খেলাঘরখেলাঘর

Borodin

টুকাইয়ের মন ভালো নেই।

যেদিন ওর মা পঞ্চমীর হাত ধরে এই বাড়িতে কাজে ঢুকেছে, সেদিন থেকেই ওর ছোট্ট জীবনটা যেন পাল্টে গেছে। কাজ তেমন কিছুই না। এ বাড়ির মামা অফিসে যায়,মামী কলেজে পড়ায়। সারাদিন ফাঁকা বাড়িতে দেড় বছরের পিন্টুর সঙ্গী টুকাই। মা এই বাড়িতে রান্না করে আরও তিন বাড়িতে কাজে যায়। তারপর ওকে মামা-মামীর  এঁটো বাসন মেজে, ঘর ঝাড়া-মোছা করে দিতে হয় , ওরা থাকতে থাকতেই। এরপর পিন্টুকে চান করানো,খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো-ওর নিজেরই ঘুম পায়।

খেয়ে উঠতে বেলা গড়িয়ে যায়। মামী ফিরে আসে। চা করে দিয়েই পিন্টুকে নিয়ে ও পার্কে যায় বেড়াতে। মামা ফিরবার পর কেউ না কেউ আসে বাড়িতে। পিন্টুর জন্য খেলনা, জামাকাপড় নিয়ে আসে। সবাই বলে মেয়েটাকে তো বেশ পেয়েছো, দাও না ভাই আমাদের জন্য একটা দেখে। মামা ভালো ভালো খাবার আনে। সবার হয়ে গেলে ও একটু ভাগ পায়। রাতে খাবার টেবিলের পাশে, মাটিতে বসে  ও খায়। মেঝেটার ঠান্ডা লাগে ইজেরের তলা দিয়ে। ও বলে না কিছু।

রান্নাঘরের পাশে মাটিতে ওর বিছানা। সবাই শুয়ে পড়লে পুতুলটা বার করে। তার একটা চোখ নেই।চুলগুলোও উঠে গেছে। অনেকদিন আগে বাবা কিনে দিয়েছিলো। বাবা এখন জেলে। একদিন স্বপনকাকু আর মা-কে নিয়ে কী একটা হয়েছিল । বাবা খুব মারলো স্বপনকাকুকে। তারপর পুলিশ এসে বাবাকে ধরে নিয়ে গেলো। স্বপনকাকু এখন আর আসে না।বগলে একটা কাঠের ডান্ডায় ভর দিয়ে হাঁটে। বাবা টুকাইকে খুব ভালোবাসতো। অনেক লেখাপড়া শেখাবে বলেছিলো। মামী পিন্টুকে 'অ-আ-ক-খ' আর 'এ-বি-সি-ডি' শেখাতে চেষ্টা করে। টুকাইও একটু একটু শেখে, আবার ভুলে যায়। তাতে কিছু না, কাজগুলো ভুললেই ভয়।

মামা-মামী অবশ্য খুব ভালো। পিন্টুর অনেকরকম দিদি আছে,তাদের ছোটো হয়ে যাওয়া পুরনো জামা মাঝে মধ্যেই এনে দেয়। গাড়ি করে বেড়াতে গেলে ওকে নিয়ে যায়। চিড়িয়াখানাও নিয়ে গিয়েছিলো। তবে পুজোর সময় গোয়া না কোথায় গিয়েছিলো অনেক দিনের জন্য তখন টুকাই মার কাছেই ছিলো। ওরা ফিরে আসার পর ছবিগুলো দেখেছিলো টুকাই। কী দারুণ! পাহাড়, সমুদ্র -কী নীল। পিন্টু কি মজা করেছে ওখানে। সেই প্রথম ওর পিন্টুকে হিংসা হয়েছিলো।

আজ সকালে একটা মজা হয়েছে।

পাশের বাড়িতে একটা দাদু থাকে, সব চুল সাদা আর ইয়া মোটা। মূর্তি গড়ে। মাঝে মাঝে অনেক লোক আসে বাড়িতে ট্রাকে চাপিয়ে বিরাট বিরাট কালো সাদা মূর্তি নিয়ে যায়। আজ মামা-মামী চলে যাবার পর ও পিন্টুকে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে, দাদুটা ডাকলো। কিন্তু কিন্তু করেও দরজায় তালা দিয়ে, পিন্টুকে নিয়ে ও দাদুটার বাড়ি গেল।

দাদুটা ওকে নিয়ে গেল বিরাট একটা ঘরে। বাব্বা! সেখানে কত পুতুল আর মূর্তি। মানুষ, বাঘ,বেড়াল, গণেশ আরও কত কী! আবার একটা কাঠের গুঁড়ির মধ্যে তিনটে বানর ছানা। টুকাই তো হাঁ।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো নিজেরই খেয়াল নেই। হঠাত দাদুটা বললো,"দ্যাখতো চিনতে পারিস কিনা?" এ কী? যে গোল টেবিলটার ওপর একতাল মাটি ছিলো-সেখানে ওটা কে? ও মা! এ যে টুকাই নিজেই। দাদু বললো,"তুই এতো সুন্দর দেখতে, তাই ভাবলাম তোকে বাড়িতেই রেখে দিই। এবার বল দেখি,হয়েছে কিনা তোর মতো?"

খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে,এক ছুট্টে ও বাড়ি চলে এলো পিন্টুকে নিয়ে। অনেকক্ষণ লাগলো বুক ঢিপঢিপটা ঠিক হতে। তারপর ও বুঝলো মনটা  
ভালো হয়ে গেছে। আর কক্ষোণো পিন্টুকে হিংসা করবে না টুকাই।

 

 

 

পার্থ দাশগুপ্ত
কলকাতা