সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

গরমের ছুটিটা শুভ দিব্যি কাটাচ্ছিল প্রাণের বন্ধু সন্তুর সাথে, হঠাত বিপত্তি ঘনিয়ে এল। টি টাইমে ঝড়ের মত সন্তুর আবির্ভাব, মায়ের হাতের ভাজা পেঁয়াজি একখানা ধাঁ করে মুখে সেঁধিয়ে গরমে তিড়িং লাফ জুড়ে আঁউ আঁউ করে সে যা বলল তার মর্ম হল- সে মামাবাড়ি যাচ্ছে দু চার দিনের মধ্যে। কাঁসাইপুর নামে এক ছোট শহর, কলকাতা  থেকে ট্রেনে ঘন্টা পাঁচেক, সেখানে নাকি তার মামাবাড়ি। সন্তুর অভাবে যে গরমের ছুটিটা ঠান্ডা লুচির মত চুপসে যাবে সেই ভেবে শুভ মরিয়া হয়ে বলে উঠল- "কাকু কাকীমা যাক না তুই আমার  বাড়িতে থেকে যা।"
"সে এবারে হচ্ছে না, মা একেবারে খেপে উঠেছে, দু বার মা একাই গেছিল তো।" শুভর বাংলার পাঁচের মত মুখের দিকে চেয়ে বলল সন্তু, তারপর তুড়ি মেরে চেচিয়ে উঠে বলল- "দি আইডিয়া তুই চল আমারদের সাথে, দারুন জমবে।"
-"জমে একেবারে কুলপি হবে, তোদের দেখা পাচ্ছে এতযুগ পর সঙ্গে ফাউ আমি।" বলল শুভ,
-"আরে একবার গিয়েই দেখ, আমার মামাবাড়ি এক্কেবারে কার্টুন নেটওয়ার্ক।"
-"সে আবার কী?"
-"সাসপেন্স ভাই, এখন চল কাকু কাকীমাকে পটানোটা জরুরি"।

        

বিহার সীমান্তের কাছাকাছি বেশ সুন্দর ছিমছাম শহর কাঁসাইপুর, কংসাবতী নদী ও টিলার মত পাহাড় থাকায় বেশ মনোরম পরিবেশ। স্টেশন থেকে রিক্সা নেওয়া হল, সন্তু ও শুভ একটায় চাপল, সন্তুর মা বাবা আরেকটায়। রিক্সাওয়ালা দাঁত বের করে জানাল, " খেস্তগীর ইয়ে মানে বাড়ি যাবেন তো, আর বলতে হবে না  সক্কলেই চেনে।"
"ইয়ে মানে" টা মুদ্রাদোষ ?নাকি কিছু একটা বলতে গিয়ে হোচঁট খেল লোকটা ,সন্তুর মনে হল।     
মামাবাড়িতে চার মামা, তিন মামী, ছোটমামার ২২-২৩ মত বয়স, অবিবাহিত। বিধবা ঠাকুমা বাড়ির মাথা,দোর্দন্ডপ্রতাপ। সন্তুর  মামাতো ভাইবোনের সংখ্যা পাঁচ। এক দাদা, দুই বোন ও দুই ভাই, সবচেয়ে ছোটটি তিন বছর, বড় দাদা ক্লাস টুয়েলভ।  
এছাড়া বাড়িতে সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করছে গুচ্ছের  মালি, গোয়ালা, রাঁধুনী ইত্যাদি।
শুভ এমন যৌথ পরিবারে কখনো থাকেনি, সে প্রতিমুহুর্তে বড় মামাকে সেজমামা, মেজমামীকে বড়মামী , সোনাকে মনা, পরীকে তরী বলে তালগোল পাকিয়ে একসা করল।  
প্রথম রাত্রে গোল বাঁধল শোয়ার ব্যবস্থা নিয়ে। তিনটি অপশান - একখানা বড় গেস্টরুম , আর দোতলায় একটা  ঘরে একা থাকে ব্যচেলার ছোটমামা,  এছাড়া বাড়ির বাইরের দিকে একটা বসবার ঘর , যেটাকে বৈঠকখানা বলছে এরা। এই তিনএর মধ্যে সন্তুর মা বাবা অবশ্যই গেস্টরুমের দখল নিলেন, সন্তু ও শুভ ছোটমামার সাথে ঘর শেয়ার না করে বৈঠকখানায় থাকার সিদ্ধান্ত নিল। ঠাকুমা একটু কিন্তু কিন্তু করলেন, বাইরের  বড্ড আওয়াজ আসে বলে। শুভ তাঁকে নিশ্চিন্ত করে বলল- " ঠাকুমা আপনি একবার কলকাতায় এসে দেখুন আওয়াজ কাকে বলে।"
রাত্রে দুই বন্ধু মহানন্দে বকবক করল- শুভ তো দারুন অভিভূত- " বুঝলি সন্তু দারুন মিস করতাম না এলে, আরে গাধা বলবি তো তোর এমন একটা জমাটি মামাবাড়ি রয়েছে"।
"হেঁ হেঁ , গরমের ছুটি জমে কুলপি, কী বলিস?"।
হঠাত বাইরের রাস্তায় কিছু  বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল, গলাটা কুকুরেরই কিন্তু অদ্ভুত, মানে মানুষ হলে বলা হত হেঁড়ে গলা।  চেচানি গানের মত কন্টিনিউ হতে থাকল, ঠিক যেন গান ধরেছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা।
দুই বন্ধু বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এল, সদর দরজাটা লোহার গ্রীল, তার ওপাশে ধাপিতে বসে মোটাসোটা কালো এক কুকুর মাহসুখে উঁ উঁ শব্দে কালোয়াতি গাইছে। বেশ কিছুক্ষণ ওরা দুজন লম্ফঝম্ফ করে ওটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করল, বাবাজী পাত্তাও দিলে না। এবার তারা লাঠিসোটা খুঁজতে বেরোলো, বেশ মিনিট পনেরো গেল, শুভ বলল- " ওরে আমার শরীর খারাপ করছে, কী বিটকেল গলা"
এবারে ভেতর বাড়ি থেকে মেজমামার ছেলে বিট্টু বেরিয়ে এল, বাথরুম থেকে একবালতি ভর্তি জল ও মগ নিয়ে । সন্তু বলল,"কী করবি  রে বিট্টু?
সে হাত তুলে অভয় দিয়ে তার পিছনে আসতে ইশারা করল।
বারান্দায় বেরিয়ে সে ভুতু ভুতু করে কুকুরটাকে কাছে ডেকে সেটার গায়ে বেশ কয়েক মগ জল ছুঁড়ে দিল।  
ভুতু পরিত্রাহি হাঁক ছাড়তে ছাড়তে সে তল্লাট ছেড়ে পালাল অন্য পাড়ার লোকেদের ঘুম ভাঙাতে।
বিট্টু বলল- "আজ রাতের মত নিশ্চিন্ত, ঘুমিয়ে পড়'।
বোঝা গেল একাজ তাকে প্রায়ই করতে হয়।
পরদিন জানা গেল ঈশ্বরদত্ত তল্লাটকাঁপানো গলার জন্যে এপাড়ায় ভুতুর মহা নামডাক, সে আবার এ বাড়ীর বাগানেই জন্মেছিল, তাই রাত্রি হলেই নাড়ির টানে এখানে হানা দেয়।

সকাল সকাল মেজমামা উঠানে মুগুর ভাঁজছেন, পেটাই চেহারা, এককালে মিলিটারিতে ছিলেন।  শুভ দাঁত মাজতে মাজতে কশরত দেখছে সমীহের চোখে।
সন্তু এসে বলল-" কী মেজমামা তোমার কাল রাত্তিরে ঘুম হয়েছে" ঈঙ্গিতটা ভুতু বিভ্রাটের দিকে।  
-" বিলক্ষন , দারুন গরম পড়েছে, বেশ ঘুম হল" ।
শুভ বলে ফেলল-" গরমে ঘুম ভালো হয় আপনার"।
- "অবশ্যই, গরমে ঘুমনো হচ্ছে স্ট্রাগেল, স্ট্রাগেল মানেই চ্যালেঞ্জ, বুঝলে"।
সন্তু ফিশফিশ করে বলল-  "কেটে পড় নয়তো আর্মি জয়েন করিয়ে ছাড়বে, আর স্ট্রাগেল শুরু হবে মুগুড় দিয়ে" ।
    
একটু পরে ভাই বোনেরা জলখাবার খেতে বসেছে, শুধু ম্যারাথন পড়ুয়া বড়দাদা তখনো আসেনি। তার দেখা শুভ বিশেষ পায়নি, সন্তু জানিয়েছে সে এজগতে বিশেষ থাকে না, শুধু সায়েন্স তার ধ্যান জ্ঞান, অন্য কোনো খবর রাখা জরুরি নয় তার কাছে।
সেজমামীমা একটা জবরদস্ত নাড়ু বানিয়েছেন, বিট্টু সেটাতে সবে কামড় বসিয়ে আরামে চোখ বুজেছে এমন সময় দরজার কাছে বড়দাদার গম্ভীরগলায় ডাক এল -"বিট্টু, আমার সায়েন্স ড্রয়িং এর সাপ্লাই ঘোষ এর দোকান থেকে নিয়ে আসবি আজকেই "
-রেলিশ করে নাড়ু খাব যে তার উপায় আছে? বিট্টু বলল।
দাদা শুনল ," অ্যারিস্টটল নাড়ু খাবে"।
সে বলল -"অ্যারিস্টটলের সাথে নাড়ুর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না, গ্রীসে নাড়ু পাওয়া যেত না, তাছাড়া নিজেকে অ্যারিস্টটলের সাথে কীভাবে তুই কম্পেয়ার করতে পারিস, গন্ডমূর্খ। "

আবার রাত্রি  এল, আজ ঠাকুমা বলেছেন ছোটমামার সাথে দোতলার ঘরে শোবে তারা। ছোটমামা একাই একটা সাবেকী বিশাল পালঙ্কে শোয়, তিনজনের শুতে কোনো অসুবিধা নেই সেটাতে।
 
 পরদিন কোথায় কোথায় বেরানো যায় তা নিয়ে শুভ ও সন্তুর বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা চলল। গরম যা জবরদস্ত পড়েছে ছোটমামা পরামর্শ দিল দূরের সারাদিনের ট্যুর আপাতত থাক-" বৃষ্টি নামলে যাবি, কাল বরং বিট্টু আর পরীকে বল তোদের এই কাছের কাপালিক কালীবাড়িটা  দেখিয়ে আনবে, বিকেলের দিকে হেঁটেই ঘুরে আসতে পারবি"।
বিট্টু আর পরী দুজনে পিঠপিঠি ভাই বোন, পরী বড়মামার মেয়ে বয়েস তেরো, বিট্টু মেজমামার ছেলে বয়েস চৌদ্দ, শুভ সন্তুর কাছাকাছি বয়সের বলে এদের দুজন সবসময় দেখভালের দ্বায়িত্বে আছে।
এগারোটা নাগাদ এরপর তিনজনে ঘুমিয়ে পড়ল, গতকালের ঘুমের ব্যাঘাতে শুভ ঠিক করেছিল আজ একটা জম্পেশ ঘুম দেবে।
ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখল কাপালিক কালির হাড়িকাঠে তার মাথা, আর একটা ছাগলে তার মাথার চুল চিবোচ্ছে।
আসলে ছোটমামা তাদের চুল টেনে জাগানোর চেষ্টা করছেন, " ওঠ ওঠ , মশারির ভিতরে মশা ঢুকে পড়েছে, না মেরে ফেললে ঘুমোতে দেবেনা"।
সন্তু জড়ানো গলায় বলল " দিব্যি ঘুমতে দিচ্ছে মামা, আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা"।
"আরে কানের কাছে কেমন প্যাঁ প্যাঁ গান গাইছে শুনছিস না"
শুভ বলল-"ভুতুর গানের কাছে এতো লালাবাই"।
কোন আছিলাতেই ছোটমামা ছাড়লেন না, অগত্যা দুই বন্ধু উঠে চারপেয়ে জীবের মত মশারি হাতরাতে লাগল। মামা বলল চারটে ঢুকেছে মনে হচ্ছে, এই একটা আমার হাতে নিহত হল ," চটাস শব্দ করে মামা হাতের তালু দেখালো, যেন ইন্ডিয়া পাকিস্তান ম্যাচে কাচ লুফেছেন  " তোরা দুটোই ফেলিওর"।
এভাবে বেশ কিছুক্ষন চলার পড় সন্তু ফাঁকিবাজি করে একটা চটাস শব্দ তুলে বলল "হুররে আরেকটা ডেড, চল এবার ঘুম"।
ছোটমামা সবেগে মাথা নেড়ে বলল- " ডেডবডি ? শো মি দ্যা ডেডবডি, এভিডেন্স ছাড়া এ শর্মা কিছু বিশ্বাস করে না"।
পরদিন ঠাকুমা সব শুনে বললেন-"ছোট তুই একা আজ থেকে বৈঠকখানায় শুবি, ওরা তোর ঘরে শোবে"।

                  

 ৫

বিকেলের দিকে কালীবাড়ি দেখতে পরী ও বিট্টু্র সাথে বেরোলো সন্তু ও শুভ । পাড়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুভ অবাক হয়ে দেখল বুড়ো থেকে বাচ্চা সকলেই পরীকে পিসি বলে ডাকছে, -"কী গো পরী পিসি দাদাদের পাড়া দেখাতে বেড়িয়েছ",
বা "আরে পরী পিসি আর বিট্টু দাদা চললে কোথায় , সঙ্গে এরা কে ? ও কলকাতার দাদা " এই রকম নানা প্রশ্ন  করছে সকলে, কিন্তু বাচ্চারা নাহয় বোঝা গেল, বড়রা কেন পুচকে পরীকে পিসি বলে, সন্তু আর বিট্টূর কাছে জানতে হবে তো, শুভ ভাবল।
পরীর মুখখানা সবসময় সিরিয়াস, এক আধবার মুচকি হাসি ছাড়া তাকে শুভ এসে থেকে কখনো  জোরে হাসতে দেখেনি।  কালীমন্দিরের চাতালে বসে শুভ গতকালের হাড়িকাঠ ও ছাগলের স্বপ্নটা  বলল, সন্তু ও বিট্টু হো হো করে হাসলেও পরী  গম্ভীর গলায় বলল, "এখানে এখনো কাপালিকের বংশধররা আসে , মাঝে মাঝে মানুষ ধরে এনে বলিও চড়ায়"।  
বিট্টু পরীর মাথায় চাঁটি মেরে বলল- "গুল শুরু"
-"রাত্রে আসিস, সন্তুদা আর শুভদাকে নিয়ে ,কোনটা গুল কোনটা সত্যি দেখব" । ঠান্ডা হিম গলা করে বলল পরী, শুভর বুকটা সত্যিই ছ্যাঁত করে উঠল।
সন্তু বলল-" এই পরীটা না হেবি নাটুকে আছে, ভয় দেখাতে ওস্তাদ"।
পরী চোখ গোলগোল করে বলল- " সমাদ্দারদের দশ বছরের বাচ্চা হারিয়ে গেছিল, তারপর এখানে হাড়গোড় পাওয়া যায়, ঠাকুমাকে জিগ্যেস করিস"।
বিট্টু বলল- "সে পরীর জন্মের পঞ্চেশ বছর আগের গল্প, বুঝলি, এমন কত গল্প এই কালীবাড়ি নিয়ে"।
পরী টুক করে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক গলায়  বলল "তোদের থাকতে হয় থাক আমি চললুম, আমার আবার তাকদুম আসবে"।
শুভ বলল-" ও বাবা, তাকদুমটা আবার কী ,এতো সাঙ্ঘাতিক ক্রিপি মেয়ে রে"।
পরী কথা না বলে হাঁটা লাগালো।
বিট্টু চেঁচিয়ে বলল-" তুই তোর কালোয়াতি গা গিয়ে যা, আমরা তারপর আসছি, এমনিতেও তো টিঁকতে পারবে না শুভদারা, ভুতুর থেকেও সরেস"।
"ওর তবলার মাস্টার আসবে , গানে সঙ্গত করতে, হি হি"।
"-তবলচীর নাম তাকদুম, কী বিটকেল" শুভ বলল।
"আরে ওটা পরীর দেওয়া নাম, ও সবার নামকরণ করে নেয় নিজের মত" জানালো বিট্টু।
সন্তু বলল "হ্যাঁ আমারো একটা নাম দিয়েছিল, এবারে তোরও একটা দেবে বুঝলি শুভ "
"ইস, নির্ঘাত বিশ্রী কিছু দেবে" ।
"এই যেমন ধর আমাদের পুবের বাড়িতে ভাড়া থাকে একটা ফ্যামিলি, তা ভদ্রলোক সবসময় হাসছেন, দাঁতের পাটি বেরিয়েই রয়েছে, তার নাম হাসিমুখো হ্যাংলা"। বিট্টু বলল
"তোর নামটা কী" শুভ জানতে চাইলো সন্তুকে।
"আমারটা বেশ হার্ম লেস, আসলে ওটা ও দিয়েছিল  আটবছর বয়সে, কোলকাদা, মানে কলকাতার দাদা আর কি।"
" নতুন পড়শি মুখুজ্যেবাবুর নাম দিয়েছে, বিনয়ের অবতার, দেখাবো তাকে  একদিন, তার নাম তো প্রায় সকলে ভুলেই গিয়েছে, বিনয়বাবু বলেই বেশী লোকে জানে"। বিট্টু বলল শুভকে।
"আচ্ছা তাহলে পরীকে লোকে পিসি ডাকে কেন?" শুভ জানতে চাইল।
সন্তু হো হো করে হেসে উঠল- " ওটাও পরীর নিজের দেওয়া, বিট্টু বলে দে গল্পটা-"
-"আসলে বড়জ্যেঠি মানে বিট্টুর মা স্কুল টিচার তো, খুব ছোট থেকে পরী পাড়ার দুই জাঁদরেল পিসির কাছে থাকত, তারা একরকম  ভালোবেসে বেবী সিটিং করতেন, তা সেই ছোট্টবেলা থেকে পরীর ধারনা হয় পিসিরা ভীষন পাওয়ারফুল , কথা ফোটার পর থেকেই সে সকলকে বলে বেড়াত আমাকে পরী ডাকবে না, আমি পরী পিসি। সেই থেকে ও পাড়ার বড় ছোট সবার পিসি।

রাত্রে ছোটমামার ঘরে শুভ-সন্তু শুয়ে শুয়ে গল্প করছে এমন সময় ছোটমামা ঘরে এন্ট্রি নিলেন, এরা বেশ অপরাধবোধে ভুগছিল মামাকে তার ন্যায্য পালঙ্ক থেকে উতখাত করার জন্যে। তাই ওরা দুজনেই হইহই করে জানালো-"মামা তুমি থেকে যাও ঠাকুমা তো আসছে না দেখতে", মামা বলল-"উহুঁ, মাতৃ আদেশ নরচর হবেনা, আমি কয়েকটা বই খাতা ঘাঁটাঘাটি করে চলে যাব তোরা ঘুমো, এই টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বসছি"।
একরকম জোর করেই ছোটমামা ঘরের লাইটটা অফ করে দিল- " না ঘুমোলে গাঁট্টা খাবি, কাল ঘুম হয়নি করে মাকে খুব নালিশ হল"।
ওরা ফিসফিসিয়ে গল্প চালাতেই লাগলো, মাঝে মাঝে আড়চোখে মামার সিরিয়াস পড়াশোনাও দেখছিল,
সন্তু বলল- "ছোটমামা যে এত পড়াশোনা করে রাত্তিরে তা তো জানা ছিলনা"।
জানলার দিকে মুখ করে বসে ছিল মামা, মাঝে মাঝে বাইরে তাকাচ্ছিল, এই জানলা দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত চাষজমি, টিলা, জঙ্গল ইত্যাদি দেখা যায়, মানুষের বাস নেই ওদিকে, শুভ দেখেছে দিনের বেলা।  
কিছুক্ষন পর মামা অস্থির পায়ে পায়চারি লাগালো, তারপর হঠাতই জানলার কাছ থেকে ঘুরে টেবিল লাইট অফ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
সন্তু ধীরে ধীরে উঠে জানলার কাছে গেল ও কিছু পরে শুভকে বলল- " এই গাধা ঘুমলি নাকি? দেখে যা এখানে"
শুভ সন্তু দেখল জঙ্গলে টিলার মাথায় একটা টর্চ জ্বলছে নিভছে।
" ওটা কোন জায়গাটা বুঝলি?" সন্তু বলল।
"নাঃ"
"কাপালিক কালিবাড়ির কাছে"।
-"তাহলে কী দাঁড়ালো? ছোটমামাকে কেউ ডাকছে ওখানে?"
-"হুঁ, চল একটা আডভেঞ্চারে নামি"-সন্তু বলল।
শুভ বলল "বিপদে পড়লে মা বাবা আস্ত রাখবে না"।
"আরে খুব রিস্ক নেব না, আগে চল ছোটমামা বাড়িতে না নৈশ অভিযানে গেল সেটা তো দেখি"।
ওরা পা টিপে টিপে বাইরের ঘরে এসে দেখলো , মামা হাওয়া , বাথরুম টাও চেক করল, নাঃ কোত্থাও নেই। বাইরে ভুতু আউঁ শব্দে কাউকে আদর জানালো, দুজনে উঁকি দিয়ে দেখল ছোটমামা গলির মোড়ে পোউঁছে গেছে, সন্তু বলল-"ফলো করবি"?
শুভ কোনমতে রাজি হল।
সন্তু ছুটে গিয়ে ঘরের কোনের শক্ত ছোট লাঠি নিয়ে এল, -"চল"।
    
কালিবাড়ির ভিতরে জরাজীর্ণ দুটো ঘরে টিমটিমে আলো জ্বলছে, মাটিতে ও কয়েকটা খাটিয়ায় বিছানা পাতা, মাথায়, হাতে পায়ে বিবিধ জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধা গোটা সাতেক লোক শুয়ে বসে আছে, ছোটমামা সকলের নাড়ি , চোখ, জিভ দেখছে। দু একজন যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মামা দুটো কালো ষন্ডামার্কা ছেলেকে কিসব নির্দেশ দিল, তারা কিছু সবুজ পাতার চুরুটের মত এনে ছটফট করা লোকগুলোকে ধোঁয়া টানতে দিল, কিছুক্ষন পরে লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়ল। অন্ধকারে ভাঙ্গা দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে ওরা সব দেখছিল, শুভ ভয়ে ফিসফিসিয়ে বলল-" ওরে কেটে পড়ি,  তোর ছোটমামার ব্যাপার বিশেষ সুবিধের নয় মনে হচ্ছে"।
-"মামার পিছু পিছু ফিরব, নাহলে বিপদে পড়লে কে বাঁচাবে?"বলল সন্তু।

    

সকাল সকাল বিট্টু এসে ডেকে নিয়ে গেল বাইরের বসার ঘরে, পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখালো -"এই দেখ বিনয়বাবু, কথা বলার ধরনটা লক্ষ্য কর"।
বড়মামা চায়ের কাপ নিয়ে বসে, সঙ্গে  আর একজন ভদ্রলোক, গোলগাল টাকমাথা নিপাট ভালোমানুষ  চেহারা।
বড়মামা বললেন -" অনেকদিন পর এলেন সব কুশল তো বিনয়বাবু"
বিট্টু জিভ কেটে বলল-" কেলো করেছে, মামা যে মুখের ওপরে বিনয়বাবু বলতে লেগেছে"
বিগলিত হেসে মাথা নাড়িয়ে ভদ্রলোক বললেন-" এই ভালোই ভগবানের আশীর্বাদে, একটু সমস্যা আছে তাই আপনার সাহায্য চাইতে এলাম আপনি বিচক্ষণ মানুষ, হেঁ হেঁ"।
সন্তু বলল " বিনয়ের অবতারই বটে"।
কাথা বার্তা চলল বড়মামার সাথে বেশ কিছুক্ষন, প্রতিবার সম্বোধনেই বড়মামা ভদ্রলোককে বিনয়বাবু বললেন, আর ওরা পর্দার আড়ালে ফিকফিক করে হাসলো ।
শেষে আর না পেরে ভদ্রলোক বললেন- " আপনি আমার নাম ভুলে গিয়েছেন বোধহয়, বিনয় তো আমার নাম নয়, আমি তো প্রিয়গোপাল"।
বড়মামা মুখচোখ লাল করে বললেন "বটেই তো, এই কে আছিস পরীটাকে ডাক তো, আজ ওটার নাম দেওয়া ঘুচিয়ে দেব"।
প্রিয়গোপাল তখনো বিনয়ের অবতার, "হেঁ হেঁ, উত্তেজিত হবেন না, মামনী এমনিতে বড় লক্ষীমেয়ে, ওতে আমি কিচ্ছুটি মানে করিনি,  আপনাদের বাড়ির যা নামকরন করেছে তার কাছে তো আমার নাম নস্যি"
"সে কী , আমার বাড়ির, মানে আমাদের বাড়ির নাম আছে নাকি? জানিনা তো, তা সেটা কী বটে?" বড়মামা বিস্মিত।
"খাস্তগীর নাট্যশালা, আপনার সামনে কেউ বলবে না তবে কাঁসাইপুরে এ তো চালু কথা "
"ওহো এবার বোঝা গেল" শুভ ফিসফিস করে বলল "রিক্সাওয়ালা প্রথমদিন ওটাই বলতে গিয়ে গিলে ফেলেছিল"।
বড়মামা হুংকার দিলেন-"প..........রী...............।"

এর পরেই কলকাতা ফেরার দিন এসে গেল, দুই বন্ধু ও বাড়ির সকলেরই মন ভার। সন্তু ও শুভ দুপুরে ছাদের ঘরে বসে বলাবলি করছিল কাপালিক কালিবাড়ির সেরাত্রের ঘটনাটার ব্যাখ্যা কিভাবে মামাকে জিগ্যেস করা যায়, এভাবে  ফিরে গেলে তো দুইবন্ধুকে পেট ফুলে মরতে হবে, মামার বিপদের কথা ভেবে ওরা কাউকে বলতেও পারে নি ঘটনাটা। ঠিক এই সময়ে ছোটমামা কোত্থেকে ঘরে আবির্ভূত হলেন। দুজনেই আঁতকে উঠল, মামা চেয়ারে বসে বললেন-" চললি তাহলে, যাক ঘরটা আবার ফিরে পাব, যা জাঁকিয়ে বসেছিলি, হা হা হা।
"তা যাচ্ছ যাও কথাটা পাঁচকান কোরোনা, বাবুসোনারা"।
সন্তু বলল " ইয়ে মানে তুমি জানতে আমরা গিয়েছিলাম? নাকি এক্ষুনি জানলে?"
"অতই বোকা ভেবেছ আমাকে, মন্দিরে ঢুকেছ থেকে জানি, শাকরেদরা নিকেশ করে দিত আমায় জানাতে এল ভাগ্যিস"
"এতো ভালো কথা নয় মামা, এসব কী করছ তুমি"-সন্তু বলল।
"লোকগুলোকে তো দেখলি, উন্ডেড তাও দেখলি, মাথা মোটা নাকি ? বুঝলি না যে ওদের হেল্প করছি বাঁচানোর জন্যে। ওরা পাহাড়টিলা বলে কাছের একটা গ্রামের আদীবাসী, ওই এলাকার মাইনের ব্যাবসায়ীদের সাথে অনেকদিন থেকে ওদের লড়াই চলছে। ওরা খুব প্রকৃ্তিপ্রেমী, ব্যাবসায়ীরা ওদের গ্রামকে ভয়ানক দূষিত করছে আর ওদের জমি কিনে মানে একরকম কেড়ে নিয়ে ওদের তাড়াতে চাইছে। "
শুভ বলল  "এতো আমি টিভিতে দেখেছি একটা নিউজ চ্যানেলে ডকুমেন্টারী দেখাচ্ছিল"
"কেতাত্থ করেছ, তা আন্দোলন করলে পুলিশ ওদের ধরে জেলে ভরে আর  পেটায়। আর এ অঞ্চলের ভদ্র লোকজন পাঁচ বছর ধরে এই অন্যায় দেখছে আর দুধে ভাতে আছে, যা হয়"।
সন্তু বলল "ভারী অন্যায়, কিন্তু তুমি ওদের হেল্প করছ জানলে পুলিশ তোমাকেও ধরবে ছোটমামা"।
"আমি আর কিছু বন্ধু মিলে ওদের কয়েকবছর যাবৎ দেখাশোনা করি, মূলত চিকিৎসা, আর দুটো ডাল ভাতের ব্যবস্থা আর কী। তাও যাদের পুলিশ টর্চার করে তাদেরি ওই মন্দিরে এনে রাখি, সবার জন্যে করা সম্ভব হয়না"।
 "তাই ওই মন্দির নিয়ে ভয়ের গল্প চালু রেখেছ তোমরাই"- সন্তু বলে।
"হ্যাঁ , মাঝে মাঝে কিছু হাড়গোড় ওরাই  ছড়িয়ে রেখে ভয় দেখায় , যাতে কেউ না ঘেঁসে, উপায় তো নাই।" -বলে মামা।
" আমরা কি কলকাতায় গিয়ে এই ব্যাপারে জনমত গড়তে পারি না?"- শুভ বলে।
"জনমত, হা হা, ভারী নেতামার্কা কথা বললি, চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই তবে গোপন কথা ফাঁস হবেনা কিন্তু"- সতর্ক গলায় জানায় ছোটমামা।
শুভ আর সন্তুর পেট আঁইঢাঁই কমে এল, মাথায় একটু দ্বায়িত্ব বাড়ল অবশ্য। ছোটমামা যেমন শুধুই মজার মানুষ নন অনেক উঁচু মনের মানুষও, তেমনি ওদেরও প্রমাণ দিতে হবে ওরাও কিছু করতে জানে । এরপর মজাদার মামাবাড়িকে বিদায় জানানোর পালা, সুযোগ পেলেই আবার আসবে সেকথা বলাই বাহুল্য।

ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

বহরমপুর মুরশিদাবাদে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, প্রথম দিকের পড়াশোনা বিঞ্জান নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে তুলনামূলক সাহিত্যে বিষয় বদল শুধু ভালবাসা থেকে। বর্তমানে আমেরিকার বস্টন শহরে বসবাস। কবিতা আবৃত্তি , লেখা আর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ানো শখ ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা