অনেকদিন পরে তোমার সাথে খেলা নিয়ে আড্ডা দিতে এলাম। প্রথমেই তোমাকে জানাই নতুন বছরের অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা। নতুন বছর ২০১৫ খুব ভাল কাটুক তোমার। এখন শীতের দিন, তুমি নিশ্চয় সুযোগ পেলেই বাইরে রোদে প্রচুর খেলা করছ- ক্রিকেট, ফুটবল বা অন্তত মনের আনন্দে দৌড়াদৌড়ি? এদিকে আমি ইচ্ছামতীর সাথে অনেকদিন গল্প করতে আসিনি বলে ইচ্ছামতী আর চাঁদের বুড়ি দুজনেই আমার ওপর বেজায় খাপ্পা হয়ে আছে ! তাই কথা দিতে হয়েছে যে আমি আরো নিয়মিত এসে তোমাদের সাথে খেলাধুলো নিয়ে গল্পগুজব করে যাব। নতুন বছর তো সবে শুরু হল, সারা বছর ধরে খেলার দুনিয়ায় নিশ্চয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে নানা চমক। কিন্তু সেসব হওয়ার আগে, আজকে বরং ২০১৪ তে খেলার জগতে উল্লেখযোগ্য কি ঘটে গেল - সে বিষয়ে আরেকবার আমরা একবার চট করে চোখ বুলিয়ে নিই চল! ভাবছ, নতুন বছরে পুরনো গল্প কেন? এর কারণ হল- দারুণ সব সাফল্যের গল্পগুলি কিন্তু কোনদিন পুরনো হয় না !

তুমি তো এতদিনে জেনেই গেছ, ফুটবল আমার সবথেকে প্রিয় খেলা ! তাই খেলার গল্প করতে বসলে আগেই শুরু করব ফুটবল দিয়ে। গত বছরের জুন/জুলাই মাসে ব্রাজিলে বসেছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। অনেক ভাল খেলা দেখলাম, আমাদের প্রিয় অনেক ফুটবলারকে একসাথে খেলতে দেখলাম, আর তার সাথে সাথে আমার মত তুমিও নিশ্চয়ই আগামী দিনের অনেক নতুন পছন্দের তারকাকে খুঁজে পেয়ে গেলে। যোগ্য দল হিসেবে শেষ পর্যন্ত জার্মানীই চ্যাম্পিয়ন হল; ফাইনালে মারিও গোটজের গোলে লিওনেল মেসির আর্জেন্তিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে। চতুর্থ বারের জন্য বিশ্বসেরা হওয়া ছাড়াও প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে আমেরিকা মহাদেশে বিশ্বকাপ জেতার সন্মানটাও তাদের মুকুটে যুক্ত হল।

অন্যদিকে ক্লাব ফুটবলে স্পেনের ফুটবল লীগ, যা "লা লীগা" নামে পরিচিত, সেখানে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের জয়জয়কার ছিল গত বছর। দীর্ঘদিনের বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের একাধিপত্যের জন্য লা লীগা খানিকটা একঘেয়ে যাচ্ছিল। তাই সীমিত রসদ নিয়ে বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের সাথে পাল্লা দিয়ে আর ২০০৪ সালের পর এই প্রথম তাদের হাত থেকে চ্যাম্পিয়নের শিরোপা কেড়ে নিয়ে অনেকেরই মন জিতে নিল অ্যাটলেটিকো। তবে তবুও তাদের সমর্থকদের মনে একটু আক্ষেপ থেকে যাবে। কারণ এর সাথে ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদার টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপাও তো তারা প্রায় জিতে ফেলেছিল। তীরে এসে তরী ডুবল ফাইনাল ম্যাচের শেষ মিনিটে এসে। রিয়াল মাদ্রিদের সাথে ফাইনাল ম্যাচে ১-০ গোলে জিতছিল অ্যাটলেটিকো। ৯০ মিনিট শেষ হয়ে ইনজুরি টাইম শুরু হয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছে রেফারীর বাঁশি বাজানোর। সেই সময় হঠাৎ গোল খেয়ে যায় তারা। আর হয়তো এই আচমকা ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে একষ্ট্রা টাইমে ৪-১ হেরে গোলে হেরে যায় অ্যাটলেটিকো।
কিন্তু এই শিরোপা রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসেও একটা বিশেষ গুরুত্ব রেখে যাবে। এক তো নিজেদের শহরের প্রতিদ্বন্দী ক্লাবকে হারিয়ে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া, আর তার সাথে এই নিয়ে দশবার ইউরোপ সেরা হওয়ার শিরোপা অর্জন।

২০১৪ সাল আর্সেনাল সমর্থকদেরও একেবারে নিরাশ করেনি। মরসুমের মাঝামাঝি সময় অবধি এগিয়ে থেকেও লীগ না জেতার আক্ষেপ তাদের থাকবে - কিন্তু ২০০৫ সালের পর আবার এই প্রথম এফ-এ কাপ জেতা সেই আক্ষেপ অনেকটাই মিটিয়ে দেবে। ইংল্যান্ডের এই কাপ টুর্নামেন্ট বিশ্বের প্রাচীনতম কাপ টুর্নামেন্ট। নয় বছর ধরে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কাছাকাছি এসেও শিরোপা অধরা রয়ে গেছে। তাই ওয়েম্বলী স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল হাল সিটি যখন খেলা শুরুর প্রথম আট মিনিটের মধ্যেই ২ গোলে এগিয়ে যায়, তখন আর্সেনাল সমর্থকদের মাথায় হাত - স্বপ্ন হয়তো এবারেও অধরা রয়ে গেল। কিন্তু তখনও হার মানেনি খেলোয়াড়েরা; শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় একষ্ট্রা টাইম অবধি আর পুরোপুরি আধিপত্য বজায় রেখে তারা জিতে যায় ৩-২ গোলে। সমর্থকেরা এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর ভেঙ্গে পড়ে আনন্দের বাঁধ।

এর মধ্যে ভারতীয় ফুটবলেও ঘটে গেল অনেক পরিবর্তন। অনেক অর্থব্যয় করে, বিদেশ থেকে নামী খেলোয়াড়দের নিয়ে এসে দশটি শহরের দশটি দল নিয়ে শুরু হয় ইন্ডিয়ান সুপার লীগ, বা সংক্ষেপে আই-এস-এল। রবার্ট পিরেস, ফ্রেডি লিউনবার্গ, ডেভিড ট্রেজেগুয়ে, লুই গার্সিয়ার মত তারকারা এখন তাদের সোনালী দিন অনেকটাই পিছনে ফেলে এসেছেন - কিন্তু তবুও তাদের ভারতের মাটিতে খেলতে দেখা যেমন দর্শকদের কাছে খুবই রোমাঞ্চকর, তেমন ভারতের উঠতি খেলোয়াড়দের কাছেও এটা ছিল একটা বড় সুযোগ এদের সান্নিধ্যে খেলে নিজেদের খেলার উন্নতি করার। তুমিও হয়তো এর মধ্যে অনেক খেলাই দেখেছ আর তার সাথে নিজের পছন্দের দল আর অনেক পছন্দের ফুটবলারও তৈরী হয়ে গেছে। প্রথমবারের টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হল আমাদেরি শহরের দল "অ্যাটলেটিকো দে কোলকাতা"। প্রথমবারের এত বড় এই টুর্নামেন্টের আয়োজনে কোন ত্রুটি ছিল না, আর তাই এর জনপ্রিয়তা হয়তো আগামী বছরে আরো বারবে। ভারতের ফুটবলপ্রেমীরা তার সাথে আশা করবে যে এই প্রয়াস যেন আখেরে ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির কাজে আসে।

এবারে চল ক্রিকেটের কথায় আসি। বিভিন্ন খবরের মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা হয়তো ঘটল বছরের একদম শেষের দিকে। অস্ট্রেলিয়াতে চার টেস্টের সিরিজ চলাকালীন হঠাৎ করে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে বসলেন মহেন্দ্র সিং ধোনী। ক্যাপ্টেন হিসেব টেস্টে এমনিতে ধোনীর রেকর্ড খুব একটা ভাল নয়, বিশেষ করে বিদেশের মাঠে। টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গিয়ে ধীরে হীরে তিনি যে একদিনের ক্রিকেট আর টি-২০ এর দিকে বেশী মনোনিবেশ করবেন সেটা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু তৃতীয় টেস্টের পর সিরিজের মাঝেই যে এমন ঘটবে সেটা অনেকেই ভাবেনি। ২০০৮ সালে প্রথম ক্যাপ্টেন হওয়ার পর মোট ৬০ টা টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনী।
টেস্টে নতুন ক্যাপ্টেন হলেন বিরাট কোহলী। সারাবছর ভাল ব্যাটিংয়ের নমুনা রেখে তাই কোহলীর বছরটাও শেষ হল উজ্জ্বলভাবে। আর এর মাঝে অস্ট্রেলিয়া সিরিজেই তিনি করে ফেললেন দুটি বিরল রেকর্ড। সিরিজের চারটি টেস্টে মোট চারটি সেঞ্চুরী করলেন কোহলী। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে একই টেস্ট সিরিজে বিদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে এই রেকর্ড ছিল শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের হার্বার্ট সাটক্লিফ আর ওয়ালি হ্যামন্ডের। আর এই চারটে সেঞ্ছুরির দুটি এল একই টেস্টে - অ্যাডিলেড টেস্টের দুই ইনিংসে। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একই টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড এর আগে ছিল বিজয় হাজারে, সুনীল গাওস্কর আর রাহুল দ্রাবিড়ের। এঁদের মধ্যে বিজয় হাজারে অ্যাডিলেডের মাঠেই ১৯৪৮ সালে প্রথম এই রেকর্ড করেছিলেন।

বছরের শেষের দিকে ক্রিকেটজগতে ঘটে গেল একটা খুব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও। ২৫ শে নভেম্বর সিডিনির মাঠে শেফিল্ড শীল্ডের ম্যাচে ব্যাট করার সময় একটা বল এসে লাগে অস্ট্রেলিয় ব্যাটসম্যান ফিলিপ হিউজেসের গলায়। মাঠের মধ্যেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। দু'দিন পর মৃত্যু হয় ২৫ বছরের এই তরুণ ক্রিকেটারের।

ফুটবল, ক্রিকেটের পর এবারে টেনিস। এবছর আমরা পেলাম দুই নতুন গ্র্যান্ডস্ল্যাম বিজয়ীকে। বছরের প্রথম গ্র্যান্ডস্ল্যাম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে নিলেন সুইজারল্যান্ডের স্টানিস্লাস ওয়ারিঙ্কা। আর বছরের শেষ গ্র্যান্ডস্ল্যাম ইউ-এস-ওপেন জিতলেন মোনাকোবাসী বসনিয়ান মারিন সিলিচ। ভারতীয়দেরও একেবারে খালি হাতে ফিরতে হলনা। ইউ-এস-ওপেনের মিক্সড ডাবলস বিভাগে ব্রাজিলের ব্রুনো সোয়ারেসকে সাথী করে চ্যাম্পিয়ন হলেন সানিয়া মির্জা।

২০১৪ তে বসেছিল এশিয়ান গেমসের আসরও - দক্ষিণ কোরিয়ার ইঞ্চিয়ন শহরে। সেখানে ভারতীয় খেলোয়াড়েরা ১১ টি সোনাসহ মোট ৫৭ টি পদক এনে দিলেন দেশকে। এর মধ্যে মণিপুরের মহিলা বক্সার মেরী কমের নাম তো তুমি জানই। এশিয়ান গেমসে সোনা জেতা ছাড়াও তাঁর নাম ঘরে ঘরে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর জীবনী নিয়ে তৈরী হিন্দি সিনেমা "মেরী কম" বেরোনোর পর থেকে।
আজকের মত আড্ডাটা এখানেই থামাই। শুরু হয়ে গেছে নতুন বছর ২০১৫। এবছরের বিশেষ আকর্ষণ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আর তা ছাড়া বাকি অন্য সব খেলাধূলা তো আছেই। আমার মত তুমিও নিশ্চয়ই সব খবরের দিকে নজর রাখবে আর ফাঁকে ফাঁকে মনের মত খেলাগুলো দেখার জন্য কিছুটা সময়ও করে নেবে।
ছবি সৌজন্যেঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট