খেলাঘরখেলাঘর


গল্প-কথকঃ শুক্তি দত্ত

অনে—ক দিন আগের কথা, সে কত্তো—দিন  আজ আর মনে নেই। জার্মানির এক গ্রামে এক বিধবা মহিলা তার সাতটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। এই মেয়েরা সকলেই এক রকম পোষাক পড়ত। উজ্জ্বল ছাপার জামা, তার ওপর কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন ও মাথায় টুকটুকে লাল রঙের ছোটো টুপি – এই ছিল সাত বোনের পোষাক। চকচকে সুন্দর চুলগুলিকে পরিষ্কার একটা বেণীতে বেঁধে এই রকম পোষাক পরে তাদের ভারী সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন দেখাত।

একবার এক গুড-ফ্রাইডে’র দিনে মেয়েদের মা তাদের একলা বাড়ীতে রেখে কাছের এক গির্জাতে গেলেন কাজ করতে। যাবার আগে সাত বোনকে সাবধান করে গেলেন, “শোনো মেয়েরা, বাড়ী ফিরে যেন না দেখি কোন দুষ্টুমি করেছ। আর খবরদার, উনুনের পিছন দিকের ঘরে উঁকি মারবে না।”

মা চলে গেছেন অনেকক্ষণ হল। খালি বাড়িতে বাচ্চারা গোল হয়ে বসে তাদের বড় দিদির কাছে গল্প শুনছিল। তারপর তারা একসঙ্গে গান করল, খানিকক্ষণ খেলল; কিন্তু সময় যেন আর কাটেনা। “উঃ, মা তো আসছে না, কি যে করি!” জাতীয় কথা শুরু হল। “হ্যাঁরে মা কেন উনুনের পিছনের ঘরে তাকাতে বারণ করল রে? এই, চুপ করে বসে থাক, এসব কথা একদম নয়। সত্যিই তো ওখানে কি আছে রে?” – এরকম নানা কথা তাদের মধ্যে ঘুরতে লাগল, আর ক্রমশই তারা আরো অস্থির হয়ে উঠতে লাগল। কৌতূহল আর বাধা মানে না।

শেষ পর্যন্ত তারা আর নিজেদের সামলাতে পারল না। একজন গিয়ে পিছনের ঘরটাতে চুপি দিল। “ওরে, এখানে না একটা ঝোলা রয়েছে,” সে সবাইকে বলল। তার পিছনে আরেকজন উঁকি দিল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা দেয়ালে একটা পেরেক থেকে ঝুলছে।” ব্যস, বাকিদের আর আটকানো গেল না। মা’র বারণ ভুলে সবাই হুড়মুড় করে বাকি পাঁচজনই ঢুকে পড়ল সেই ঘরে।

ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে তারা ঝোলাটাকে খোঁচা দিয়ে বুঝতে চাইল ভিতরে কি আছে। প্রতি মুহূর্তেই তাদের কৌতূহল এত বাড়ছিল যে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মেয়েটি ঝোলাটাকে দেয়াল থেকে নামিয়েই ফেলল। সাত জোড়া ছোট্ট হাত ঝটিতি ঝোলার বাঁধন খুলে ফেলল; বের করে আনল একটা খয়েরী কাগজের মোড়ক, তাতে ভর্তি বাদাম আর আপেল। আসলে তাদের মা সামনের ঈস্টারের ভোজে খাবার তৈরী করার জন্য এগুলি জমাচ্ছিলেন।

সাতটা ছোট মেয়ে মেঝের উপর গোল হয়ে বসে পেট পুরে বাদাম আর আপেল খেয়েছে। মা ফিরে দেখলেন মেয়েরা শান্ত হয়ে চুপ করে বসে আছে, আর তাদের সামনে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে বাদামের খোলা আর আপেলের খোসা। খালি ঝোলাটা দেয়ালের গায়ে পেরেক থেকে তেমনি ঝুলছে।

রাগে দুঃখে মা চীৎকার করে উঠলেন। ভুলে গেলেন যে পবিত্র দিনগুলিতে কোন কিছু হঠাৎ বলে ফেলা উচিত নয়। “ওরে নচ্ছার মেয়েরা, ইঁদুরের মত ছিঁচকে চোরের স্বভাব তোদের। তোরা তাই হলিনা কেন?” যেই না এ কথা বলা, উজ্জ্বল ছাপার জামা পরা, তার উপর কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন লাগানো, বিনুনী করা চুলে ছোট্ট লাল টুপি পরা সাতটা ছোট মেয়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সাতটা নেংটি ইঁদুর হয়ে গেল। প্রত্যেকটা ইঁদুরের পিঠটা উজ্জ্বল রঙের, পেটের কাছে বড় সাদা দাগ আর মাথার উপর লাল টুকটুকে ছোট দাগ।

বেচারা মা এই দেখে দুঃখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি একদৃষ্টে ইঁদুরছানাগুলিকে দেখতে লাগলেন। তারাও সব ভুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। দুঃখে মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। কতক্ষণ যে তাঁরা এইভাবে ছিলেন বলা যায় না। ইতিমধ্যে একজন পড়শী এসে দরজায় ঠক্‌ঠক্‌ করে তাদের ডাকছিলেন। কিন্তু কেউই দরজা খুলছিল না দেখে দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে তিনি ভিতরে উঁকি মারলেন। যেই না উঁকি দেওয়া, অমনি সাতটা ইঁদুর একে একে ফুড়ুৎ করে বাড়ির বাইরে দৌড়ে পালাল। গাঁয়ের পথ দিয়ে, মাঠের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা একটা ছোট বনের ভিতর ঢুকে পড়ল। থামল এসে একটা পুকুরের ধারে। তাদের পিছনে দৌড়ে আসছিলেন তাদের মা। তিনিও এসে পৌঁছলেন সেখানে। সাত ইঁদুর তাদের মায়ের মুখের দিকে একবার দেখল, তারপর একে একে সেই পুকুরে ঝাঁপ দিল।

মা এই দৃশ্যটা চুপ করে দেখলেন। দীর্ঘক্ষণ তিনি সেই পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন, একটুও নড়লেন না। আস্তে আস্তে মা এক পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলেন। এর পর বনের ভিতর দিয়ে যাবার সময় যে কেউ সেই পুকুরের পাড়ে আসত, দেখতে পেত পাষাণপ্রতিমা মা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ কেউ বলে যে, মধ্যরাতে যখন সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে, তখন তারা দেখেছে সাতটা ছোট ইঁদুর এক এক করে জল থেকে উঠে আসে আর চাঁদের আলোয় সেই পাষাণমূর্তি মায়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে।

গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ছোট্ট সোনারা বলোতো, এইরকম দুঃখের মধ্য দিয়ে গল্প শেষ হলে কি মন ভাল লাগে? তাই ভাবছি, শেষের ঘটনাটাও তোমাদের জানিয়ে দিই। একদিন এক মহিলা সেই বনের পথে সাত ছেলেকে নিয়ে যাবার সময় ক্লান্ত হয়ে পুকুরপাড়ে বসলেন। ছেলেদের বয়স সেই সাতটি মেয়ের থেকে একটু হয়তো বড়। পুকুরের পাশে মূর্তিটি দেখে কিছু না ভেবেই ছেলেদের মা তার গায়ে যেই না হাত দিয়েছেন, অমনি কী আশ্চর্য! মূর্তিটা নড়ে উঠল, চোখে পলক পড়ল আর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মূর্তিটা সজীব হয়ে গেল।

ভয় পেয়ে ছেলেদের মা দু-পা পিছিয়ে এলেন। তারপর সব কথা ধীরে ধীরে শুনলেন। এদিকে আরেকটি ঘটনা ঘটল। মা যেই পাথর থেকে মানুষ হলেন, অমনি পুকুরের ভিতর থেকে সাত ইঁদুর একে একে উপরে উঠে এল। ইঁদুরের খোলস থেকে বেরিয়ে এল সাতটি ফুটফুটে মেয়ে – পরণে উজ্জ্বল ছাপার জামা, জামার উপরে কড়া মাড় দেওয়া সাদা এপ্রন আর মাথায় টুকটুকে লাল রঙের ছোট্ট টুপি। সবার মনেই খুশীর হাওয়া। প্রত্যেকটা মেয়ের সঙ্গে একটি করে ছেলের বিয়ে হল। তারা জোড়ায় জোড়ায় সেখান থেকে রওনা হল। পিছনে চললেন দুই মা।

(জার্মানীর উপকথা থেকে)

শুক্তি দত্ত ভালবেসে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। রূপকথা, প্রাচীন সাহিত্য, দেশবিদেশের লোকসাহিত্য, গল্পকথা পড়তে ভালবাসেন। সেগুলো নিয়ে আলোচনা বা শিশুদের সেই গল্প শোনাতেও ভালবাসেন। প্রধানতঃ শিশুমনস্তত্ত্ব ও তাদের শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। সেটা শুধু পড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি শিশু সাহিত্য, লোকসাহিত্য প্রভৃতিকে তাদের মূল্যবোধ বিকাশে কাজে লাগাতে চান।