খেলাঘরখেলাঘর

dodo

 


ডোডো পাখির নাম শুনেছো? শুনে থাকাটা নতুন কিছু নয়। আমরা অনেকেই শুনেছি। যে সমস্ত প্রানী পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে চিরকালের মত, তাদের উদাহরন হিসেবে ডোডো পাখির নাম আমরা অনেক জায়গাতেই পেয়ে থাকি। ইংরাজী ভাষাতে তো ডোডোকে নিয়ে রীতিমত একটা প্রবাদবাক্য চালু আছে –‘ডেড এস এ ডোডো’। কিন্তু আমরা কি জানি সেই পাখি কেমন ছিল? কোথায় থাকতো তারা? কি করেই বা তারা হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে? ঠিক করেছি আজ সেই গল্পই শোনাব তোমাকে। আমাদের এই পৃথিবী থেকে কত প্রানীই হারিয়ে গেছে চিরতরে। কিছু প্রানী হারিয়ে গেছে প্রকৃতিতে তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে – তাদের অস্তিত্ব শুধু টিকে আছে অভয়ারন্য, চিড়িয়াখানায় বা সাফারি পার্কে। আজকের পৃথিবীতে বন্যপ্রানী সংরক্ষনের প্রয়োজনীয়তা ঠিক কতটুকু তা সঠিকভাবে বুঝতে গেলে ডোডোর কাহিনী আমাদের জানা খুব প্রয়োজন।

ডোডো কোথায় পাওয়া যেত? তা কেবলমাত্র একটা জায়গাতেই। ভারত মহাসাগরের ওপর ভারতবর্ষ আর মাদাগাস্করের মাঝামাঝি একটা ছোট্ট দ্বীপ মরিশাসে। সেখানেই ছিল ডোডোর বাসস্থান। উচ্চতায় প্রায় সাড়ে তিন ফুট। আর ওজনে কুড়ি কিলো। ভাবতেই পারছো নিশ্চয়ই কি পেল্লায় পাখি ছিল ডোডো। এই পাখির প্রথম চাক্ষুশ বিবরন পাওয়া যায় ডাচদের বিবরন থেকে। ডোডোর কোন ফটো পাওয়া গেছে বলে শুনিনি। তবে সেই সময়কার অনেক শিল্পীই ছবি এঁকেছেন ডোডো নিয়ে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রোল্যান্ড স্যাভেরি। নীচের ছবিটি ১৬২৬ সালে আঁকা কালিপেনে। অবশ্য শিল্পী রোল্যান্ড নন। রোল্যান্ডের বেশীর ভাগ ছবিই তেলরঙে। 

 

dodo
ডোডো পোর্ট্রেট। মূল শিল্পী - এড্রিয়েনে ভ্যান্ডার ভেন

আজকের দুনিয়ায় তাদের সবচেয়ে কাছের প্রজাতি হল নিকোবর পিজিয়ন (বিজ্ঞানসম্মত নামঃ কলোনিয়াস নিকোবারিকা)। অবাক হচ্ছ? বিজ্ঞানীরা বলেন ডোডোর উৎপত্তি  হয়েছে আদপে পায়রা ও ঘুঘু প্রজাতি থেকে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কলাম্বিডে। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে যে পায়রার বা ঘুঘুর মত হালকা, উড়ুক্কু পাখি থেকে ডোডোর মত, বিরাট স্থূলকায়, উড়তে অক্ষম একটি প্রজাতির সৃষ্টি হল কি করে? প্রথম প্রথম কিন্তু ঐ প্রকান্ড ঠোঁট দেখে ডোডোদের শকুনের সমগোত্রীয় মনে করা হত। ১৮৪০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে  একটি কঙ্কাল দেখতে দেখতে প্রানীবিজ্ঞানী রেনহার্ড পায়রার সাথে ডোডোর সাদৃশ্য খুঁজে পান। তাঁকে সমর্থন করেন এডুয়িন স্ট্রিকল্যান্ড। অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হল এই ঘটনায়। তারপরে অবশ্য একশ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীরা এই মতামতকে সমর্থন করেছেন। শেষমেষ ডিএনএ পরীক্ষাতেও তা নির্ভুল প্রমানিত হয়।

ডিএনএ বিশ্লেষন করে না হয় দেখা গেল পায়রা থেকেই ডোডোর উৎপত্তি। কিন্তু তাইই বা হয় কি করে? এই নিয়ে একটি মতবাদ চালু আছে। তুমি  বড় হয়ে যখন ল্যামার্ক আর চার্লস ডারউইনের মতবাদ পড়বে তখন হয়তো আরো ভালো করে বুঝতে পারবে। অনুমান করা হয় আজ থেকে কয়েক কোটি বছর আগে একদল পায়রা মরিশাসের দ্বীপগুলিতে হাজির হয়। একে তো পায়রাদের কোন জায়গায় একসাথে টানা বসবাস করার মতিগতি নেই। তারা বারে বারেই নতুন নতুন আস্তানার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। হতে পারে হয়তো ঝড় উঠে তাদের এই দ্বীপে এনে হাজির করেছিল। আসল কথাটা হচ্ছে, যেভাবেই এসে পড়ুক না কেন, তারপর থেকে তারা সেখানেই থেকে যায়। মরিশাস ছিল পাখিদের কাছে স্বর্গ। ছোটখাটো যেসব স্তন্যপায়ী প্রানীদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা – যেমন ধেড়ে ইঁদুর, বেড়াল, কুকুল, বুনো শুয়োর ইত্যাদি এখানে একেবারেই ছিল না। সমুদ্রের প্রতিকূলতা তারা কোনদিনই পেরোতে পারেনি। ফলে পায়রাদের দল সেখানে বড় সুখেই থাকতে লাগল। সুখে থাকতে থাকতে যা হয়, তাই হল তাদের সাথে। আস্তে আস্তে আকাশে ওড়ার প্রয়োজন কমে আসতে থাকল। তারপর বিবর্তনের নিয়মেই ওড়ার ক্ষমতা হারিয়েই গেল একেবারে। চেহারা ভারী হয়ে এল। সেই ভারী শরীরকে বইবার জন্য পা শক্ত হল। ডানার শক্তি হারিয়ে যেতে শুরু করল। এই সুখের জীবনই শেষমেষ কাল হল তাদের কাছে।

pigeon
পায়রা থেকে ডোডোর পথে। শিল্পীর পরিচয় পাওয়া যায় নি

ডোডোদের সম্পর্কে কি কি জানা যায় না? অনেক কিছুই। যেমন ধর তাদের খাবারদাবার কি ছিল? যেহেতু তারা উড়তে পারত না, সেহেতু এরকম মনে করে নেওয়াটা নেহাত অনায্য হবে না যে ওরা খাবার সংগ্রহ করত মাটিতে পড়ে থাকে ফলমূল থেকেই। খুব সম্ভব সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তীরে উঠে আসা অনেক কিছুই খেয়ে ফেলত তারা। এমনটাও মনে করা হয় পায়রাদের মত তারাও মাঝে মাঝে ছোট খাট পাথর খেয়ে নিত, যা তাদের খাবার হজম করতে সাহাজ্য করত।



dodo's beak

ডোডো পাখির ঠোঁট। অনেক প্রশ্ন থেকেই গেছে এই নিয়ে

ডোডোদের সামাজিক জীবন নিয়েও সেভাবে প্রায় কিছুই জানতে পারা যায় না। ওরা কিভাবে দল বেঁধে থাকতো? কত বড় বা ছোট ছিল সেই পরিবার? কটা করে ডিম পাড়তো তারা একসাথে? কিভাবে বাচ্চারা বড় হত। এইসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের আজও জানা নেই। একে তো ডোডোর ওপরে প্রামান্য গ্রন্থের অভাব আছে, তারপরেও যেটুকু আছে তাতে আধুনিক বিজ্ঞানীরা খুবই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে ঐসব লেখকেরা আদৌ কখনো ডোডো দেখেছেন কিনা। সাউথ আফ্রিকার ইস্ট লন্ডনে একটি ডোডো পাখির ডিম আজও সযত্নে রাখা আছে। তবে এ নিয়ে বিতর্ক আছে ওটা আদপেই ডোডোর ডিম না উটপাখির ডিম – তাই নিয়ে। ডোডো পাখির ঠোঁট নিয়ে প্রশ্ন কম নেই। ঐ ঠোঁটের কারনেই পায়রাদের বংশ হিসেবে ডোডোকে মেনে নিতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু ঐ বিশাল ঠোঁটের কাজটা ঠিক কি ছিল – আত্মরক্ষা? খাবার জোগাড় করা, মাটি খোঁড়া নাকি অন্য কোন জৈবিক প্রয়োজন? তা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। অনেক জীববিজ্ঞ্রানী মনে করেন ডোডোর হয়তো আরো উপপ্রজাতি ছিল। কিন্তু আজ তা প্রমান করবার বড় উপায় নেই।

যদিও প্রথমে আরবরা ও পরে পর্তুজীজরা মরিশাস দ্বীপপুঞ্জে পা রেখেছিল, তবু ডোডোর কথা প্রথম জানতে পারি আমরা ১৫৯৮ সালের ওলন্দাজ বিবরনী থেকেই। শুধু ওলন্দাজ নয়, তারপরে একে একে ফরাসী আর ইংরেজরাও এসেছে মরিশাসে। আর খুব সহজ শিকারের লোভেই হারিয়ে গেছে ডোডো। অনুমান করা হয় ১৬৪০ সালের মধ্যেই ডোডো হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। যদিও এর বেশ কিছু বছর পরে, ১৬৮০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন লেখক দাবী করেছেন তাঁরা ডোডো দেখেছেন বলে। তবে তাই নিয়ে তর্কের অবকাশ থেকেই যায়। ভেবে দেখো মাত্র চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে মানুষের আগ্রাসনে একটি প্রজাতি হারিয়ে গেছে চিরকালের মত। নীচের ছবিটা দেখলে ডোডোদের করুন অবস্থার একটা সুন্দর প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।

dutch-arrival
মরিশাসে ডাচদের আগমন। মূল শিল্পী ডামরিকান


ডোডো না হয় একটা দুর্বল, ভীতু, অক্ষম প্রজাতির প্রানী ছিল। প্রকৃতির সাথে, প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। তাই তাদের হার মানতে হয়েছে মানুষের সীমাহীন লোভের কাছে। কিন্তু সিংহ? সে তো বনের রাজা। আমি কদিন আগে একটি সাফারি পার্কে গিয়ে জানতে পারি সিংহের একটি উপপ্রজাতি বার্বারি লায়ন চিরতরে হারিয়ে গেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে। গুটিকয়েক সঙ্কর প্রজাতির সন্তান সন্ততি টিকে রয়েছে সাফারি পার্কের নিরাপদ আশ্রয়ে। তাহলে ভেবে দেখো মানুষের কাছে কোন প্রানীই রেহাই পায়নি। অথচ প্রকৃতির প্রয়োজনে ওদের সবাইকেই বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। জীবনের বৈচিত্রকে যাতে বড় হয়ে বুঝতে পারো, সমস্ত প্রানীকেই ভালবাসতে পারো সেজন্য ছোট থেকেই প্রকৃতির নিয়মকে বুঝতে হবে। ডোডো পাখির মত আর কোন প্রজাতি যাতে ভবিষ্যতে হারিয়ে না যায় সে দায়িত্ত নিতে হবে আমাদেরই।

 

 

লেখা ও ছবিঃ
অভ্র পাল
কার্ডিফ, ওয়েল্‌স্‌, যুক্ত রাজ্য