খেলাঘরখেলাঘর

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
 
  রূপকথার গল্প শুনতে কে না ভালোবাসে? মানো চাই না মানো - তুমি যতই বড় হও বা ছোট, ক্লাসের মনিটরই হও বা সাইকেল রেসের চ্যাম্পিয়ন - তুমিও পছন্দ করো রূপকথার গল্প পড়তে। রাজা-রানী-রাজপুত্র-রাজকন্যা-রাক্ষস-পরী-ডাইনী- ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী-পক্ষিরাজ ঘোড়া - শীতের রাতে লেপের তলায়ই হোক, বা গরমের ছুটির দুপুরে, বা বর্ষার বিকেলে - এইসব গল্প সবসময়েই দারুণ লাগে পড়তে। আর যদি কেউ পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প বলে, তাহলে তুমি পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চেপে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়েই পড়তে পারো...তাই না?

আচ্ছা ভাবো তো একবার - এই সব রূপকথা এলো কোথা থেকে? কে বা কারা লিখেছিলেন আমাদের এই ভালোলাগা গল্পগুলি? জানলে অবাক হবে, পৃথিবীর সব দেশেই, আর আমাদের বাংলাদেশে তো বটেই, রূপকথার গল্প কিন্তু বহুদিন বেঁচে ছিলো লোকের মুখে মুখে। সেইইই কোন হারিয়ে যাওয়া সময়ে, হয়তো কোন এক চাঁদনি রাতে, কোন এক দিদিমা তাঁর নাতি-নাতনিকে কোলের কাছে শুইয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে হয়তো বলেছিলেন সেই প্রথম গল্পটা। তারপর সেই গল্প ছড়িয়ে পড়লো মুখে মুখে- এক গল্প থেকে তৈরি হলো আরেক গল্প...কলাবতী রাজকন্যা নাম পালটে হয়ে গেলো কেশবতী...দুধের পাহাড় হয়ে গেলো ক্ষীরের সাগর...সময়ের সাথে সাথে সেই নাতনি  হয়ে গেলো দিদিমা, আর সে সেই গল্পটাই আবার শোনালো তার নাতি -পুতিদের । এইভাবেই বেঁচে থাকে যেকোন দেশের উপকথা, লোক কথা আর রূপকথা।

কিন্তু মুখে মুখে ঘুরতে থাকলে তো আর চলবে না! মানুষের জীবন যতো আধুনিক হতে থাকলো, ততই বেড়ে যেতে লাগলো নানারকমের কাজ, কমে যেতে থাকলো এক সঙ্গে বসে গল্পগুজব করার সময়, পড়াশোনার চাপে আর সময় রইলো না নিয়ম করে ঠাকুমা বা দিদিমার কাছে গল্প শোনার। মুখে মুখে যেমন বেঁচে ছিলো অনেক গল্প, না জানি হারিয়ে গেলো আরো কত! তাই একসময়ে এইসব গল্প গুলিকে একত্র করে রাখাটা খুব জরুরি হয়ে পড়লো। বাংলার রূপকথাকে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে চিরদিনের জন্য ঠাঁই দেওয়ার এই কাজটি যিনি নিলেন, তাঁর নাম দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৮৭৭-১৯৫৭)।

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ছিলেন শিশুসাহিত্যিক এবং লোককথা সংগ্রাহক। বাংলাদেশের যাবতীয় লোককথাকে তিনি সংগ্রহ করলেন, এবং বাংলা সাহিত্যকে তিনি দিলেন কয়েকটি অমূল্য রতন - ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, দাদামশায়ের থলে এবং ঠানদিদির থলে। এই সংকলনগুলিতে তিনি ভরে দিলেন বাংলাদেশের সেই সব অনাবিল রূপকথা- বুদ্ধু-ভুতুম, সুখু-দুখু, নীলকমল আর লালকমল, ডালিমকুমার, সাত ভাই চম্পা, আরো কতো কতো গল্প। সাথে রইলো বাংলার প্রচলিত হাসির গল্প আর ব্রতকথা।

অন্যান্য রূপকথার গল্পের বইয়ের থেকে দক্ষিণারঞ্জনের লেখার তফাৎ কোথায়? -তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, সেটি যেন ঠিক সেই ঠাকুমা-দিদিমার মুখের ভাষা। তাঁর লেখাগুলিতে অনেক সময়েই এক শব্দের বারবার ব্যবহার পাওয়া যায়। ছেদ ও যতি চিহ্নের ব্যবহারও অন্য রকমের। যদি কেউ তাঁর লেখা গল্পগুলিকে ছেদ-যতি এবং শব্দের ব্যবহার মেনে পড়তে পারে, তাহলে ঠিক মনে হবে যেন সেই হাজার বছর আগের দিদিমাই সামনে বসে গল্পটা বলছেন।তাঁর লেখার এই বিশেষ ধরণ নিয়ে 'ঠাকুরমার ঝুলি'র সংকলনের ভূমিকায় প্রশংসা করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এই রূপকথার গল্প লেখা ছাড়াও দক্ষিণারঞ্জন আরো নানা রকমের লেখা লিখেছেন ছোটদের জন্য। তাদের মধ্যে কয়েকটি হলো 'চারু ও হারু' 'উৎপল ও রবি', বাংলার সোনার ছেলে', 'বিজ্ঞানের রূপকথা'।

আজকের দিনে বসে, তোমার কার্টুন নেটওয়ার্ক, ভিডিও গেমস আর হ্যারি পটারের তুলনায় 'ঠাকুরমার ঝুলি' একটু ধীরগতির মনে হতে পারে। কিন্তু কোন দিন যদি সত্যি আর কিচ্ছু ভালো না লাগে, তাহলে হাতে তুলে নাও এই বইটা। তুমি যদি চাও, তাহলে কিন্তু পক্ষিরাজ ঘোড়া তোমাকে পিঠে করে নিয়ে যাবে যতদূর যেতে চায় তোমার কল্পনার রাশ...
 
 
 
 
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলী, কলকাতা
মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।