সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

এই পয়লা বৈশাখ শব্দটা যে ঠিক কবে প্রথম শুনেছি তা এখন হাজার চেষ্টা করলেও মনে করতে পারি না। কি প্রসঙ্গে শুনেছিলাম তাও মনে নেই। কিন্তু এটা বেশ মনে আছে ‘পয়লা’ শব্দটার মানে আমি একেবারেই জানতাম না। মাস পয়লা, পয়লা বৈশাখ... এই ‘পয়লা’ বস্তুটি যে আসলে কী... তা আমার কাছে ধাঁধার মত ছিল। তারপর এক সময় মায়ের কাছে শুনলাম ‘পয়লা’ তারিখ হ’ল যে কোনও মাসের প্রথম দিন। হিন্দির প্যাহেলা শব্দ থেকে ভেঙে ঢুকে পড়েছে। কি বাংলা সাল, কি তার প্রথম দিন... একদম ছোটবেলা সে সব বোধ ছিল না। তবে জানতাম বছরে একটা দিন আসে, সেদিন বলে হালখাতা... চেনা-জানা দোকানে গেলেই মিষ্টির বাক্স, কোল্ড ড্রিংক্‌স্‌ আর ক্যালেণ্ডার দেয়। বাংলা নববর্ষ বলে যে কিছু হয়... তা চেনা এই বাংলা ক্যালেণ্ডার থেকেই। জানুয়ারী মাসে বাবার অফিস থেকে ক্যালেণ্ডার নিয়ে আসতেন, রঙিন ক্যালেণ্ডার জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বার অবধি... ইংরাজী তে। তারপরেও আবার বছরের মাঝখানে এই বাংলা ক্যালেণ্ডার কেন? আর এই সব মাসের নাম গুলোই বা কি? সেই প্রশ্ন যেদিন সাহস করে মা’র কাছে করলাম, সেদিন জানলাম আমাদের বাঙালিদেরও একটা মাসের হিসেব আছে। বাঙালি বছর, যাকে ভাল বাংলা বলা হয়ে বঙ্গাব্দ। সেই বছরের প্রথম দিন কেই বলা হয় নববর্ষ। সেই আমাদের পয়লা বৈশাখ। যে বছর ঠিক করে জানলাম, সেই বছর বাংলার ১৪০০ সাল। তারপরেও হাজার একটা মাথা গোলানো ব্যাপার ছিলো। ভাবতাম, পৌষ আর জানুয়ারী একই সময়, তো পৌষ মাসেই বছর শুরু। তারপর যখন জানলাম বৈশাখে শুরু, তো কিছুতেই মেনে নিতে রাজী নই এই মাঝখানে বছর শুরু কেন হবে? তারপর দেখলাম ইংরাজী মাসের মাঝামাঝি কোনও একদিন বাংলা মাস শুরু, সেও ভারি অদ্ভুত লেগেছিল। বলতে পারো, এত প্রশ্ন, এত চিন্তা... সবই এই পয়লা বৈশাখ, মানে নববর্ষ কে ঘিরেই।

আমার ছোটবেলাটা ৯০-এর দশকে, মানে গত শতাব্দীর শেষ দশক। যারা সেই সময় বড় হয়ে উঠছে, অথবা সেই সময় প্রাপ্ত বয়স্ক তাঁরা বুঝতে পারবেন আমাদের আশেপাশের সবকিছু খুব দ্রুত পালটে যাওয়ার দশক ছিল ওইটি। একদম ক্রিকেটের স্লগ ওভারের মত। একের পর এক পরিবর্তন দেখেছি পর পর। এই টিভিতে এক ডিডি মেট্রো এলো, তো ক’দিন পরেই ঘরে ঘরে কেব্‌ল টিভি। পাড়ায় একটা দু’টো বাড়িতে টেলিফোন থাকত, সেখান থেকে হঠাৎ ঘরে ঘরে ল্যাণ্ড লাইন। কয়লার ইঞ্জিন উঠে গেল, ইলেক্ট্রিক আর ডিজেল... কু ঝিক ঝিক শেষ। সেই পরিবর্তন বা বিবর্তনের হাওয়া যে বাঙালির পয়লা বৈশাখেও লাগবে, তা আর অস্বাভাবিক কি! তবে আমরা আমাদের সব কিছুর মধ্যেই বেশ ছিলাম সেই দ্রুত পরিবর্তনের যুগে। বাঙালিরা এখনও বাঙালি থাকতে আন্তরিক ভাবেই ভালবাসে, তাই বাংলার গন্ধ লেগে থাকা সব কিছুকে আগলে রাখে... সেই আগলে রাখা আমাদের নববর্ষ। বছরের শেষ মাস চৈত্র, তখন থেকে বৈশাখ মাসের জন্য আয়োজন, কেনাকাটা শুরু হ’ত। তার পোশাকী নাম ‘চৈত্র সেল’। মা আর বড় পিসিমা গিয়ে প্রত্যেকের জন্য কিছু না কিছু কিনে আনতেন। পুজোর সময় শার্ট-প্যাণ্ট কেনা হ’ত। কিন্তু এই পয়লা বৈশাখের জন্য হালকা হাফ হাতা পাঞ্জাবী। বেশ রঙিন আর সুন্দর কাজ করা, ছাপা... কখনও আকাশী, কখনও হালকা কমলা, কখনও সবুজ... আমার যা রঙ পছন্দ। পয়লা বৈশাখের দিন একটু বেশি সকালেই মা ঘুম থেকে তুলে দিতো। পাড়ার শিবমন্দিরে মা-ঠাকুর্মা পূজো দিতে যেতেন। সেইদিন আমাকেও সঙ্গে যেতে হ’ত, সকাল সকাল চান করে... ওই নতুন হাফ হাতা পাঞ্জাবী পড়ে। পাড়ার পুরনো মিষ্টির দোকানটায় আগের দিন থেকেই ভিড় জমা শুরু হ’ত। আর সেই পয়লা বৈশাখের সকালে উপচে পড়া ভিড়। সেদিন ওরা কিছু অন্যান্য ধরণের মিষ্টি বেশি বানাতো। বাড়িতে যে সেদিন খুব বড় কিছু আয়োজন, বা বিশেষ কিছু আরম্বর হ’ত তা নয়। তবে ঠাকুর্মার বারণ ছিল, পয়লা বৈশাখে মাংস আসবে না বাড়িতে। পাকা রুই বা কাৎলা আনা হ’ত। ছুটির দিন, বাবা বাড়ি থাকতেন... তাই আমার ছুটির দিনেও হুল্লোড়টা সেভাবে আর করা হ’ত না। ছুটির দিন বলেই পড়তে বসার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হ’ত... পাশের বাড়ির জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইরা কেউ না কেউ উঁকিঝুঁকি দেবেই পাঁচিলের ওপারে, জাফরির ফাঁকে, একটু বেলা হ’তেই। বেরিয়ে পড়লেই হ’ল। কিন্তু ওই, বাবা বাড়িতে থাকলে সব কিছুই ভেবে চিনতে করতে হ’ত। মা বলত “বছরের প্রথম দিন যেমন কাটাবি সারা বছর তেমন কাটবে... পড়াশুনো না করলে, সারা বছর আর পড়াশুনো হবে না।” একটু ভয়-ভয়েই বসতে হ’ত কিছু একটা করতে। বাংলা কাগজ দু’টো নেওয়া হ’ত সেদিন... শুধু নববর্ষে বিশেষ কে কি লিখল পড়ার জন্য। একটি বিশেষ কাগজ সেদিন একটি নববর্শ-স্পেশাল ক্রোড়পত্র প্রকাশ করত।আমি সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, বাবার ওইসব পড়ে দিন কাটত। আমি টিভিতে বাংলা নববর্ষের বিশেষ বৈঠকী অনুষ্ঠান দেখতাম। শ্রী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা-র সঙ্গীত শিল্পী, অভিনেতা সতীনাথ মুখোপাধ্যায় (বেশির ভাগ সময় সঞ্চালনার দায়িত্ব এনার ওপর পড়ত), আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ, এছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যোগ দিতেন সেই বৈঠকে। এমন বৈঠকী অনুষ্ঠান দূর্গাপুজোর সময় হ’তে দেখতাম আর এই নববর্ষে। বিশেষ করে মনে পড়ে প্রবীণ রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সেকালের কথা, তাঁর দেখা বাঙালির নববর্ষ... সেই সব গল্পগুলো করতেন গানের ফাঁকে ফাঁকে। এখনও নববর্ষ এলে সবার আগে দু’টো কথা মাথায় আসে, কালীঘাটের মন্দির... আর শ্রী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। হাবিজাবি সব কিছু করেই কাটত সকাল থেকে দুপুর... আর সবকিছুর মধ্যেই, মনে মনে অপেক্ষা করতাম কখন সন্ধে হবে। কারণ সন্ধেবেলাই পয়লা বৈশাখ ওরফে হালখাতার আসল মজা!

যেসব গয়নার দোকান অথবা কাপড়ের দোকান আমাদের খুব পরিচিত, যাদের আমরা পুরনো খরিদ্দার... তারা আগে থাকতে নেমন্তন্ন করে রাখত, এই পয়লা বৈশাখের, যা তাদের কাছে হালখাতা। নতুন বছরের ব্যবসার শুভ সূচনা, একদম খাতায় হলুদ-সিঁদুর দিয়ে টাকার ছাপ আর তারপর সিদ্ধিদাতা গনেশের পায়ে ছোঁয়ানো। নতুন লাল ব্যবসার খাতা দেব-দেবীর পায়ে ছুঁয়ে (যা বাঙালির কাছে বাই ডিফল্ট মা কালী) নতুন করে শুরু করা... অবাঙালিদের যেমন ধন্তেরস পর দিওয়ালিতে হয় – একদম স্বস্তিকা এঁকে ‘শুভ লাভ’। তো, সেই হালখাতায় খাতা খোলার জন্য আমাদের নেমন্তন্ন হ’ত। তখন অতসত বুঝতাম না। সাফ কথা, কোল্ড ড্রিংক্স খাব, মিষ্টির প্যাকেট দেবে (চকলেট সন্দেশ আর দরবেশটা হাতাবো) আর ক্যালেণ্ডার পাবো। ঘরে ফিরেই, একের পর এক ক্যালেণ্ডার খোলা শুরু। আমার নিজের পছন্দের ছিল শিবঠাকুরের ছবি দেওয়া ক্যালেণ্ডার... ইয়া বড় মহাদেবের বেশ ছবি হবে, সেটা আমাদের ঘর থাকবে। আর মা পছন্দ করত পরমহংসদেবের ছবি আছে এমন ক্যালেণ্ডার। যে বছর দুটোই আসত, একটু গোলমাল বাঁধত। বড় পিসিমাকে বোঝাতে হ’ত –“একটা এ’ঘরে থাক একটা ও’ঘরে থাক... তুই তো সব ঘরেই যাবি।”

বাঙালির নববর্ষ ঠিক ইংরাজীর ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ নয়। তার কাউণ্ট ডাউন হয় না, ‘নিউ ইয়ার ব্যাশ’ পার্টি হয় না। প্রায় সব রাজ্যেই দেখেছি তাদের একটা নিজস্ব নববর্ষ উজ্জাপনের প্রথা আছে, বাঙালিদেরও তেমন। এ আমাদের এক বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য। বাবুঘাটে, আউট্রাম ঘাটে সক্কাল সক্কাল লোকজন গঙ্গায় স্নান করতে যাবে... বড় বাজারে ভিড়, কালীঘাটে লাল হালখাতা হাতে লোক গিজগিজ করছে। ধাক্কাধুক্কির মাঝে মায়ের লাল তিনটে চোখের একটা চোখ অথবা বড় সোনার লকলকে জিভটা হঠাৎ করে ঝলসে ওঠা... নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে এক ঝলক দেখে, ধাক্কা খেতে খেতে হাত জোড়। নববর্ষের বৈঠক, রকমারী মিষ্টি, লাল পাকা রুই-কাৎলা। সাহিত্যিকরা নতুন কিছু লেখা শুরু করবেন। একটা গোটা বাঙালি সংস্কৃতির নাটশেল এই একটা দিন... গোটা দিন জুড়েই একটা ভাল লাগা... নিজে কিছু করি আর না করি। পেছন ফিরে তাকালে হিসেব করে দেখি... দিনটা আলাদা করে বিশেষ ভেবে চিনতে পরিকল্পনা করে না কাটালেও ঠিক যেমন ভাবে একটু একটু করে সব পাওয়া যায়... তেমনই কাটাতাম। কোনও কিছু না পাওয়ার আফসোস নেই। আশা করি তোমারও নববর্ষের দিনটা তুমি এই ভাবেই পরিবারের সকলের মাঝে আনন্দে কাটাতে পারো। নতুন বছর তোমার শুভ হোক।

পুরোপুরি কলকাতার মানুষ হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস এখন ব্যাঙ্গালোর বা ব্যাঙ্গালুরু। কলকাতারই কলেজ থেকে বি টেক পাশ করে এখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মী। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই মাঝে মধ্যে একটু লেখা আর সময় সুযোগ হ'লে ব্যাগ গুছিয়ে কাছে-দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়া, এই নিয়েই জয়দীপ। সেই সব বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম অভিজ্ঞতা ছোটদের কাছে বলার ইচ্ছে বহুদিন। সেই ইচ্ছাপূরণ করতেই ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কলম ধরা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা