পুষুর দুঃস্বপ্ন
আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। 'কি মজা, দশ-দশটা বয়ামভর্তি মধু' - নিজের অজান্তেই হাততালি দিয়ে উঠল পূষু।
বাঘা ছিল পাশেই। বললো-'হুম, খুব মজা। কিন্তু দেখিস, লালহাতিয়াটা এসে আবার রাত্তিরে সব সাবাড় না করে ফেলে।'
'সেই ভয়ংকর লালহাতিয়াটা?' - পুষু চোখ বড় বড় করে ফেললো।
'ব্যাটা এক নম্বরের লোভী' - বাঘা বললো। 'তুমি কি দেখেছো ওকে?' 'না',বাঘা বললো,'কিন্তু দেখিনি বলেই কি আর ভয়টা কমে যায় না কি? দেখতে পাচ্ছি না বলেই তো আরও সাবধান হতে হবে। ব্যাটা কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছে কে জানে?'
পুষু বললো,'আমি সাবধানেই থাকবো, তুমি চিন্তা কোরো না।'
'হুমমমমম', গরগর করলো বাঘা,' তাহলে এখন আমি চলি'।
পুষু দরজা বন্ধ করে খাটে এসে উঠলো। মস্ত বড় ফাঁকা বাড়িটায় একলা পুষু জেগে রইলো। নাক পর্যন্ত লেপ চাপা দিয়ে মিটিমিটি চেয়ে দেখতে লাগলো লালহাতিয়াটা ঢুকে পড়ে কিনা। চেয়ে থাকতে থাকতে, চেয়ে থাকতে থাকতে ঘুমে চোখ বুজে এলো পুষুর।
এমন সময়, হটাত, সারা বাড়িটা উঠলো কেঁপে, যেন ছাতের উপর বাজ পড়েছে। হুড়মুড় করে দরজা ভেঙ্গে একটা মস্ত লালহাতিয়া দুমদাম করে ঘরে ঢুকে পড়লো। থালা বাসন ঝনঝনিয়ে, পেয়ালা-পিরিচ ভেঙ্গে, বাতিদানটা উলটিয়ে ফেলে থপথপ করে সেটা এগিয়ে গেলো মধুভর্তি আলমারির দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গবগবিয়ে সাবড়ে দিলো তিনটে বয়ামভর্তি মধু।
পুষু ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেললো।
কান্নার আওয়াজে লালহাতিয়াটা ঘুরে দাঁড়ালো পুষুর দিকে।ক্যাটকেটে সবুজ রঙের ঘোলা চোখ দিয়ে কটমট করে চাইলো। সুরুত করে নীল শুঁড় বার করে পুষুর সর্বাঙ্গ শুঁকলো। 'আহা, এবার তো তোকে খাবো'। বলেই একটা খালি বয়াম পুষুর মাথায় উলটে দিলো।
ভয়ের চোটে খাট থেকে লাফ মেরে নীচে নামলো পুষু। দুহাত দিয়ে ঠেলে খুলে ফেলতে চাইলো বয়ামটা - কিন্তু বয়ামটাতো আর নেই মাথায়?! আর লালহাতিয়াটা? সেটাই বা কোথায় গেলো?
'কোথায় লুকোলো ভয়ংকরটা?' পুষুর মনে একরাশ দুশ্চিন্তা। ভয়ে খুঁজতেও পারছে না সে কোনোখানে। ভয়টাকে কোনোরকমে চাপা দিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো কচিকাঁচার বাড়ির দিকে।
'ভাইরে, বাঁচা আমাকে' হাঁপাতে হাঁপাতে বললো পুষু, কোনোরকমে। 'কি হয়েছে-এত রাতে?' ঘুমের ঘোরে দুচোখ রগড়াতে রগড়াতে শুধোলো কচিকাঁচা। 'একটা সা-সাং-ঘাতিক ল-লালহাতিয়া!' জিভ টিভ জড়িয়ে একশা পুষু তখন।
ঘুম ছুটে গেলো কচিকাঁচার। তার আর তখন ভাবার সময় কোথায়? একছুট্টে পুষুর হাত ধরে বেরিয়ে এলো সে ওই অত রাতে। ভালো করে ভেবে দেখার সময় পেলে কি আর সে একটা সাংঘাতিক লালহাতিয়ার খোঁজে এভাবে বেরিয়ে আসতো?
বাড়ির সামনে এসে হাঁক পাড়লো পুষু-'কোথায় লুকিয়েছিস রে লালহাতিয়া? বেরিয়ে আয়।'
কচিকাঁচা পুষুর দরজার কোনা থেকে ঝাঁটাটা নিয়ে বনবন করে মাথার ওপর ঘোরাতে লাগলো।
'আচ্ছা পুষু', কচিকাঁচার যেন হঠাত ঘুম ভাঙ্গলো, 'যদি সত্যিই আমরা লালহাতিয়াটাকে দেখতে পাই, তাহলে কি করবো?'
তাইতো? তাইতো? তাইতো? ভেবে কুলকিনারা পেল না পুষু। 'তারচেয়ে চল, কেষ্টদাকে ডেকে আনি', কচিকাঁচা বললো।
'সেই ভালো'- হাঁপ ছাড়লো পুষু।
কেষ্টদা তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। দুজনে মিলে ঠেলে তুললো অকে। 'পুষু', একটু যেন বিরক্ত গলায় বললো কেষ্টদা, 'তুই নিশ্চয়ই একটা যাচ্ছেতাই স্বপ্ন দেখেছিস। সত্যি সত্যি কোনো লালহাতিয়া নেই।' 'কি বলছো তুমি?' অভিমানী গলায় পুষু বললো,' ওই লালহাতিয়াটা আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। ওড় নীল শুঁড়টা দিয়ে আমাকে শুঁকছিলো। বললো আমাকে খেয়ে ফেলবে। আর তুমি বলছো সত্যি নয়?'
'ঠিক আছে', কেষ্টদা একটু নরম গলায় বললো,'তোর বাড়িতে যদি সত্যি সত্যি একটা লালহাতিয়া লুকিয়ে থাকে, তাহলে আমি আর কচিকাঁচা মিলে ওটাকে খুঁজে বার করবই।'
'আমরা? দুজনে মিলে?' ঢোঁক গিলে বললো কচিকাঁচা।
'হ্যাঁ রে ভীতুর ডিম', ধমকে বললো কেষ্টদা। 'বেশ, তাই হবে', কচিকাঁচা বললো।
সবাই মিলে লেফট-রাইট করতে করতে চললো পুষুর বাড়ির দিকে। তাড়াতেই হবে লালহাতিয়াটাকে।
বিছানার তলায় খুঁজলো। লালহাতিয়া নেই।
আয়নার পেছনে খুঁজলো। লালহাতিয়া নেই।
টেবিলক্লথ তুলে টেবিলের নীচে খুঁজলো। লালহাতিয়া নেই।
আলমারির দরজাটা খুললো। কী আশ্চর্য! দশটা বয়ামই তো থাকে থাকে সাজানো, ঠিক যেভাবে ঘুমোতে যাবার আগে সাজিয়ে রেখেছিলো পুষু।
কান চুলকোতে লাগলো পুষু। 'তাইতো, তবে ত স্বপ্নই দেখেছি। কিন্তু স্বপ্নটা বড্ড সত্যির মতো। কেন এরকম স্বপ্ন দেখলাম বলোতো ?'
'স্বপ্নগুলো মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয়', বিজ্ঞের মত বললো কেষ্টদা। 'কিন্তু সেগুলো সব মনের মধ্যে দেখা দেয়, সত্যি সত্যি নয়।'
'কিন্তু', পুষু বললো,' আমি যদি ঘুমিয়েই ছিলাম, তাহলে মনের মধ্যে লালহাতিয়াটা ঢুকে পড়লো কি করে?'
