সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
 ধর্মের ধরন ধারণ

ঘুমটা ভেঙেই গেল। বুক জ্বালা, আইঢাই, কেমন অসোয়াস্তি ভাব। মনে করার চেষ্টা করলাম রাতে যত টুকরো মটন সাঁটিয়েছি, সেই অনুপাতে যথেষ্ট জেলুসিল খাওয়া হয়েছিল কিনা। ওষুধের ডিবেটার দিকে হাত বাড়াতে পাশের টেবিলটা ভোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী আপদ! বেডসাইড টেবিল আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেন? অন্ধকারে ভালো ঠাহর হল না, শুধু মনে হল একটা ধুমসো মতন কিছু ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    - উঁহু। যা ভাবছ তা নয়। বেড়াল ঢোকেনি ঘরে

চমকে উঠলাম। গলাটা আসছে আমার মাথার ভেতর থেকে। কোথায় যেন পড়েছিলাম বেশি মটন খেলে ছাগলের মত বুদ্ধি হয়ে যায়। আমি কী ছাগল হতে গিয়ে পাগল হয়ে গেলাম?

    - আরে বাবা পাগল ছাগল না। কেবল খাইখাই। ভালো করে চেয়ে দেখ দেখি। এমনি গতর, এমন কুঁজ জ্ঞানবাপীর গলি ছাড়া আর কোথায় দেখেছ?

কাশী! চার বছর আগে একবারই যাওয়া। জোর গুঁতো খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছিলাম।

    - ষাঁড়?

আপন মনেই বলে উঠলাম।
    - ওহে যে সে ষাঁড় নয় হে। অঙ্কে একশোয় ঊনআশি পাওয়ার জন্য ভাইঝিকে বিকেলবেলা কী বলে গাল দিচ্ছিলে মনে আছে?

চিরকুটকে গোবরগণেশ বলেছিলাম মনে হয়। না কী হোঁদলকুতকুত?

    - উঁহুঁ হুঁ। বডি শেমিংটা বলছিই না। আর কী বলেছ?

প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করলাম আদরের ভাইঝিকে আর কী কী বলেছি। অপদার্থ, হস্তিমূর্খ,  মাথায় ষাঁড়ের গোবর...?

    - হল না। কাছাকাছি গেছ।
    - অ্যাঁ অ্যাঁ … ধর্মের ষাঁড়?

বুঝলাম ঠিকই ধরেছি। গলাটি বেশ খুশিয়াল হয়ে বলল

    - এই তো। ধরতে পারলে এতক্ষণে। বেশ বেশ। এইবারে বল দেখি বাপু, ধর্ম কাকে বলে?

সামনের ধুমসো ছায়াটা গুছিয়ে বসল।

    - সেরেছে! ষাঁড় বাবাজি এই মাঝরাতে ইন্টারভিউ নেবে নাকি? কেন যে মরতে চিরকুটকে বকতে গেলুম! ঐ কেতু ব্যাটাচ্ছেলে অফিসে এসে ছেলের ফুল মার্কস নিয়ে আদিখ্যেতা করছিল বলেই না?

    - কোনটা? কেতুর ছেলের অঙ্কে একশো পাওয়া না অঙ্কে একশো পাওয়া? কোনটা তোমার কাছে ধর্ম? তলিয়ে বল বাপু। বুঝতেই পারছ তোমার মগজে সেঁধিয়ে আছি। ঠিক ঠিক উত্তর না দিলে তোমার নিস্তার আছে ভেবেছ?

ঢোক গিলে হাতজোড় করে বললাম

    - ধর্ম খুব উঁচু জিনিস বাবাজি। আমি সামান্য লোক - দেবদ্বিজে ভক্তি করা, পাপতাপ বাঁচিয়ে চলা - এই তো হল গিয়ে ধর্ম। তা চিরকুটকে বকাঝকা করাটা নেহাত অন্যায় হয়ে গিয়েছে, এইবেলা যদি ক্ষমাঘেন্না করে দেন, পরের বারে একশোয় শূন্য পেলেও আমি রসোগোল্লা কিনে খাওয়াব এই প্রতিজ্ঞা করছি।

ষাঁড় বাবাজি গলার মধ্যে শব্দ করে হাসলেন।

    - উঁচু জিনিস? দেবদ্বিজে ভক্তি? হুম। তাহলে ধর্মে একটা ঈশ্বর লাগে বলছ?

    - আজ্ঞে আলবাত লাগে। সঙ্গে ধূপ ধুনো কলাটা মূলোটা নকুলদানা বাতাসা

    - অর্থাৎ ধর্ম বলতে যা বোঝায় সব হিন্দু ধর্ম?

    - তা কেন তা কেন? আরোও আছে তো সব। শিখ হলে হালুয়া, মুসলিমদের শিমুই, হালিম, ক্রিশ্চানদের কেক, বৌদ্ধদের মোমো - না ওটা বোধহয় ভুল হচ্ছে, মানে ঐ আর কী। সব ধর্মেই ঠাকুর দেবতা আছে, তাদের প্রসাদ ট্রসাদ আছে। আমি সামান্য মানুষ স্যার।

ফস করে বলে ফেললাম। দেখেছি অফিসে, স্যার বলে লোকজনকে দিব্যি হাত করা যায়।

    - হুম। তাহলে চিরকুটকে সেদিন যে পড়ানো হচ্ছিল জলের ধর্ম হল যে পাত্রে থাকে সেই আকার ধারণ করে? এই ধর্মের দেবতাটি কে?

ষাঁড় বাবাজি প্রশ্নটা গুলির মত ছিটকে এল। কী মরতেই যে চিরকুটটাকে পড়াতে গিয়েছিলাম!

    - ঐ ধর্ম আর এই ধর্ম তো আলাদা মশাই! ওগুলো স্কুলের বইতে যেমন লিখেছে। ইংলিশে তো প্রপার্টি বলে। ঐটেই ঠিক। ভৌতবিজ্ঞানের ধর্ম তো আসলে ধর্ম নয় কিনা? আমি প্রতিজ্ঞা করছি স্যার চিরকুটকে আর পড়াতে বসব না।

    - তার মানে বইতে ইংলিশে রিলিজিয়ন লেখা থাকলে তবেই সেটা ধর্ম?

    - হ্যাঁ ঐ প্রপার্টি আর…

    - তাহলে সেদিন যে কেতুর সাথে বাবরি মসজিদ রাম মন্দির নিয়ে রামায়ণ নামাচ্ছিলে, তা সে রামায়ণ তুমি বুঝি ইংলিশে পড়েছ?

    - আহা। সে তো বাংলাতেই…কিন্তু আসল লেখা তো সংস্কৃতে হয়েছিল, তাই না?

    - বাংলায় যা ধর্ম সংস্কৃতে তাকে কী বলে হে?

আমি গোঁজ হয়ে বললাম

    - আপনি কথার প্যাঁচে ফেলছেন আমাকে। আমি বলছিলাম যে ধর্ম লোককে ভক্তি করতে শেখায় তার কথা।

ষাঁড় বাবাজি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি সবে মনে মনে ভাবছি এই তাহলে বাবাজি ভালোয় ভালোয় কেটে পড়বেন, ধেয়ে এল পরের প্রশ্ন

    - তাহলে বলতে চাইছ ভক্তি ছাড়া ধর্ম হয়, কিন্তু ধর্ম ছাড়া ভক্তি হয় না?

    - বলতে চাইছি না, বলছি

বলেই জিভ কাটলাম। এই সেদিনই কমল মিত্রের গলায় ডায়লগটা শুনেছিলাম। ষাঁড়বাবাজিকে উত্তম কুমার ভাবছি জানলে কী মনে করবেন কে জানে রে বাবা! তা বাবাজি বিশেষ ভ্রূক্ষেপ করলেন না। ঘরময় পায়চারি করতে করতে বললেন

    - এই চিরকুট তোমাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে বলে মনে হয়? আমি জানি তুমি জান যে করে। তোমাকে দেখলেই কেমন তটস্থ হয়ে যায় পাছে পড়া ধর আবার। এই ভয় বা ভক্তি যাই বল, এইটা কোন ধর্ম থেকে শিখিয়েছ চিরকুটকে?

বাহ, সহজ প্রশ্ন। নড়েচড়ে বসে বললাম
    - যে কোনো ধর্মেই তো শেখায় গুরুজনকে ভক্তি শ্রদ্ধা করতে, তাই না? আমাদের সনাতন সংস্কৃতিই তাই।

    - তাই যদি বল চিরকুট তবে বাংলার স্যার কথা বলতে গেলে কেমন তুতলে যান সেটা নকল করে দেখায় কেন আর তোমরাই বা দেখে হেসে কুটোপাটি হও কেন? তোমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে গুরুকে গুরুজন ধরে না বুঝি?

আমি জিভ কাটলাম। এই রে!
    - ভুল হয়ে গেছে স্যার। এইবারটা ক্ষমা করে দিন। প্রতিজ্ঞা করছি …

    - আরে রাখ তোমার প্রতিজ্ঞা। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করছি। চিরকুট তার রাশভারী পিসিকে গুরুজন মানে কিন্তু তোতলা মাস্টারকে মানে না। কেন?

    - ইয়ে, মানে বাচ্চারা তো একটু আধটু ভয় না পেলে…

    - তাহলে বলছ ধর্ম ছাড়া ভক্তি হয় না। ভয় ছাড়াও ভক্তি হয় না। তবে ধর্ম কী শুধু ভয়? না আরও বেশী কিছু?

আমি গুম মেরে খানিক বসে রইলাম। ষাঁড় বাবাজির মতলব সুবিধের ঠেকছে না। যেন আমি একজন কেষ্টবিষ্টু নেতা, উনি সাংবাদিক এসেছেন জেরা করতে। খানিক ভেবেচিন্তে বললাম

    - তা ভয় ব্যাপারটা কিছুটা তো আছেই। ঠাকুর দেবতারা মহা শক্তিশালী তো! চটিয়ে দেওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। ভবিতব্যের ভয়েই তো লোকে তাঁদের মানে। ভক্তি করে। কিন্তু ধর্ম শুধু ভয়ই দেখায় না। মানুষকে ঠিক ভুল বোঝাতেও শেখায়। পাপ আর পূণ্যের ভেদাভেদ করে দেয়।

    - বটে? চিরকুটের স্কুলের নিয়মকানুনও অনেকটা এইরকম শুনেছি। প্রিন্সিপাল বেজায় কড়া। টুকলি করা অন্যায়, ক্লাস চলাকালীন কথা বলা অন্যায়, এমনকি টিফিন আনতে ভুলে গেলেও ধমকধামক জোটে। এই নিয়মগুলো তাহলে ধর্ম?

আমার এইবারে রাগ হচ্ছিল। কীসব ফালতু কথা!
    - আরে সব নিয়ম তো আর ধর্ম হয় না! একটা কৃষ্ণ থাকলে তবেই গীতা। পয়গম্বর থাকলে তবেই কোরান। যীশু বলেই বাইবেল। একজন এইরকম দেবতা না থাকলে তাদের বলা নিয়মগুলো কেমন করে ধর্ম হবে?

    - অর্থাৎ দেবতা ছাড়া ধর্ম হয় না? তাহলে বল দেবতা কেমন করে হয়? চিরকুটের স্কুলের প্রিন্সিপালকে তুমি দেবতা কখন মানবে?

    - চিরকুটের স্কুলের প্রিন্সিপালের নিয়ম যদি লাখ লাখ লোক মানতে শুরু করে তাহলে সে দেবতা। হল?

    - সে কী হে? তুমি দেবতার রেসিপি বলছ, না নেতার? ঊনিশশো তেত্রিশ সালে একজন রাষ্ট্রনায়ক লাখ লাখ লোককে নিজের নিয়ম মানাতেন না? চিরকুটের ইতিহাসটা তুমিই ম্যানেজ কর তো? সে যুক্তিতে হিটলারও তো তাহলে দেবতাই দাঁড়াচ্ছে, নাকি?

আমি চেঁচামেচি করে উঠলাম
    - আরে নিয়ম মানালেই দেবতা হয় নাকি? ভালো কাজ করতে হবে, মানুষকে পথ দেখাতে হবে। মানুষ মারলে, মারতে বললে সে কী দেবতা হয়?

বাবাজি মাথা নাড়লেন
    - দাঁড়াচ্ছে না হে। কুরুক্ষেত্রে, লঙ্কায় যা হয়েছে তা ধর্মযুদ্ধ নয়? যীশু মহম্মদের দোহাই দিয়ে কত বড় ক্রুসেড হয়েছে তুমি জান না? রাম মন্দির বাবরি মসজিদ নিয়ে যা হয়েছে যা হচ্ছে তাতে কত লাখ লোক মরেছে দাঙ্গায় তা জান? তাতে এই দেবতাগুলো খারিজ হয়ে যায় না তাদের ধর্মগুলো?

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম
    - আপনি কী বলতে চান? দেবতা বলে কিছু নেই? ধর্ম একটা মিথ্যে?

    - আমার ঘাড়ে কটা মাথা তা বলি? যে বিশ্বাসকে ধরে তোমরা বাঁচো তার চেয়ে বড় সত্যি কী আছে আর? যে প্রতীককে ধরে তোমরা একজন একজন করে এক হাজার কোটির সাথে মিশে যেতে পার তার থেকে বড়ো থাকা আর কী আছে? আজ যদি আমি বলি তোমার ঠাকুর মিথ্যে এই দেখ আমার ক্ষমতা তার চেয়েও বেশী তবে কাল থেকে তুমি আমাকে নিজের ঠাকুর মনে করে পুজো শুরু করবে। তা নয়। বলছিলাম চিরকুটের ভৌতবিজ্ঞানের বইটা নেহাত ফেলে দেওয়ার নয়।

    - অ্যাঁ?

    - ঐ জল যা করে তুমিও তাই কর। তুমি নিজে একজন ভদ্রমহিলা, তোমার মাথার মধ্যে বলছি আমি, এদিকে তুমি লাগাতার ভক্তিভাবে স্যার স্যার করছ আমাকে পুরুষমানুষ ভেবেই। যেমন পাত্র তেমনি আকার। বাংলা ইংরাজির বাদানুবাদে প্রপার্টি রিলিজিয়ন গুলিয়ে যাচ্ছে যখন ভয়ভক্তির চশমাটা খুলে বরং একটু লেখাপড়া কর। সেই যে লোকটা বলেছিল ভাবা প্র্যাকটিস কর - সে কথাটা না হয় নাই ফেললে। ঐ যা এক আধ গ্রাম সবেধন নীলমণি ঘিলু আছে সেটা বইয়ের পাতায় সেঁটে না রেখে একটু খাটিয়েই দেখ না? ধর্মের কত ধরন আর কে কী ধারণ করল না জেনে বুঝে শুধু চিরকুটকে ধর্মের ষাঁড় বলে কোনো লাভ আছে?

ধর্মের ধরন ধারণ

গুম হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বাইরের ঘরে কে কাশছে। আকাশটা যেন একটু পরিষ্কার হয়ে এসেছে। ষাঁড় মশাই হয়ত গায়েব হয়েছেন। গা ঝাড়া দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আজ ভৌতবিজ্ঞানের বইটা নিয়ে একবার বসতে হচ্ছে।

নিবাস কলকাতা। পেশায় কেরানী, ভালোমন্দ পড়তে পেলে বেশী কিছু চান না, শুধু লুচি তরকারিতেই তুষ্ট।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা