আগের পর্বঃঊদেয়ার রাজাদের দেশ - মহিশূর-পর্ব ১
চান্নাপাটনার কাঠের খেলনা
চান্নাপাটনা বা চন্পাটনা, এই মাইসোর যাওয়ার পথেই আরও একটু ছোট শহর। শহর বললেও ভুল বলা হয়... সিটি তো নয়, টাউন-ই। আগে গ্রামই ছিল, এখন উন্নত হয়েছে কিছু টা। এ জায়গার একটা বিশেষত্ব আছে বটে, কিন্তু যে কোনও কারনেই হোক, তার পর্যটকদের খুব একটা আকর্ষণ করে না। বা পর্যটন দপ্তর সেই ভাবে লোক টানার মত পরিকাঠামো তৈরী করেনি। বিশেষত্বটি কি জানো? কাঠের পুতুল! হ্যাঁ, না না রকম কাঠের পুতুল তৈরী হয় ওখানে, নানান মাপের... ছোট বড় মাঝারি। খুব সুন্দর সুন্দর পুতুল। এই কাঠের পুতুলের জন্যই চান্নাপাটনার নামডাক। কেউ চাইলে, কারখানায় গিয়ে এই পুতুল কি ভাবে তৈরী হয়, তা দেখতে পারে, কারিগররা কেমন পরিশ্রম করে অমন সুন্দর জিনিস বানায়ে তা দেখতে পারে। আর সাজিয়ে রাখা পুতুলগুলো দেখলে কেনার ইচ্ছে তো হতেই পারে, তাই না? কাঠের ঘোড়া, রাজা-রাণী, সৈন্য, হাতি, বাঘ, নৌকা... আরও কত কি! সে নিয়ে যেমন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলতে পারে... আবার বৈঠকখানায় সাজিয়েও রাখা যেতে পারে। রাস্তার ধারে দোকানে সাজিয়ে রাখা দেখেছি, তবে গাড়ি থেকে নেমে কাছে গিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে ইচ্ছে হয়নি... কিনব তো না, শুধু শুধু বেচারাদের মনে আশা জাগানোর দরকার কি? আর মাইসোর সময় মত পৌঁছনোর তাড়া ছিল। হয়ত এই মাইসোর যাওয়ার তাড়াতেই আমার মত অনেকে আর এই চান্নাপাটনাতে সময় কাটাতে চায় না, গাড়ি না থামিয়ে সোজা বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় মাইসোর পৌঁছনর চিন্তা... আর ফেরার সময় বেশি রাত হওয়ার আগে ব্যাঙ্গালোর ফেরার চিন্তা... কাজেই এই কাটুম-কুটুমের দেশের কপাল আর ফেরে না।
এই চান্নাপাটনা পার হওয়ার পর থেকেই একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার চেপে বসেছিল, অবশ্য বেড়াতে বেরোলেই এই সখটা মাঝে মাঝে ঘাড়ে চেপে বসে... কি জানো? সাইনবোর্ডে দেখা, গন্তব্য আর কত দূর। বেশ কিছু দূর অন্তর অন্তর একটা করে অমন সবুজ বা হলুদ সাইন বোর্ড। তাতে লেখা, মাইসোর এত কিলোমিটার, শ্রীরঙ্গপত্তনম এত কিলোমিটার... কেমন যেন অধৈর্য করে তোলে। মনে হয় এরপরে কখন আবার একটা সাইনবোর্ড আসবে, তাতে দূরত্ব কতটা কমবে? অনেকক্ষণ চলার পর দেখলাম একটা বোর্ড এলো, যদি হয় তাতে দূরত্ব বেশি কমল না... মনে হয় ব্যাটা চালাকি করে এমন লিখেছে... গাড়ি এত জোরে চলছে, এইটুকু মাত্র এগোলো? হতেই পারে না! ড্রাইভারকে একবার বলেই দিলাম, “ভাই, তোমাদের এখানকার লোকজন চালাকি করে ডিস্ট্যান্স কমিয়ে লেখে... আসলে অনেকটাই দূর... আমি বেশ বুঝছি!” সে হা হা করে হেসে বলল, “আরে নেই ভাইয়া... গাড়ি মে কিলোমিটার দেখনা... একদম বড়াবড় রিডিং হোতা।” মাঝে বেশ চংমঙে ভাবটা আবার একটু মিইয়ে গেলো, ঝিম মেরে পড়ে রইলাম সিটে... দু-তিন স্লাইস কেক-এর টুকরো... খাওয়ার সঙ্গে গাড়ির সিটে গুঁড়ো ছড়ানো... আর দু’তিন ঢোক বোতলের জল। দেখতে দেখতে মানডেয়া চলে এলো, আর বেশি দেরি নেই। মানডেয়ার কথা বিশেষ করে কিছু বলার নয়, তবে এই খানে রাস্তা এক জায়গায় ইংরাজী অক্ষরের ‘Y’-এর মত ভাগ বাঁদিকে চলে গেছে। যারা মাইসোর যাচ্ছে তারা কেউ এই বাঁদিকে যাবে না, সোজাই যাবে। কিন্তু এই বাঁদিকে গেলেও বেশ দারুণ জায়গায় পৌছনো যায়... শিবানাসমুদ্রা বলে এক জায়গায় ঝর্ণা, কিছু জঙ্গলে-পাথুরে অঞ্চল, হারিয়ে যাওয়া পুরনো শহরের অবশেষ, আরও কত কি! কাবেরী নদী এই অঞ্চলের পাথুরে জমিতে বইতে বইতে এদিক-ওদিক দিয়ে ঝুপ-ঝাপ করে পড়ে জলপ্রপাত সৃষ্টি করে, বর্ষাকালে সে সব ঝর্ণা আর তার আশেপাশের সবকিছুই সত্যিই দেখার মত হয়। আর তালকাড় (বা তালকাড়ু) বলে একটি অবলুপ্ত প্রাচীন শহরের অবশেষ। এই তালকাড় নিজেই এক কিংবদন্তী, মাইসোর রাজবংশের সাথে অদ্ভুত ভাবে জড়িয়ে আছে এর ইতিহাস। অনেক কিছু দেখার আছে সেখানে, বেশ কিছু পুরনো মন্দির, ঐতিহাসিক নিদর্শণ। তবে এইখানে গেলে, বা এই তালকাড় নিয়ে বেশি কিছু বলতে বসলে আমাদের দেরি হয়ে যাবে... সোজা গেলেই কিছুক্ষণ পরে শ্রীরঙ্গপত্তনম... টিপু সুলতান, হায়দার আলির রাজ্যের রাজধানী। আমরা সেখানেই যাব। তারপর সেই কিছুক্ষণের অপেক্ষা, সাইনবোর্ডে কিলোমিটার কমে পাঁচ হ’ল, দুই হ’ল... আর অবশেষে সামনে আবার একটা বিশাল গেট ‘Welcome To the Historical City of Srirangapatna’