খেলাঘরখেলাঘর

তা বলে পাকিস্তানে ঢুকে পড়লেই বোঝা যাবে না যে অন্য দেশে এসেছি। যাবে কি করে? সব তো আগে এক ছিল। একই চেহারার লোক, এক রকম রাস্তা, সব এক; এই তো, শহরের নাম অবধি হচ্ছে হায়দ্রাবাদ! তবে এ হায়দ্রাবাদ, আমাদের অন্ধ্রের নামপল্লী, মানে সে হায়দ্রাবাদের থেকে অনেক আলাদা। তবে দুজনেই কিন্তু সমুদ্রের খুব কাছে। এখান দিয়ে সিন্ধু নদ বয়ে গেছে। এখানে প্রচন্ড গরম - এপ্রিল মাসে প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি গরম... বৃটিশ আমলের পুরনো ছবি আছে এই হায়দ্রাবাদের, আপাদ মস্তক ধুলোয় মোড়া দোতলা বাড়ি, মাথায় একটা তেরচা তেকোণা ব্যাপার খাড়া করা- সেই কায়দা করে লাগানো বিরাট তেকোণা ঘুলঘুলি বয়ে শীতল বাতাস ঢুকছে। কেল্লাটা এখনও আছে, কিন্তু বড় দুর্দশাগ্রস্ত। এই ঊষর, ধূসর রাস্তার নাম হল করাচী- হায়দ্রাবাদ হাইওয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, রাস্তা কোথায় নিয়ে চলেছে। করাচী হল সমুদ্রের ধারে মেগাসিটি। সেখান থেকে আরব সাগরের পাড় ঘেঁষে গাড়ি চালালে সিধা বেলুচিস্তান।

করাচী
করাচী

কিন্তু মুকুলের দুষ্টু লোকের মত আমরা বেলুচিস্তান যাব না। পাসনি বলে একটা নৌকাঘাটা আছে, তার ডানদিকে তুরবাত বলে একটা জায়গায় যাব। কারণ, কিছুই না, সমুদ্র বরাবর রাস্তাটা আসলে এয়ারপোর্টের পরেই শেষ হয়ে যাবে। তুরবাত পৌঁছোলে একের পর এক ড্যাম - এখানেই পাকিস্তান শেষ হয়ে ইরান শুরু হল। এখানে বাহুকালাত বলে একটা লম্বা নদী আছে, তাতে মাঝে মাঝেই কুমীর দেখতে পাওয়া যায়। ভাব একবার - মরুভূমিতে কুমীর ঘোরাফেরা করছে । আবার এই পথেই পাহাড়ের মধ্যে একটা এইটুকু ছোট্ট শহর আছে তার নাম কি না হল 'জবর-দস্ত'! এইটা কিন্তু বেলুচিস্তানেরই অংশ। ইরানশেহর থেকে বাঁদিলে গেলে দেখবে মাঝে মাঝেই একের পর এক সরাইখানা। নানান নাম না জানা শহর, প্রাচীন পারস্যের খোদাই করা মূর্তি।  যেগুলির নাম মনে রাখা কঠিন, সেগুলি মনে রাখা কষ্ট। কিন্তু পথে যে কতগুলো হায়দ্রাবাদ, এলাহাবাদ, মোরাদাবাদ, জাহানাবাদ, হোসেনাবাদ, হাজিবাদ, হাসনাবাদ পড়ছে তার সীমাসংখ্যা নেই!
আর এভাবে চলতে চলতেই দেখছি বালির রঙ হলদে থেকে একেবারে ফটফটে সাদা হয়ে গেল। নস্‌রাবাদের ছুঁচলো চুড়ো দূরে উঁকি দিচ্ছে। এটা খুবই অদ্ভূত, কারণ ইরানে বেশিরভাগ মসজিদের মাথা হয় গোল। এখানকার পাথরের পাহাড়গুলোতে সকাল সন্ধ্যায় এমন সব আশ্চর্য রঙ ধরে যে ছবি তুলে কলকাতায় দেখালেই একেবারে ডবোল ফার্স্ট প্রাইজ দেবে! একটা তো দেবে পাহাড়ের রঙের জন্য, অন্যটা দেবে মরুভূমিতে উট আর উটপাখির ছবি তোলার জন্য;এক্কেবারে বাঁটুল দি গ্রেট এর উটোর মত দেখতে।

উট ও উটপাখি
উট ও উটপাখি

এই পথেই মসজিদে ভরা 'কোম' বলে একটা শহর পড়ে, তার ঠিক আগের শহরের নাম 'আয়না', আর ইস্ফাহানের দিকে গেলেই নমক লেক।সে এক আশ্চর্য দৃশ্য! টন টন নুন শুকিয়ে গুঁড়ো হয়ে নিজে থেকেই লেকের পাশে পড়ে আছে। লবণ আন্দোলনের মত দলবল নিয়ে নুন তুলতে শুরু করলেই হয় আর কি!

নমক লেক
নমক লেক

এ অঞ্চলে অল রোড্‌স লীড টু তেহরান - সে আমরা যে পথেই গমন করি না কেন...পুরো মরুভূমি ঝেঁটিয়ে পার করে  যে কোথা থেকে এতগুলি রাস্তা এসে তেহরানে ঢুকেছে খোদায় মালুম!আজাদী স্কোয়ারের মধ্যে দুপেয়ে আজাদী টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে - কিন্তু এত ভীড় যে আমাদের এগোতে হবে। মাঝখান থেকে মনটা খারাপ লাগছে এই ভেবে যে এ পথেই ইস্ফাহান পড়ার কথা ছিল, কিন্তু পেলাম না। কে জানে কেন? ইস্ফাহানের ফুলের কারুকার্য করা শেখ লুতফুল্লা মসজিদ, রাতে আলো জ্বলা চেহেল সতুন প্রাসাদ, ফ্লোরেন্স এর মত খাজু ব্রিজ, ফুলের বাগান, সব বৃথা গেল।

আজাদি
আজাদী টাওয়ার

তেহরানের উত্তরদিকে গেলে আর মরুভূমি নেই, বরফে ঢাকা সাদা ধপধপে পর্বত। রাস্তার দুধারে রঙিন উঁচু গাছের সারি। আর পাহাড়টা পেরোলেই কাস্পিয়ান সাগর। এখানে বাইশ নম্বর রাস্তাটা পুরোটা কাস্পিয়ানের ধার দিয়ে গেছে। এখানে কোথায়ই বা থামব, আর কোথায়ই বা চালাব?একপাশে সমুদ্র, অন্যদিকে পাহাড় - যেমন সূর্যোদয়, তেমন মায়াময় সূর্যাস্ত। আর তেমন খানাপিনা! মাঝে মাঝে এমন কি কমলালেবুর বাগান পর্যন্ত রয়েছে।

কমলালেবু-ক্যাভিয়ার
ক্যাভিয়ার ও কমলালেবু

এই বাগান গুলির কাছে 'অঞ্জলি' বলে একটা জেলা আছে,সেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্যাভিয়ার পাওয়া যায়। মাছের এমন ডিম শত খুঁজলেও কোথ্‌থাও পাবো না। সাগর আর পাহাড়ের মধ্যে শুধু ঘন সবুজ জঙ্গল। কে বলবে একটু আগেও সবকিছু ধুলো আর বালিতে ঢাকা ছিল? এই রাস্তাতেই শেষের দিকে 'হয়রান' বলে একটা শহর , তারপর পাড়ের কাছে 'আস্তারা' বলে একটা শহর, আর তার পরেই তুর্কী। না, ভুল বললাম- আজারবাইজান।

বাকু
কাস্পিয়ান সাগরের তীরে সব থেক বড় নগর বাকু, আজারবাইজান

আজারবাইজান ভারি মজার জায়গা। তুর্কি যেমন এশিয়া আর ইউরোপের সন্ধিস্থল,  তেমন, আজারবাইজান হল এশিয়া থেকে রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপ যাওয়ার রাস্তা। আর সেইজন্য এখানে লোকজনের নাম খুব মজাদার - যেমন- 'আরিফ রাজ্জাকভ' বা 'জামিল গুলিয়েব' বা 'নাফিসা আব্দুল্লায়েভ' কিংবা 'ফরিদ মনসুরভ'। আর এদের খাওয়া-দাওয়া অতি উৎকৃষ্ট। দেখেছ - দোকানে কি বিকোচ্ছে? আমরা যাতে না বুঝতে পারি তাই নামটা কেবল অল্প করে বদলে দিয়েছে। গনগনে গরম কৌরমা প্লেট, সবজি দিয়ে জোবজা কৌরমা প্লেট, তারপরে দোল্‌মা, শরবত- এইসব। এরা কিন্তু খাওয়া দাওয়া নিয়ে খুব সিরিয়াস। আমরাও।

খাবার
আজারবাইজানের খাবার