১। বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোনোর দিন বিদ্যালয়
রাজুর মা বললেন, “আমাদের ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে শুনে আমার অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি । রাজু এত ভাল করে শিক্ষাদান করবার জন্য আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাদের জন্যই তো এত ভালো ফল করেছে”। “না না ! ধন্যবাদের কি আছে! আমরা নিশ্চিন্ত ও অনেকদূর যাবে। ওকে বলে দেবেন আমাদের কাছ থেকে প্রচুর শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ রইল” রাজুর শিক্ষিকা হেসে বললেন।
২। বাড়িতে
মা বললেন , “রাজু বার্ষিক পরীক্ষায় তুই আবার একই ফল করেছিস । প্রথম হওয়ার জন্য আমরা তোর পছন্দমত একটি আইপ্যাড পুরস্কার হিসেবে দিলাম । “অসংখ্য ধন্যবাদ মা। আমি জানতামই তো আমি প্রথম হবো। আমার বন্ধুরা কিছু পড়াশোনা করে না, বলছিলে তাই জন্যই তো এতো সহজে বারবার প্রথম হই” রাজু উত্তর দিলো ।বাবা সঙ্গে সঙ্গে রাগত স্বরে বললেন, প্রথম হয়েছে মানলাম কিন্তু যে অহংকারী হয় সে কখনো প্রকৃত মানুষ হতে পারে না একথা সদাসর্বদা মনে রাখিস। ঠিক আছে ঠিক আছে! আমি এক কথায় আমি এমনি বললাম । এমনিতেও আমি ওই নিয়মের ব্যতিক্রম।
৩। বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথন
রাজুর ঝকঝকে গাড়িটি বিদ্যালয়ের সামনে এসে থামলো। সে বেরিয়ে আসতেই বন্ধুরা চিৎকার করে উঠলো “ সকলে জায়গা করো রাজু ক্লাসে আসতে যেন একটু অসুবিধে না হয় এই নিয়ে ও তৃতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হল। আর্থিক অবস্থা অসম্ভব ভালো। আমাদের সবার সম্মানের যোগ্য”। রাজু ক্লাসে আসতেই ওর একজন সহপাঠী ওর কাছে ছুটে এসে বলল , “রাজু আজকে নিয়ে তিন দিন হল এই অঙ্কটা কিছুতেই পারছিনা আমাকে এটা করতে একটু সাহায্য করবি রে ভাই”।রাজু অংকটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখেই বললো ,”এই অংকটা তো আমি এক মিনিটে করে ফেলতে পারি। তোর মত বোকা ছেলে তো কখনো দেখিনি রে অমিত। এইটা তিনদিনেও তুই করতে পারলি না । তোর তো আমার সঙ্গে কথা বলার যোগ্যতাই নেই দেখছি”। অমিত কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ আমি জানি যে আমি তোর মতো পড়াশোনাতে ভালো নয়। তোর মত বুদ্ধি নেই আমার কিন্তু এই অংকটা না করলে আমার মনজে শান্ত হচ্ছে না । কিভাবে করতে হবে একটু দয়া করে বলে দে” । রাজু মাথা নেড়ে বলল একদমই না অন্য কারোর থেকে অঙ্ক টা বুঝে নে। তোর সঙ্গে মিশলে আমিও তোর মতই খারাপ হয়ে যাব। কিন্তু এই শ্রেণীতে তো তোর মত মেধাবী আর কেউই নেই কার কাছে বুঝবো। তা নিয়ে তুই চিন্তা কর আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছিস।
৪। ধূপ-ধুনো কান্ত
রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক । রাজুর গাড়িটি প্রায় তিন মিনিট ধরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে । এদিকে রাজু রীতিমতো অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ড্রাইভারকে থেকে থেকে তারা লাগছে, “ কিগো আর কতক্ষণ এরকম ভাবে বসে থাকব আর একটু আগে গাড়িটা শুরু করলে ট্রাফিকের বাধায় না থেমে এতক্ষণ অনেকটা চলে যাওয়া যেত”। এরকম কথা বার্তা চলছে এমন সময় হঠাৎ দেখল যে একটি ছেলে ধূপধুনো বিক্রি করবে বলে সেই তখন থেকে জানলা টোকা দিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য করা মাত্র তারমধ্যে অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া দেখা দিল । জানলা খুলে চিৎকার করে বললো, “ এই তুই সেই তখন থেকে আমার গাড়ির জানালা দিয়ে যাচ্ছিস কেন রে ? জানিসনা গাড়িটা নোংরা হচ্ছে”। ছেলেটি ভয় পেয়ে বললো, “ ভুল হয়ে গেছে বাবু। একটি ধূপধুনো সেট কিনবেন? সেই সেদিন থেকে একটাও বিক্রি হয়নি”। রাজু রেগে বলল , “তোর এত বড় সাহস আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলছিস জানিস আমি পড়াশোনা কত ভালো ? কত বড় স্কুলে পড়ি ? আর লেখাপড়া ছেড়ে এসব কি করছিস ? তোর জীবনে তো দেখছি বারো আনাই বৃথা!” ছেলেটি ম্লান হাসি হেসে বলল , “আর বলবেন না বাবু পড়াশোনার বই কিনতে প্রতিদিন এত খাঁটি । লেখাপড়া করার জন্যই তো এত চেষ্টা। তাই বলছি একটা সেট কিনুনি না। আপনার তো কোন ক্ষতি হবেনা বরং আমার অন্তত একটা উপকার হবে। বিশ্বাস রাখতে পারেন ঠকাচ্ছি না। একেবারে খাঁটি জিনিস”। “ওসব চালাকির পাত্র নয়। পড়াশোনার নাম করে জিনিস কেনা। কিছু কিনবো না গাড়িটার ময়লা করিস না।
৫। সুমতি
ছুটির দিন। কাকভোর রাজু হাঁটতে বেরিয়েছে ।রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পাশের গ্রামে চলে এসেছে । গ্রাম্য প্রকৃতি পরিবেশ উপভোগ করতে করতে চলেছে । এমন সময় দেখল একটা ভাঙ্গা খরের কাঁচা বাড়ির সামনে একজন দরিদ্র ছেলে একটি পুরনো বই থেকে সমানে অংক করে যাচ্ছে । বইটাও অনেক জায়গায় ছেঁড়া, পাতা গুলো হলুদ, ঝুরঝুরে ও উইপোকায়ে কাটা। ছেলেটাকে উপহাস করতে সে তার দিকে এগিয়ে গেল। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “ এই তুই কোন শ্রেণীতে পড়িস?” সেই ছেলেটি অত্যন্ত মিষ্টি গলায় তাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করে বললো যে সে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র রাজুও পরে সপ্তম শ্রেণীতে। জিজ্ঞাসা করল কি করছিস? “আজ্ঞে অংক করছি বন্ধু”। “তাতো দেখতেই পাচ্ছি”। বলে ছেলেটার বইটি নিজের দিকে ঘুরিয়েই বিস্মিত হয়ে দেখল যে অঙ্গ গুলির নবম শ্রেণীর। আশ্চর্য হল এই বুঝে যে অংক গুলি বুঝতে গেলে তার মাথা গুলিয়ে যাবে আর সব থেকে বড় অবাক হওয়ার কারণ ছেলেটি যথেষ্ট সহজ এবং তাড়াতাড়ি অংক গুলি করছে। নিমেষের মধ্যে রাজুর মনে এত দিন এত বছর ধরে যে অহংকার পোষণ হয়েছিল যার জন্য তার সমস্ত মানবিকতা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সেই অহংকার কোথায় যেন উবে গেল। উপলব্ধি করলো এতদিন ধরে নিজেকে সবথেকে বেশি মেধাবী ভেবে কী ভুলটাই না করেছি! অনেকে যে আমার থেকে হাজার হাজার গুণ বুদ্ধিমান তা এতদিন আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু অবশেষে এই ছেলেটির জন্য এত বছর পরে চোখে ফুটল রাজুর।
শেখার ইচ্ছে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ছেলেটিকে ভরপুর গলায় বলল “বন্ধু এই অংক গুলো কেমন ভাবে করতে হয় তা আমাকে দয়া করে বুঝিয়ে দেবে”। ছেলেটি একগাল হেসে বললো “নিশ্চয়ই! এখানে এসে বসো শিখিয়ে দিচ্ছি”। রাজু তার পাশে গিয়ে বসলো। ছেলেটি বোঝায়, রাজু অবাক হয়ে শোনে, তার অংকের জ্ঞান ক্রমশ বাড়তে থাকে।
আমার কথাঃ
আমার নাম অর্হণ গুহ মজুমদার । আমি গার্ডেন হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর গ বিভাগে পড়ি। আমি বড় হয়ে একজন বিজ্ঞানী হয়ে মানবজাতির দুঃখ কষ্ট দূর করতে ব্যবহৃত হবে এমন আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হতে চাই। পড়াশোনার মধ্যে সমস্ত বিষয়ে অত্যন্ত ভালো লাগলেও বিজ্ঞান এবং অংক সব থেকে বেশি ভালো লাগে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা নানারকম বই আমাকে আকৃষ্ট করে। বাংলা গল্পের বই গুলো বিশেষ করে আমাকে যেমন অন্য এক জগতে নিয়ে যায় যেখানে অন্য প্রকৃতি-পরিবেশ আমি লালু, শংকর প্রভৃতি কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে কিছুটা সময় অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে কাটাই -যেমন সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু, ফেলুদা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লালু ইত্যাদি। প্রফেসর শঙ্কু তার বিচিত্র আবিষ্কার, ফেলুদা রহস্য রোমাঞ্চ ভরা জীবন এবং লালু তার ডাকাবুকো প্রকৃতি দিয়ে আমার মনকে ভুলিয়ে রাখে।
ছবিঃ পিক্সাবে