খেলাঘরখেলাঘর

শীত-গরমের চক্কর

শীত আর গরমের চক্করটা কেমন বুঝছ ? এই মাস দু'এক আগেই ঠান্ডায় হি হি  করে কাঁপছিলে, সোয়েটার-জ্যাকেট না চাপালে চলছিল না,আবার এখন দেখ গায়ে একটা জামা রাখতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে।

একটা প্রশ্ন করি ? বলতে পারো, শীতকালে শীত আর গরমকালে গরম লাগে কেন ? কি ভাবছ! বোকা বোকা প্রশ্ন হয়ে গেল ? মোটেই না। বুঝিয়ে বলি আগে, তারপর বলো প্রশ্নটা ঠিক, না বোকা বোকা।

এটা ত জানা কথা যে রোদে দাঁড়ালে গরম লাগে কারণ রোদে আলো ছাড়াও আছে আরও একটা জিনিষ, যার নাম হল 'তাপ'- এই তাপের জন্যই গরম লাগে। তাই ছাতার তলায় বা গাছের নীচের ছায়াতে দাঁড়ালে গায়ে তাপ লাগতে পারে না আর সেজন্য গরমও লাগে না।

তাপ কি জান ? তাপ এক ধরনের 'শক্তি' ইংরাজিতে যাকে বলে এনার্জি ( energy)। একে দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়, মানে বুঝতে পারা যায়। এখন যেমন বুঝতে পারছ যে গরম পড়েছে-  কারন চারপাশে তাপ বেড়েছে। এই তাপ কিছু কিছু ধর্ম (property) মেনে চলে। তার মধ্যে প্রধান হল যে, সে সব সময় গরম জিনিষ থেকে ঠান্ডা জিনিষের দিকে চলে যেতে চায়। যার মধ্যে যায়, সে জিনিষটা গরম হয়ে ওঠে। সুতরাং যা থেকে তাপ চলে যায় সে যে ঠান্ডা হবে এটাই স্বাভাবিক। হয়েও যায়। 

এখানে একটা কথা বলে রাখি। 'তাপের ' সংগে 'গরম', 'ঠান্ডা' বা 'উষ্ণতা' কিন্তু গুলিয়ে ফেলো না,ঠিক যেমন 'চিনির' সাথে 'মিষ্টি' গুলিয়ে ফেলা যায় না। চিনি আর মিষ্টি কি এক জিনিষ ? চিনি থাকলে তবে না মিষ্টি হবে! ঠিক তেমনি তাপ পেলে কোন জিনিষ গরম হবে আবার চলে গেলে সে জিনিষটা ঠান্ডা হয়ে পড়বে।

রান্নাঘরে গ্যাসের উনুনের তাপে তার ওপরে কোন পাত্রে রাখা ঠান্ডা জল গরম হয়ে যাবার কারণ এটাই। তাই বলে আবার ভেবে বসো না যে গ্যাসের উনুনটা ঠান্ডা হয়ে যাবে। সেটা হয়ই বা কি করে ?  গ্যাস পুড়ে পুড়ে ওখানেই ত তাপ তৈরী হচ্ছে কিনা! আর জানই ত সিলিন্ডার থেকে অনবরত গ্যাস এসেই যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, গ্যাস শেষ হয়ে গেলে বা গ্যাসের যোগান বন্ধ করে দিলে, উনুনটা আর গরম থাকবে না।

এখন আমাদের শরীরের কথা ভাব। এটা সব সময় গরম থাকে। শরীরের উষ্ণতা কত জান ত ? ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছা কাছি। শরীর উষ্ণ থাকে কি করে ? আমরা নানা ধরনের খাবার খাই। সেই খাবার আমাদের শরীরে শক্তি জোগায়, আর সেই জন্য আমাদের দেহ উষ্ণ থাকে।তাই যতদিন আমরা জীবিত থাকি ততদিন শক্তি পাবার জন্য আমাদের খাওয়া দাওয়া করে যেতে হয়। আগে যে গ্যাস উনুনের কথা বললাম, ঠিক সেটার মত। খাবার থেকে অনবরত শক্তি এসেই যাচ্ছে।
         
এবার ভাবা যাক যে এখন শীতকাল। এ সময়ে বাতাসের উষ্ণতা শরীরের উষ্ণতা থেকে কম থাকে। ধরি কোন সময়ের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সে সময় শরীরের উষ্ণতা তো সেই ৩৭ ডিগ্রীতেই আছে। অর্থাৎ শরীরের উষ্ণতা বাতাসের চেয়ে বেশী। তাহলে তাপের নিয়মমত(যেটা আগে বলেছি) এবার তাপ শরীর থেকে বাইরে বেরোতে থাকবে। এতে শরীরটা ঠান্ডা হতে থাকবে অর্থাৎ শীত করবে। এই জন্যই ত শীতকালে শীত লাগে।
        
এমন সময়ে আমরা কি করি ? গরম জামা গায়ে দিই। কেন বল দেখি ? এটাতো সহজ কথা, যাতে তাপটা বাইরে বেরিয়ে যেতে না পারে। তাহলে গরম জামাটা এমন কি বস্তু যে শীতকে আটকে দেয় ?
গরম জামা বললেও আসলে জামাটা সত্যিই গরম নাকি ? মোটেও না। তবে জামাটা শরীরের তাপকে কি ভাবে আটকায় ? তা বলি এবার।

গরম জামা

গরম জামা


আগে একটা সংখ্যায় 'সুপরিবাহি' আর 'কুপরিবাহি' বস্তুর কথা বলেছিলাম, মনে আছে ? নেই ? যার মধ্যে দিয়ে তাপ সহজে চলাচল করতে পারে সেটা তাপের সুপরিবাহি। যেমন কোন ধাতব জিনিষ। আর যার ভিতর দিয়ে তাপ চলতে পারে না সেটা তাপের কুপরিবাহি। কাচ, কাগজ বা কাপড়চোপড়--এ রকম জিনিষ হল কুপরিবাহি। আর বাতাসও এই রকমই একটা বস্তু।
         
একটা গরম জামা, ধর উলের সোয়েটার, দেখ। সুতো গুলো কেমন মোটা মোটা আর কোঁচকানো। শুধু তা-ই নয় জামাটা কেমন ঢিলাঢালা করে বোনা। কোঁচকানো,মোটা মোটা সুতো আর ঢিলাঢালা বুনোটের ফাঁকফোকড়ে আটকে থাকে প্রচুর বাতাস যা কিনা তাপের একেবারে হদ্দ বাজে কুপরিবাহি। এর ভিতর দিয়ে তাপ  সহজে বাইরে যেতে পারে না। তাপ বাইরে যেতে না পারলে শরীর তো গরম থাকবেই, না কি বল ? সেজন্যই সোয়েটারকে বলি গরমজামা।
শীত যদি খুব বেশী পড়ে, একটা সোয়েটারে কাজ না চলে, তখন একটা জ্যাকেট চাপিয়ে নিলে শীত একদম জব্দ। কারণ সোয়েটার আর জ্যাকেটের ফাঁকে আটকে যায় পুরু বাতাসের স্তর,যেটা মোটা কুপরিবাহির কাজ করে।

রাতে ঘুমোবার সময় কম্বল বা লেপও একই রকমভাবে কাজ করে। কম্বলের উলের ফাঁকে বা লেপের তুলোর ফাঁকে আটকে থাকা বাতাস দারুন সুন্দর কুপরিবাহির কাজ করে থাকে।
         
লক্ষ্য করে দেখেছ কিনা জানি না যে যখন বেশি শীত পড়ে মা তখন লেপ-কম্বল-কাঁথা রোদে দেন। কেন বলত ? যাতে তুলো ফেঁপে উঠে আরও বেশি বেশি বাতাস নিজের ভিতর ঢুকিয়ে নেয়, যাতে লেপটা আরও কুপরিবাহি হয় আর বেশি গরম আর আরামদায়ক হয়।
         
তুলো ফেঁপে ওঠে কেন ? এর কারণ, আমাদের চারপাশের প্রায় সব জিনিষ তাপ পেলে আয়তনে বেড়ে যায় অর্থাৎ বড়সড় হয়ে যায়। এটা খুব সহজেই বুঝতে পারবে যদি একটা কাজ কর।  একটা বেলুনকে অল্প বাতাস ভরে মুখটা ভাল করে বেঁধে রোদে ফেলে রাখো, কিছুক্ষন পরে দেখবে যে সেটা ফুলে বড় হয়ে গেছে।

কোম্বোল
শীতে কম্বলের তলায় শুয়ে ভারি আরাম হয়

         
কেন হল এমন ? ঐযে বললাম, তাপ পেলে সব জিনিষ আয়তনে বেড়ে যায়! এখানে রোদের তাপে বাতাস আয়তনে বড় হয়ে বেলুনকে বেশি করে ফুলিয়ে দিল। ঠিক এমনি করে লেপের ভেতরে আটকে থাকা বাতাস তাপ পেয়ে ফুলে উঠে তুলোকে ফাঁপিয়ে দেয়, আর সেই জায়গায় আরও বাতাস ঢুকে পড়ে।
        
উত্তর মেরু অঞ্চলের গ্রীনল্যান্ডের নাম শুনেছ ত, যেখানে এস্কিমোরা থাকে ? ওদের ছবি দেখেছ ? কেমন লোমশ পোষাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখে যাতে কোন প্রকারেই শরীরের সামান্য তাপও বাইরে যেতে না পারে। ঐ মোটা লোমশ পোষাক সেই কাজটা করে। তবে ওখানে এতই ঠান্ডা যে এত কিছু করেও তাপ শরীরে ধরে রাখা ভারি মুশকিল হয়ে যায়। তাই শরীরের তাপ বাড়াতে ওরা অনেক চর্বি খায়, এমনকি শীল মাছের চর্বি কাঁচাও চিবিয়ে খায়।

এস্কিমো
এস্কিমো

         
এভারেস্ট শৃঙ্গজয়ী তেনজিং নোরগে বা স্যার এডমন্ড হিলারীর ছবি দেখেছ নিশ্চয়ই। দেখবে সেইরকম মোটা মোটা ফাঁপা পোষাক পড়া ওঁদের।
         
শীতকালে একটা কাজ করে দেখতে পার। একটা সোয়েটার না পরে তার বদলে দু'টো পাতলা জামা পরে দেখো, প্রায় একই ফল পাবে। কারণটাও একই। দু'টো জামার ফাঁকে অনেকটা বাতাস আটকে থাকতে পারে।

শীতের ব্যাপারটা তো বোঝা গেল, নাকি। আর গরমের ব্যাপারটা ? এতে উলটো কান্ড ছাড়া আর কি হবে ?
          
এখন এই গরমের সময় ধর বাইরের উষ্ণতা ৪০ ডিগ্রী। আর তোমার শরীরের তাপমাত্রা ত সেই ৩৭ ই আছে। তার অর্থ তোমার দেহ বাইরের তুলনায় ঠান্ডা। তাহলে নিজের ধর্ম অনুযায়ী তাপ কি করবে ? তোমার ঠান্ডা দেহে ঢুকে পড়বে। তখন গরমে প্রানটা আইঢাই করবে। এই কারণেই গরমকালে গরম লাগে। বুঝতে পারলে কথাটা ? তাহলে প্রশ্নটা খুব একটা বোকা বোকা ছিল না, কি বল ?
           
কিন্তু গরমের এই কষ্ঠ থেকে রক্ষা পাবার উপায় কি ? শীত আটকাবার গরম জামার মত 'ঠান্ডা জামা' পাওয়া যায় না আমাদের আবহাওয়ায়, তবে যারা মরুভূমি অঞ্চলে থাকে তারা একরকম পোষাক ব্যবহার করে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত মোটা কাপড়ের পোষাক পরে থাকে সবসময়। কাপড় আর তার মধ্যে আটকে থাকা বাতাস বাইরের তাপকে ভেতরে আসতে দেয় না। মরুভূমিতে দিনে যেমন গরম রাতে আবার তেমনি ঠান্ডা। এই মোটা কাপড়ের পোষাকটা ঠান্ডা বা গরম - দুটো থেকেই দেহকে বাঁচায়।

 

বেদুইন 
বেদুইন       

আমরা অবশ্য নানা রকম ঠান্ডা পানীয়, আইসক্রিম-- এ সব খেয়ে আরাম পাবার চেষ্টা করে থাকি। একটু ভাল লাগলেও সেটা একেবারেই সাময়িক ব্যাপার কোন স্থায়ী সমাধান নয়।

আইসক্রিম
গরমকালে খেতে ভারি মজা

          
অফিস-কাছারি, বাড়িঘর, সিনেমা বা থিয়েটার হল - এ সব যন্ত্রের সাহায্যে ঠান্ডা করা হয়ে থাকে। এমন জায়গায় কিছুক্ষন থাকার পর বাইরে এলে শরীর ভীষন খারাপ হয়। হঠাত গরম লেগে সর্দিগর্মি হয়ে যেতে পারে। হিতে বিপরীত যাকে বলে আর কি। পড়াশোনা,স্কুল, খেলা - এ সব ছেড়ে বিছানায় বেশ কয়েক দিনের জন্য পড়ে থাকা, আর বিশ্রী সব ওষুধ গেলার ব্যবস্থা পাকা!
         
কিন্তু  গরমের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য প্রকৃতি মা একটা ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যখন খুব গরম পড়ে তখন খেয়াল করেছ নিশ্চয়ই যে আমাদের শরীর দরদর করে ঘামতে থাকে। ঘাম কিন্তু এমনি এমনি হয় না। ঘাম শরীর থেকে বেরিয়ে বাষ্প হয় উড়ে যাওয়ার সময় দেহ থেকে তাপ নিয়ে যায়। এতে দেহ ঠান্ডা হয়। তাই উপযুক্ত পরিমান জল পান করতে হয়। তাতে শরীর ঠান্ডাও থাকে আর ঘামের জন্য উবে যাওয়ার ফলে দেহে জলের ঘাটতিও হয় না।
        
এই ঘাম আর তার ফলে শরীর ঠান্ডা হওয়ার ব্যাপারটা উঁচু শ্রেনীতে যখন পড়বে তখন আরও ভাল করে জানতে পারবে। ঘাম কোথা থেকে বার হয় বল দেখি! আমাদের দেহের চামড়ায় অনেক ছোট্ট ছোট্ট ছিদ্র আছে, যা খালি চোখে দেখতে পাবে না। এই ছিদ্রপথে ঘাম বাইরে আসে। সেই জন্য খেয়াল রাখতে হয় যাতে এই সব ছিদ্র পথ বন্ধ হয়ে না যায়।
         
গরমের নানা সমস্যা থেকে শরীরকে বাঁচাবার জন্য আমরা অনেকরকম প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে থাকি, যা অনেক সময় ঘাম বেরোবার পথকে বন্ধ করে দিতে পারে। এটা হলে দেহ ঠান্ডা ত হবেই না বরং গরমে হাঁসফাঁস  করে অসুখে পড়ে যাবে। তাই বেশী গরমে কি কি করা উচিত-অনুচিত, তা ডাক্তার কাকুদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া খুব জরুরী।    
         
খুব গরম পড়েছে, তাই সাবধানে থেক সবাই।     

 

 

সন্তোষ কূমার রায়
রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।