অবোধ-বন্ধু পত্রিকা
এবারে তোমাকে এমন একটি পত্রিকার গল্প শোনাবো যার নামটা প্রথমবার শুনেই আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল! বলা হ'ত ছোটদের জন্য পত্রিকা... আর নাম দিয়েছিল কিনা 'অবোধ-বন্ধু'! বলে দেখি – তোমার মত বুদ্ধিমান মানুষকে 'অবোধ' বললে কেমন রাগ হয়? ছোট মানুষ বলে হেলা ফেলা? ভারী অন্যায়! আমি যখন ছোট ছিলুম, তখন আমাকে কেউ অবোধ বললে তো খুব খাপ্পা হয়ে যেতুম তার ওপর! কিন্তু অনেকেই এই 'অবোধ-বন্ধু' পত্রিকাটি পড়ত... এমন কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছোটবেলায় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে এই বইয়ের হদিস পেয়েছিলেন, এবং নিজেও পাঠক ছিলেন এই পত্রিকার; এসব কথা ওনার 'জীবনস্মৃতি' পড়লেই জানা যায়। যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ নামের একজনের প্রয়াসেই এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, ১৮৬৬ সালে (বাংলার ১২৭৩, ফাল্গুন মাস)। ইনিই ছিলেন প্রথম সম্পাদক। তবে দেখা যায়, এর আগে ১৮৬৩ সালেও একবার এই পত্রিকা মাসিক ভাবে প্রকাশ করা শুরু করেছিলেন যোগেন্দ্রনাথ বাবু, কিন্তু তখন বেশিদিন চালাতে পারেন নি। ১৮৬৬ সালে আবার প্রকাশ করার পরেও কিছুকাল পর আর্থিক অসংগতির কারণেই আর ওনার পক্ষে টানা সম্ভব হয় নি। পরের বছর, মানে ১৮৬৭ সালেই 'অবোধ-বন্ধু' পত্রিকাটির দায়িত্ব উনি সমর্পন করেন সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত কবি এবং সাংস্কৃতিক জগতের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব শ্রী বিহারীলাল চক্রবর্তীকে। এর পর থেকে বিহারীলাল চক্রবর্তীই 'অবোধ বন্ধু' পত্রিকার দায়ভার গ্রহণ করেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী কে জানো? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে, মানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন কবিতা লিখে প্রশংসা পাচ্ছেন, সেই সময়কারই আর একজন প্রশংসিত কবি। বাড়ির অন্দরমহলে অনেকেই এনার কবিতা পড়তে ভালবাসতেন, এমন কি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও এনার কবিতার অনুরাগী কম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন -
"বাল্যকালে আর একটি ছোট কাগজের পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম। তাহার নাম অবোধ-বন্ধু। ইহার আবাঁধা খণ্ডগুলি বড়দাদার আলমারি হইতে বাহির করিয়া তাঁহারই দক্ষিণদিকের ঘরে খোলা দরজার কাছে বসিয়া বসিয়া কতদিন পড়িয়াছি। এই কাগজেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা প্রথম পড়িয়াছিলাম। তখনকার দিনের সকল কবিতার মধ্যে তাহাই আমার সবচেয়ে মন হরণ করিয়াছিল।"
বিহারীলালের 'নিসর্গ-সন্দর্শন' কাব্যের অধিকাংশ 'অবোধ-বন্ধু'তেই প্রকাশিত হয়। 'সুরবালা' কাব্যেরও কিছু অংশ এতে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার দায়িত্ব বিহারীলাল চক্রবর্তীর হাতে আসার পর নতুন করে বিভাগগুলি সাজানো হ'তে থাকে। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, চরিতকথা, গল্প, কবিতা, গ্রন্থসমালোচনা... একে একে এই বিভাগগুলি নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকে। হ্যাঁ, ছোটদের মাসিক পত্রিকায় সেই প্রথম গ্রন্থ সমালোচনা (মানে একটি বই পড়ে পাঠকের কেমন লাগল সেই নিয়ে আলোচনা) দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়কার কৃতী লেখিকা কৈলাসবাসিনি দেবী এবং বামাসুন্দরী দেবী, এনাদের বইয়ের সমালোচনা প্রকাশিত হয় 'অবোধ-বন্ধু' পত্রিকায়। তবে সেই বইগুলো ছোটদের পড়ার মত বই ছিল বলে মনে হয় না। এছাড়াও কৈলাসবাসিনী দেবী মহিলাদের জন্য এবং মহিলাদের লেখা নিয়েই একটি বিভাগ পরিচালনা করতেন, যার নাম 'বামাগণের রচনা'। ঠিক 'অবোধ বন্ধু' নাম শুনে যেমন আমি ক্ষেপে গেছিলুম, সেরকম এই 'বামাগণের রচনা' নাম শুনেও অনেকের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। মেয়েদের 'বামাগণ' বলা একেবারেই ভাল কথা নয়, এটা সবসময় মনে রেখো, কেমন? আসলে এমন নামকরণ থেকে বোঝা যায়, তখনকার সমাজে বেশিরভাগ মানুষের ভাবনা-চিন্তা এতটাই পিছিয়ে ছিল যে স্বাভাবিক কিংবা ভাল কাজ করতে গেলেও ঠিক কিছু না কিছুর মধ্যে দিয়ে সেই পিছিয়ে পড়া মনের ছায়াটা বেরিয়ে আসত। ঠিক সেই পিছিয়ে পড়া মনেরই প্রকাশ 'অবোধ-বন্ধু' এবং 'বামাগণের রচনা'র মত নামকরণ। অথচ, তাদের এমন কোনও উদ্দেশ্যই ছিল না যে এসবের করে ছোটদের বা মহিলাদের মনকে কষ্ট দেওয়া হয়। এ ছাড়া এই পত্রিকা আরও একটি মুশকিল ছিল, তা হ'ল ছোটদের জন্য মাসিক পত্রিকা ভেবে নিলেও আসলে এটি পুরোপুরি ছোটদের জন্য পরিকল্পিতই ছিল না। এই মাসিক পত্রিকার লক্ষ্য ছিল ঘরের অন্দরমহলে পৌঁছনো, যেখানে ছোটদের সাথে তাদের মা-পিসি-মাসি প্রভৃতি বাড়ির বড় মহিলারাও বইটির পাঠিকা হ'ন এবং অপেক্ষা করেন পরের সংখ্যার জন্য। না হ'লে বিহারীলাল নিজের বেশ সুগঠিত (বড়দের জন্যই) কবিতাগুলি এই পত্রিকায় প্রকাশ কেন করবেন? আর এইসবের জন্য এমন গেরো বাঁধল যে অনেকে এই 'অবোধ-বন্ধু' শিশুপাঠ্য পত্রিকা বলে মেনে নিতেই রাজী হলেন না। তবে শিশু-সাহিত্য বা কিশোর-সাহিত্য সেখানে বেশি থাকুক বা না থাকুক, পত্রিকা হিসেবে 'অবোধ-বন্ধু'র সাফল্য এসেছিল বিহারীলাল দায়িত্ব নেওয়ার পর, এবং সাফল্য এসেছিল বলেই তার নাম উল্লেখযোগ্য হয়েছে এবং ঠাকুরবাড়ির মত সংস্কৃতিসম্পন্ন অন্দরমহলে এর একটা জায়গা ছিল।