'শোন পুষু', কেষ্টদা মাস্টারমশাইয়ের মতো গলায় বললো,' রোজ রাতে তুই যখন ঘুমোতে যাস, তখন তোর শরীরটাই শুধু ঘুমোয়, মগজটার অনেকখানি জেগে থাকে।'
'আর সেই জেগে থাকা মগজটাই তখন স্বপ্ন দ্যাখে, বুঝলি?' ফুট কাটলো কচিকাঁচা।
'ঠিক তাই। এমনিতে স্বপ্নরা খুব সুন্দর হয়, আর না হলে বোকা বোকা। জেগে উঠে আর কিছু মনে থাকে না। কিন্তু তুই যদি খুব ক্লান্ত হয়ে বা চিন্তা করতে করতে ঘুমোতে যাস, তাহলে সেই বোকা বোকা স্বপ্নগুলোই বিদ্ঘুটে আর ভয়ংকর হয়ে যায়।' কেষ্টদা ভাষণ শেষ করলো।
'আসলে আমি একটু বেশিই চিন্তা করছিলাম শুতে যাওয়ার সময়ে। আর ঘুমটাও যা জোর পেয়েছে - কিন্তু-' পুষু ভাবতে ভাবতে বললো।
কচিকাঁচা জোর করে পুষুকে বিছানায় গুঁজে দিলো।
'আচ্ছা, আবার যদি আমার মগজ ঘুমের মধ্যে লালহাতিয়াটাকে ফিরিয়ে আনে?'পুষু জিজ্ঞেস করলো।
'দ্যাখ', কেষ্টদা বললো,' স্বপ্নটা তো তোর নিজের। তুই-ই ঠিক করবি তুই কি করতে চাস। যদি লালহাতিয়াটা ফিরে আসে, সোজা ওর চোখে চোখ রেখে বলবি -এইও-খবরদার - এক্ষুণি এখান থেকে চলে যা।'
'লালহাতিয়া-পালা-লালহাতিয়া-পালা-লাল-' বিড়বিড় করতে করতে পুষু আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
কচিকাঁচাকে সঙ্গে নিয়ে কেষ্টদা নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো।
এমন সময়ে, হঠাত, আবার সারা বাড়িটা উঠলো কেঁপে, যেন ছাদের ওপর বাজ পড়েছে। একটা মস্ত লালহাতিয়া থপথপ করে করে এসে দাঁড়ালো পুষুর বিছানার পাশে। 'হো হো'। চেঁচিয়ে উঠলো লালহাতিয়াটা।
'লালহাতিয়া -পালা-লালহাতিয়া-পালা-লালহা-'কোনরকমে বলতে পারলো পুষু।
লালহাতিয়াটা একটু ঘাবড়ে গেলো।'মানে?' শুধোলো সে।
'এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাও।' কড়া গলায় বললো পুষু।
লালহাতিয়াটা কেমন যেন হয়ে গেলো। ওর শুঁড়ের আগায় ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপতে লাগলো। ওর চোখদুটো ভরে এলো জলে।
'কি হলো?' পুষু জিজ্ঞেস করলো অবাক হয়ে।
'আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটু জলখাবার খুঁজতে এসেছিলাম। আর তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো?' ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেললো লালহাতিয়া।
পুষুর মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেলো। ঈশ, বেচারার খিদে পেয়েছে, আর সে কি না এমন চটেমটে কথা বললো ওর সঙ্গে?
'আমারও না কেমন খিদে খিদে পাচ্ছে', পুষু বললো,' একটু মধু খাবে নাকি আমার সঙ্গে?'
পুষু ওর ছোট্ট চেয়ারে বসতে দিলো লালহাতিয়াকে। অতবড় লালহাতিয়াটাকে ওইটুকু চেয়ারে কি মজার দেখাচ্ছিলো।কিন্তু সে ব্যাটার অ্যায়সা খিদে পেয়েছিল যে ও এসব খেয়ালই করেনি।
মধুর বয়াম চেটেপুটে শেষ করতে করতে এবার পুষু আর লালহাতিয়া দুজনে মিলে একটা চমতকার সুন্দর স্বপ্ন দেখলো।
পার্থ দাশগুপ্ত
গড়িয়া, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন পার্থ দাশগুপ্ত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
এক্সট্রা
স্কুলের সামনের মাঠে জোর ফুটবল খেলা চলছে দু’দলের – তুবড়ি ভার্সেস রকেট। সাইড লাইনের পাশে গালে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে আছে রাজু। খুব মন খারাপ তার। তাকে কেউ খেলতে নেয় না। একমাত্র যদি কেউ চোট পেয়ে মাঠের বাইরে বেরিয়ে আসে তখন ওর ডাক পড়তে পারে। কিম্বা হঠাৎ যদি বল মাঠের বাইরে অনেক দূরে চলে যায় তো বড় দাদারা বলতে পারে – ‘যা এক্সট্রা, বলটা কুড়িয়ে নিয়ে আয়।’ তখন একটু বলটা ছোঁয়ার সুযোগ পাবে। এছাড়া আজকের মত রোজ রোজ সারা টিফিন টাইম বলের দিকে তাকিয়ে চাতক পাখির মত বসে থাকা। বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে যায় এক একদিন।
হঠাৎ একটা বল জোরে শট মারল ক্লাস এইটের মানস। লাফাতে লাফাতে বলটা ঢুকে গেল পশ্চিমের বাগানে। আর সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল – ‘এক্সট্রা, বলটা নিয়ে আয়।’
‘সমীর কে বলো।’
‘তুই যাবি কি যাবি না। না গেলে কিন্তু আর খেলতে পাবি না।’
ইচ্ছে ছিল না একটুও। কিন্তু খেলতে পাওয়ার লোভে হাঁটা দিল রাজু। মাঠের পশ্চিম দিকের এই বাগানটা রায়দের। বেশ বড়সড় একটা জঙ্গল যেন। সেই বাগানের মাঝখানে রায়দের একটা অনেক পুরনো পোড়ো বাড়ি আছে। কেউ কত কাল সেখানে বাস করেনা কে জানে। বাড়িটার দিকে তাকালেও কেমন একটা গা ছম ছমে ভয় করে রাজুর। আজও বুক ঢিপ ঢিপ করছে। তাও এগোচ্ছে সে।
বাগানের ভারী লোহার গেটটা খুলতে বাঁ হাত ঠেকালো। কিন্তু বেশী জোর দেওয়ার আগেই একটা বিশ্রী ক্যাঁ-চ আওয়াজ করে গেটটা খুলে গেল। মাথা নিচু করে ঢুকে যায় রাজু। কোনভাবেই বাড়িটার দিকে চোখ পড়ে যায় ও চায় না। ভেতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় যেখানে বলটা পড়েছিল। কিচ্ছু চোখে পড়ে না। আতিপাতি করে খুঁজতে থাকে। মাঠ থেকে উঁচু ক্লাসের দাদাদের নির্দেশ আসে – ‘ঐ যে কয়েত বেলের গাছটার তলায় দ্যাখ। ’
রাজু দেখল। কিচ্ছু নেই। কয়েত বেল, সবেদা গাছ, আম গাছ সব মিলিয়ে বন হয়ে আছে। নীচটায় বিস্তর ঘন ঝোপ। সেখানে অনেক বিছুটি গাছ। গায়ে লেগে গেলেই এমন কুটকুট করবে। সাবধানে এগোয় রাজু। এপাশে বড় গাছগুলোর গায়ে ইয়া বিশাল বিশাল মাকড়সার ফাঁদ আর তাতে বড় বড় লোমশ মাকড়সা ফাঁদ পেতে রয়েছে। কে জানে এদের মধ্যে কেউ টারান্টুলার বংশধর কিনা। যদি একটা কামড়ায় তাহলে স্পাইডার ম্যান হয়ে যেতে পারে ও। তখন আর কোন কিছু ভয় পাবে না রাজু। নানা রকম ভাবতে ভাবতে ও এগোতে থাকে। হঠাৎ পা পিছলে যায়।
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যেতে থাকে। কি জানি কতক্ষণ একটা অন্ধকার সুরঙ্গ বেয়ে ও পড়ছিল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। ওর রোগা পটকা শরীরটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল চোখের চশমাটা বুঝি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। তারপর এক সময় ধপাস করে পড়ল কোথাও। চোখ খুলে দেখে একটা সবুজ আলো চারিদিকে। কিছুতেই রাজু বুঝতে পারছে না এ কোথায় এসে পড়ল। কোথা থেকেই বা সবুজ আলোটা আসছে। তারপরে খেয়াল হল রাজুর বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের পাশে যে এক্সট্রা আঙ্গুলটা আছে সেই আঙ্গুলের নখটা থেকে সবুজ আলো ঠিকরে বেরচ্ছে। রাজু এত অবাক হল যে ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এই আঙ্গুলটার ওপর ওর এতদিন ভীষন রাগ ছিল – একে তো আঙ্গুলটা কোন কাজের নয় তার ওপরে ক্লাসে এটার জন্যে সবাই ওকে আলাদা করে রাখে। স্কুলের ছোট বড় সবাই ঐ এক্সট্রা আঙ্গুলের জন্যে ওকে ‘এক্সট্রা’ বলে ডাকে। একদিন এত দুঃখ হয়েছিল যে মাকে রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেছিল যে ডাক্তার কাকুকে বলে আঙ্গুলটা কেটে বাদ দিয়ে দিতে। মা বলল, ‘ভগবান যখন এটা দিয়েছে তোকে তখন নিশ্চয় কোন একটা ভালো উদ্দেশ্য আছে। বড় হলে একদিন ঠিক বুঝতে পারবি’। এখন মনে মনে রাজু ধন্যবাদ দেয় মাকে। ভাগ্যিস এটা মা বাদ দিতে দেয়নি। তাই এই অন্ধকারে একটু আলো দেখা যাচ্ছে। না হলে বুঝতেই পারত না কোন দিকে যাবে।
হাল্কা সবুজ আলোর মধ্যে দেখল একটা দরজা। ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তক্ষুনি দরজাটা ম্যাজিকের মত খুলে গেল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখে একটা অন্য পৃথিবী। জ্যোৎস্নার মত নরম আলো চারিদিকে। সেই আলোতে সব কিছু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে সে। একটুও ভয় করছে না ওর। ও ঘুরে ঘুরে চারিদিক দেখলো। যতদূর চোখে পড়ে মনে হল কেমন উঁচু নিচু পাহাড়ি জায়গা। চারিদিকে অনেক সরু সরু বাঁশ গাছের জঙ্গল। মাঝে মাঝে জলা জায়গা। কিছু বড় বড় আকাশ ছোঁয়া লম্বা মোটা মোটা গাছ। সেই রকম একটা গাছের গুঁড়ির মধ্যের এক কোটর থেকে একটা অন্য রকম আওয়াজ পেয়ে উঁকি মারে রাজু। দেখে কিছু অদ্ভুত দর্শন ছোট ছোট সাইজের প্রানী। তিনটে বাচ্চা মা-এর গা ঘেঁসে ঘুমাচ্ছে আর মা প্রানীটা কি সব আওয়াজ করছে । ওকে দেখেই মা প্রানীটা উঠে বসল। ডাক দিল ওর বন্ধুদের–‘দ্যাখো এসে গেছে আমাদের বন্ধু। তোমরা যে যে দেখা করতে চাও চলে এসো তাড়াতাড়ি।’
মুহুর্তের মধ্যে বাঁশ বন আর জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো শয়ে শয়ে সেই অদ্ভুত দর্শন প্রানী। বিড়ালের থেকে একটু বড় আকারের। প্রায় সবার গায়ের রঙ লালচে কমলা ঘেঁষা। পা গুলো কালো। মুখে, চোখে, কানে সাদা ছোপ ছোপ। কেউ কেউ তাদের পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে খানিকক্ষন। মোটা লোমশ লেজ। ডগায় গোল গোল দাগ। সবাই এসে ওকে ঘিরে ধরল। বলল, ‘সুস্বাগাতম বন্ধু। আমাদের দেশ তোমার কেমন লাগছে?’
‘বেশ ভালো লাগছে।’
ওদের কথার উত্তর দিয়ে রাজু নিজেই চমকে গেল খুব। ও কী করে এই সব প্রানীদের ভাষা বুঝতে পারছে? আর কথাও বলতে পারছে? রাজু জিজ্ঞাসা করে – ‘তোমরা কি আমাকে চেন? তোমরা কে? আমি কখনো তোমাদের মত প্রানী দেখিনি।’
তখন একজন খুব বয়স্ক প্রানী ঐ ভীড় ঠেলে এগিয়ে এলো। ওকে বলল সামনের উঁচু জায়গাটায় উঠে যেতে। রাজু উঠে গিয়ে একটা ঢিপিতে বসে। বয়স্ক প্রানীটাও উঠে গিয়ে পাশে বসে। বলতে শুরু করে –
‘আমরা লাল পান্ডার বংশধর। এই পান্ডা রাজ্যে আমি রাজা। এদের ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। কিন্তু সম্প্রতি আমরা একটা বিপদে পড়েছি। তুমি আমাদের সাহায্য করলে আমরা সেই বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারি।’
‘আমি? আমি কি করে তোমাদের সাহায্য করব?’
‘তুমি কি খেয়াল করেছ যে তোমার হাতেও ছটা আঙ্গুল আছে আমাদের মত। যে সব মানুষের হাতে আমাদের মত ছটা আঙ্গুল থাকে তাদের বিশেষ ক্ষমতা থাকে। তারা আমাদের দেশে এলে আমাদের ভাষা বুঝতে পারে। তারা আমাদের দেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওই ছ’নম্বর আঙ্গুলের নখ থেকে সবুজ আলো বেরোয়। আর আমাদেরও ছ’নম্বর আঙ্গুলের নখ থেকে সবুজ আলো বেরোয়। তাতে আমরা বুঝতে পারি আমাদের এক বন্ধু এসেছে এই দেশে।’
রাজু খেয়াল করল সত্যি ওদের সবার হাতে ছটা আঙ্গুল। আর সেই এক্সট্রা আঙ্গুলের নখ দিয়ে ওর মতই হাল্কা সবুজ আলো বেরচ্ছে।
ও বলল, ‘আমি তোমাদের জন্যে কিছু করতে পারলে খুব খুশী হব। বল কি রকম সাহায্য চাও তোমরা।’
‘বলব সব। আগে তুমি কিছু খেয়ে নাও। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোমার খুব খিদে পেয়েছে।’
সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিল রাজুর । ওরা অনেক ফল আর নরম নরম হাল্কা সবুজ ছোট কাঠির মত কিছু এনে দিল। ও অবাক হয়ে ভাবল এগুলো কি খাওয়া যাবে। তাও মুখে পুরল একটা। আহা কী সুন্দর নরম মিষ্টি খেতে সবুজ কাঠি গুলো। ফল গুলোও খুব সুস্বাদু। সব খাবার এক নিমেষে শেষ করে ফেলল। তার পর উঠে গিয়ে ঝর্নার জল খেল।
তখন পান্ডা রাজা বলল চলো দেখবে চলো। ওকে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল ওদের দেশ। মা পান্ডারা কেমন কাঠি আর পাতা দিয়ে গাছের কোটরে বাসা বেঁধেছে। ছোট পাণ্ডা গুলোর গায়ে তেমন লোম নেই। কিছু ছোট পান্ডার গলায় আর লেজে কেমন ঘা মতো হয়েছে।
তাই দেখে রাজু বলল -‘পান্ডা রাজা, ওদের গায়ে ঘা কেন?’
‘বন্ধু, ওটাই ওদের অসুখ। বেশ কিছু বছর ধরে ছোট ছোট পান্ডার এই অসুখ হচ্ছে। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওরা মরে যাচ্ছে। তাই পান্ডাদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই ভাবে চললে আর কয়েক বছর পরে লাল পান্ডা বিলুপ্ত হয়ে যাবে । তুমি যদি কোনভাবে এর ওষুধ এনে দিতে পারো তাহলে আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব তোমার কাছে।’
‘আমি চেষ্টা করব। কিন্তু কি করে বুঝবো যে কোন ওষুধে তোমাদের এই অসুখটা সত্যিই সারবে?’
পান্ডা রাজা খানিকক্ষন ভাবল। তারপর একটা খুব ছোট্ট বাচ্চা পান্ডাকে ডাকল। বলল – ‘এর নাম ভিন্ডি। এর মা বাবা কেউ নেই। সবাই এই অসুখে মারা গেছে। এরও গায়ে ঘা হয়েছে। একে তুমি সঙ্গে নিয়ে যাও। কোন ওষুধের সন্ধান পেলে সেটা আগে এর গায়ে লাগিয়ে দেখবে। যদি এর ঘা সেরে যায় তাহলে বুঝতে পারবে তুমি ঠিক ওষুধ খুঁজে পেয়েছ। তখন বেশী করে ঐ ওষুধ নিয়ে ভিন্ডিকে সঙ্গে করে এখানে এস। আমরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।’
সঙ্গে সঙ্গে খুশী মনে ভিন্ডি লাফিয়ে ওর গায়ে উঠে ওর ঢোলা প্যান্টের পকেটে ঢুকে পড়ল।
‘কিন্তু এখানে আবার আসব কি করে?’
‘কেন? যে ভাবে এসেছ সে ভাবেই। বাগানের গেটের লোহার দরজাটায় তোমার এক্সট্রা আঙ্গুলটা ঠেকাবে আর সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে যাবে। তারপরে সবেদা গাছের নীচে আসবে। বিছুটি গাছ বাঁচিয়ে ডান দিকে হেঁটে আসবে। যেখানে অনেক লাল লাল ছোট ছোট ফলের গাছ আছে। তার ফুল গুলো দেখবে উলটানো কলসির মত। ওখানে এসে দাঁড়ালেই তুমি এখানে এসে পৌঁছে যাবে।’
‘আচ্ছা। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব পান্ডা রাজা।’
পান্ডা রাজা তখন ওকে পাহাড়ের এক গুহাতে নিয়ে গেল। সেখান একটা বিশাল গর্ত দেখিয়ে বলল – ‘এই গর্ত দিয়ে গড়িয়ে যাও। যেখানে ছিলে সেখানে পৌঁছে যাবে।’
রাজু সবাই কে বিদায় জানিয়ে সেই গর্তে ঢুকে পড়ল। এইবার আর ওর ভয় করল না। নখ থেকে বেরনো আলোতে ও সুরঙ্গটা বেশ ভাল দেখতে পাচ্ছিল। একটুও তালগোল পাকালো না শরীরটা। বেশ স্লিপে চড়ার মত করে নেমে এল আস্তে আস্তে।
বেরিয়েই দেখে সবেদা গাছটা আর তার নীচে সেই লাল ফলের গাছটা। তার ফুল গুলো সত্যি উলটানো কলসির মত। সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজল ঢং ঢং করে। এক ছুটে রাজু ঢুকে গেল স্কুলে। ক্লাসে সারাক্ষণ খুব সাবধানে নড়াচড়া করল। সিট থেকে একবারো উঠলো না। কেউ যদি দেখে ফেলে পকেটের ভিন্ডিকে। পাশে বসে অরিত্র ফিসফিস করে জিগ্যেস করল – ‘তুই বাগানে ঢুকে কোথায় ভ্যানিস করে গেলি? শেষে মিহিরদা গিয়ে বলটা কুড়িয়ে আনল।’
‘আমি ওই দিকে কটা পাকা সবেদা পড়েছিল সেগুলো কুড়োতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সবগুলো পাখিতে খাওয়া বিচ্ছিরি।’
২
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় স্কুল বাস থেকে নেমে বাড়ি না ঢুকে সোজা বাড়ির কাছের একটা পার্কে গেল রাজু। সেখানে গিয়ে একটা বড় ঝাউ গাছের আড়ালে বসল। টিফিনটা খাওয়ার সময় হয়নি আজ। মা দেখলে বকবে। টিফিনটা ভিন্ডির সঙ্গে ভাগাভাগি করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে হবে। তাছাড়া ভিন্ডির সঙ্গে অনেক আলোচনাও আছে। কী ভাবে ওষুধ খুঁজবে তার কোন আইডিয়া আসছে না মাথায়।
পকেটে হাত দিয়ে ভিন্ডিকে বার করতে যায় রাজু । দেখে কিচ্ছু নেই। পকেট ফাঁকা। কোথায় গেল। পকেটেই তো ছিল। মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় রাজুর। তখন ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কুঁই কুঁই শব্দ পায়। তাড়াতাড়ি ব্যাগ খোলে। দ্যাখে ব্যাগের ভেতরে ভিন্ডির চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।
‘আরে ভিন্ডি। তোকে না দেখতে পেয়ে আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘স্কুলে অনেক ছেলে দেখে ভয় পেয়ে তোমার ব্যাগে ঢুকে পড়েছিলাম।’
ভিন্ডি ওর গা ঘেঁষে বসে। দুজনে মিলে ভাগ করে টিফিন খায় আর গল্প করে।
টিফিন খাওয়া শেষ হলে রাজু ভিন্ডিকে জিজ্ঞেস করে - ‘কী করে জানা যায় বলতো কী ওষুধে তুই ভালো হবি?’
ভিন্ডি বলে - ‘দেখি ঐ হুলো বিড়ালটা কিছু জানে কিনা। চলো ওকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি।’
দুজনে যায় হুলো বিড়ালের কাছে। ‘বিড়াল ভাই, বিড়াল ভাই, তোমার একটু সাহায্য খুব দরকার।’
হুলো বিড়ালটা পেট ভরে খেয়ে সবে একটা হাসনুহানার ঝোপের মধ্যে একটু ঘুমাচ্ছিল। রেগে গিয়ে বলে –
‘বিরক্ত কোরো না এখন। দেখছ না ঘুমাচ্ছি।’
‘তুমি না সাহায্য করলে আমি বাঁচব না। দেখো আমায় গা। কেমন সব লোম উঠে যাচ্ছে। তুমি এর ওষুধ জানো?’ ভিন্ডি নিজের গা দেখায়। হুলো বেড়াল তখন সামনের ডান পা দিয়ে চোখ রগড়ে উঠে বসল। বলল –
‘আমি কী আর জানি? তবে ঐ কাঠবিড়ালীটা জানতে পারে। চলো ওর কাছে যাই তিনজনে।’
পার্কের এক কোনে এক ঝাঁকড়া কাঠবাদাম গাছের নীচে কাঠবিড়ালীটা তখন ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজছিল। ওরা কাছে গিয়ে বলল – ‘কাঠবিড়ালী, একটু দাঁড়াও ভাই। আমাদের কিছু কথা বলার আছে।’
‘আমি খাবার জোগাড় করায় খুব ব্যাস্ত আছি। দেখতে পাচ্ছ না?’
‘আমরা তোমায় বাদাম কুড়িয়ে দিই যদি?’
‘না না সে তোমরা পারবে না। আচ্ছা বলো কি দরকার।’
সব শুনে কাঠবিড়ালী বলে – ‘আমি এসবের খবর রাখিনা। চলো দেখি ঐ কাঠঠোকরাটা জানে কিনা।’
কাঠঠোকরাটা একমনে গাছের গুঁড়িতে ঠক ঠক করে গর্ত করে পোকা ধরে খাচ্ছিল। সে বিরক্ত না হয়ে সব মন দিয়ে শুনল। তারপর বলল – ‘কাকেরা খুব বুদ্ধিমান হয়। কাকগুলো জানলেও জানতে পারে। চলো সবাই মিলে ওদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করি।’
সবাই মিলে যায় কাকেদের কাছে। এক ঝাঁক কাক বট গাছের মাথায় বসে গল্প গুজব করছিল। তারা সব শুনে ভয়ানক জোরে কা কা করে সবাই কে জানিয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করে - ‘কেউ কি জানো এর ওষুধ?’
এক কাক বলে – ‘একজন জানতে পারে। হুতুম প্যাঁচা। খুব জ্ঞানী আর অনেক বয়স তার। পার্কের পেছন দিকে একটা অর্জুন গাছ আছে। তার কোঠরে সে থাকে । ওর কাছে যাও।’
সবাই মিলে গেল প্যাঁচার কাছে। প্যাঁচা শুনলো খুব গম্ভীর হয়ে। তারপরে বলল – ‘জটিল সমস্যা। আমি পাখিদের অসুখের ওষুধ জানি। কিন্তু জন্তু জানোয়ারদের অসুখের সম্বন্ধে খুব বেশি জানিনা। তবে একটা গোপন খবর দিতে পারি। প্রত্যেক অমাবস্যার রাত্রে এই পার্কে জন্ত জানোয়ারদের সভা হয়। তারা তাদের সুবিধে অসুবিধে নিয়ে আলাপ আলোচনা করে। অনেক জ্ঞানী গুনী জন্তু জানোয়াররা আসে। তোমরা সেই সময় এসে কথা বলে দেখতে পার।’
‘এ তো দারুন ব্যাপার। ঠিক আছে তাই আসব। এমন সুযোগ হারানো যাবে না।’
‘তবে সভা শুরু হয় অনেক রাত্রে। সভায় সভাপতি থাকে এক শেয়াল। সে তিনবার হুক্কা হুয়া বলে ডাকে। তারপরে শুরু হয় আলোচনা। তোমরা এই আওয়াজটা শুনতে পেলেই পার্কে চলে আসবে। ঘুমিয়ে পড়ো না যেন।’
রাজু আর ভিন্ডি প্যাঁচা, কাঠঠোকরা, কাঠবিড়ালী, হুলোবিড়াল আর সব কাকেদের কে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি এসে দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা দেখল ভালো করে। আর মাত্র দুদিন পরেই অমাবস্যা। ঠিক করল প্যাঁচার কথা মতো ওরা সেই দিন পার্কে যাবে।
৩
অমবস্যার দিন রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাজু আর ভিন্ডি দুজনে জেগে বসে রইল বিছানায়। ঘরের একটা জানলা খুলে রাখল যাতে শিয়ালের ডাক শুনতে পায়। এপাশে রাত বাড়তে থাকে। ঘুমে চোখ বুজে আসছে রাজুর। মাঝেমাঝেই ঘুমিয়ে ঝুঁকে পড়ে যাচ্ছে ভিন্ডির গায়ে। ভিন্ডির চোখে ঘুম নেই। বসে বসে চীনা বাদামের খোলা কড়মড় করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাদাম খাচ্ছে সে। রাজু উপায় না দেখে ভিন্ডির মতো চীনাবাদাম খেতে শুরু করল। হঠাৎ হুক্কাহুয়া ডাকে চমকে গেল রাজু। তারপর গুনে গুনে ঠিক তিনবার হুক্কা হুয়া ডাক দিয়ে থেমে গেল শেয়ালটা। তখন চুপিচুপি দুজনে বেরল বাড়ি থেকে। রাজুর হাতে একটা টর্চ। রাস্তা খুব অন্ধকার। দেখল রাস্তায় কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, খরগোস, হনুমান, কাঠবিড়ালী আরো কত রকমের প্রানী। সবাই চলেছে পার্কের দিকে। অন্যদিন হলে রাজু এত রাত্রে বাড়ির বাইরে বেরোনার কথা ভাবতেই পারত না। কিন্তু আজ সব কিছু অন্যরকম।
পার্কের কাছে পৌঁছতেই দেখল দুটো ভয়ংকর দেখতে বিশাল চেহারার কুকুর গেটে পাহারা দিচ্ছে। তারা প্রথমে রাজুকে ঢুকতে কিছুতেই অনুমতি দিচ্ছিল না। তারপর ভিন্ডি ওদের অনেক করে বোঝালো যে রাজু ওর বন্ধু। রাজু সাহায্য করেছে বলেই আজ ও এখানে আসতে পেরেছে। তখন কুকুর দুটো নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলে নিল। তারপর বলল –‘একমাত্র একটা শর্তে ঢোকার অনুমতি দিতে পারি। ভেতরে গিয়ে একটা কথাও বলা চলবে না রাজুর।’
সেই শর্ত মেনে নিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকলো। দেখল সভা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ভেতরের বড় ফুটবল খেলার জায়গাটায় গোল হয়ে সবাই বসে আছে। আশে পাশের গাছের কোন ডালও খালি নেই। কয়েক শো প্রানী। রাজু সবার নাম ও জানে না। কারো কারো ছবি দেখেছে শুধু। একজন মোটাসোটা বয়স্ক শেয়াল মাঝখানে বসে কিছু বলছে। রাজু আর ভিন্ডি গিয়ে সামনের দিকে বসল। সবাই ওদের দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে।
ভিন্ডি বলল – ‘চিন্তা করোনা। ওরা এই সভায় কোন দিন কোন মানুষকে আসতে দেখেনি। তাই খুব অবাক হয়েছে।‘
শেয়ালটা নিজের বক্তব্য শেষ করেই ভিন্ডিকে ডাকল। ভিন্ডি গিয়ে সব কথা বলল। শিয়ালটা আরো কয়েকটা শেয়ালের সঙ্গে আলোচনা করে নিল। তারপর বলল - ‘নিম।’
ভিন্ডি বলল – ‘নিম?’
শিয়ালটা বলল – ‘নিম গাছ খুব উপকারী। নিমের গাছের পাতা, ফল, ফুল, ছাল থেকে অনেক রকম ওষুধ তৈরী হয়। তোমরা কি জানো আফ্রিকাতে নিম গাছকে বলে মারোবাইনি। যার মানে এমন গাছ যা চল্লিশটা অসুখ সারাতে পারে। যাও গায়ে নিম পাতার রস গায়ে লাগাও। আর রোজ দু চারটে করে নিম পাতা চিবিয়ে খাও। সব অসুখ সেরে যাবে।’
রাজু শুনে খুব খুশী হল। এত সোজা ওষুধ। নিম গাছ তো অনেক আছে। পার্কের মধ্যেই আছে বেশ কয়েকটা। শেয়ালকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে এল ওরা।
পরদিন সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে পুকুরের ধারের নিম গাছ থেকে এক মুঠো কচি পাতা তুলে আনে রাজু । দু হাতের চেটোর মাঝে নিম পাতা রেখে থেঁতলে রস বার করে লাগিয়ে দেয় ভিন্ডির গায়ে। দুটো পাতা ওর মুখে দিয়ে বলে – ‘নে, চিবিয়ে খেয়ে নে।’
ভিন্ডি নিম পাতা চিবিয়ে তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে - ‘ইস কী বিচ্ছিরি তেতো খেতে।’
‘কিন্তু খুব উপকারী। এটাই তোর ওষুধ। লাফাস না। খেয়ে ফেল।’
এই ওষুধ চলল রোজ। তিনদিনের দিন পুরো সেরে গেল ভিন্ডির অসুখ। তাই দেখে রাজু আর ভিন্ডির খুশির সীমা রইল না।
পরদিন সকালে স্কুল যাওয়ার সময় রাজু একটা বড় প্যাকেট ভর্তি নিম পাতা আর একটা বড় প্যাকেট ভর্তি নিমের ফল ঢুকিয়ে নিল ব্যাগে। ভিন্ডিকে পুরে নিল প্যান্টের পকেটে। তারপর স্কুলের টিফিনের সময় সবাই যখন খেলায় ব্যাস্ত, তখন চুপি চুপি ঢুকলো রায় বাগানে। গেটে ওর এক্সট্রা আঙ্গুলটা ঠেকাতেই খুলে গেল দরজা। তারপর এসে দাঁড়ালো সবেদা গাছের তলায় সেই লাল ফলের গাছটার কাছে। আর সঙ্গে সঙ্গে হুস করে ঢুকে গেল সুড়ঙ্গে। সবুজ আলো বেরতে থাকল ওর আর ভিন্ডির নখ থেকে।
ওকে আর ভিন্ডিকে দেখে পান্ডা রাজা আর তার দেশের সবাই খুব খুশী হল। ভিন্ডির অসুখ সেরে গেছে দেখে ওদের চোখ গুলো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো। ও নিম পাতার প্যাকেটটা দিল পান্ডা রাজা কে। আর জলা জায়গার চারপাশে ছড়িয়ে দিল সব নিম গাছের ফল। বলে দিলো – ‘এই ফলগুলো থেকে গাছ জন্মাবে। গাছ একটু বড় হলে পাতা তুলে পাতার রস লাগাবে গায়ে। আর রোজ দুটো একটা পাতা তুলে খাবে। যখন ফল ধরবে এই গাছে পাকা ফল ঝরে ঝরে পড়বে, তখন সেই ফল নিয়ে গিয়ে ফেলে দিও সব জলা জায়গার আশে পাশে। এইভাবে একদিন এই গাছ পান্ডা রাজ্যের চারিদিকে ছেয়ে যাবে। তোমাদের কোন দিন আর পাতার অভাব হবে না। আর অসুখও হবে না।’
সবাই খুব খুশি হল। ওকে অনেক ধন্যবাদ জানালো। বলল মাঝে মাঝে ঘুরে যেতে পান্ডা রাজ্যে।
কাজ সেরে রাজু ফিরে এলো স্কুলে। খুব মন কেমন করতে লাগল ভিন্ডির জন্যে। কদিনে বেশ বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে মন খারাপ করে বসে রইল রাজু। আর ঠিক তখনই পকেট থেকে ভিন্ডি বেরিয়ে টেবিলে উঠে বলে – ‘তোমার মনখারাপ কেন?’
‘আরে, তুই কোথা থেকে এলি?’
‘আমি তো পালিয়ে এসেছি এখানে তোমার সঙ্গে থাকব বলে।’
‘কিন্তু পান্ডা রাজা জানতে পারলে খুব দুঃখ পাবে। রেগেও যাবে হয়তো।’
‘আমি পান্ডা রাজাকে বলেই এসেছি। এখন চলো দুজনে পার্কে গিয়ে একটু খেলে আসি। আর কাঠবিড়ালী, প্যাঁচা, কাঠঠোকরা, হুলো বিড়ালদের সঙ্গে দেখা করে আসি।’
রাজু আর ভিন্ডি দুই বন্ধুতে দারুন সময় কাটে এখন। ভিন্ডি বাঁশ তেমন খেতে পায় না। কিন্তু নানা রকম ফল, বাদাম, মুরগীর ডিম আর পোকামাকড় খেয়ে দিব্যি খুশীতে আছে। দিনের বেলা রাজু স্কুলে গেলে ভিন্ডি অনেক ঘুমায় আর বিকেলে রাজু স্কুল থেকে ফিরলে সারাক্ষন রাজুর সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। রাত্রেও জেগে থাকে অনেক্ষন। এখনো রাত জাগা অভ্যেসটা যায়নি। সময় পেলে ওরা মাঝে মাঝেই ঘুরে আসে পান্ডা রাজ্যে। তখন পেট ভরে বাঁশ খেয়ে আসে ভিন্ডি। রাজুকে এখন কেউ এক্সট্রা বলে ডাকলে আর দুঃখ হয়না ওর। ওরা তো কেউ জানেনা ওর লুকোন ক্ষমতাটা।
রুচিরা
বেইজিং, চীন
- বিস্তারিত
- লিখেছেন রুচিরা
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
টিয়াপাখিদের দেশে
ভাবো তুমি দাঁড়িয়ে আছ আর তোমার পাশে হঠাত একটা টিয়াপাখি উড়ে এসে বসল। তুমি ভাবছ সেটা আর এমন কি কথা? কথাটা হল - পাখিটা তিন ফুটের বেশি লম্বা!!-মানে হতে পারে তোমারই সমান লম্বা!!গায়ে উজ্জ্বল লাল-হলুদ আরে নীল রঙের পালক। আমার পাশে যখন এত বড় একটা পাখি উড়ে এল, আমি তো চমকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার যোগাড়! তারপর অবাক হয়ে পাখিটার রঙের বাহার দেখতে থাকলাম। এই পাখিটার নাম স্কারলেট ম্যাকাও। এরা মধ্য ও দক্ষিন আমেরিকার বাসিন্দা।
স্কারলেট ম্যাকাও -উজ্জ্বল লাল, আকাশী নীল রঙের পালক
ভাবতে অবাক লাগে এদের গায়ের এত রঙের বাহার এল কোথা থেকে! পাখিগুলো রীতিমত পাখিদের স্কুলে পড়া -শিক্ষিত, প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। স্কুলে পাখিগুলোকে শেখান হয়েছে কি ভাবে মানুষের সাথে মেলা মেশা করতে হয়। এরা মজার খেলাও দেখাতে পারে। পাখিদের মধ্যে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা হলে স্কারলেট ম্যাকাও সেরা পছন্দের মধ্যে একজন হবেই হবে।
স্কারলেট ম্যাকাও খাবার নিচ্ছে আমার বন্ধু প্রদীপের হাত থেকে
কি, কেমন আছ? আগের সংখ্যায় আমরা গেছিলাম যেখানে প্রাকৃতিক বিস্ময় আছে। আজ এসেছি যেখানে শুধু অনেক ধরনের টিয়া পাখি আছে!জায়গাটার নাম প্যারট জাঙ্গল - স্থান- মিয়ামি, ফ্লোরিডা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এই জায়গাটা হল চুটিয়ে মজা করার জায়গা। জায়গাটা ফ্লোরিডা তে একটা দ্বীপের মধ্যে। সেখানে এই পাখিরা খাঁচার মধ্যে নয়, খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ায়। সেই ১৯৩৬ সাল থেকে শুরু। অস্ট্রিয়ার ফ্রানজ শের এর স্বপ্ন ছিল এমন একটা জায়গা বানানোর, যেখানে পাখিরা খাঁচায় নয়, খোলা আকাশের নিচে থাকবে।ওনার পরিবারের লোকেরা এই ভাবনাকে হেসে উড়িয়ে দেয়। তারা বলে যে পাখিরা সব উড়ে চলে যাবে। দমে না গিয়ে ফ্রানজ শের ২৫ টা পাখি নিয়ে শুরু করেন প্যারট জাঙ্গল। এখন এখানে ১১০০ ক্রান্তীয় পাখি আর ২০০০ ধরনের গাছপালা আছে। সত্যি, একজন মানুষ নিজের মনের জোরে এগিয়ে গেলে কত কি করতে পারে!
দ্বীপে ঢুকলেই চোখে পড়বে রং-বেরঙ্গের টিয়াপাখি। পাখিদের কলরবে কান ঝালাপালা হওয়ার যোগাড়। অধিকাংশ পাখি আবার কথা বলতে পারে। সামনেই একটা বড় স্কারলেট ম্যাকাও এর সিমেন্টের মূর্তি বসান আছে। জায়গাটা সবুজ গাছপালা, অর্কিড, আর জানা-অজানা পশু-পাখিতে ভর্তি। চিড়িয়াখানাই বলা যায়। কিন্তু এইখানে সব ধরনের পশু পাখি নেই যা চিড়িয়াখানায় থাকে।
স্কারলেট এর লাল রঙ থেকে চোখ ফেরালেই এবারে নীল সোনা রঙের টিয়াপাখি। নাম ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও। এদের পিঠের রঙ শরতকালের আকাশের মত নীল, আর পেটের দিকের রঙ উজ্জ্বল সোনার মত হলুদ।
ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও-পিঠের রঙ নীল আর বুকের পালক হলুদ
সবচেয়ে অবাক করা কথা হল, লজ্জা পেলে বা রেগে গেলে, এই পাখিদের গালের রঙ বদলে যায়!! ভাবা যায়!!ঠিক যেন মানুষের মত। এরাও লম্বায় প্রায় আড়াই ফুট হয়। এরাও মধ্যে এবং দক্ষিন আমেরিকার বাসিন্দা। এরা সবসময় দল বেঁধে থাকতে ভালবাসে। একা থাকতে একদম পছন্দ করে না। এরা মানুষের গলা ভাল নকল করতে পারে। এদের কাছে গিয়ে কথা বললেই এরা সহজেই কথা বলে।
নারকেল কিনতে যাই চল এবার। দোকানের একপাশে একটা নীল রঙের বেশ বড়সড় টিয়াপাখি রাখা আছে। তুমি ভাবছ এখানে টিয়াপাখি কেন? তুমি বললে নারকেলটা ভেঙ্গে দিতে। দোকানদার নারকেলটা নিয়ে পাখিটার দিকে এগিয়ে গেল। তুমি অবাক হয়ে ভাবছ- হচ্ছেটা কি? তারপর অবাক হয়ে দেখলে টিয়াপাখিটা এক চঞ্চুর ধাক্কায় নারকেলটা ফাটিয়ে দিল!!
হায়াসিন্থ ম্যাকাও- এই পাখি চঞ্চুর একধাক্কায় নারকেল ফাটাতে পারে
আমি কিন্তু একদম সত্যি কথা বলছি। এই টিয়াপাখিটা উড়তে পারা টিয়াদের মধ্যে সবথেকে বড়। রাজকীয় চেহারা। গোটা শরীর নীল রঙের পালকে ঢাকা। ঠোঁটের কাছে এক চিলতে হলুদ। কুচকুচে কালো চঞ্চু। যারা টিয়াপাখি ভালবাসে, তাদের নয়নের মণি- হায়াসিন্থ ম্যাকাও। এরা সাড়ে তিন ফুট অবধি লম্বা হতে পারে। ডানা মেললে এরা চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হতে পারে, অর্থাৎ প্রায় একজন বড় মানুষের সমান লম্বা!!
এবার আমরা গেলাম অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে বড় কাকাতুয়া দেখতে। ব্ল্যাক পাম কাকাতুয়া। এদের চঞ্চু কাকাতুয়াদের মধ্যে সবথেকে লম্বা। মজার ব্যাপার হল, দেখলে মনে হবে যেন জিভ ভ্যাঙ্গাচ্ছে।আসলে, এদের ওপরের চঞ্চু আর নিচের চঞ্চুর গঠন আলাদা বলে মুখ পুরোপুরি বন্ধ হয়না, তাই লাল জিভটা সবসময় দেখা যায়। তাই মনে হয় জিভ ভ্যাঙ্গাচ্ছে। এদের ও রাগ বা উত্তেজনা হলে গালের রঙ বদলে যায়।
ব্ল্যাক পাম কাকাতুয়া
প্যারট জাঙ্গল এর পাখিরা খেলা দেখাতে ওস্তাদ। টিয়াপাখি সাইকেল চেপে ব্যালান্স এর খেলা দেখায়। এমু, ময়ূর, বাজপাখি ও খেলা দেখায়।
টিয়াপাখি সাইকেলে চেপে খেলা দেখাচ্ছে
বাচ্চাদের খেলার জায়গায় অনেক গৃহপালিত পশু-পাখি আছে। আমার অবাক লেগেছে চাইনিজ সিল্কি চিকেন দেখে।
চাইনিজ সিল্কি চিকেন
এছাড়াও আছে পেঙ্গুইন, ক্যাসোওয়ারিস আর টার্কি। টার্কির ছবি পাঠালাম তোমার জন্য। আমি আগে কোনদিন টার্কি দেখিনি। তুমি কি দেখেছ? টার্কির গলার কাছে কি ঝুলছে বলত?
টার্কি -গলায় কি ঝুলছে বলত?
এছাড়া আছে ফ্লোরিডার বিখ্যাত কুড়ি ফুট লম্বা কুমির- নাম ক্রকোসরাস। ক্রকোসরাসের চোয়ালটাই চার ফুট এর বেশি লম্বা।
বিশাল লম্বা ক্রকোসরাস
আরো দেখলাম জলের ধারে ঘুলে বেড়াচ্ছে গোলাপি ফ্লেমিংগো। ফ্লেমিংগোদের ছবি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব। এদের গায়ের সব পালক গোলাপি। এরা শুধু চিংড়ি মাছ খায়। সবসময় দল বেঁধে থাকা এই পাখিদের সবথেকে বেশি দেখতে পাওয়া যায় কেনিয়াতে।
গোলাপি ফ্লেমিংগো
এবার ছবিগুলো কিন্তু আমার তোলা নয়। আমার কম্প্যুটর কিছুদিন আগে খারাপ হয়ে গিয়ে সব ছবি নষ্ট হয়ে যায়। আমার বন্ধু দেবযানী দাশগুপ্ত তাঁর তোলা ছবিগুলি আমাকে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
কেমন লাগল বল তোমার? আমি এবার তৈরি হচ্ছি মনার্ক প্রজাপতিদের পরিযান দেখব বলে। আমার বাড়ির খুব কাছ দিয়েই এপ্রিল মাস নাগাদ মনার্ক প্রজাপতিরা উড়ে যায়। তাদের যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে এবার ছবি তোলার ইচ্ছা আছে। জানাব তোমায়, ছবি তুলতে পারলাম কিনা।
দেবাশীষ পাল
ওকলাহোমা সিটি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
ছবিঃ
দেবযানী দাশগুপ্ত
ব্ল্যাক পাম কাকাতুয়ার ছবিঃ ফ্লিকার
- বিস্তারিত
- লিখেছেন দেবাশীষ পাল
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে
টোকিও না টাকি- কোথায় থাকি?
দেখতে দেখতে ব্যাংকক এর সুবর্নভূমি বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। এই বিমানবন্দর এত বড় যে এর মধ্যে আমাদের কলকাতার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অন্তত গোটা বিশেক ঢুকে যাবে। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত এত দূর যে অন্তত গোটা দশেক ফ্ল্যাট এস্কেলেটর আছে।
লম্বা ফ্ল্যাট এস্কেলেটর চলে গেছে কতদূর!
ব্যাংকক থেকে টোকিও পৌঁছে গেলাম সময়ের একটু আগেই। প্রথমেই যা চোখে পড়বে তা হল ঝকঝকে পরিচ্ছন্নতা। অসম্ভব রকমের ভীড়, কিন্তু সব কাজকর্মই হচ্ছে সুশৃংখলভাবে। হোটেলে পৌঁছে স্নান সেরে বেরোলাম রাস্তায়। টোকিওর সব রাস্তা বাধঁনো। কোথাও মাটি দেখা যায় না। চেনা বলতে একমাত্র ম্যাকডোনাল্ড এর দোকান। সেখানেই রাতের খাওয়া সেরে এলাম।
টোকিওর ফুটপাথ -মাটি দেখা যায়না
১৬ তারিখ সারাদিন কাজের পর সন্ধ্যেবেলা অন্যান্য দেশের বন্ধুদের সাথে কাছাকাছি বাজারগু্লো ঘুরতে গেলাম। টোকিওর সব রাস্তাই এত ঝকঝকে যে হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে।
টোকিও শহর
রাতে হোটেলে ফেরার পর পাকিস্তানের বন্ধু সইদ আমাকে দিয়ে গেল ওর দেশ থেকে আনা প্যাকড চিকেন বিরিয়ানি। বাথরুমের গরম জলের কলে প্যাকেট গরম করে নিয়ে খেতে খেতে মনটা ভাল হয়ে গেল। কেমন যেন এক আত্মীয়তার অনুভব হল।
১৭ তারিখ সকালবেলা শিনাগাওয়া রেল স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করলাম ফুকুই নামের এক ছোট শহরের দিকে। চাপার সুযোগ হল সেই বহু শোনা বুলেট ট্রেনে। ভেবেছিলাম এমন জোরে যায় যে ট্রেনে বসেও তা বুঝতে পারব। কিন্তু ও হরি!!- ট্রেনগুলো এমন সুন্দর আর আধুনিক যে কোন ঝাঁকুনিই নেই। মনে হয় শিয়ালদহের লোকাল ট্রেনে যাচ্ছি। এই ট্রেনটার নাম হিকারি সুপার এক্সপ্রেস। এটা মাত্র পাঁচ ঘন্টায় ১০০০ মাইল যায়।সবচেয়ে বেশি স্পিড হচ্ছে ঘন্টায় ২৮৫ কিমি।
বুলেট ট্রেন
১৮ তারিখ সারাদিন কেটে গেল কাজেকর্মে। বিকেল বেলা ফেরার ট্রেন ধরলাম। আগের বারের মতই একদম ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ট্রেন ছাড়ল। এই ট্রেনেও আগের বারের মত মাত্র একজন সুসজ্জিত হকার তরুনী। কোল্ড কফি, জুস, কেক, এইসব পন্য তার। ট্রেনের কাঁচ তুলে হাওয়া খাওয়ার কোন গল্প নেই, চা গরম বলে কোন হকার নেই, নেই ঝালমুড়ি বা বাদামওয়ালা।
ট্রেনের ভেতর- চা, ঝালমুড়ি, বাদামভাজা...কিছুই নেই!
কাজকর্ম শেষ হয়ে গেল। ২১ তারিখ ফিরে এলাম কলকাতায়। ঠিক নয়দিন বাদে গেলাম টাকি, নিছক বেড়ানোর জন্য। এবার সঙ্গে আমার স্ত্রী। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে এসে হাসনাবাদ লোকাল ধরে দুই ঘন্টা পরে টাকি। টাকি হাসনাবাদের ঠিক আগের স্টেশন। মাঝে যে সব স্টেশনগুলো পড়ল, তাদের নামগুলো অদ্ভূত - ভ্যাবলা হল্ট, লেবুতলা হল্ট, কড়েয়া কদম্বগাছি, ভাসিলা, মালতিপুর - নামগুলোর মধ্যেই কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা!! ট্রেনে যেতে যেতে নানারকম টুকটাক খাওয়ার মধ্যে একটা বিশেষ খাবার হল 'মাখা সন্দেশ'।
টাকির পাশে ইছামতী নদী। ইছামতীর পাশের রাস্তাটি সরু, কিন্তু পিচের রাস্তা, এবং পরিষ্কার ও বটে! এই রাস্তাটির কোন নাম আছে কিনা কেউ বলতে পারল না।
টাকিতে নদীর ধার বরাবর রাস্তা
নদীর ধার বরাবর বেশ কটি খাবারের দোকান আছে। বাঁশের বেঞ্চে বসে নদীর দিকে মুখ করে বসলে মনে হবে সারা পৃথিবীটা আমার। হটাত করে মনে পড়ে গেল টোকিওর কথা। এই মুক্ত চেহারাটা ওখানে ছিল না।
ইছামতী নদী
দুপুরবেলা ভ্যান রিকশা চেপে বেড়াতে গেলাম। প্রথমেই গেলাম বাংলাদেশ সীমান্তের সব থেকে কাছে যে জায়গাটা, সেই গোলপাতার জঙ্গলে। আরো দেখলাম রামকৃষ্ণ মিশন আর স্থানীয় বাজারহাট।
পরদিন দুপুরে বেড়তে গেলাম হাসনাবাদ। উল্টোদিকে পার-হাসনাবাদ যাবার জন্য দুই-তিন মিনিট অন্তর লঞ্চ ছাড়ছে। ভাড়া মাত্র পঞ্চাশ পয়সা!! একটু ভালোভাবে যেতে গেলে এক টাকা বেশি দিতে হবে। বিজয়া দশমীর দিন টাকির যে বিখ্যাত ভাসান হয় তার মূল অনুষ্ঠান হয় এখানেই।
কিন্তু বেশি কাছে যাওয়া বারন। তাই নদীর মাঝ বরাবরই থাকতে হল। দেখতে গেলাম মাছরাঙা দ্বীপ। এই দ্বীপে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির ভেড়া চাষ করা হয়।
দূরে ওই দেখা যায় বাংলাদেশ
দুপুরবেলা আমাদের ফেরার পালা। ভ্যান চেপে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে ভাবলাম এই যে এভাবে ভ্যান এ চেপে যাওয়া, খোলা মাঠ, নদীর সঙ্গ, এরকম কি টোকিওতে পাওয়া যায়!! হয়ত জাপানেও এরকম জায়গা আছে, কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে সেই জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়না। এমনও হতে পারে, এইরকম আড়ম্বরহীন ভাবে হয়ত খুব উন্নত দেশগুলোতে ঘোরা যায়না। আহা, এমনটা যদি হত যে আমার শহরটার পরিকাঠামো আর ব্যবস্থা টোকিওর মত ঝকঝকে সুন্দর হত, আবার টাকির মত প্রকৃতির কাছাকাছি চলে যাওয়া যেত, তবে কেমন হত ?
বালি, হাওড়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অঞ্জন দাস মজুমদার
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে
আঁকিবুকি
অনুভব শেঠ, ৭ বছর, বেইজিং, চিন
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সৃজন বিভাগ
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত