সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
চার ঐক্যবদ্ধ বন্ধু

সে অনেকদিন আগের কথা। বারানসীর এক জঙ্গলে একদিন দেখা গেল এক হাতি, এক বাঁদর, এক খরগোশ আর এক তিতিরপাখির মধ্যে খুব তর্ক -বিতর্ক লেগেছে। তারা একটা গাছের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সারা জঙ্গলে সেরকম গাছ আর দুটি নেই। রসালো, সুস্বাদু, পাকা ফলের ভারে সেই গাছের ডালগুলো সব নুয়ে পড়ছে। ঘন সবুজ পাতায় তার ডাল-পালা গুলি ভরা। তার ফলের আর ফুলের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে দশদিকে। হাতি বাঁদর, খরগোশ আর তিতির, সবাই-ই নিজের সুবিধামত সেই গাছের ফল এবং পাতা খায়, সেই গাছের সুশীতল ছায়ায় বিশ্বাম নেয়, তার ফুল -ফলের সুগন্ধ বুক ভরে টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সেদিন নিজেদের মধ্যে গাছের দখলদারি নিয়ে লেগেছে বিবাদ। গাছটা আসলে কার মালিকানায় পড়ে, সেই নিয়ে লেগে গেছে ঘোর তর্ক।

চার ঐক্যবদ্ধ বন্ধু

হাতি গম্ভীর গলায় বলছে -"আমি এই গাছটাকে সবার আগে অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছি, তাই এই গাছটা আমার।"

চার ঐক্যবদ্ধ বন্ধু

সেই শুনে খ্যাঁক খ্যাঁক করে খানিক হেসে বাঁদর বলল- "সে তো বুঝলাম, কিন্তু বলছি যে তুমি কি গাছের ডালে কোন ফল দেখতে পাচ্ছ? পাচ্ছ না তো? পাবেই বা কি করে? ওগুলো তো সব আমি খেয়েছি। আর সে আমি খেয়েছি তুমি এই গাছ দেখতে পাওয়ার অনেক আগে থেকে, বুঝলে? তাই এই গাছ অন্য কারোর নয়, এ গাছ আমার।"

চার ঐক্যবদ্ধ বন্ধু

এই কথা শুনে খরগোশ তার মিষ্টি গলায় বলল- " তাহলে তো বলতে হয় এই গাছ তোমাদেরও আগে আমার। এই গাছ যখন ছোট্ট চারা ছিল, তখন আমি এর কচিপাতাগুলিকে খেয়ে পেট ভরাতাম। তখন তো গাছে ফলই ধরেনি। তাছাড়া, মাটির নিচে এই গাছের শিকড়ের আশেপাশের মাটিকে নিয়মিত খুঁড়ে আমি এর শিকড়্ গুলিকে শক্তপোক্ত হতে সাহায্য করেছি। তাই এই গাছের আসল মালিক আমি।"

চার ঐক্যবদ্ধ বন্ধু

তিতির এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিল। এবার এগিয়ে এসে বলে উঠল - " ওহে, এই গাছ তোমাদের কারোরই নয়। এই গাছ হল আমার। কেন বলতো? কারণ আমিই তো প্রথম অন্য জায়গায় ফল খেয়ে এই গাছের বীজ এখানে এসে ফেলেছিলাম। আমি এই গাছের বীজ এখানে না ফেললে, আজকে এটা এখানে এত বড় হয়ে উঠত কি? ওহে খরগোশ, তুমি যবে থেকে এর কচি পাতা খেয়েছ; বাঁদর, তুমি যবে থেকে এর ফল পেড়েছ; হাতি, তুমি যবে থেকে একে দেখতে পেয়েছ- হিসেবমত তার অনেক আগে থেকেই এই গাছের মালিক আমি। "

তিতিরের কথা শুনে হাতি, বাঁদর আর খরগোশ তর্ক থামিয়ে খানিক্ষণ ভাবনা চিন্তা করল। তারপরে তারা মেনে নিল যে তিতিতের কথাই ঠিক। সে যদি গাছের বীজটা এনে এখানে না ফেলত, তাহলে তো গাছটা এই বনে বেড়েই উঠত না। তাই গাছের মালিক যদি কেউ হয়, তাহলে সে হল তিতির। শুধু তাই নয়, তিতিরকে তারা তাদের বড় দাদা মেনে নিয়ে তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে অভিবাদন করল।

হাতি, বাঁদর, খরগোশ আর তিতির - চারজনে খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠল। তারা ঠিক করল, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ না করে তারা সবাই মিলেমিশে ভাগ করে খাবে সেই গাছের ফল, বিশ্রাম নেবে তার ঠাণ্ডা ছায়ায়। তারা একসাথে মিলে খাওয়ার জন্য ফল সংগ্রহ করবে। মাটিতে পড়ে থাকা আর নীচু ডালগুলিতে ঝুলে থাকা ফলগুলি যোগাড় করল খরগোশ আর তিতির। বাঁদর গাছের ডালে ঝুলে থাকা ফলগুলিকে পেড়ে সবার জন্য ছিঁড়ে নিচে ফেলতে থাকল। কিন্তু গাছের একদম উঁচু ডাল গুলি থেক ফল পেড়ে আনতে প্রয়োজন পড়ল হাতির। কিভাবে ? বলছি শোন।

বনের অন্য পশুরা অবাক হয়ে দেখল, হাতির পিঠে চেপে বসেছে বাঁদর, বাঁদরের পিঠে খরগোশ, আর খরগোশের পিঠে তিতির। আর এইভাবে তারা গাছের সবথেকে উঁচু ডাল গুলির কাছে পৌঁছে গেল আর সেখান থেকে ফলগুলিকেও সহজে পেড়ে নিয়ে আসতে পারছে। আর তারপরে সবাই মিলে দিব্যি ভাগ করে খাচ্ছে। এইভাবে চারজন একে অপরের ক্ষমতা এবং শক্তি সাহায্য নিয়ে নিজেদের জন্য যথেষ্ট খাবার সংগ্রহ করতে পারছে, আর কেউই খালি পেটে থাকছে না। এরপর থেকে চারজনকে মাঝেমধ্যেই এইভাবে দেখা যেতে লাগল। তাই দেখে জঙ্গলের অন্যান্য পশুপাখীরা এদের নাম দিল- 'চার ঐক্যবদ্ধ বন্ধু'।

চার বন্ধু হয়ে উঠল শান্তি, একতা, সহযোগিতা, পারস্পরিক সদ্ভাব এবং বন্ধুত্বের প্রতীক।

গল্পটি আসলে একটি বৌদ্ধ উপকথা, আর এর উৎস দেখা যায় জাতকের গল্পমালায়। এই গল্পটির মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি প্রতীকী স্তর।

কারো মতে, হাতি, বাঁদর, খরগোশ আর তিতির হল এই দুনিয়ার চারটি বসবাসযোগ্য এলাকার প্রতীক - যথাক্রমে মাটি, বায়ু, পাতাল বা মাটির নীচের অংশ এবং আকাশ । আরেকটি প্রতীকী মতে, হাতি হল আমাদের শরীরের প্রতীক, বাঁদর হল আমাদের সদাচঞ্চল মনের প্রতীক, খরগোশ হল আমাদের অনুভূতি বা চেতনার প্রতীক আর তিতির হল আমাদের আত্মার প্রতীক।

অন্য আরেক মনে হাতি হল শক্তির প্রতীক, বাঁদর বুদ্ধির প্রতীক, খরগোশ গতির প্রতীক আর তিতির হল দূরদর্শিতার বা কল্পনার প্রতীক।

এই গল্পটি ভুটানের মানুষদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা গল্প। সে দেশে নানা ধরণের শিল্পকর্মে- ছবিতে, স্থাপত্যে, সূচীশিল্পে, অন্যান্য হস্তশিল্পে বার বার করে ফুটে উঠেছে এই গল্পটি। তবে শুধুমাত্র ভুটানে নয়, এই গল্পটি তীব্বতীদের মধ্যেও সমান ভাবে জনপ্রিয়।

আমার তো মনে হচ্ছে এই গল্পটির জনপ্রিয়তা শুধু ভুটান বা তীব্বতেই কেন সীমাবদ্ধ থাকবে? এরকম সুন্দর একটা গল্প তো সারা পৃথিবীর সর্বত্র সমান ভাবে জনপ্রিয় হওয়া দরকার। এই গল্পটা আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয়, চেহারা, শক্তি বা সংস্কৃতির তফাৎ যতই থাক না কেন, হাতি , বাঁদর, খরগোশ আর তিতিরের মত মানুষেরাও ধর্ম-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে একে অপরের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে, শান্তিপূর্ণ ভাবে , একে অপরকে সহযোগিতা করে , একে অপরকে সমান অধিকার দিয়ে, এই পৃথিবীতে খুব সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে।


ছবিঃ পারিজাত ভট্টাচার্য

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা