সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
হেমন্তকাল- যাকে নিয়ে কেউ রচনা লেখে না!

পুজো শেষ, একাদশী… তারপর হঠাৎই পাড়াগুলো কেমন নিঝুম হয়ে যেত। এতদিন ধরে আলো-ঝলমল করা রাস্তার আলোগুলো একদিনে সব সরিয়ে নেওয়া হত। মণ্ডপের কাপড়, ত্রিপল সব সরানোর কাজ চলত। পড়ে থাকত শুধু বাঁশের খাঁচা। আলোর লাইটিং-এর ফ্রেম, মণ্ডপের ফ্রেম… চলে যাওয়া একটা উৎসবের অবশেষ। যে সব পাড়ার পুজো পঁচিশ-ত্রিশ বছর পর আজ অনেক বড়ো আয়োজনের পুজো হয়ে উঠেছে, তারা সবাই তখন এত বড়ো আয়োজক ছিল না, জানো তো? কেউ কেউ মাঝারী, কেউ কেউ একেবারেই অপরিচিত ছিল। খুব সাধারণ মানের মণ্ডপ, এত থিমের ব্যাপার ছিল না শহরতলি অঞ্চলে। আর শহরতলির একটু ভেতর দিক মানে তো সে সময়ে মফঃস্বলই বলা চলে। প্রতিমা-নিরঞ্জনের পর চালচিত্রটা পড়ে থাকত। কোথাও টিমটিম করে একটা আলো জ্বালানো থাকত, কারণ কদিন পরে লক্ষ্মীপুজো হবে… তারপর পুরোপুরি খুলে ফেলা হবে মণ্ডপের সব বাঁশ। লক্ষ্মীপুজো অবধি কিছুটা টিকিয়ে রাখা হত। একটা বাতি জ্বলত সন্ধে হলে।

কেমন একটা হঠাৎ মন খারাপ নেমে আসা দৃশ্য... পুজো আসবে আসবে আনন্দ… চলে গেলেই সব খালি। টিমটিম করা ওই আলো, অযত্নে পড়ে থাকা চালচিত্র। দশমীর পর থেকে যে এক একজন আত্মীয়ের পরিবারে বিজয়ার প্রণাম করতে যেতাম মা-বাবার সঙ্গে… মামাবাড়ি, পিসিদের বাড়ি, বাবার মামাবাড়ি, মায়ের পিসতুতো দাদাদের বাড়ি (সেও আর এক মামাবাড়ি—বছরের এই সময়টা যেন একটা কলকাতা আর তার আশপাশ ঘোরার বিশেষ সময় হয়ে উঠত। বড়িশা, কালীঘাট, মূর অ্যাভিনিউ, ঢাকুরিয়… থেকে শিবপুর অবধি। মোটামুটি একটা লিস্ট হয়ে থাকত। আমরা দশ দিনের মধ্যে সবার বাড়ি যাব। তাঁরাও আসবেন কেউ না কেউ। আর বছরের পর বছর, সেই সব অঞ্চলের রাস্তা দিয়ে চেনা মণ্ডপদের (যেগুলো এক প্রকার ল্যান্ডমার্ক ছিল কিছু অঞ্চলের) পাশ দিয়ে যাওয়া… ওই পুজো শেষের বিষাদমাখানো টিমটিম করা আলো আর শূন্য খাঁচা দেখতে দেখতে। আবার একটা বছরের অপেক্ষা।

ঠিক এই সময়টাতেই, এক অদ্ভুত ব্যাপার হত। সন্ধে হলেই একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে যেত পাড়ার রাস্তাগুলো। ছোটোবেলা এত নাম জানতাম না, পরে আসতে আসতে চিনেছি। মাধবীলতা ফুল সবার আগে চিনলাম… আমাদের বাড়িতেই, সদর দরজার ওপর ছড়িয়ে থাকত। সন্ধে হলে বাড়ির চারপাশ সেই গন্ধে ভরে থাকত। কোনো পাড়া দিয়ে যাওয়ার সময়ে এই পরিচিত সুবাস পেলে বুঝতে পারতাম, কারো না কারো বাড়িতে মাধবীলতা ফুটে আছে। তারপর চিনলাম ছাতিম, ভালো নাম সপ্তপর্ণী। ডালের এক উৎস থেকে একসঙ্গে সাতটা পাতা বেড়ে ওঠে বলে এমন নাম। দুর্গাপুজো আসার আগে থেকেই শরতে ছাতিমের ফুল নিজের উপস্থিতি জানান দিতে থাকে। কিন্তু পুজো চলে যাওয়ার পর, ফাঁকা রাস্তাগুলো এই ছাতিমের গন্ধ, আর তার সঙ্গে হালকা হিমের চাদর নেমে আসা… এ এক অন্যরকম সময়। ওই বিজয়ার প্রণামের পালা শেষ হলেই হঠাৎ দেখতাম বেলা ছোটো হয়ে যাচ্ছে, মাঠে খেলার মেয়াদ কমে যাচ্ছে। মা বলতে শুরু করত—হিম পড়বে, সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরে আসবি।

তোমাদের কাছে বলতে লজ্জা নেই, ছোটোবেলাতে হিম মানেই বুঝতাম না। আর মাকে বা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতেও চাইতাম না— পাছে মুখ্যু ভাবে। নিজে নিজেই ভেবে নিতাম, সন্ধের পর একা রাস্তায় থাকলে বা বাড়ির ছাদে থাকলে বিপজ্জনক কিছু একটা পড়বে হয়ত আকাশ থেকে। হিম যা-ই হোক, আমার মত ছোট্ট মানুষের পক্ষে খুব একটা সুবিধের না, ভয়েরও হতে পারে ব্যাপারটা।

সন্ধের পর ছাদে গেলে হালকা হালকা ঠান্ডা লাগত। বাতাস বইলে গা শিরশির করে উঠত। অথচ শীত না, অন্য রকম। ছাদের পাঁচিলগুলো কেমন ঠান্ডা-ঠান্ডা ভিজে-ভিজে মনে হত। খেলা থেকে ফিরেই পড়তে বসতাম না, ছাদে চলে যেতাম। আমাদের বাড়ির ছাদের উত্তর দিকে ছিল জামরুল, জাম আর নিম গাছ, পাশের বাড়ির বাগানে। আর একদিকে দূরে ঈশাণ কোণে (উত্তর-পূর্ব) একটা ডোবা। সেখানে মাছরাঙা আসত মাছ ধরতে। আর অগ্নি কোণে (দক্ষিণ-পূর্ব) লম্বা দুটো নারকেল গাছ… মিত্তিরদের বাড়ি। ওই অঞ্চলের সব থেকে চওড়া দোতলা এবং দালানযুক্ত বাড়ি। সন্ধে হলেই ওই ডোবা আর নারকেল গাছের দিক থেকে মিটিমিটি জোনাকি উড়ে আসতে শুরু করত। দুর্গাপুজোর কদিন পর, যখন দেখতাম, তুলসী গাছের গোড়ায় সন্ধেবেলা ঠাকুমা ‘পিদিম’ জ্বেলে দিয়ে যাচ্ছে সন্ধে হতেই— বুঝতে পারতাম কার্তিক মাস পরে গেল। অবশ্য দুর্গাপুজো কার্তিক মাসেও হয়। মলমাস বলে একটা ব্যাপার থাকে। তখন তো এসব অত বুঝতাম না। শুধু জানতাম কার্তিক মাসে তুলসীতলায় বাতি দেওয়া হয়। ঠাকুমা প্রদীপকে বলতেন পিদিম। আলাদা আলাদা ত্রিশটা মাটির পিদিম ঘরে বানানো হত, বাগানের মাটি দিয়ে। প্রতি সন্ধেবেলা একটি নতুন প্রদীপ জ্বালানো হত, আর আগের দিনেরটা সরিয়ে রাখা হত। পরে সব একসাথে ফেলে দিয়ে আসা হত একটা বড়ো পুকুরে—ভৈরব পুকুর।

আমার একটা দুষ্টুমি ছিল, ঠাকুমা চোখের আড়াল হলেই এই প্রদীপের আগুন নিয়ে খেলা। কোথাও সুপুরির খোলা, শুকনো জামরুল পাতা, পেয়ারা পাতা… এসব জড়ো করে তাতে প্রদীপের আগুন ধরিয়ে দিতাম। তারপর ক্যাপ-বন্দুক ফাটানোর ওই লাল ক্যাপের ফিতে ছোটো ছোটো করে ছিঁড়ে সেই আগুনে ফেলে দেওয়া। চটাপট-দপাদপ আওয়াজ শুরু হত ক্যাপে আগুন লাগতেই। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠত জ্বলন্ত পাতা। উড়তে শুরু করত হাওয়ায়। মা বা বড়োপিসি টের পেলে রক্ষে থাকবে না! তাই অল্প পাতা জড়ো করেই কাজ হাসিল করতে হত। তারপর লক্ষ্মী ছেলের মত নেমে পড়তে বসে যাওয়া। মাঝে মাঝে পরদিন সকালে কেউ না কেউ পোড়া-পাতা আবিষ্কার করত। সেই মত ব্যবস্থাও হত আমার।

আসলে, আরো কিছুটা সময় সন্ধেবেলা ছাদে কাটানোর একটা ঝোঁক ছিল। তাকে ছাদে থাকার ইচ্ছেও বলতে পারো, পড়াশুনোয় ফাঁকি দেওয়ার ছলও বলতে পারো। মাধবীলতা ফুলের গন্ধ। আরো কীসব রাতে ফোটা ফুলের গন্ধ। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। আর কাছে দূরে এক একটা বাড়িতে এক-একটা বাঁশ বা লম্বা লাঠির মাথায় আলো জ্বলে ওঠা— আকাশপ্রদীপ। কারো কারো ঘরে প্রদীপ, আর কারো কারো বাড়িতে এমন লাঠির ওপর বাতি জ্বলত। লাল, সবুজ, বেগুনী, নীল। একটাই আলো… ছাদ থেকে অনেকটা ওপরে একা একা জ্বলছে সারা রাত। এই আকাশপ্রদীপ জ্বলতে দেখলেই বুঝতে পারতাম— কার্তিক মাস এসে গেছে। এসে গেছে হেমন্ত কাল।

১৯৮৯-এ তখন তিন বছর বয়স, হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলা সবাই টিভির সামনে থমথমে মুখে বসে… হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রয়াত। খবরটা সকলের কাছে এতটাই আকস্মিক ছিল, যে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। পরদিন সকালে সব কটি বিশেষ সংবাদপত্রে বড়ো বড়ো ছবিসহ সেই সংবাদ। অনেক ছোটো… কে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বুঝতাম না। চিনতাম না। শুধু এই ঘটনায় বুঝলাম, গায়ক… যতটা বিখ্যাত, তার থেকেও বেশি সম্মানিত। পূজিত বললেও ভুল হয় না। উনি চলে গেলেন আশ্বিনে, পুজোর কিছু আগে। পুজোতে পাড়ার মাইকে মাইকে হেমন্তের গান। এর প্রায় বছর দুয়েক পর, বাংলার ছটি ঋতু মুখস্থ করা শুরু হল, জানলাম শরত আর শীতের মাঝে এক ঋতু— হেমন্ত। গ্রীষ্মকালে গরম করে, বর্ষাকালে বৃষ্টি হয়, শীতকাল খুব ঠান্ডা। শরৎকালে সোনালী রোদ, আকাশে পেঁজাতুলো, মাঝে মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি আর দুর্গাপুজো… শারদীয়া উৎসব। বসন্তকালে গাছে নতুন পাতা, ফুল… শীত চলে গিয়ে আবার দখিণা বাতাস। রচনাতে তো ঋতুরাজ বসন্ত বলে দিত! কিন্তু এই হেমন্তকাল কেমন?… শরৎ আর শীতের মাঝে কী আলাদা হয়?… এখন আর আলাদা করে টেরই পাওয়া যায় না, গ্রামাঞ্চলে বোঝা গেলেও শহরে তো একেবারেই না। হেমন্তকাল রচনা কেউ লিখতে দেবে না স্কুলে।

কিন্তু দু-তিন দশক আগে অবধি শহরে বা শহরতলি অঞ্চলেও শরতের যাওয়া আর শীতের আসার মাঝে হেমন্তের একটা অস্তিত্ব ছিল, স্পষ্ট অস্তিত্ব। কোনো রচনা বইয়ের দরকার নেই, এই আলাদা আলাদা লক্ষণগুলি দিয়েই আমরা হেমন্তকে চিনে নিতাম। কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি অবধি একটা সময়— ইংরেজী মাসে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে নভেম্বরের শেষ অবধি। ভোরবেলা হালকা ঠান্ডা লাগত, একটা পাতলা চাদর না থাকলে সকালে চোখ-জ্বালা, নাক থেকে জল… বাঁধা-ধরা ছিল আমার। মা পারলে তখন থেকেই কান-ঢাকা টুপি পরিয়ে দেয়। শরতের মতই একটা ঝলমলে সকাল, অথচ রোদের আঁচটা যেন কেউ রেগুলেটর দিয়ে কমিয়ে দিয়েছে। অনেক বেলা অবধি এই ভাবটা থাকত। যেহেতু আমাদের অঞ্চলে অনেকগুলো ছোটো-বড়ো পুকুর ছিল। দেখতাম, সকাল হতে পুকুর আর তার কাছাকাছি জায়গাজুরে একটা পাতলা সাদা চাদরের মত ভেসে আছে বাতাসে। কুয়াশার মত ঘন নয়, মিহি পাতলা একটা চাদর। ঠিক যেমন শীতকালে দেখা যায় সন্ধের আগে বা ভোরবেলা— ক্ষেত, মাঠ, পুকুর বা বিলের ওপরে, ট্রেনে করে যেতে যেতে। যেমন দেখা যায় শীতের সকালে গড়ের মাঠে। সেই পাতলা চাদরে কেমন একটা হালকা ধুনোর গন্ধ মিশে থাকত। কোনো কোনো পুকুরে তখনও ভেসে থাকত নিরঞ্জন হওয়া প্রতিমার কাঠামো, খরের আদল। পান্নার মত সবুজ জলে সেই খরের কাঠামো, হালকা রোদ… আর ওপর চাদরের মত স্তর। গ্রামাঞ্চলে হেমন্তের রূপ আরো সুন্দর। ছোটোবেলা এবং পরে কলেজে পড়ার সময়েও দু-এক বার এক কার্তিক মাসে গ্রামে থেকেছি। কখনো কোনো আত্মীয়ের বাড়ি, অথবা বন্ধুর বাড়ি। কালীপুজো উপলক্ষে। গ্রামের হেমন্তের সকাল, আর বিকেল থেকে রাত অবধি হেমন্তের প্রকৃতি পরিবর্তন যে কতটা সুন্দর, কতটা কাব্যিক… না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। এখনো কার্তিক মাসে শহরের বাইরে, গ্রামের দিকে থাকলে সেই সৌন্দর্য অনুভব করি, পুরনো কথা মনে পড়ে। কালীপুজো… অমানিশি, কেমন বিকেলের পর থেকে আসতে আসতে পালটে গেল আকাশ, চারপাশের পরিবেশ। নিঝুম পল্লীগ্রামের বাড়িতে বাড়িতে শুধু শঙ্খধ্বনি আর বাতি দেওয়া। আলোর রোশনাই নেই সে অর্থে। শুধু যে অঞ্চলে বারোয়ারী পুজো, সেখানে কিছুটা আলো। অনেক রাত অবধি জেগে সেই সব রাস্তায় হেঁটেছি। সকালে চারপাশের পুকুর, মাঠ, ক্ষেত… দেখে মনে হত সমস্ত গ্রামাঞ্চল জুড়েই যেন এক রাত্রিব্যাপি লোকাচার সমাপ্ত হল। এখনো ধুনোর গন্ধ লেগে আছে পাতলা কুয়াশার চাদরে। শারদীয়া এক বড়ো উৎসব বাঙালীর... কিন্তু এই হেমন্তের এক অমাবস্যা রাতে বেঁচে আছে কালীপুজো— রামপ্রসাদী গান, পান্নালাল ভট্টাচার্য, নজরুলগীতি... কথামৃতের একটুকরো অধ্যায়।

হেমন্তের বিকেলের রঙ এমনিই অন্যরকম ছিল। বিকেল থেকে ঝুপ করে সন্ধে হওয়ার পথে ধূসর রঙে ছেয়ে যেত আকাশ। দূষণ বা জলবায়ু পরিবর্তনের মত ধোঁয়াশা নয়— এক নরম ধূসর বর্ণ আকাশ। মেঘ থাকলেও তাই, না থাকলেও তাই। ওই যে শুরুর দিকে একটা মনখারাপের কথা বললাম… পুজো চলে গেছে, কালীপুজোর অপেক্ষা, খেলার সময় কমে যাওয়া, আবার পড়তে বসা… এইসব কিছু মিশে থাকত আকাশের ওই রঙে। তারপর আকাশে আরো একটু অন্ধকার গাঢ় হতেই সন্ধ্যাতারার মত এক এক করে জ্বলে উঠত আকাশপ্রাদীপ। এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে ভেসে আসত শাঁখ বাজানোর আওয়াজ, সন্ধে দেওয়া হত— আর ওই লম্বা বাঁশ বা লাঠির পোলের ওপর জ্বলে উঠত নাইট-ল্যাম্পের মত আলো। আগে যখন বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা ছিল না, কিছু কিছু বাড়িতে প্রদীপ জ্বালানো হত তুলসীমঞ্চে বা তুলসী গাছের গোড়ায়। এখনো অনেক বাড়িতে দেখবে তুলসী মঞ্চে একটা ছোট্টো খুপরি ঘর করা, প্রদীপ রাখার জায়গা। আর কিছু পরিবারে একটু ভালো করে ব্যবস্থা করা হত— একটা মাটির মুখঢাকা পাত্রের গায়ে ছোটো মাপের গর্ত করে রাখা হত। আর ভেতরে রাখা হত মাটির প্রদীপ। ওই গর্ত দিয়ে প্রদীপের আলো বাইরে থেকে দেখা যেত। তারপর সেই পাত্রকে সাবধানে টাঙিয়ে দেওয়া হত এক লম্বা বাঁশ বা লাঠির মাথায়। সেই লাঠিও থাকত বাড়ির ছাদে বা উঁচু কোনো স্থানে… যা আকাশের কাছাকাছি, অনেক দূর থেকে দেখা যায়। বিষ্ণুলোক থেকে লক্ষ্মী-নারায়ণ যাতে সেই বাতি দেখতে পান। মনুষ্যজন্মের কর্মফলের সব পাপ, ভুল, ত্রুটি ক্ষয় হয়। শুধু বাঙালীরা না, ভারতের অনেক প্রান্তেই এই সময়ে এভাবে আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর প্রচলন ছিল। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে। মন্দিরের বাইরে লম্বা মিনারের মত দীপদান, তার ওপর প্রদীপ জ্বলত সারা রাত। মন্দিরের প্রবেশদ্বার বা গোপুরমের সব থেকে ওপরের প্রকোষ্ঠে বড়ো সরার মত পাত্রে অনেকটা জ্বালানী বা ইন্ধন দিয়ে আগুন জ্বালানো হত। বাতিঘরের মত সেই আলো দেখা যেত মন্দিরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি থেকে। যেহেতু বহু শতাব্দীর প্রচলিত প্রথা, অনেকেই মনে করেন এর সঙ্গে মানুষের অগ্নি সংগ্রহ করার অভ্যাসের কোনো যোগ আছে। এর পরেই শীতকাল, ঠান্ডার দাপট, গরম জলের ব্যবস্থা, অন্যান্য যতরকম কাজে আগুনের দরকার হয়, এমনকি বিপদ সংকেত বা বিপজ্জনক প্রাণীকে দূরে রাখতেও অনেক অঞ্চলেই আগুনের ব্যবস্থা জরুরি ছিল, একটানা আগুনের ব্যবস্থা থাকত দু-তিন মাস ধরে। এমন মাটির পাত্রে, বা প্রদীপের মাধ্যমে একটানা তেল বা ঘি দিয়ে আগুনের উপস্থিতি টিকিয়ে রাখা হত। এ তো গেল আকাশপ্রদীপের নিজের গল্প… কিন্তু আমাদের কাছে এই ছোটোবেলায় এই আকাশপ্রদীপও হেমন্তকাল। আমরা তো বাঁশের মাথায় মটকার ভেতর জ্বলা প্রদীপ দেখিনি, আমরা দেখেছি নাইট-ল্যাম্পের মত আলো। একটা হিসেব থাকত, কোন বাড়ি থেকে কোনো রঙের আলো জ্বলবে, কখন জ্বলে উঠবে। না জ্বললে ভাবতাম… আজ কী হল? ও বাড়িতে আকাশপ্রদীপ জ্বলে না কেন?

এখন সেই পাড়াও নেই, সেই পরিবেশও নেই। পুকুরগুলোকে গোর দিয়ে দিয়ে সব ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। যেগুলো আছে, পাড় বাঁধিয়ে সংরক্ষণ করা, চারপাশে ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি— সেই আগের চেহারা আর নেই, চেনা যায় না। বড়ো বাগানওয়ালা বাড়িগুলোও নেই, তাদের সেই জাম-জামরুলের গাছেরাও নেই। আর আকাশ তো ঠিক করে দেখতেই পাই না আগের মত। আকাশ প্রদীপ আর নজরে আসবে কী করে! নাহ… আকাশ প্রদীপও দেখতে পাই না আশেপাশে। গ্রামের দিকে, বা অন্য জেলার মফঃস্বল অঞ্চলে গেলে তাও চোখে পড়ে যায় হঠাৎ। তবুও, পুজোর পর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভেসে আসে ছাতিমের সুবাস। কোনো বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে ছুঁয়ে যায় মাধবীলতার চেনা গন্ধ। দ্রুত খুলে ফেলা মণ্ডপের বাঁশের পাশে মুখ নীচু করে বসে থাকতে দেখি দুটো কুকুরকে। ক্লাবের খোলা দরজা দিয়ে যে ক্যারামবোর্ড দেখা যায়— সেই ক্যারামবোর্ডের ওপর জ্বলা আলোটা দেখেই মনে পড়ে টিমটিম করে জ্বলা সেই মণ্ডপের আলো, আর চালচিত্র। গভীর রাতে জনশূন্য রাস্তায় ধোঁয়াশা নেমে আসা দেখতে দেখতে মনে হয়— হেমন্ত এসে গেল নীরবে। গ্রামাঞ্চলে কার্তিক মাসের রাত মনে পড়ে, মনে হয় কোনো উপায়ে যদি দুটো রাত নির্জনে, পল্লী অঞ্চলে কাটিয়ে আসতে পারি। দেখে আসতে পারি হেমন্তের অলীক লোকাচার।

হেমন্তকাল- যাকে নিয়ে কেউ রচনা লেখে না!

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা