খেলাঘরখেলাঘর

পথে ঘাটে চলতে চলতে নিশ্চয়ই ছোট সাদা গাড়ি দেখেছ যা সাইরেন বাজিয়ে চলছে আর তার সামনে লেখা আছে এইরকমঃ

অ্যামবুল্যান্স

এই লেখাটাকে আয়নায় দেখ তো! কি দেখছ?
লেখা আছে -AMBULANCE
অর্থাৎ যে গাড়িতে কোন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আয়না তো সবার বাড়িতেই আছে। সেটার দিকে তাকালেই বুঝবে সে কেমন উল্টোমত ব্যবহার করে। তোমার বামদিকের সিঁথিকে মনে হয় ডান দিকে, বাঁ-হাত, বাঁ-পা হয়ে ডান -হাত, ডান পা। তবে মাথাটা পায়ের দিকে বা পা'টা মাথার দিকে হয় না। এর একটা কারণ অবশ্যই আছে, সেটা পরে বড় হয়ে বুঝবে।
যা হোক যা বলছিলাম। ওই লেখাটা উলটো করে লেখার কারণটা বলি এবার।
ওই গাড়ির আগে যাওয়ার একটু তাড়া আছে সব সময়েই , কারণ ওতে গুরুতর অসুস্থ লোকজন যাতায়াত করে। রাস্তায় চলার সময়ে সামনে গাড়ি থাকলে সে গাড়ি যাতে পথ ছেড়ে দেয়, তার জন্য ঐ ব্যবস্থা। কিন্তু কি করে?
লক্ষ্য করে থাকবে প্রত্যেক গাড়িতেই চালকের ডানদিকে জানালার বাইরে একটা করে আয়না আছে। কোনওটা গোল, কোনওটা বা চৌকো। চালক ওই আয়নার সাহায্যে তাঁর পেছনে আসা গাড়িগুলিকে দেখতে পান। AMBULANCE লেখা থাকলে আয়নায় তার ছবি উলটো হত। চালক হয়ত সেটা গ্রাহ্যই করতেন না। কিন্তু উলটো লেখা সেই আয়নায় সোজা হয়ে চালকের চোখে পড়লেই তিনি ব্যস্ত হয়ে পথ ছেড়ে রাস্তার পাশে চলে আসেন। আর অ্যাম্‌বুলেন্স তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারে।
আয়নায় তৈরি হওয়া এই ছবিকে বলে প্রতিবিম্ব। গাড়ির চালকের ওই আয়নায় যে প্রতিবিম্ব তৈরি হয় তাতে পেছনের সব গাড়ির অর্থাৎ রাস্তার হাল পরিষ্কার দেখা যায়। ছোট আয়নার মধ্যে গাড়ি-ঘোড়া ছোট ছোট করে দেখা যায়। খেয়াল করে দেখেছ? না হলে দেখে নিও।
তোমার বাড়ির আয়নায় কি ছোট ছোট প্রতিবিম্ব দেখা যায়? মানে তোমার চেহারা কি ছোট্ট হয়ে যায়? না যায় না, তোমার স্বাভাবিক চেহারাটাই দেখা যায়।
কি রকম হল এটা? কোন আয়নায় স্বাভাবিক। একটু অবাক লাগছে তো?
এটা জান যে কোন কোন আয়নায় আবার বড়ও দেখা যায়। কোনটায় বা ব্যাঁকা-ত্যাড়াও দেখায়!
ছোট বেলায় একবার এক বন্ধুর সাথে মেলায় বেড়াতে গেছিলাম। সেখানে নানান খেলা, সার্কাস, ইত্যাদির সাথে 'হাসিঘর' বলে একটা তাঁবু ছিল। টিকিট কেটে ঢুকে দেখি  হাসিঘরই বটে। অনেকগুলি একই আকারের ড্রেসিং টেবিল বা আলমারিতে  লাগানো হয় এমন বড় বড় আয়না সারি সারি দাঁড় করানো রয়েছে সেখানে।
প্রতিটা আয়নার সামনে যেতেই নিজের কিম্ভূত কিমাকার প্রতিবিম্ব দেখেই হাসি পেল। প্রথম আয়নাতে স্বাভাবিক হলেও পরেরটাতেই একেবারে ছোট্ট, তার পরেরটাতে আবার বেশ বড় সড় স্বাস্থ্যবান দেখতে পেলাম। তার পরে আবার বেঁটে পেটমোটা বা সিড়িঙ্গে বা বাঁকামত চেহারার। অবাক কান্ড। কি করে হয় বলত?
সেটা বলি এবার।

সমতল আয়না
সমতল আয়না

বাড়িতে আমরা যে আয়না ব্যবহার করি সেগুলিকে বলে 'সমতল' আয়না। সমতল মানে হল সমান তল বিশিষ্ট অর্থাৎ উঁচুনিচু নয় কোথাও। শান্ত পুকুরের জল সমতল। যদি পুকুরে ঢেউ থাকে তাহলে সেটা হয়ে যায় অসমতল।
সমতল আয়নায় স্বাভাবিক প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। অর্থাৎ প্রতিবিম্ব হয় নিজের চেহারার মাপে। বাকি যে নানারকমের প্রতিবিম্বের কথা বললাম, সে সব তৈরি হয় অসমতল আয়নার জন্য।
সমতল কাঁচের পেছলের তলে একটা বিশেষ ধরনের প্রলেপ লাগালে সামনের দিক থেকে তাকে চকচকে দেখায়। এটাই আয়না। এতেই প্রতিবিম্ব তৈরি হয়।
তুমি রুটি ভাজার তাওয়া দেখেছ। এর একটা দিক উঁচুমত, আর অন্য দিক নিচু। উঁচু তলাকে বলে উত্তল আর নিচু তলাকে বলে অবতল। যে কাঁচে আয়না তৈরি করা যায়, সেই জাতীয় কাঁচ দিয়ে যদি একটা তাওয়া বানানো যায়,  আর ওই তাওয়ার একদিকের (উঁচু বা নিচু) তলে আয়নার মত বিশেষ প্রলেপ দেওয়া হয়, তবে সেটা একটা আয়নার মত ব্যবহার করবে। তবে সেটা আমরা প্রতিদিন যে আয়না ব্যবহার করি, তেমন হবে না, অর্থাৎ সমতল আয়না হবে না।
যদি নিচু দিকে প্রলেপ লাগানো হয় তবে উঁচু দিকটা চকচকে আয়নার মত ব্যবহার করবে। এই ধরণের আয়নাকে বলে "উত্তল" আয়না। এতে যে প্রতিবিম্ব তৈরি হবে সেটা হবে ছোট ছোট, যেমন গাড়ির চালকের ডানপাশের জানালার বাইরে থাকে। এখন বুঝতে পারি হাসি ঘরের যে আয়নায় আমি নিজের ছোট চেহারা দেখেছিলাম সেটাও ছিল "উত্তল" আয়না।

গাড়ির চালকের জন্য উত্তল আয়না
গাড়ির চালকের জন্য উত্তল আয়না

আর উঁচু দিকে প্রলেপ দিলে নিচু দিকটা আয়নার মত আচরণ করবে। তখন এই আয়নাকে বলে "অবতল" আয়না। এর কাছাকাছি দাঁড়ালে বড়সড় আকারের প্রতিবিম্ব তৈরি হবে। এমনটা ওই হাসিঘরে দেখেছি। এমন আয়না ব্যবহারিক জীবনেও কাজে লাগে। দূরে দাঁড়ালে এতে উলটো এবং ছোট বা বড় প্রতিবিম্ব তৈরি করা যায়। উচ্চ ক্ষমতার দূরবীন তৈরি করতেও এমন উত্তল বা অবতল আয়নার দরকার হয়।
একটা কাঁচের গ্লাসকে টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে যদি ওপর থেকে নিচু পর্যন্ত লম্বালম্বি কেটে ফেলা হয়( যদিও সেটা কাটা যায়না) তবে যে আকার পাবে তাতেও প্রলেপ লাগিয়ে আয়না তৈরি করা যেতে পারে।
প্রলেপ ভেতরের দিকে লাগালে বাইরে চকচকে হবে, আর বাইরে দিলে ভেতরে চকচকে হবে। এরকম আয়না হল চোঙাকৃতি আয়না।
এরকম আয়নাকে দাঁড় করিয়ে তার সামনে দাঁড়ালে সিড়িঙ্গে মার্কা দেখানে, তা যেদিকেই চকচকে থাক না কেন। আর যদি ওই আয়নাটাকে শুইয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তার সামনে দাঁড়ালে পেটমোটা দেখতে পাবে।আর আয়নার কাঁচটা যদি একেবারেই সমতল না হয়ে অসমতল হয়, তবে তাতে আঁকা-বাঁকা ছবি দেখা যাবে। অযত্ন করে বানানো আয়না এইরকম অসমতল হয়।

উত্তল আয়নায় বিকৃত প্রতিফলন
উত্তল আয়নায় বিকৃত প্রতিফলন

তাই আয়না কেনার সময়ে এটা খেয়াল করা দরকার যেন সেটা অসমতল না হয়। খেয়াল না করলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অনেকে ঠকেও যায়। পরে আফসোস করতে হয়।
কি করে খেয়াল করবে? খুব সোজা।
যে আয়নাটাকে কেনা হবে, সেটার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার পেছনের দূরের জিনিষগুলির প্রতিবিম্ব দেখার চেষ্টা করবে। ভাল আয়না হলে সোজা স্পষ্ট প্রতিবিম্ব হবে আর খারাপ হলে সেগুলি আঁকাবাঁকা হবে।
এ সম্পর্কে আরো কিছু বলা বাকি থাকল। পরের সংখ্যায় জানাব।

সন্তোষ কুমার রায়
কোদালিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা।

ছবিঃউইকিপিডিয়া

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।