সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পাখি

ছোটবেলা থেকেই আমার পাখি পোষার ভীষণ সখ। লাভবার্ড, কাকাতুয়া, ম্যাকাও, বা পেঙ্গুইন পেলিক্যান নয়, যে কোন একটা পাখি হলেই হ’ল। এমনকি চড়াই বা গোলা পায়রা হলেও আপত্তি নেই।

আমাদের বাড়ির কাছেই একটা জুটমিলের জমিতে একটা শাল কাঠের খুঁটির ওপর কে বা কারা জানিনা, একটা হাল্কা কাঠের বাক্স লাগিয়ে ছিল। তাতে অনেক পায়রার বাস ছিল। বেশীর ভাগই অবশ্য গোলা পায়রা। গোটা দু’তিন সাদা বা লালচে খয়েরী। সুযোগ বুঝে কতবার ওখানে খুঁটি বেয়ে উঠে, পায়রা ধরে আনার পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু হয় আশেপাশে লোক থাকে, না হয় লোকজন না থাকলেও, পায়রারা বাসায় না থাকায়, পরিকল্পনা মনের মধ্যেই থেকে যায়। একদিন সুযোগ বুঝে খুঁটি বেয়ে পায়রা ধরতে উঠলাম। তারা আমার মতো একটা আনাড়ী চোরকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে, ফড়ফড়্ করে আওয়াজ করে উড়ে গেল। একটা লোক, কোথায় ছিল কে জানে, আমার কান্ডকারখানা দেখে এগিয়ে এল। তাকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। সে কিন্তু খুব নরম সুরে আমায় জিজ্ঞাসা করলো—“পায়রা ধরে কী করবে”? বললাম পায়রা পুষবো।
গোলা পায়রা আবার কেউ পোষে নাকি? ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যার সময় এস, পায়রা ধরে দেব।
পরদিন আশায় আশায় ওখানে গিয়ে, লোকটাকে আর দেখতে পেলাম না। অন্য একজনকে তার বিবরণ দিয়ে এবং আমার আসার কারণ জানাতে, সে মুহুর্তের মধ্যে একটা নীলচে কালো গোলা পায়রা ধরে আমার হাতে দিয়ে বললো—“সাবধানে নিয়ে যাও”।

বাড়ি ফিরে একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে, ঝুড়ির তলায় কিছু চাল ও মুড়ি দিয়ে, তাকে খাটের তলায় রেখে দিলাম। পরদিনই বাড়ির পাঁচিলে একটা কাঠের বাক্স টাঙ্গিয়ে, তাতে পরম যত্নে পায়রাটাকে রাখলাম। কিন্তু পায়রাটার কপালে বোধহয় ভাল বাসা লেখা ছিল না। বাক্সে রেখে হাত ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সে তার ডানা নেড়ে আমাকে টাটা করে, উড়ে চলে গেল।

পাখি

আমার দিদির শ্বশুর বাড়ি ছিল পাশের রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই। বোধহয় দু’শ বছরের পুরানো জমিদার বাড়ি, আর ঐ বাড়িতেই ছিল পায়রার আড়ৎ। সেখান থেকে একটা পায়রা ধরে আনলাম। প্রথম দিনই সেটা বাক্সে একটা ডিম পাড়লো। আমাদের বাড়িতে মুরগী ছিল। তারা ডিম পাড়লে, রোজ তুলে রাখা হ’ত। ডিম পাড়া বন্ধ হলে, সব ডিম একসাথে মুরগীর খাঁচায় রেখে দেওয়া হ’ত। মুরগীটার তখন একমাত্র কাজ ছিল সারাদিন ডিমের ওপর গ্যাঁট হয়ে বসে, ডিমে তা দেওয়া। বেশ কিছুদিন পরে ঐ ডিমগুলো থেকে ছোট্ট ছোট্ট, গোল গোল বাচ্ছা জন্মাতো। সেই মতো পায়রার ডিমটাও অন্যত্র তুলে রাখলাম। পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আর ডিম না পাড়ায়, ডিমটা বাক্সে রাখতে গেলাম। মনে একটা খুশী খুশী ভাব— একটা পায়রা এনে, কত অল্পদিনে দু’টো পায়রার মালিক হব। হায়! ডিমটা বাক্সে রাখা মাত্র, পায়রাটা উড়ে গেল, আর তার পা লেগে ডিমটা মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে গেল। সকলে বললো ডিমে নোনা লেগে গেছে, ওটা থেকে বাচ্ছা জন্মাতো না। তাই পায়রাটা ডিম ফেলে দিয়ে চলে গেছে। ডিমে হাত দিলে নাকি নোনা লেগে যায়। দুই প্রজাতির পাখির ক্ষেত্রে দু’রকম নিয়ম হবে কে জানতো, তবে আমার পায়রা পোষার পর্ব, সেখানেই শেষ হয়ে গেল।

বাড়িতে তখন গরু ছিল। তার খাবার খোলচুনি বা ভাঙ্গা ডাল, একটা মুখ কাটা তেলের টিনে রাখা হ’ত। মোবাইল ফোনের টাওয়ারের কল্যানে, চড়াই পাখি শেষ হতে বসেছে। অথচ তখন প্রতি বাড়িতেই প্রচুর চড়াই পাখির দেখা মিলতো। যাহোক্, আমার বাড়ির টিনে তাদের পর্যাপ্ত খাবারের সন্ধান, তারা কী ভাবে পেয়েছিল। সারাদিন আট-দশটা চড়াই, পাঁচিল থেকে টিন আর টিন থেকে পাঁচিল করে কাটিয়ে দিত। বাবার হুকুমে টিনটার ওপর ঢাকা দিয়ে রাখা হ’ত, যাতে গরুর খাবার নষ্ট করতে না পারে।

রবিবার বা স্কুল ছুটির দিনে দুপুরে সবাই ভাত ঘুম দিলেই, আমি আমার পাখি শিকারের অস্ত্র নিয়ে তৈরী হয়ে যেতাম। অস্ত্র বলতে এয়ার গান, তীরধনুক, এমন কী গুলতি পর্যন্ত না। আমার একটা মোক্ষম অস্ত্র ছিল। সেটা একটা নারকেল দড়ির তৈরী গোল পাপোশ্। টিনের ঢাকনা খুলে একটু আড়ালে চুপ করে অপেক্ষা করা ও টিনের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। মূহুর্তের মধ্যে কী ভাবে সংবাদ পেয়ে দশ-বিশটা চড়াই চলে আসতো। আমি চুপ করে আড়াল থেকে তাদের খাওয়া দেখতাম। দুপুর রোদে ঘুরে ঘুরে খাবারের সন্ধান করতে না হওয়ায়, এবং একই জায়গায় এত সুখাদ্যের ব্যবস্থা করায়, তারা আমাকে বোধহয় দু’হাত, সরি দু’পা তুলে আশীর্বাদ করতো। কিছুক্ষণ সময় তাদের নির্বিঘ্নে খাওয়ার সুযোগ দিয়ে, আমি আমার অস্ত্র নিয়ে তৈরী হ’তাম। আট-দশটা চড়াই একসাথে টিনের মধ্যে ঢুকে মনের সুখে খাবার খেতে শুরু করলেই, আমি পা টিপেটিপে গিয়ে টিনের মুখে পাপোশ্ চাপা দিয়ে দিতাম। তারপর হাত ঢুকিয়ে একটা একটা করে পাখি ধরা।

পাখি

একটা বড় জুতোর বাক্সের দু’দিকে ছুঁচ দিয়ে পরপর ফুটো করে, মোটা মোটা ঝাঁটার কাঠি ঢুকিয়ে, একটা খাঁচা তৈরী করাই ছিল। এবার পাখিগুলোকে একটা একটা করে জুতোর বাক্সে পোরা। জায়গা অনুপাতে পাখির সংখ্যা খুব বেশী হয়ে যেত। কিন্তু বাবার জন্য এত দামী পাখি পোষা থেকে প্রতিবারই আমি বঞ্চিত হতাম। পাখি পোষার প্রধান অন্তরায় ছিলেন আমার বাবা। একেই বোধহয় ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে। পাখিগুলোকে সন্ধ্যার আগেই ছেড়ে দিতে হ’ত। অনেকদিন সন্ধ্যার পর বাবা অফিস থেকে ফিরে, পাখি ধরার জন্য তিরস্কার করতেন। কিন্তু সন্ধ্যার পর পাখিগুলোকে ছেড়ে দিলে বিড়ালের কবলে পড়তে পারে বলে পরদিন সকালে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিতেন। আর সেই রাত্রিটা আমার খুব আনন্দের হ’ত। সামান্য পড়াশোনার পর অনেকটা সময় আমি পাখিগুলোকে সঙ্গী হিসাবে পেতাম। বারবার জুতোর বাক্স থেকে কাঠি খুলে বার করতে গিয়ে দু’একটা উড়েও যেত। সারারাত অন্ধকারে কোথায় থাকবে, বা এত রাতে অন্ধকারে নিজের বাসা চিনে ফিরে যেতে পারবে কী না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তাও কম হ’ত না।

একদিন ছোট একটা দড়ি দিয়ে দু’টো চড়াই পাখির পা বেঁধে দিয়ে ছেড়ে দিলাম। ভেবেছিলাম তারা একে অপরকে হারিয়ে ফেলবে না, সব সময় একসঙ্গে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ফল হ’ল উল্টো। পাখিদুটো ছাড়া পেয়ে হুস করে উড়ে গিয়ে, যে যার পথ দেখলো। ফলে দড়ি টানাটানি করে ঝপ করে মাটিতে পড়ে গেল। দ্বিতীয় বারও একই ফল হ’ল, তবে মাটিতে না বসে, বাড়ির ছাদের কার্নিশে গিয়ে বসলো। বুঝলাম এভাবে দড়ি বাঁধা থাকলে, দুটোই মরে যাবে। শুরু হল তাদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা। ওরা দড়ি টানাটানি করে একবার এখানে বসে, একবার ওখানে পড়ে যায়, কিন্তু দু’জনে একসঙ্গে একবারও উড়তে পারলো না। শেষে অনেক চেষ্টার পর ওদের ধরে, বাবার দাড়ি কামানোর বাক্স থেকে ব্লেড নিয়ে, খুব সাবধানে দুটোরই পায়ের দড়ি কেটে দিলাম। ওরা মহানন্দে উড়ে গেল বটে, কিন্তু দাড়ি কামানোর নতুন ব্লেডে কে হাত দিয়েছে, তাই নিয়ে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র হয়ে গেল। যখন বুঝলাম চড়াইপাখি পোষার যোগ্য নয়, তখন অন্য কোন পাখির সন্ধানে লেগে পড়লাম।

ছোটবেলা থেকে মাঠে, ঘাটে, জলাজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফড়িং, প্রজাপতি, মাছ, পশুপাখি, গাছের সাথে সখ্যতা। একটু বড় হয়ে স্কুল, এবং তারপরে কলেজ পালানোর নেশায় এর ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন ও অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে ও ভ্রমণের নেশায় আরও বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিচিত্র সংস্কার, বিচিত্র জায়গা দেখার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সুবীর কুমার রায় কর্ম সুত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। নেশা ভ্রমণ ও লেখা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা