সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
 ধনী লোকটি ও মৃত্যুর স্বর

অনেক বছর আগের কথা, রুমানিয়ায় একজন ধনী মানুষ বাস করত। তার এত টাকা ছিল যে, সে যদি এক সপ্তাহের সারা দিন, সারা রাত ধরে তার টাকা পয়সা গুনতে থাকত, তবুও তার অর্থের হিসাব রাখা শেষ হত না। এত যার ধন-দৌলত, তোমরা ভাবছ নিশ্চয়, সে কত সুখী। কিন্তু কি অবাক কাণ্ড, তার মনে এতটুকুও স্ফূর্তি ছিল না। তার সবসময় মনে হত, সে যদি মরে যায়, তবে এত ধন-সম্পত্তির কি হবে। অন্য সবাই যখন হাতে টাকা থাকলে রংবেরঙের পোষাক কিনে, বেড়াতে গিয়ে, ভাল ভাল খেয়ে খরচ করে আনন্দ পায়, তখন এই লোকটি মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে থাকত। মরে গেলে সে যে এই বিপুল সম্পত্তির এক অংশও সঙ্গে নিতে পারবে না, সেই ভেবেই তার মুখ সর্বদাই বিষণ্ণ হয়ে থাকত। তার আত্মীয়রা তাকে কত বুঝিয়েছে, কোন কথাই তার কানে যেত না।

এত দুঃখের চিন্তার বোঝা আর সইতে না পেরে, লোকটা একদিন দেশান্তরী হল। সে ভাবছিল, সারা পৃথিবীতে কি এমন একটা দেশ নেই যেখানে মৃত্যু নেই? সে যদি সেরকম দেশ খুঁজে পায় তবে সে বাকি জীবন সেই দেশেই বাস করবে। অনেক বছর ধরে সে ঘুরতেই থাকল, কত অজানা জায়গায় গেল, বিচিত্র ধরণের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেল। সব জায়গাতেই তার কথা শুনে লোকে তাকে পাগল বলে ঠাট্টা করে খুঁচিয়ে অস্থির করে তুলল।

শেষ পর্যন্ত সে একটা বিচিত্র দেশে উপস্থিত হল। সেখানকার অবস্থা দেখে তার কিঞ্চিৎ আশা হল। জানা গেল, সে দেশে মৃত্যু শব্দটার সঙ্গে কারোরই পরিচয় নেই। প্রথমে তার তো নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ইতস্ততঃ করে একজনকে সে জিজ্ঞাসা করল, " যদি কারোরই মৃত্যু না হয়, তাহলে তো তোমাদের দেশে সবসময়ই লোক গিজ্‌গিজ্‌ করে, তাই না?" "মোটেই না, তা হবে কেন", সেই লোকটি উত্তর দিল, " আমাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন সময়ে শুনতে পায় একটা স্বর তাকে ডাকছে। এবং যখন সে সেই স্বরকে অনুসরণ করে বের হয়, সে আর ফিরে আসে না।"

লোকটার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে পৃথিবীতে এমন একটা দেশ থাকতে পারে। এখান থেকে কেউ কি আর ফিরে যায়? সে ঠিক করল, সে এখানেই বাকি জীবন থেকে যাবে আর এখানকার বোকা লোকেদের মত কখনও সেই 'স্বরের' ডাকে সাড়া দেবে না। তাহলেই তাকে কোনদিনও মরতে হবে না। এই হল তার স্বপ্নের দেশ। মৃত্যুকে ফাঁকি দেবার এমন উপায় কি ছাড়া যায়? শুধু তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের জন্য তার ঈষৎ চিন্তা রয়ে গেল। ইশ, তার পরিবারও যদি তার মতই বুদ্ধিমান হত। তাই সে সবার উপর কঠোর হুকুম জারি করল, কেউ যদি শোনে কোন অচেনা স্বর নাম ধরে ডাকছে, তবে সে যেন কিছুতেই সেই ডাকে সাড়া না দেয়।

