কাম্বা জাতির উপকথা :
কেনিয়ার প্রায় প্রতিটি প্রদেশেই হাতির উদ্ভব ও মহিমা বিষয়ে নানান অলৌকিক গল্প মানুষের মুখে মুখে চালু আছে । তার মধ্যে কিকাম্বা ভাষায় সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় গল্প হলো এটি ।
প্রাচীনকালে কেনিয়ার উকাম্বানি অঞ্চলে বাস করতো বুত্নআজিবা নামে এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ । দুই স্ত্রী ও সন্তান সন্ততি মিলিয়ে তার মোট পরিবার সংখ্যা সতেরো । অথচ বুড়োর এমন আর্থিক সঙ্গতি নেই যে তাদের দু'বেলা পেট ভরে খেতে দেয় । দিনের পর দিন প্রায় অনাহারে থাকতে থাকতে একে একে তার প্রথম স্ত্রী ও নয় সন্তানের মৃত্যু হয় । বৃদ্ধ বুত্নআজিবার পক্ষে এই শোক ছিলো দুঃসহ । সেই সঙ্গে বাকি আটটি সন্তান ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় ভেবে না পেয়ে তার মানসিক ভারসাম্য যখন প্রায় নষ্ট হতে বসেছে, ঠিক সেই সময় তার কানে পৌঁছয় ধনী ব্যবসায়ী ইভগানগিয়ার দানশীলতার কাহিনি ।
ইভগানগিয়া একজন সৎ সরলমনা বৃদ্ধ । কঠোর পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা ও উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সে নিজের ভাগ্য নিজে হাতে তৈরী করেছে । সম্পত্তিস্বরূপ তার রাজপ্রাসাদের মতন সুবিশাল অট্টালিকা, অগুন্তি শস্যের গোলা, হাজার হাজার একর উর্বর জমির মালিকানা; এইসব দেখে আপাতভাবে মনে হতেই পারে পৃথিবীতে এমন সুখী ক’জন আছে! কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত! বাস্তবে তার এই বিপুল সম্পত্তি ভোগ করার বিশেষ কেউ ছিল না!পরিবার বলতে শুধু চিররুগ্ন স্ত্রী আর এক বোবা ছেলে । অতএব শেষ বয়সে পৌঁছে ইভগানগিয়া সিদ্ধান্ত নেয় তার সমস্ত সম্পত্তি সে গরিব মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেবে।
কেনিয়ার দূর দূরান্তে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে । দলে দলে দুঃখী মানুষ জড়ো হয় ইভগানগিয়ার আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকার সদর চাতালে । ইভনের প্রাসাদ থেকে কখনো কাউকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে শোনা যায় নি । বিচক্ষণ দাতার মত হাসি মুখে সে সাধ্যমত চেষ্টা করতো প্রত্যেকের অভাব দূর করতে ।
লোকমুখে ইভগানগিয়ার দানকর্মের গল্প শুনে বুত্নআজিবার মনে ক্ষীণ আশা জাগে । যেভাবেই হোক ইভগানগিয়ার সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে । শেষে পাঁচ দিন পাঁচ রাত্রি অক্লান্ত হেঁটে বুত্নআজিবা হাজির হয় ইভগানগিয়ার বাড়ি । বুত্ন'র মুখে তার চরম দুর্দশার বিবরণ শুনে ইভগানের ভারি কষ্ট হয়! সে তত্ক্ষনাত কর্মচারীদের আদেশ দেয় বৃদ্ধের সঙ্গে অনেক ফসল ও গবাদি পশু পাঠিয়ে দেবার । কিন্তু বুত্নআজিবা কিছুতেই কোনো দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করে । বরং সে ইভনের কাছে জানতে চায় ধনী হবার গোপন রহস্য! যাতে তাকে বা তার পরিবারকে কখনো কারোর কাছে হাত না পাততে হয়। বোকা বুত্নর কথা শুনে মনে মনে হাসে ইভগানগিয়া । শেষে অনেক বিবেচনা করে বুড়োর হাতে একটা মলম দিয়ে বলে,
‘‘এই মলমটা তোমার স্ত্রীর ওপরের মাড়ির দাঁতে ঘষে দিও । কিছুদিন পর দেখবে দাঁত লম্বায় বাড়তে শুরু করেছে । বেশ খানিকটা বড় হলে ওটাকে কেটে বাজারে বিক্রি কর । অনেক দাম পাবে । তোমার নিত্যদিনের যন্ত্রণা ঘুচবে ।’’
মনের আনন্দে ঘরে ফেরে বুত্নআজিবা ।
ইভনের পরামর্শ মত সেই মন্ত্রপূত মলমটা স্ত্রী খায়ার দাঁতে যেই না লাগানো,অমনি দিন কয়েকের মধ্যে তার মাড়ির দাঁত অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেতে শুরু করে । সেই দাঁত কেটে বাজারে বিক্রি করে সত্যিই অনেক রোজগার হয় তাদের। কথায় বলে মানুষের লোভ আগুনের শিখার মতই দুর্দান্ত। একবার প্রকাশের সুযোগ পেলে তাকে বশ করা খুব মুশকিল! কিছুদিন যেতে না যেতেই আরো বেশি টাকা রোজগারের লোভে বুত্নআজিবা আরো একবার খায়ার মাড়ির দাঁতে মলম ঘষে । এবার প্রায় চোখের নিমেষে সেই দাঁত দৈর্ঘ্যে বেড়ে যায় কয়েক গুন । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এইবার খায়া কিছুতেই দাঁত কাটতে রাজি নয় । শুধু দাঁত কেন, দেখা গেলো পরবর্তী দু'তিন দিনে তার শারীরিক গঠন পাল্টাতে শুরু করেছে । তার গায়ের চামড়া ধারণ করেছে ধূসর বর্ণ, দু’পায়ের বদলে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে চার পা’য় । এমনকি খাদ্যগ্রহনের জন্য হাতের পরিবর্তে শুঁড় ব্যবহার করতেই সে বেশি উত্সাহী । অত বড় চেহারা নিয়ে এমন ছোটো একটা মাটির ঘরে থাকা একসময় খায়ার পক্ষে অসহ্য হয়ে দাঁড়ালো! তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন সে বনে পালিয়ে গেলো । বনে থাকাকালীন সে অনেকগুলি সন্তানের জন্ম দেয় । শাবকগুলিকে দেখতে হুবহু আমরা যে প্রাণীটিকে বর্তমানে হাতি নামে সনাক্ত করি, তার মত । কেনিয়ার কাম্বা জাতির মানুষ আজও বিশ্বাস করে পৃথিবীতে হাতি নামক প্রাণীটির উদ্ভব এভাবেই ঘটেছিলো।
আফ্রিকার নানা দেশে আচার ভাষা ও কৃষ্টিতে যত বৈচিত্র্যই থাকুক না কেনো, যে পৌরানিক তথ্যটির প্রতি সকলের আস্থা আজও অটুট সেটি হলো;
‘‘হাতির পূর্বপুরুষ ছিলো মানুষ!’’
শর্মিষ্ঠা খাঁ
বুসান, দক্ষিণ কোরিয়া