খেলাঘরখেলাঘর

মহাভারতে ধর্ম বকের ক্যুইজের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, যার কোনো ঋণ নেই সেই প্রকৃত সুখী। দ্বাপর যুগের সে সব ফিলজফি এই ঘোর কলিতে স্বাভাবিক ভাবেই অচল। বরং ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ আজকের ফ্যাশান! ক্রেডিট কার্ড বা লোনদাতাদের রমরমা থেকেই তা মালুম হয় বেশ। অবশ্য কিছু খলিফা মানুষ আছেন যাঁরা ধার করারও ধার ধারেন না। দিব্যি খোশমেজাজে পরস্মৈপদী জীবনযাপন করেন। আজকের গল্প এমনই এক বিরলপ্রতিভা ভদ্রলোককে নিয়ে।

দূরদৃষ্টিতে কিছুদিন ধরেই কেমন গোলমাল ঠেকছিল। কাল সন্ধেয় শেষমেষ গেলাম পাড়ার গোবিন্দদার চশমার দোকানে একটা চোখের ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তারবাবুর আসতে লেট। খদ্দেরের তেমন ভিড় নেই। তাই গোবিন্দদা একথায়-সেকথায় তাঁর এক বিশেষ খদ্দেরের গপ্পো পাড়লেন। পাশের পাড়ার জনৈক বয়স্ক,এককালীন উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরে এবং বর্তমানে মোটা পেনশনজীবী এই ভদ্রলোক গত বছর গোবিন্দদার দোকান থেকে বেশ সৌখীন, ভালো দামের চশমা তৈরি করান। কিন্তু তারপর দাম মেটাবার আর নাম করেন না! খাতির দেখিয়ে ডেলিভারী দেবার সময় "পরে আপনার সময়মত দেবেন" বলেই নিজের জালে মোক্ষম ফেঁসেছেন গোবিন্দদা। শেষে একদিন সকাল সকাল রাস্তায় ধরলেন তাঁকে। নাকে সেই চশমা উঁচিয়েই বাজারের থলে হাতে চলেছেন তিনি। টাকার কথা পাড়তেই খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি, "এটা একটা চশমা হয়েছে ? কিচ্ছু ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না। আরো কটা দিন ট্রায়াল দিয়ে দেখি। আরে, তোমার ঐ কটা টাকা মেরে দিয়ে আমি পালাচ্ছি নাকি, য়্যাঁঃ ?" গোবিন্দদা অধোবদন - হকের টাকা চাইতে গিয়ে। আর ভদ্রলোক বীরদর্পে চললেন মাছের বাজারে। বলা বাহুল্য তাঁর হাঁটাচলায় দৃষ্টিবিভ্রমের কোনো লক্ষণ নেই।

আরো মাসতিনেক কাটল। ভদ্রলোক দিব্যি বিনিপয়সার চশমা পরে দেশদুনিয়া ঘুরে বেড়ান, অবশ্য গোবিন্দদার দোকানের রাস্তাটা বাদে। শেষে আর থাকতে না পেরে একদিন গোবিন্দদা ভদ্রলোকের ছেলেকে রাস্তায় পেয়ে সব কথা বললেন। ছেলে বাপের চালচলন বিলক্ষণ চেনে। সে বলল, "সামনের হপ্তায় মাস পয়লার দিন বাবা পেনশন তুলবে। ঐ দিন রাত দশটা নাগাদ একবার আমাদের বাড়ি এসো। এসে জাস্ট কলিং বেল টা টিপবে। তারপর যা করার আমি করব।"

যেমন কথা তেমন কাজ। নির্দিষ্ট দিনে বেল টেপার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে দরজা খুলেই ভিতরের ঘরের দিকে হাঁক দিল, "বাবা, একবার শুনে যাও।" বাবা ভদ্রলোকটি মনে হয় নিদ্রার আয়োজন করছিলেন। স্যাণ্ডো গেঞ্জী আর লুঙ্গি পরে হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে এলেন তিনি বাইরের ঘরে। ছেলে বলল,"ইনি কি বলছেন - তুমি নাকি ওঁর দোকানে পাওনা বাকি রেখেছ?" শুনেই ভদ্রলোক লাফিয়ে চলে এলেন গোবিন্দদার সামনে। খালি চোখে ঠিক চিনতে পারলেন কিনা বোঝা গেল না। তার পরেই সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে পা থেকে হাওয়াই চটিজোড়া খুলে এক টানে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, "এটা একটা হাওয়াই চটি ? আবার বাড়ি বয়ে দাম চাইতে এসেছে!!"



ছবিঃদীপায়ন সরকার

জ্যোতির্ময় দালালের জন্ম ও পড়াশোনা কলকাতায়। ২০০৯ সাল থেকে আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশে কলেজ ষ্টেশন শহরে 'টেক্সাস এ এন্ড এম' বিশ্ববিদ্যালয়ে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডক্টরেট-এর ছাত্র। এর আগে আই আই টি খড়্গপুর থেকে এম টেক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি ই ডিগ্রী লাভ। আই টি ইণ্ডাস্ট্রিতে বছর চারেক কোডিং করে করে তিতিবিরক্ত হয়ে সেক্টর ফাইভকে দুচ্ছাই বলে পি এইচ ডি করতে পলায়ন। লেখালিখি ছাড়া শখ ভ্রমণ ও ফোটোগ্রাফি চর্চা ।