দিন, মাস, বছর গড়িয়ে গেল। ধনী লোকটার মন থেকে আস্তে আস্তে মৃত্যুভয় মুছে যেতে লাগল; বরং সে যে মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পেরেছে, সেজন্য বেশ একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করত। একদিন পরিবারের সকলে রাতের খাওয়া্র শেষে গল্পগুজব করছে, এমন সময় হঠাৎ লোকটির স্ত্রী চেয়ার থেকে শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল। তার কোল থেকে তার সেলাইএর সরঞ্জাম মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। " ঠিক আছে, আমি আসছি, আমি আসছি " বলে কোন দিকে না তাকিয়ে সে আলনা থেকে পালকের কোটটা নিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল। বাইরে তখন শীতের রাত্রি বরফে ঢেকে যাচ্ছে।

ধনী লোকটিও উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে উঠল। স্ত্রীর এই আচরণের অর্থ তার কাছে মূহুর্তেই স্পষ্ট হয়ে গেল। সে কড়া গলায় স্ত্রীকে ধম্‌কে বলল, " হচ্ছে কি? তোমায় না বলেছি এরকম কোন স্বর শুনলে সাড়া দেবে না? কোত্থাও যাবে না। মরতে যদি না চাও, তবে চুপ করে বসে থাকো।" ভয়ে তার চীৎকারটাও কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল।

আকুল গলায় মহিলা বললেন, " তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না, কে যেন আমায় বারবার ডেকে যাচ্ছে? দয়া করে এক মিনিটের জন্য যেতে দাও, দেখে আসি কিসের প্রয়োজনে কে আমায় এতবার ডাকছে?"
তার স্বামী তাকে বারবার বোঝাতে চাইল যে এটা নতুন শিকার ধরবার জন্য মৃত্যুর একটা ফাঁদ মাত্র। কিন্তু মহিলার মন তাতে মানল না। কিছুতেই স্বামীকে রাজি করাতে না পেরে সে একটা চালাকি করল। " ঠিক আছে, তুমি যখন চাইছ না, আমি যাব না। কিন্তু আমার হঠাৎ খুব শীত করছে। আমার পালকের কোটটা একটু দেবে?"

কথা শুনে লোকটির মনটা একটু ঠাণ্ডা হল। যাক্‌, বউটাকে তাহলে বোঝানো গেছে। এই ভেবে সে পালকের কোটটা স্ত্রী-এর হাতে দিল। যেই না কোটটা হাতে পাওয়া, সেটা গায়ে গলিয়ে তার স্ত্রী এক ঝট্‌কায় দরজার বাইরে গিয়ে শীতার্ত রাত্রির অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

স্বামীটি প্রথমে একটু হক্‌চকিয়ে গেলেও এক মূহুর্ত পরেই সেও ছুটে বেরিয়ে গেল তার বৌকে ধরবার জন্য। ছুটতে ছুটতে স্ত্রীকে ধরার জন্য হাতটা বাড়িয়ে সে কোনরকমে তার কোটটার একপ্রান্ত ধরল। কিন্তু তার হাতের মধ্যে শুধু কোটটাই ধরা রইল। মহিলা ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি আসছি বলে চিৎকার করতে করতে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এল। তাকে আর দেখাও গেল না।

হতাশ হয়ে লোকটি ঘরে ফিরে এল। যতই হম্বিতম্বি করুক, বৌকে সে বড্ড ভালবাসত। কোন কাজে আর মন বসে না; একা ঘরে বসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সে ভাবত, " বৌটা আমার ভারি বোকা ছিল। কত করে তাকে বোঝালাম, সে শুনলই না! " তারপরই তার চোখ লাল হয়ে যেত, রেগে গিয়ে সে হাত মুঠি করে চেঁচিয়ে উঠত, " কিন্তু আমি এত সহজে ভুলব না। মৃত্যু আমায় কিছুতেই বোকা বানাতে পারবে না।"

দিন যায়, বছর যায়, সব শোকই আস্তে আস্তে মুছে যায়। লোকটার কাজকর্ম যেমন বেড়েছে, তার টাকাপয়সাও আরো জমা হয়েছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে সে এখন সুখী, পরিতৃপ্ত। একদিন সে গেছে নাপিতের কাছে, চুলদাড়ি কেটে পরিষ্কার হয়ে সে যাবে এক পার্টিতে। তাকে দেখে নাপিত বলল, "বাবু, একটু বসুন, হাতের কাজটা সেরেই আপনার কাছে আসছি।" ধনী লোকটির বিশেষ তাড়া ছিল না। সে একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজে দেখতে লাগল।

হঠাৎ সেই সেলুনের সবাই সবিস্ময়ে দেখল, লোকটি সোজা হয়ে বসল, তার মুখ রাগে ভয়ে লাল হয়ে গেছে। সে চেঁচিয়ে বলছে, "আমি যাব না, কক্ষনো যাব না। তুমি আমায় অন্যদের মতো বোকা পেয়েছ নাকি?" সকলেই অবাক হয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল। নাপিত বিনীতভাবে বলল, "মশাই, এখানে তো কেউ নেই। কাকে আপনি একথা বলছেন?"

ধনী লোকটি কারো কথায় কর্ণপাত করল না। একই কথা বারবার চেঁচাতে চেঁচাতে সে হঠাৎ নাপিতের হাতের ক্ষুরটা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। যে তাকে ডাকছে, তাকে সে এমন শাস্তি দেবে যাতে ভবিষ্যতে সে আর লোকটাকে কখনও বিরক্ত করার সাহস না দেখায়।

 ধনী লোকটি ও মৃত্যুর স্বর

ছুরি বাগিয়ে চিৎকার করতে করতে সে শহরের সমস্ত রাস্তা শেষ করে বরফে ঢাকা পাহাড়ের রাস্তা ধরে দৌড়তে লাগল। নাপিত বেচারা তার ছুরির জন্য পিছনে পিছনে ধাওয়া করতে লাগল। এইভাবে যখন দুজনের মধ্যে আর মাত্র কয়েক হাতের ব্যবধান রয়েছে, হঠাৎ ধনী লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যাপার দেখে খাবি খেয়ে নাপিত শেষ মূহুর্তে নিজের রাশ টেনে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সেইখানে এসে দাঁড়াল, যেখান থেকে ধনী লোকটিকে আর দেখা যায়নি। ভয়ে নাপিতের তো ভির্‌মি খাবার দশা। কিছুক্ষণ কাঁপবার পর সে একটু স্থির হয়ে সন্তর্পনে পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে উঁকি মারল। বাপ্‌রে, কি বিশাল অতলস্পর্শী খাদ! নীচে যে কোথায় শেষ হয়েছে দেখাই যায় না। নাপিত ধনী লোকটির চিহ্নমাত্র দেখতে পেল না।

নাপিতের পা যেন চলে না; তবু ফিরতে তো হবেই। শহরে ফিরে সে সমস্ত মানুষজনকে সব ঘটনা বিস্তারিতভাবে জানাল। সে আরও বলল, এখন তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, এর আগে যেসব মানুষেরা এই বিচিত্র স্বর শুনে তাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে গেছে, তারা সকলেই এভাবেই সেই বিশাল খাদে পড়ে হারিয়ে গেছে।

এসব শুনে সেই শহরের মানুষজন খুব অবাক হয়ে গেল। যে গভীর খাদ তাদের এত বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-পরিজনদের গিলে ফেলেছে, সেই খাদ নিজেদের চোখে দেখবার জন্য তাদের কৌতূহল আর বাধা মানে না। শেষে একদিন নাপিতের পরিচালনায় এক বিশাল জনতা রওনা হল সেই খাদ দেখার জন্য। কিন্তু একি! বিশাল দলটি গিয়ে কোথাও কোন খাদ দেখতে পেল না। তাদের সামনে পড়ে আছে এক দিগন্তবিস্তৃত সবুজ প্রান্তর।

তবে সেই দিন থেকে সেই অদ্ভুত স্বর আর শোনা গেল না। পৃথিবীর অন্য সব মানুষজন যেভাবে মারা যায়, সেভাবেই তাদেরও জীবনের সমাপ্তি ঘটতে লাগল।

উৎসঃ রুমানিয়ার লোকগাথা।

ছবিঃ দীপায়ন সরকার

শুক্তি দত্ত ভালবেসে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। রূপকথা, প্রাচীন সাহিত্য, দেশবিদেশের লোকসাহিত্য, গল্পকথা পড়তে ভালবাসেন। সেগুলো নিয়ে আলোচনা বা শিশুদের সেই গল্প শোনাতেও ভালবাসেন। প্রধানতঃ শিশুমনস্তত্ত্ব ও তাদের শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। সেটা শুধু পড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি শিশু সাহিত্য, লোকসাহিত্য প্রভৃতিকে তাদের মূল্যবোধ বিকাশে কাজে লাগাতে চান।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা