খেলাঘরখেলাঘর

মঙ্গোলিয়া

আজ তোমাকে আমি মঙ্গোলিয়ার লোকেদের বেশভূষা সম্বন্ধে কিছু জানাতে চাই । চেঙ্গিজ খানের সময় থেকে আজ পর্যন্ত মঙ্গোলিয়ার পারম্পরিক বেশভূষায় বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি । তার কারণ হচ্ছে যে এই সব পারম্পরিক পরিধান মঙ্গোলিয়ার আবহাওয়া আর জীবন যাত্রার সঙ্গে মানানসই । অল্প কিছু পরিবর্তন নিশ্চই হযেছে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে আসাতে, কিন্তু তা নগন্য । মঙ্গোলিয়ার রাজধানী আর সবচেয়ে বড় শহর হচ্ছে উলানবাতার । এই শহরের লোকেরা কিন্তু খুব একটা পারম্পরিক বেশভূষা পরেনা । শহরে আজকাল পাশ্চাত্য পরিধান বেশি ব্যবহার হয় । কিন্তু আজো মঙ্গোলিয়ার সুদুর গ্রামাঞ্চলে, লোকে পারম্পরিক বেশভূষা পরাটা পছন্দ করে । বিশেষ করে যারা যাযাবর জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত ।

মঙ্গোলিয়ার পারম্পরিক বেশভূষা

মঙ্গোলিয়ার পরম্পরাগত পোষাক হচ্ছে ডীল বা কাফতান । গ্রামাঞ্চলের লোকেরা প্রায় সবসময়ই এই ডীল পরে থাকে আর শহরাঞ্চলের লোকেরা বিশেষ বিশেষ উত্সবের দিনে এই ধরনের কাপড় পরে । এটি একটি গোল গলার, লম্বা, ঢিলে ধরনের গাউন । বামদিকের কাপড় ডান দিকের কাপড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে পাঁচটি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় । এই ডীলের ওপর অনেক ধরনের অলঙ্করণ করা থাকে । ডীলের হাতা বেশ লম্বা হয় আর হা্তের ওপরের দিকটা ওল্টানো থাকে যা কাপের মতো দেখতে লাগে । শীত কালে এই ওল্টানো অংশটি খুলে দেওয়া হয় যাতে পুরো হাত ঢেকে যায় । ডীলের নীচে এক ধরনের ঢিলে পায়জামা পরা হয় । মেয়েরা ডীলের নীচে এক ধরনের ঘাগরাও পরে । এই ধরনের ঘাগরার ডান আর বাম দিকে কুঁচি করা থাকে ।

আগেকার দিনে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে লম্বা চুল রাখতো আর বিনুনি বাঁধতো । ছেলেরা মাথার সামনের দিকের আর কানের দুপাশের চুল কামিয়ে ফেলতো যাতে শুধু মাথার পেছনের দিকে লম্বা চুল থাকে । অবশ্য এসব আর আজকাল খুব একটা দেখা যায়না ।

মঙ্গোলিয়ায় বসবাসকারী বিভিন্ন জায়গার লোকেরা আলাদা আলাদা ধরনের ডীল পরে । এই সব ডীলের রং, অলঙ্করণ আর ছাঁদ আলাদা আলাদা । পুরাতন কালে সামাজিক স্তর হিসেবেও পরিধান আলাদা আলাদা হত । যেমন ধর যারা পশুপালন করতো তাদের ডীল খুবই সাধারণ ধরনের হত যা তারা শীত বা গ্রীষ্ম দুই ঋতুতেই পরতো । আবার মন্দিরের পূজারীরা হলুদ রঙের ডীল পরতো । জমিদাররা আবার খুব সাজানো ডীল পরতো যার ওপর সিল্কের রঙ্গিন ফতুয়া (খান্তাজ) পরা হত আর মাথায় থাকতো সুন্দর রঙ্গিন টুপি ।

মঙ্গোলিয়ার পারম্পরিক বেশভূষা

এই ডীল এ কিন্তু কোনো পকেট থাকেনা । কোমরের কাছে একটি লম্বা সিল্কের কাপড় বাঁধা থাকে যাতে বিভিন্ন দরকারী জিনিস যেমন নস্যির ডিবে, তামাকের ডিবে, ছুরি ইত্যাদি বেঁধে রাখা থাকে । অনেক লোকে এই সিল্কের কাপড় না বেঁধে রুপোর এক ধরনের গয়না পরে থাকে ।

গরমকালে যে হালকা ধরনের ডীল পরা হয় তাকে তের্লেগ ডীল বলা হয় । বসন্ত বা শীত কালে যে ভারী ডীল পরা হয় তার ভেতরে কাপাস বা উলের একটা স্তর থাকে যাতে ঠান্ডা না লাগে । এই ধরনের ডীল কে হভোন্তেই ডীল বা হুর্গান দোতর্তেই ডীল বলা হয় । ভেড়ার চামড়া দিয়ে বানানো এক ধরনের ডীল শীত কালে পরা হয় যাকে ছাগান নেখি ডীল বলা হয় ।

মঙ্গোলিয়ার পারম্পরিক বেশভূষা

বিভিন্ন বয়সের লোকেরা আলাদা আলাদা ডীল পরে । যেমন ধর একটু যারা বয়স্ক লোক তাদের ডীল গুলো খুব একটা রঙচঙে হয় না । বিবাহিত ও অবিবাহিত মেয়েরা আলাদা আলাদা ধরনের ডীল পরে । বিবাহিত মহিলাদের ডীল বেশি রঙ্গিন আর সাজানো হয় ।

মঙ্গোলিয়ানরা অনেক ধরনের রঙ্গিন টুপি পরে যা তাদের পরম্পরাগত বেশভূষার একটি অঙ্গ । বয়স, ঋতু আর স্ত্রী-পুরুষ ভেদ হিসেবে, বা উত্সব হেতু আলাদা আলাদা ধরনের টুপি পরা হয় । মঙ্গোলিয়ানরা প্রায় ৪০০ আলাদা আলাদা ধরনের টুপি পরে । মঙ্গোলিয়ান টুপির ধার প্রায় ওপর দিকে ওল্টানো থাকে আর টুপি ওপরে ঠিক মাঝখানে একটি গিঁট মারা থাকে । আগেকার দিনে ধনী লোকেরা যে সব টুপি পরতো তাতে নানারকমের মনি-রত্ন লাগানো থাকতো । মেয়েদের টুপিতে নানা রঙের সিল্কের রিবন লাগানো থাকে ।

মঙ্গোলিয়ার পারম্পরিক বেশভূষা

মঙ্গোলিয়ান বেশভূষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে জুতো । এই জুতো খুব মোটা হয় আর ভেতরে মোটা উলের স্তর লাগানো থাকে যাতে মঙ্গোলিয়ার প্রচন্ড ঠান্ডাতেও কষ্ট না হয় । মঙ্গোলিয়ান জুতোর সামনের দিকটা অনেকটা আমাদের দেশের নাগরা জুতোর মতো ওপর দিকে উল্টানো থাকে । এটি এই জন্য হয় যাতে ঘোড়া চরার সময় পা পিছলে না যায় । অবশ্য এত মোটা জুতোর সামনের দিকটা যদি উল্টানো না থাকতো তাহলে চলাফেরার খুব অসুবিধে হত । এই ধরনের জুতো বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলের লোকেরা পরে, কিন্তু শহরের লোকেরাও যে পরেনা তা নয় । জুতোর ওপর দিকটা সুন্দর ভাবে সাজানো থাকে । এতে কোনো লেস বা জিপার লাগানো থাকেনা । মঙ্গোলিয়ার লোকেরা শীতকালে খুব মোটা উলের মজা ব্যবহার করে ।

মঙ্গোলিয়ার পারম্পরিক বেশভূষা

 

ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য্যি ফলিত ভূতত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পেশায় ভূতাত্বিক হলেও আসল নেশা ফটোগ্রাফি এবং লেখালিখি। কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, অস্ট্রেলিয়া এবং মঙ্গোলিয়ায়। ভূতাত্বিক হওয়ার সুবাদে প্রকৃতির নিত্য পরিবর্তনকে এবং ক্রিয়া-প্রক্রিয়াকে সহজে অনুভব এবং বিশ্লেষণ করেন।