ইরান ও আজারবাইজানের এক সীমান্ত
আসলে আমরা এমন একটা জায়গায় আছি যেখানে ক্রমশঃ দেশ বদলে যাচ্ছে। খালি সীমান্ত আর সীমান্ত - একটু এদিক ওদিক করলেই ইরান থেকে আর্মেনিয়া হয়ে জর্জিয়া,তুর্কি এইসব জায়গায় পৌঁছে যাব। তবে রাস্তা একটাই। আজারবাইজানের 'গাঞ্জা' শহর দিয়ে আর্মেনিয়ার 'লেক সেভান' -এ। এই লেক এর ওপরে একটা অসাধারণ সুন্দর চার্চ আছে। সেভান লেকের অবস্থা এক সময়ে আরল সাগরের মতই হয়ে যাচ্ছিল।
লেক সেভান, পাড়ে চার্চ
আরল সাগরের গল্পটা জান তো? এই বছর ত্রিশ-চল্লিশ আগেও আরল সাগর ছিল পৃথিবীর পাঁচটা বৃহত্তম হ্রদ গুলির মধ্যে একটা। তারপর ওখানে একটা ড্যাম বানাতে গিয়ে কুড়ি বছরে সব খতম। যা পড়ে আছে, তাতে এত রাসায়নিক বিষ যে মাছ চাষ অবধি বন্ধ হয়ে গেছে। আবহাওয়াও আর আগের মত নেই। লেক সেভানে ঠিক এভাবে জল কমিয়ে চাষবাসের কাজে লাগাতে গিয়ে সবকিছুর বারোটা বেজে যাচ্ছিল । কিন্তু সময় মত মানুষের টনক নড়ায় সেটা আটকানো গেছে।
সেভান লেক থেকে দক্ষিণে নেমে এলেই হল আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভান। আর তার নীচে বয়ে চলেছে আরাস নদী। সেই নদী পেরোলে আবার তুর্কী। এই আরাসের কাছে আরারাত পাহাড় দেখতে খুব ভাল লাগে। এই আরারাতেই নাকি নোয়ার নৌকা ফেঁসে গেছিল। কয়েকশো বছর আগে আরারাত ছিল আগ্নেয়গিরি। আর এখন মাথাভর্তি বরফে তার মাথা ঠান্ডা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, ১৮৪০ সালে একখানা ভূমিকম্প হয়েছিল বটে, তখন নাকি ভেতরে ভেতরে লাভা বেরিয়েছিল।
আরারাত পাহাড়
এই এলাকায় তুর্কীর সেই বিখ্যাত শহর 'কার্স' - যার ওপর কিনা নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুক ' স্নো' বলে এক অসাধারন বই লিখেছেন। এখান থেকে শত শত রাস্তা জট পাকিয়ে এ শহর থেকে ও শহরে চলে গেছে। শহরের আয়তন অকিঞ্চিৎকর হলে কি হবে - তুর্কীর শহর, এমনকি এরজুরুমের মত মেজ শহরেও না থেকে পারব না।
এরজুরুমের মিনার
এ অঞ্চল আদিতে ছিল আনাতোলিয়া - রোমান আর গ্রীক সাম্রাজ্যের স্মৃতি এখনও রাস্তায় রাস্তায়। বাইজান্টাইনরা এই জায়গার নাম দেয় থিওডোসিপোলিস। দূর থেকে দেখবে এসব শহরের মাথায় এখনও মসজিদের চূড়ো বর্শার ফলার মত দাঁড়িয়ে আছে। তুর্কীর পূব থেকে পশ্চিমে গেলে প্রথমে বরফ থেকে সমতল, তারপর নানা হ্রদ, জঙ্গল, মিনার। আর এসবের মধ্যে গোলকধাঁধার মত নকশা আঁকা রাস্তা। মাকড়শার জালের মত এই পথ ধরে উপরে এলে দেখি কি আশ্চর্য - আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে একেবারে কাস্পিয়ান সাগর! আহা না, এটা নির্ঘাত কৃষ্ণ সাগর ! তবে এর অবস্থা আরলের মত না। জান তো, প্রাচীনকালে এই সমুদ্রের মত হ্রদ ধরে ইরান হয়ে বহু মানুষ ভারতবর্ষে পা দিয়েছিলেন।
কৃষ্ণ সাগর
আর হ্রদ থাকলেই পাশ দিয়ে ঠিক রাস্তা করা রয়েছে - গভীর জল, পাহাড়, সূর্যাস্ত - আর কি চাই ! এখানে এত জনপদ, কিন্তু জীবনে এদের নাম শুনিনি - কোকামান, পাশালর, কারাসু, উজুনকুম, কোপরু, চিকো, কাদিকোয় ...
কিন্তু দেখ, কাদিকোয় তো লোকে ইস্তাম্বুল থেকে এমনি এমনিই যায়; তবে কি আমরা ইস্তাম্বুলের আশেপাশে এসে পড়েছি কোথাও? বলতে বলতেই আন্দালু হিসরি এসে পড়েছে, সাগর কেমন পাতলা হয়ে একটা প্রণালী তৈরি করে ফেলল, একের পর এক নৌকা আন্দালু কাভাগির দিকে যাচ্ছে - এটা নিশ্চয় বসফরাস প্রণালী!
ইস্তানবুল
যা বুঝছি, আমরা প্রায় ইস্তাম্বুল এসেই গেছি। এবার আর গাড়ি না চালিয়ে একটা নৌকায় উঠে পড়লেই হয়। প্রণালীর পূর্ব দিকের সব কটা ঘাট বা বন্দর পড়ে এশিয়ার দিকে আর পশ্চিমে সবকটা পড়ে ইউরোপের মধ্যে। মাঝে দুটো বিশাল সেতু স্থলপথে ইউরোপ আর এশিয়াকে দুটো সুতোর মত আটকে রেখেছে। প্রণালীর উল্টোদিকে মর্মরা সাগর- অবশ্য মর্মরা মানেই তো সাগর। আমরা চলে আসছি এমিনোনুর জাহাজঘাটায়, সারাটা রাস্তা একের পর এক মিনার আমাদের পাশে - এখানে ছিল অটোমান সুলতানদের প্রাসাদ, আর বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের গোড়া। অবশ্য তখন তো আর ইস্তাম্বুল নাম ছিল না, নাম ছিল কন্স্টান্টিনোপ্ল্। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে এসব গল্প করছি তার নাম হালিচ, বা গোল্ডেন হর্ন। হালিচ ছিল বাইজান্টাইন নৌবহরের প্রধান কেন্দ্র। দেখতে পাচ্ছ কি, কিভাবে একটা তলোয়ারের মত এ জায়গাটা মর্মরায় ঢুকে গেছে? বিকেলের রোদে সেই তলোয়ার সোনার মতই ঝকঝক করছে। আর হ্যাঁ, এখানে এশিয়া শেষ হয়ে গেল, ওপারে ইউরোপ।
মর্মরা সাগর এবং গোল্ডেন হর্ন
বিক্রম
ডাব্লিন, আয়ারল্যান্ড