দুই.
ঘরে আর মাত্র তিন-চার দিনের খাবার আছে। শস্যদানা, ছোটো পোকা, ঘাস আর ছোটো উদ্ভিদের পাতা। কিন্তু বাবুইয়ের ছানার চাই ফুলের মধু আর রেণু। কবে একদিন তারা খেয়েছিল একটুখানি, তারপর থেকে ওগুলোই মুখে লেগে আছে। সুযোগ পেলে বায়না ধরে, আর না পেলে গো ধরে বসে থাকে।
কিন্তু এখন মধু আর রেণু আনা কি চাট্টিখানি কথা? বাইরে পোড়া রোদ্দুরের সঙ্গে বিশ্রী গরম। একটুখানি বাতাসও নেই। তালগাছটার পাখাগুলো একটুখানি মৃদু দোল খেলেও বেশ আরাম লাগে বাবুইদের। আজ সবকিছু কাটা গাছের মতো স্থির। প্রকৃতির রস শুকিয়ে গিয়ে কেমন যেন গোরস্থান হয়ে গেছে। যেন কী এক বিশাল শোকের ঘটনা ঘটেছে, সবাই নিশ্চলভাবে নড়াচড়া বন্ধ করে শোকপালন করছে।
বাবুইয়ের বাসাখানি শীতে গরম, গরমে শীত। তারপরও বাতাসের দোলা না পেয়ে কেমন হাফ ধরে যায়। এ দিকে ছানাপোনাগুলো গতকাল থেকে ‘ফুলের রেণু খাবো’ বলে বলে বাবুইয়ের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। এই গরমে সে কোথায় পাবে ফুলের রেণু? আজ দুপুরে বাচ্চাগুলো এমন কান্না জুড়ে দিলো যে, একটু রোদ নরম হতেই বাধ্য হয়ে বাবুই বের হয় ঘর থেকে। বাইরে একটু বাতাসও পায়। কিন্তু তা এমন লু হাওয়ার মতো যে বাবুইয়ের শরীরে যেন ফোস্কা পড়ে যেতে চায়। ভয় পেয়ে সে একটি গাছের ছায়ার নীচে একটুখানি জিরিয়ে নেয়। চারদিকে প্রাণশূন্য। শুধু দূরের মহাসড়কে পঙ্গপালের মতো ব্যাঙের ঝাঁক আশ্রয় নিয়েছে। হঠাৎ বাবুই নিজের অজান্তে হেসে উঠলো। মাটিচাপার ভয়ে ব্যাঙগুলো রাস্তায় উঠেছে, অথচ একটু বেসামাল হয়ে বাস-ট্রাকের তলে চাপা পড়ে পটাপট ফেটে যাচ্ছে। ওদের ব্যাঙাই দাদা কি একটু সতর্ক করে দিতে পারতো না?
বিশ্রাম শেষে ফুলের রেণু খুঁজতে আবার উড়াল দেয়। কিন্তু কোথাও কোনো গাছে ফুল দেখতে পায় না সে। ফুলগাছ কি সব হারিয়ে গেছে, কিংবা গাছ থেকে সব ফুল ঝরে পড়ে গেছে? হঠাৎ দূরে কিছু শুকনো ফুলগাছ দেখে দ্রুত সেদিকে এগিয়ে যায় বাবুই। ফুলগাছটির পাশে একটি বাড়ন্ত তালগাছ। বাবুই দেখে সেই ছোটখাট তালগাছে তরুণ বয়সী অচেনা এক বাবুই খুব সুন্দর নলখাগড়া আর হোগলার ডাল দিয়ে বাসা বাঁধছে। এমন গরমে বেশিক্ষণ কাজ করা যায় না। কিন্তু তরুণ বাবুইয়ের হাতে সময় বেশি নেই। কাছে গিয়ে তালের একটি লম্বা পাতার ওপর আরাম করে বসে বাবুই। তারপর গোপন কথা বলার মতো ফিসফিস করে বলে, ‘ভূমিকম্প হবে, জানিস?’
সামনের সপ্তাহে তরুণ বাবুইয়ের বিয়ে। এরইমধ্যে সে নতুন বাসাটির দুটি নিম্নমুখী গর্ত বানিয়েছে। সেই গর্তের একপাশে তার নতুন বৌ ডিম পাড়বে, অন্যপাশে লম্বা করে যাতায়াতের পথ থাকবে। তরুণ বাবুই ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ সরাতে সরাতে হেলাফেলা করে বলে, ‘জানি।’
বাবুই ভেবেছিল ভূমিকম্পের আগাম খবর দিয়ে খুব করে চমকে দেবে তরুণ বাবুইটিকে। উল্টো সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘কী করে জানলি?’
তরুণ বাবুই নতুন বানানো বাসাখানি যত্ন করে পেট দিয়ে ঘঁষে গোলাকার ও মসৃণ করতে থাকে। কাজের ফাঁকে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে সে আগন্তুক বাবুইকে বলে, ‘ভুতুই দাদু বলেছে।’
বাবুই চমকে যায়, ‘ভুতুই দাদু? তাঁকে তুই কোথায় পেলি?’
বাবুইকে তরুণ বাবুই আবার চমকে দিয়ে বলে, ‘তোমার পেছনে তাকিয়ে দেখো।’
বাবুই পেছনে তাকিয়ে ‘হা’ হয়ে যায়। ভুতুই এসেছে! সত্যিকারের ভুতুই! সেই সুদূর আফ্রিকা থেকে এসেছে!
তরুণ বাবুই বলে, ‘ভুতুই দাদু তোমার কথাই জিজ্ঞেস করছিল। এই দেখো ভুতুই দাদু আমাকে কত সুন্দর নলখাগড়া আর হোগলার ডাল দিয়েছে।’
ভুতুই দাদু দেখতে কেমন তা বাবুইয়ের কোনো ধারণাই ছিল না। তাঁর পেটের তলে হলুদ ছোপ আর কেমন চোখ ধাঁধানো স্বচ্ছ ডানা। এমন রূপ দেখে কেমন সম্মোহিত হয়ে যায় বাবুই।