এমন বোকামিও কেউ করে? ছোট বাক্সেই যদি এত জহরৎ, তবে বড়টাতে না জানি কত বেশি ধন ছিল। তার স্বভাবমতই সে বুড়োকে এর জন্য গালাগালি দিল। কিন্তু এর মধ্যেই সে একটা মতলব ঠিক করে ফেলেছে। ভোরের আলো ফুট্‌তেই সে কাউকে কিছু না বলে গৃহত্যাগ করে বনের দিকে রওনা হল। খুঁজে খুঁজে হাজির হল সেই বাড়ির সামনে। সকালের নরম আলোয় সুন্দরী মেয়েটি তখন বাড়ির সামনের সবুজ বাগানে দোলনায় দুলছিল আর মিষ্টি সুরে গান করছিল। বাগানের দরজা খুলে বুড়িকে ঢুকতে দেখে বেশ হতচকিত হয়ে গেল। বুড়ি যে তার সঙ্গে কি ব্যবহার করেছিল, তাতো সে ভুলে যায় নি।

বুড়ি কোন অনুমতি না নিয়েই সটান ভিতরে এসে মেয়েটিকে বলল, " কিগো মেয়ে, আমায় চিনতে পারছো না? কত আদরে যত্নে তোমায় সুস্থ করে তুললাম, ভুলে গেলে? " মেয়েটি মনে মনে যাই ভাবুক না কেন, সামনে মিষ্টি হেসে বুড়িকে ঘরে নিয়ে এল। আপ্যায়ন করে নানা রকম সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করল। সে ভাবছিল, খেয়ে দেয়ে বুড়ি বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু কোথায়? বুড়ি তো নড়বার নামই করেনা। আসলে সে ভাবছিল সেও বুড়োর মত একটা উপহার পাবে। কিন্তু মেয়েটির দিক থেকে সেরকম কোন উদ্যোগ না দেখে সে বলেই ফেলল, " তুমি আমায় কোন উপহার দেবে না? "

আগের মতই সেবকেরা দুটো ঝক্‌মকে বাক্স নিয়ে আসল। কেউ কিছু বলার আগেই বুড়ি ঝাঁপিয়ে পড়ে বড় বাক্সটা তুলে নিয়ে হন্‌হন করে বেরিয়ে গেল। পিছনে মেয়েটি একটু মুচ্‌কে হাসল।

এতবড় বাক্সটা নিয়ে বুড়ির বাড়ি ফেরার পথ যেন আর ফুরা--য় না। ভিতরে কি আছে জানবার জন্য বুড়ির এত কৌতূহল হচ্ছিল যে, বাক্সটাতে যদি তালা না আটকানো থাকত, তবে সে তখনই সেটা খুলে ফেলত। কিন্তু এখন কি আর করা। কোন রকমে বাড়ি এসে বুড়ি ঝড়ের বেগে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। এত দামী জিনিষ পাবার আনন্দ সে একাই উপভোগ করতে চায়। এতগুলি দামী পাথর সে যে কিভাবে ব্যবহার করবে, তা ভেবে তার উত্তেজনা বেড়েই যাচ্ছিল।

চরম মানসিক অবস্থায় সে উজ্জ্বল পাথর দেখার আশায় বাক্সটা খুলে ফেলল। কিন্তু একী! পাথর কোথায়? বুড়ি দেখল, বাক্সে একগাদা বিষাক্ত বড় বড় সাপ কিল্‌বিল্‌ করছে। যেই না বাক্সের ঢাকনাটা খোলা পেয়েছে, অমনি সেই সাপগুলি ফোঁস্‌ ফোঁস্‌ করে বেরিয়ে পড়ল। তাই দেখে বুড়ি এত ভয় পেয়েছে যে তার চিৎকার করার ক্ষমতা নেই। সাপগুলি ঘরময় ঘুরতে লাগল, আর রাগের চোটে বুড়িকে এত ছোবল মারল যে বিষের চোটে সে সেখানেই ছট্‌ফট্‌ করতে করতে অক্কা পেল।

অনেকক্ষণ বুড়ির কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বুড়ো, কি ব্যাপার, বলে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে চম্‌কে উঠল। ওরে বাবা! একগাদা সাপ ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বুড়ি চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি প্রতিবেশীদের ডাক দিল। তারপর সকলে মিলে সাপগুলি মেরে বুড়িকে সৎকার করে আসল। তোমরা তো জানই, খারাপ ব্যবহারের জন্য বুড়িকে কেউ দেখতে পারত না। এমনকি বুড়োও না। তাই সে মরে যাওয়াতে কারো মনেই দুঃখ হল না। কিন্তু বুড়ো তো একা হয়ে গেল। সে কি করল জান? বাড়িঘর সব বন্ধ করে সে তার আদরের চড়াই রানীর কাছে চলে গেল, আর ফিরে এল না।


জাপানের লোককথা (পুনর্কথিত)


ছবিঃ দীপায়ন সরকার

শুক্তি দত্ত ভালবেসে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। রূপকথা, প্রাচীন সাহিত্য, দেশবিদেশের লোকসাহিত্য, গল্পকথা পড়তে ভালবাসেন। সেগুলো নিয়ে আলোচনা বা শিশুদের সেই গল্প শোনাতেও ভালবাসেন। প্রধানতঃ শিশুমনস্তত্ত্ব ও তাদের শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। সেটা শুধু পড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি শিশু সাহিত্য, লোকসাহিত্য প্রভৃতিকে তাদের মূল্যবোধ বিকাশে কাজে লাগাতে চান।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা