সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
কি করে রামধনু তৈরি হল

সে অনেক , অ-নে-ক কাল আগের কথা ! সেই সময়ে, একদিন হয়েছে কি, পৃথিবীর যত্ত সব রঙ আছে, তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিল। প্রত্যেকেই বলতে লাগল - আমি হচ্ছি অন্যদের সবার থেকে বেশি ভাল, সবার সেরা, সবথেকে দরকারি, সব্বার পছন্দের... ঠিক একপাল হিংসুটে, ঝগড়ুটে ছেলেমেয়েদের মত।

কি করে রামধনু তৈরি হল

সবুজ রঙ গাল ফুলিয়ে বলল, " এ আর বলার কি আছে, যে আমিই হচ্ছি সব্বার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি হলাম জীবনের প্রতীক, আশার প্রতীক। ঘাস, গাছের পাতা, ফল- সব্জী - সব কিছুর জন্য আমাকেই বাছা হয়েছে - আমাকে ছাড়া সব প্রাণীরা তো মরেই যাবে...একবার খোলা প্রান্তরে- দূর -দূরান্তে, নদীর পাড়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখ্‌ দেখি - দেখবি চারিদিক সব সবুজ আর সবুজ..."

কি করে রামধনু তৈরি হল

এই অবধি বলতে না বলতেই আকাশী রঙ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, " ভারি তো মাঠ-ঘাট ! বলি আকাশ আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? জলই জীবন, সেটা জানিস না? আর নীল সমুদ্র থেকে মেঘেরা জল টেনে নেয় আর বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। আকাশকে দেখেছিস? আকাশের বিস্তৃতি দেখলেই মনে শান্তি আসবে, স্থিতি আসবে। আর মনে শান্তি না থাকলে তো তোরা সবসময়ে নানা অশান্তিতে ভুগতিস। তাই আমিই হলাম গিয়ে সবার চেয়ে সেরা।"

কি করে রামধনু তৈরি হল

এই না শুনে, হলুদ মুচকি হেসে বলল- " বাবা! তোরা কত কঠিণ সব কথা বলছিস রে ! আমি বাপু তোদের মত নই। আমি এই দুনিয়ায় নিয়ে আসি হাসি, আনন্দ আর উষ্ণতা। দেখ একবার - সূর্যের রঙ হলুদ, পূর্ণিমার চাঁদের রঙ হলুদ, দূর আকাশের তারাগুলোও হলুদই। কখনো একটা হলুদ সূর্যমুখীর দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? দেখলে এমনিতেই মন ভাল হয়ে যাবে, মুখে হাসি ফুটবে। আমি না থাকলে কোন আনন্দই থাকবে না।"

কি করে রামধনু তৈরি হল

কমলা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। কিন্তু এবারে সে শুরু করল - "আমি কিসের রঙ জানিস? আমি হলাম স্বাস্থ্য আর শক্তির রঙ। আমাকে খুব বেশি দেখতে পাবি না এদিক ওদিক, তোদের মত আমি সর্বত্র ছড়িয়ে নেই, কিন্তু আমি মানুষের শরীরকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষগুলিতে আছি। ভেবে দেখ একবার- কমলালেবু, আম, পেঁপে, কুমড়ো, গাজর- এইসব ভাল ভাল ফল আর সব্জীর কথা। আরো একটা কথা- আমি তোদের মত সবসময়ে মানুষের চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করি না, কিন্তু সূর্য যখন ভোরবেলা ওঠে, আর শেষ বিকেলে অস্ত যায়, তখন যে আমি আকাশ ছেয়ে থাকি...আকাশের সেই রূপ দেখে কিন্তু তোদের কথা কেউ মনেও আনে না রে !"

কি করে রামধনু তৈরি হল

এসব কথা শুনে লাল আর সহ্য করতে পারল না। এইবারে সে চেঁচিয়ে বলল - " আমি হলাম তোদের সবার থেকে ওপরে, তোদের রাজা, বুঝলি ? আমি হলাম রক্তের রঙ - আর রক্তই তো পশু-পাখি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য সবথেকে জরুরী। আরো জানিস - আমি হলাম বিপদের রঙ, আবার সাহসেরও রঙ। আমি কোন একটা বড় কারণের জন্য লড়াই পর্যন্ত করতে পারি। আমি না থাকলে এই পৃথিবীটা তো চাঁদের মত ফ্যাকাশে আর ফাঁকাই রয়ে যেত। তাই বলে যেন ভাবিস না, আমি সবসময়ে বিপদে ফেঁসে থাকি, বা যুদ্ধ করে বেড়াই - আমি কিন্তু ভালবাসারও রঙ। আর আমি সুন্দর সুন্দর সব ফুলের ও রঙ - গোলাপ, জবা, বৈজয়ন্ত, পলাশ...কত আর বলব ! তাই আমিই সবার সেরা, আমাকেই সব্বাই সবথেকে বেশি পছন্দ করে, বুঝলি??"

কি করে রামধনু তৈরি হল

বেগুনী এতক্ষণে উঠে দাঁড়াল। সে এমনিতেই সবার থেকে লম্বা, তারপরে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে বলে আরো লম্বা লাগছে ! সে বেশ গম্ভীরভাবে গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করল - " আমি হলাম ক্ষমতার রঙ, রাজরং। আমাকে কারা ব্যবহার করে দেখেছিস ভেবে ? রাজা-রানীরা, গোষ্ঠীপ্রধাণেরা, গীর্জার বিশপেরা আমাকেই ব্যবহার করেছে তাদের ক্ষমতা আর বুদ্ধি বোঝাতে। আমাকে কোনরকম প্রশ্ন করার সাহস কারোর নেই, বুঝলি ? - সবাই আমার কথা শুধু শোনে আর মান্য করে। তোদের সাথে এইসব ঝগড়াকরার আমার কোন প্রয়োজনই নেই..."

কি করে রামধনু তৈরি হল

সবার কথা শোনার পরে মুখ খুলল নীল। সে অন্যসবার থেকে আস্তে, ধীরে ধীরে কথা বলে। কিন্তু যেটুকু বলে, খুব দৃঢতার সাথে বলে। নীল বলল- " আমার কথা একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ, নিজেদের তখন তুচ্ছ মনে হবে। আমি হলাম চিন্তা আর দর্শনের প্রতীক, ঊষা আর গোধূলি, গভীর জল আর মধ্য রাত আমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। প্রার্থনা আর শান্তির জন্য আমাকে দরকার। তোরা কি আর আমার সাথে পাল্লা দিতে পারবি রে ? "

এইভাবে কথার পিঠে কথা চলতেই থাকল। আর কেউই যখন অন্যদের কথা মেনে নিতে রাজি নয়, তখন কি আর ঝগড়া থামে? সবাই নিজেরা নিজেদের জাহির করে চলেছে, আর প্রত্যেকেরই ধারণা সে-ই হল সেরা। এইভাবে জোরে জোরে চিৎকার চেঁচামেচির চোটে তো কান পাতায় দায় হয়ে উঠল। এমন সময়, হঠাৎ সব্বাইকে চমকে দিয়ে দিক-দিগন্ত জুড়ে এক সাদা বিদ্যুৎ ঝল্‌কে উঠল; বজ্রের গর্জনে দিক-বিদিক কেঁপে উঠল, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল...সৃষ্টি বুঝি রসাতলে গেল ! ঝড় -বৃষ্টি- বিদ্যুতের ভয়ে যারা এতক্ষণ ধরে ঝগড়া করে যাচ্ছিল, তারা সবাই চুপ করে গিয়ে একসাথে গুটিশুটি হয়ে আশ্রয় নিল গাছের ছায়ায়, পাহাড়ের গুহায়। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ভাগ করে নিতে চাইল উষ্ণতা আর সাহস, কাটাতে চাইল ভয় আর অনিশ্চয়তা।

কি করে রামধনু তৈরি হল

তখন বৃষ্টি গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলঃ

"ওরে বোকা রঙ-এর দল, নিজেদের মধ্যে লড়ালড়ি করছিস, একে অপরকে শাসন করতে চাইছিস ! তোরা কি জানিস না, ঈশ্বর তোদের সব্বাইকে সৃষ্টি করেছেন ? তাঁর কাছে তোরা প্রত্যেকে সমান, প্রত্যেকের একটা বিশেষ প্রয়োজন আছে, প্রত্যেকে একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র আর আলাদা। ঈশ্বর তোদের সব্বাইকে ভালবাসেন। তিনি তোদের সব্বাইকে চান, সমানভাবে। আয় তোরা আমার সাথে, হাতে হাত ধরে আয়। ঈশ্বর তোদের সব্বাইকে এক সাথে, পাশাপাশি রেখে আকাশজুড়ে এক বিশাল রঙধনু তৈরি করবেন, কেন জানিস? কারন, তিনি তোদের সব্বাইকে বার বার মনে করিয়ে দিতে চান , যে তিনি তোদের সব্বাইকে সমান ভালবাসেন, আর যাতে তোরা সবাই এক সাথে শান্তিতে থাকতে পারিস।

দিচ্ছেন তিনি কথা, দিচ্ছেন ভরসা-
সব্বার প্রতি থাকবে, সমান ভালবাসা।
সাতরঙা পথ বেয়ে-
হাসি-কান্নায় নেয়ে-
সুন্দরতর দিনের স্বপ্ন জাগায় মনে আশা।।"

কি করে রামধনু তৈরি হল

আর তাই, যখনই ঈশ্বর ধুলো-ধোঁয়ায় ভরা শুষ্ক তৃষ্ণার্ত পৃথিবীকে ভাল করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার জন্য ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঢালেন, তার পরে পরেই তিনি আকাশে একখানা রামধনু বসিয়ে দেন। আর আমরা যখন সেটাকে দেখি, আমাদের আবার করে মনে পড়ে, যে আমরা সবাই সমান - এই পৃথিবীর আমাদের সব্বাইকে সমানভাবে প্রয়োজন ।


( উত্তর আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের লোককথা )


ছবিঃ চান্দ্রেয়ী সেন

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা