খেলাঘরখেলাঘর

মেডেল নিলেন না নন্দপিসি

মুখুজ্জেরা মুম্বই না বেঙ্গালুরু কোথায় যেন থাকেন। সেখানে তাঁদের চাকরি, ব্যবসা – সব মিলিয়ে দারুণ রবরবা। দেবীপুরে নন্দপিসিদের ভিটের পাশে তাদের পৈতৃক ভিটে খালিই পড়ে থাকে। হঠাৎ এক ছেলের খেয়াল হলো – গরমে বাচ্চাদের স্কুল-কলেজে যখন লম্বা ছুটি, তখন এখানে এসে তারা মাসখানেক সপরিবারে থেকে যাবে। বেশ অন্যরকমের একটা অভিজ্ঞতা হবে। আর – মেজ ছেলে ফিল্ম লাইনের সাথে যুক্ত – তার মাথায় আছে, জায়গাটা যদি পছন্দ হয় তো বাড়িটাকে সিনেমার শ্যুটিংয়ের কাজেও লাগানো যেতে পারে।
সুতরাং দেবীপুর সরগরম। বাড়িঘর রঙ হলো, ঝোপ-জঙ্গল সাফ-সুতরো। বিজলির জন্য বসলো পেল্লায় এক জেনারেটার। তারপর নির্ধারিত দিনে ল্যাণ্ডাবাচ্চাদের হাঁ-করা চোখের সামনে পেটভর্তি মাল নিয়ে ঢুকলো একটা লরি আর তার পেছন পেছন একটা ঝাঁ-চকচক চারচাকা। লরিকে অবশ্য ভেতর পর্যন্ত আনা গেলো না। সুতরাং অনেক হুলুস্থুলু করেই শেষ অব্দি মুখুজ্জে পরিবার তাঁদের আদিভূমিতে অধিষ্ঠিত হলো। তাদের মেয়েদের গা ভরা গয়না, পুরুষদেরও হাতে আংটি, গলায় চেন। আর বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নব্য বারমুদা-স্ল্যাকস শোভিত। তাদের হাতে হাতে মোবাইল।
তাদের দিকে, বিশেষ করে ‘কলের গাড়ি’টার দিকে গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিসি বিড়বিড় করেন, “ঘোর অনাছিষ্টি, ঘোর অনাছিষ্টি! এবার একটা বিপুয্যয় না হয়ে যায় না!” কে তাকে বোঝাবে, এসব আধুনিকতা শহরে কেন, গাঁয়ে-গঞ্জেও আজকাল জলভাত।
খোলা মাঠ, বিশুদ্ধ বাতাস আর অবারিত আলো দেখে ছোটদের তো খুশি ধরে না। বেশ কিছুক্ষণ পাড়ায় এলোমেলো ছুটোছুটি করে বেড়ালো। কয়েকজন সাহস করে পিসির দোরেও উঁকি মারলো। পিসির ‘মুড’ এতক্ষণে কিছুটা ঠিক হলো। হাতছানি দিয়ে ডাকলেন, কাছে এলে হাতে নাড়ু-পাটালি তুলে দিলেন। “নাইস হোম-মেড চকলেট!” মুখে দিয়ে কলকল করতে করতে বাচ্চারা আবার চরায় বেরোলো।
তাদের আনন্দ অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই মিইয়ে গেলো, যখন দেখলো যে মোবাইলে টাওয়ার লাগছে না। অনেক খোঁজ-ভিজের পর পাড়ার গজু বললো, “বাছারা, এই অজ পাড়াগাঁয় ওসব পেরাইভেট-সম্রাট (স্মার্ট?) ফোন কাজে লাগবেনি। তাচ্চেয়ে ঐ চাকাগাড়িতে করে চাকুলি বাজারে গিয়ে পানুদার দোকান থেকে সস্তার চিনা মাল কিনে তাতে সরকারি (বি-এস-এন-এল?) কাড ভরো।” কিছু দ্বিধার পর মুখুজ্জে বাপরা তাই করলেন আর ফলে অন্ততঃ ‘কভি-হাঁ-কভি-না’ গোছের সিগন্যাল জুটতে লাগলো।
এরপর ভালোয়-মন্দে তাদের দিন কাটতে লাগলো। প্রাথমিক উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে গাঁয়ের লোকেদেরও মুখুজ্জেদের উপস্থিতিটা গা-সওয়া হয়ে গেলো। কিন্তু আরো কেউ ব্যাপারটা লক্ষ করছিলো।

নিশুতি রাত। পাড়া অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনকি নিশাচর মুখুজ্জেরাও মোটামুটি বিছানায়। এমন সময় তাদের দরজায় প্রবল ধাক্কা, সাথে বাজখাঁই গলার আওয়াজ, “এ্যাই, ভালোয় ভালোয় দরজা খুলে দে, নইলে –”
প্রাথমিক ভ্যাবাচাকা ভাব কেটে গেলে পর বোঝা গেলো – বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। তারপর হৈ-চৈ, কান্নাকাটি, প্রবল বিশৃঙ্খলা। সোরগোলে আশেপাশের বাড়িঘরেও আলো জ্বলে উঠলো, কিন্তু ব্যাপার মালুম হবার সাথে সাথে সেসব টুপ করে নিভিয়ে যে যার ঘরের দোর এঁটে কাঁপতে লাগলো।
ঘুম ভেঙেছে পিসিরও। কী হয়েছে বুঝতে তাঁর অবশ্য দেরি হয়নি। এককালে জমিদার বাড়ির বৌ ছিলেন, এসব ঘটনা তিনি অনেক দেখেছেন। ভাবনা-চিন্তার পর গোছগাছ করতে অবশ্য একটু সময় লাগলো, কিন্তু তারপর তিনি নির্দ্বিধায় বাইরে এসে দাঁড়ালেন। ডাকাতরা ততক্ষণে চরমপত্র দিয়েছে – ভালোয় ভালোয় দরজা খুলে না দিলে তারা ভেঙে ঢুকে সবাইকে কচুকাটা করবে, নয়তো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে। এমন সময় পিসি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গলা তুলে চেঁচিয়ে বললেন, “কী ভেবেছিস হতচ্ছাড়ারা – নন্দ বামনি বেঁচে থাকতে পাড়ায় অনাচার করবি? সময় থাকতে পালা, নইলে দেখেছিস –”
ডাকাতরা ঘুরে দাঁড়ালো। মশালের আলোয় চোখে পড়লো – তাদের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে পিসি। ডাকাত সর্দার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, “তুমি বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো ঠাকরুণ – তোমার সাথে আমাদের কোনো কাজিয়া নেই। তবে বন্দুক-টন্দুক খুব খতরনাক চিজ, ওসব নিয়ে আনাড়িদের খেলা কত্তি নেই।” তারপরই তারা আবার মুখুজ্জেদের সদরে লাগালো বেপরোয়া লাথি।
দুম! – পিসির বন্দুক গর্জে উঠেছে আর সাথে সাথে ডাকাত সর্দার আর্তনাদ করে বসে পড়েছে – তার ডান হাঁটুটা গেছে! “আনাড়ির মার!” – কাতরাতে কাতরাতে বলতে যাচ্ছে, এমন সময় গর্জে উঠলো পিসির বন্দুকের দ্বিতীয় নল আর এবার ডাকাতের অ্যাসিস্ট্যান্ট কুপোকাৎ। এই আচমকা বিপর্যয়ে ডাকাত দল মুহূর্তে বিশৃঙ্খল আর পিসি সেই সুযোগে অভিজ্ঞ হাতে বন্দুক আবার ‘লোড’ করে নিয়েছেন। আর এক রাউণ্ড গুলি ছোটার পর ডাকাতদের সাহস উধাও – গণ্ডগ্রামে এসে ফাঁকা ময়দানে গোল দেবে ভেবেছিলো, বন্দুকের সাথে লড়তে হবে ভেবে তৈরি হয়ে আসেনি। আহত সাথীদের ছেড়েই এবার বাকিরা পিটটান দেবার রাস্তা খুঁজতে লাগলো। কিন্তু সেখানেও বিশেষ সুবিধে হলো না।
জেলার ডেপুটি এস-পি মালবিকা দাস যেন কোন মুখুজ্জে বৌয়ের ক্লাস ফ্রেণ্ড। তার নম্বরটা জানা ছিলো, কপাল ভালো এই সঙ্কটের মুহূর্তে লাইনটাও লেগে গেলো। পুলিশ সাধারণতঃ রামধনুর মতো – ঝড়বৃষ্টির পর উদয় হয়। কিন্তু ‘বিগ বস’ মালবিকার তাড়ায় অন্যথায় জগদ্দল স্থানীয় থানা মুহূর্তে তটস্থ হয়ে উঠলো আর ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই ও-সি সদলবলে অকুস্থলে হাজির হলেন। গোটা তিনেক জখম ডাকাত ছাড়াও আরো ক’টা ধরা পড়লো। দু-চারটে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পালালো বটে, কিন্তু সঙ্গীদের জেরায় নাম ফাঁস হয়ে যাবার পর এখন তারাও ধরা পড়ার অপেক্ষায়।

পরদিন থেকে দেবীপুর লোকে লোকারণ্য – ফিলিম-তোলা ভ্যান গাড়ি, খোঁচাদাড়ি ক্যামেরাম্যান আর বক্তিয়ার খান মিডিয়া-দিদিদের ভীড়ে ভীড়ে ছয়লাপ। ডাকাত-তাড়ানো নন্দ পিসি মুহূর্তে ‘ফোক হীরোয়িন’। দুর্গাবতী, ঝাঁসীর রাণী, আরো কত উপমা কাগজে কাগজে ঘুরছে। মাইকওয়ালারা দল বেঁধে ‘স্পট ইন্টারভ্যু’র জন্য পিসিকে উত্যক্ত করে চলেছে। দু-চারটে নমুনা – “আপনার বন্দুক চালনায় শিক্ষাগুরু কে? “আমার ঈশ্বর শ্বশুরমশাই। নামটা তো বলতে পারবো না, পাড়ার থেকে জেনে নেবেন।” “কিন্তু অতদিনের পুরোনো বন্দুক চালু অবস্থায় ছিলো, তা কি ডাকাতির সম্ভাবনা ভেবে?” “তা কেন! আমার ঘরে তো কত পুরোনো জিনিসই পড়ে থাকে – খাট-পালঙ্ক, বাসনপত্তর, পুজোর সরঞ্জাম। আমি কি কোনোটায় এক কণা ধুলো জমতে দিই?” “আপনার প্রাণে ভয়ডর নেই? “তাই কি হয়, মানুষের শরীল তো! তবে শোনো বাছা, কোনো রক্তমাংসের প্রাণীকে এই নন্দ বামনি ডরায় না।” “মানে, আপনি কি ঐ অন্ধকারে ছায়া ছায়া যারা আসে তেনাদের কথা বলছেন?” “পাগল হয়েছো! মানুষকে যে ডরায় না সে ভিরমি খাবে ছায়া দেখে! ছায়ার কী খ্যামতা? ওরা তো দুই দাবড়ি দিলেই পালায়।” “তবে?” এই ‘তবে’টা অর্থাৎ লৌহমানবী নন্দরাণী চৌধুরাণী তবে কিসে ডরান, সেটা কিন্তু অনেক জেরাতেও বের করা গেলো না।
কিছুদিন পর আবার তোলপাড় – সাহসিকতার জন্য যেসব মহিলা রাজ্যপালের মেডেল পাচ্ছেন, এ বছর তার মধ্যে রয়েছেন পিসি! দেবীপুরে আবার হৈ-হুল্লোড়, সবাই আবার এসে পিসিকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। পিসিও প্রথম প্রথম খুব খুশি। কিন্তু তাঁর উজ্জ্বল মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়লো, যখন শুনলেন যে মেডেল নিতে সেই কলকেতায় যেতে হবে।
“সে তো নাকি অনেক দূর – কত রেলগাড়ি-বাসগাড়ি করে যেতে হয়।” চিন্তিতমুখে পিসি বললেন।
“অত ভাবছো কেন – দেবীপুর থেকে কলকাতা তো কত লোক এখন ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করছে। আমরা তোমাকে ঠিক নিয়ে যাবো” তাঁকে আশ্বস্ত করার চেষ্টায় বলে পিসির ছেলে আদিত্য।
তবে সেটুকু সংশয়ও দূর করে দিলো মুখুজ্জেবাড়ির মেজ ছেলে অনুপ। বাড়িটায় ফিল্মি শ্যুটিং করার ইচ্ছে তার মাথার থেকে যায়নি, বরং পিসির সাহসিকতার ফলে অকুস্থলে মিডিয়ার আনাগোনা জায়গাটার বেশ ‘প্রোমো’ করে দিয়েছে। তাই সে কিছুদিন পর আবার দেবীপুর এলো।
“এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনারা মোটেই মাথা ঘামাবেন না।” কৃতজ্ঞতায় গদগদ অনুপ বলে, “পিসি শুধু গ্রামের সম্মানই নন। আমাদের পরিবারের কাছে তো তিনি রক্ষাকর্ত্রী দুর্গা! ওনাকে আমি গাড়ি করে নিয়ে যাবো। আদিত্যদাও নয় সঙ্গে থাকবেন।”
ব্যস, এভাবে বিষয়টার ফয়সালা হবার পর পিসির কোনো ওজর-আপত্তিই টিঁকলো না। ঠিক হলো, নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ সামনের রোববার বেলা দু’টো নাগাদ সবাই অনুপের গাড়িতে রওনা দেবেন।

রোববার। যথারীতি বারোটার মধ্যে পিসির সামান্য মধ্যাহ্নের আহার শেষ হয়েছে। তিনি একটু বাগানে গেছেন কেচে দেওয়া কাপড়টা আনতে। বাইরে অপেক্ষা করছে মুখুজ্জেদের ফুল দিয়ে সাজানো গাড়ি, তাতে রঙীন কাগজ সেঁটে লেখা “জয়তু বিরাঙ্গনা শ্রীমতি নন্দরানি চৌধুরানি।” ড্রাইভার আর অনুপ রেডি। আদিত্য উত্তেজিতভাবে ঘড়ি দেখছে আর অপেক্ষা করছে মা ফিরে এলেই তারা রওনা দেবে। কিন্তু পিসি আর আসেন না।
“দাদা, একটু দেখুন না – এরপর দেরি হয়ে যাবে। পথে জ্যাম থাকলে –” একসময় অনুপ বলে।
আদিত্য গলা চড়িয়ে ডাকে “মা” – কোনো সাড়া নেই। সে অগত্যা বাগানের পথে পা বাড়ায়। সেখানে গিয়ে দেখে, পিসি নেই! কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর আদিত্য সোরগোল জুড়ে দেয়, লোকজন ছুটে আসে।
এ কি ভোজবাজী নাকি? পিসি গেলেন কোথায়? চারদিক তো অভ্যর্থনাকারী মানুষের ভীড়ে ভীড়াক্কার, তার মধ্য দিয়ে কোথাও গেলে নিশ্চয়ই চোখে পড়তো? “বাবা গো, পিসিকে ডাকাতে নিয়ে গেছে!” কে যেন ডুকরে ওঠে। “দুর বেঅকুফ, আমাদের এতজনের চোখের সামনে দিয়ে?” আরেকজন তাকে ধমক দেয়। এমন সময় কয়েকটি বাচ্চা হৈ-হৈ ক’রে ওঠে, “ঐ তো – ঐ যে পিসি!”
পিসি সজনে গাছের মগডালে বসে। কিছুতেই তাঁকে নামানো যাবে না। এক একবার সুসজ্জিত গাড়িটার দিকে তাকান আর ভয়ে বিস্ফারিত চোখে গাছের ডাল আরো শক্ত ক’রে আঁকড়ে ধরেন।
“ওরে, ওই সব্বোনেশে গাড়ি – ওতে একবার চড়লে আর রক্ষে আছে! মেটেলের লোভে কি জল-জিয়ন্ত পেরানডা বিসজ্জন দেবো নাকি! ঘোড়া থাকলে কথা ছিলো, টগবগিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু ঐ কলের গাড়ি – বাপ রে!”
ঐ মগডালে ওঠে সাধ্যি কার! সুতরাং নীচের থেকেই চলতে থাকে লাগাতার কাকুতি-মিনতি।

কাজেই তোমরা যাঁরা সেদিনের অনুষ্ঠানের টেলিকাস্ট দেখেছো, হয়তো লক্ষ করেছো যে অসমসাহসিকা নন্দরাণী চৌধুরানির অনুপস্থিতিতে তাঁর পুত্র আদিত্য চৌধুরী রাজ্যপালের কাছ থেকে মেডেল নিচ্ছেন। ঘোড়া আর চটজলদি কোথায় পাওয়া যাবে – তাই পিসির ‘নিরাপদ যাত্রার’ ব্যবস্থা এযাত্রায় আর করা গেলো না।
    

অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র
   
  
 
       

      

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।