চক্র দেখেছে রোজই তাদের বাড়ি এক ভিখারিনী আসছে।কোলে তার দু তিন বছরের একটা ছেলে।ছেলেটার নাম লচ্ছু।লচ্ছু ! এধরনের নাম চক্র কোনো দিন শোনে নি।মাকে জিজ্ঞেস করে ছিলো ও,মা লচ্ছু আবার কেমন নাম?
মা বলেছিলেন নাম রাখার মত ওদের ভাবনা নেই বাবা!ওরা খিদের তাড়নায় সারা দিন ঘুরে বেড়ায়,তাই ছেলে মেয়ে হলে যা হোক একটা নাম রেখে দেয়।
সে দিন যখন ভিখারিনী লচ্ছুকে নিয়ে এলো,চক্র লচ্ছুকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,ওর নাম লচ্ছু কেনো রেখেছ?
ম্লান হাসলো অন্নু ভিখারিণী,বলল,ওই রাম,লছমন আছে না,তার লছমন থেকে ওর নাম লচ্ছু রেখেছি।
--আমরা তো লক্ষণ বলি।তুমি লছমন বলছ কেনো?আবার প্রশ্ন করে চক্র।
অন্নু ভিখারিণী বলল,আমি তো বাঙালী নই,ছোট্ট বাবু!তাই--
--তা হলে তুমি বাংলা বলো কি করে?
--আমি ছোট বেলা এখানে চলে আসি।আর আমার লোক,মানে স্বামী--সে ছিলো বাঙালী।
--কোই তাকে তো কখনো দেখি নি!
--সে মোরে গেছে ছোট্ট বাবু.আজ দু বছর হলো।
এমনি সময় ঘরের ভিতর থেকে,চক্র,চক্র বলে মা ডাকতে লাগলেন।তাই আরও প্রশ্ন মনে জমা থাকলেও অবলা রয়ে গেলো।ঘরের ভিতর ঢুকতে হলো তাকে।
লচ্ছুকে দেখেছে চক্র।একটা রাক্ষস ছেলে।ওর মা রুটি,ভাত,বিস্কুট যখনি যা দেয় চক্র দেখেছে মহা পেটুকের মত খেতে থাকে লচ্ছু!ওর মা দু বার মুখে পুরল না পুরল ও গপগপিয়ে সব খেয়ে ফেলল।মনে হলো সবটা বুঝি গিলে নিল!অবাক হোয়ে চক্র দেখতে থাকে।কোনো দিন লচ্ছুকে সে জিজ্ঞেস করে,আর খাবি লচ্ছু?লচ্ছু একটু হাসে,তারপর মাথা সামের দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়।
চক্র ছুটে যায় ঘরের ভিতর।মাকে বলে,মা আর একটা রুটি দাও না। ওই লচ্ছু রাক্ষসটাকে দিয়ে আসি!
মা বলেন,ওরকম বলতে নেই বাবা!ওরা গরীব,ভালো খেতে পায় না,তাই খিদে ওদের পেটে সব সময় লেগে থাকে।কথা কটা বোলে চক্রের হাতে একটা রুটি তুলে দেন।
চক্র রুটি নিয়ে ছুটে গিয়ে লচ্ছুর সামনে তুলে ধরে।লচ্ছু এত ছোট তাও খপ করে ধরে নেয় রুটিটা।চক্র মনে মনে বলে,কি লোভী বাবা!খাবার বেলা বড়দের মত কি লাফ ঝাপ দিয়ে উঠলো দেখো!তারপর ও প্রকাশ্যেই অন্নু ভিখারিনীকে বলে উঠলো,তোমার ছেলে লচ্ছু রাক্ষস গো!
অন্নু কিছু বলল না,শুধু চক্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
হয়তো বলতে চাইল,তোমরা কি বুঝবে গো,মানুষ কোন জালায় রাক্ষস হয়!
এর পর থেকে যখনি অন্নু লচ্ছুকে নিয়ে আসত,চক্র তাকে দেখলেই বলে উঠতো,মা,মা,ওই রাক্ষস এসেছে।ঘরে খাবার আছে কিছু?
চক্র ক্লাশ থ্রীতে পড়ে।একটা প্রইভেট ইংরেজী স্কুলে।রোজ ভোরে গাড়ি আসে তাকে স্কুলে নিয়ে যেতে।স্কুলের ইউনিফর্ম পরে বইয়ের ব্যাগ ও জলের বোতল নিয়ে তৈরী থাকে।স্কুলের গাড়ি এসে হর্ন দিলো কি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও।তড়িঘড়ি করে মা,বাবাকে,টা,টা,করে বাসে চেপে বসে।
সে দিন ও তাই হলো।নিয়ম মত স্কুলে পৌঁছালো।স্কুলের টিফিনে টিফিন বক্স খোলে চক্র।মা তার জন্যে অনেক খাবার দিয়েছেন।তিনটে রুটি,দু রকমের তরকারি,দু রকমের মিষ্টি,আর টিফিন বক্সের ভেতরের ছোট্ট বক্সে ভরা আছে ঘরের তৈরী মিষ্টান্ন!ও ভাবে কি যে করে না মা!এত কিছু সে কি খেতে পারে!এত খাবার দেখে লচ্ছুর কথা ওর মনে পড়ে যায়।ও যদি থাকত তো খাবার গুলো আর নষ্ট হতো না।
তাড়াতাড়িতে সে দিন বিজন টিফিন বক্স আনতে ভুলে গেছে।টিফিনের সময় পর্যন্ত তার ঘর থেকে কেউ টিফিন বক্স পৌঁছালো না।চক্র বলল,আয় আমরা একসঙ্গে বসে টিফিন খেয়ে নিই।আমার কাছে অনেক খাবার আছে।
বিজন এক দু বার আপত্তি করে শেষে এক সঙ্গে বসে ওরা ভাগাভাগি করে টিফিন খেয়ে নিল।একটু পরেই বিজনের টিফিন নিয়ে ঘরের লোক পৌঁছালো।কি হবে সে টিফিন বক্স!তেমনি ভরা পড়ে রইল।
সে দিন অনিবার্য কোন কারণে স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হোয়ে গেলো।চক্রর পেট ভালো ছিলো না।দু তিন বার মেমকে বলে টয়লেটে গিয়েছে।পেটটা আবার কেমন যেন মোচড়াচ্ছিলো।শরীর কেমন দুর্বল লাগছিল।ছুটির ঘন্টা পড়ার পর ক্লাশ ছেড়ে সবাই বেরিয়ে গেলো।যাবার আগে দু চারজন ওকে ডেকে গেলো।কিন্তু পেটের ব্যথায় কাতর চক্র বইয়ের ব্যাগ আর জলের বোতল নিয়ে টয়লেট পরিসরের ভিতরে ঢুকল।হাতের বোতল,ব্যাগ বাইরে রেখে টয়লেটের ভিতরে ঢুকে গেলো সে।ডিসেনট্রির মত হোয়ে গেছে তার।মনে হচ্ছিল আরও একটু,আরও একটু বসলে ভালো হতো!বার বার পেটের ভিতরে একটা নিম্ন চাপ অনুভব করছিল।
এমনি আধঘন্টা কেটে গেলো,তাড়াহুড়োতে স্কুলের বাসে চক্র ওঠেনি এটা কেউ লক্ষ্য করল না।বাস ছেড়ে দিলো।চক্রর ঘরের সামনে এসে হর্ন দিলো গাড়ির ড্রাইভার।কেউ নামল না।কেউ জিজ্ঞেস করল না যে চক্র কোথায়!ড্রাইভার মনে করতে পারলো না সকাল বেলা এ ঘরের ছেলেটা বাসে উঠে ছিলো কি না।ছাত্রদের ওঠানো নামানোর লোকটা মনে করল ছেলেটা হয়তো ছুটি নিয়ে গার্জিয়ানের সঙ্গে বাড়ি চলে এসেছে।যেমনটা মাঝে মোধ্যে হোয়ে থাকে।নিয়মিত সময়ের আগে স্কুলের বাস এসে চলেগেল,চক্রর ঘর থেকে কেউ তা লক্ষ্য করল না।
এদিকে স্কুল পাহারাদার,চৌকিদার ওরা পুরোপুরি এক বেলার ছুটি পেয়ে গেছে।ওরা ক্লাশ ঘরের বাইরে টাইরে ভালো ভাবে দেখে শুনে নিল।স্কুল ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করল।মেন গেটগুলোতে তালা লাগিয়ে ঘরের দিকে চলে গেলো।
চক্র যখন নিজেকে একটু সামলালো,টয়লেট থেকে ও বেরিয়ে এলো।বইয়ের ব্যাগ আর জলের বোতল হাতে তুলে টয়লেট পরিসরের বাইরে বেরিয়ে এলো।
আরে,স্কুল একেবারে ফাঁকা,একজন স্টুডেন্টকেও ও দেখতে পেল না।না মেম, না দারোয়ান,না চৌকিদার কেউ নেই!মেনগেটের সামনে হাজির হলো ও।কিন্তু একি,গেট যে বন্ধ হোয়ে গেছে!ও জোরে জোরে ধাক্কা দিলো গেটে,গেট খোলার চেষ্টা করল।না,গেট বাইরে থেকে বন্ধ!কান্না পাচ্ছিল চক্রর।ও জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো,চীত্কার করে দারোয়ান,চৌকিদারদের ডাকতে লাগলো।না,কারো কোনো সাড়া নেই!ও চীত্কার করে উঠলো,গার্ড আঙ্কেল,গার্ড আঙ্কেল!কেউ এলো না,কেউ তাকে গেট খুলে দিয়ে গেলো না!
হঠাৎ চক্রর মনে পড়ল,স্কুলের পেছন দিকে আরও একটা গেট আছে।মনে পড়া মাত্র ও কানতে কানতে ছুটে চলল পেছন দিকের গেটের কাছে।দূর থেকেই দেখল গেট বন্ধ।তবু গেটের কাছে এলো,জোরে জোরে ধাক্কালো।এখানেও চীত্কার করে ডাকতে থাকলো গার্ড আঙ্কেল,গার্ড আঙ্কেল,বলে।
কেউ এলো না,কেউ তার ডাক সুনতে পেল না।পেছন গেটের পাশেই ও ব্যাগ, জলের বোতল নিয়ে মেঝেতে লেপটি মেরে বসে গেলো।ও হতাশায় দুটো পা সামনের দিকে ছড়িয়ে দিল।এখন আর কাঁদতে পার ছিলো না ও,মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছিল।শরীর শিহরণ দিয়ে উঠছিল।
--মা,মা,মা,কাতর ভাবে বলে উঠলো ও।মা তুমি কোথায়!আমায় এসে নিয়ে যাও,মা!একটু থেমে আবার বাবাকে ডাকতে থাকলো,বাবা,বাবা,বাপি তুমি কোথায়,তুমি কোথায়?ওর দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকলো।
বেলা তিনটে বেজে গেলো।চক্র ঘরে আসে নি এখনো।খোঁজ,খোঁজ,খোঁজ,কোথায় চক্র?স্কুলে ফোন লাগানো হলো।স্কুলের ফোন বাজতে থাকলো,কেউ উঠালো না।কেবল স্কুলের অফিস ঘরের ফোনের ঝংকার চক্রকে উতলা করে তুলল।ছুটে এসে ও দেখল স্কুলের অফিস ঘরে ফোন বেজে চলেছে। কিন্তু কি করবে ও?অফিস ঘরেও লাগা ছিল বড় এক তালা! ও অসহায়ের মত কেবল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
চক্রর মা আশপাশের বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলেন--যেখানে চক্র মাঝে মাঝে ঘুরতে যায়।না,কোথাও সে নেই।আশপাশের অলিগলি মাঠ,ঘাট কোথাও ও নেই!
চক্রর বাবা গাড়ি নিয়ে চলে এলেন স্কুলে।না,সমস্ত স্কুল বিল্ডিঙ্গের বাইরেটা তখন খা খা করছে,কোথাও একটা জনপ্রাণীর দেখা নেই।তবু তিনি গাড়ি থামিয়ে নীচে নাবলেন।স্কুলের মস্ত গেটে বড় তালা ঝুলছে দেখলেন।মনে একবার সন্দেহ হলো,এমন তো নয় চক্র স্কুলের ভিতর আটকা পড়ে আছে!পর মূহুর্তে মনে হয়েছে,না,এমন হয় না,বাচ্চাদের স্কুলে এমন ঘটনার নজির নেই বললেই চলে।তবু মেন গেটে গিয়ে তিনি কান পাতলেন।না,কোনো সাড়াশব্দ নেই।দরজায় একবার,দুবার থপ থপ করলেন।না ভেতর থকে কোনো আওয়াজ এলো না!
বেলা পাঁচটা বেজে গেলো।স্কুলের স্টাফের কাছ থেকে চৌকিদারের ঘরের লোকেশন জেনে নিয়ে চক্রর বাবা আর পাশের বাড়ির এক ভদ্রলোক গেলেন চৌকিদারের কুয়াটার্সে।চৌকিদার ছিলো না,ও বাজারে গিয়েছিল।অনেক সময় অপেক্ষার পরও যখন চৌকিদার ফিরল না,তখন ওঁরা সোজা চলে এলেন পুলিশ থানায়।সেখানে চক্রর মিসিং রিপোর্ট করা হলো।
রাত আটটা বেজে গেলো।চক্রর ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেলো।মা অঝরে কেঁদে চলেছেন।কান্নার মোধ্যে বলে চলেছেন,আমার ছেলেকে এনে দাও,আমার ছেলে কে এনে দাও গো।বাবা স্তব্ধ হোয়ে দাঁড়িয়ে আছেন,চোখে তার জলের ধারা।চক্র তাঁদের এক মাত্র সন্তান।
চক্র চুপ করে বসে আছে।মাঝখানে সামনের গেটের থেকে ঠুক ঠাক শব্দ এসে ছিলো।ও পাগলের মত টলতে টলতে ছুটে গিয়ে ছিলো।গেটের কাছে পৌঁছাতে তার দেরী হোয়ে গিয়েছিল।ততক্ষণে ওর বাবা স্কুলের গেটে দু তিন বার ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়ে ছিলো নিজের কারের কাছে।চক্র শুধু একটা গাড়ির স্টার্ট দেবার শব্দ পেয়েছিল।ভাঙা গলা নিয়ে সে প্রাণপণ চীত্কার করেছিল।কিন্তু কারো কান পর্যন্ত সে চীত্কার পৌঁছায় নি।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলো।ভীষণ ভয় করছিল চক্রর।সামান্য শব্দ কানে এসে বাধছিলো।হাওয়ার শন শন শব্দ,মশার ঝাঁকেদের ওড়ার শব্দ,আর দূরের লোকালয়ের কথাবার্তার আওয়াজ কানে আসছিল।আর পারছিলো না সে--চীত্কার করতে করতে ওর গলা শুকিয়ে গেলো,ভয় পেতে পেতে ওর শরীরে কেমন জড়তার ভাব এসে গেলো।তার ওপর সারা দিনের না খোয়াতে তার শরীর দুর্বল হোয়ে পড়েছে।আর চলতে পারছে না ও।ব্যাগ আর জলের বোতল পেছনের গেটের কাছে পড়ে রইল।সামনের গেটের কাছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ধুপ করে বসে পড়ল।দু পা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে দু হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে চুপচাপ শরীর এলিয়ে পড়ে রইল।
রাত তখন সারে দশটার কাছাকাছি।রিক্সা থেকে নামল দারোয়ান ও চক্র।চক্রকে কোলে করে নামাতে হলো।সদর দরজা আজ খোলাই ছিলো।রিক্সার সামান্য শব্দ শুনেই চক্রর মা,বাবা,এক সঙ্গে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলেন।দারোয়ানের কোলে চক্রকে দেখে,চক্র,চক্র বলে ছুটে এলেন তাঁরা।
মা চক্রকে জড়িয়ে ধরলেন,বলে উঠলেন,কি হয়েছে বাবা!কি হয়েছে তোমার!কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা।বাবা হতবাক হোয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।তাঁর চোখের কোন ভিজে যেতে লাগলো।
দারোয়ান করুণ সুরে বলে উঠলো,বাবু!,ভয়ে তার মুখ দিয়ে কথা সরছিল না।হঠাৎ সে চক্রর বাবার পা জড়িয়ে ধরলো,বাবু! আমায় মাপ করুন।আমি দোষ করেছি,বাবু!
ছেলে স্কুলে আটকে পড়েছিল জানতে পেরে সত্যি রাগে কান্ডজ্ঞানহীন হোয়ে পড়লেন তিনি।দারোয়ানকে ঠাস,ঠাস,চড় মারতে লাগলেন।
দারোয়ান কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,আরও মারুন,বাবু সাব,আরও মারুন।
--দাঁড়া,আমি তোকে পুলিশে দেবো,তোকে আমি ছাড়ব না,চক্রর বাবা ভীষণ উত্তেজিত হোয়ে গেলেন।
দারোয়ান হাত জোড় করে কাঁদো কাঁদো হোয়ে বলে ওঠে,বাবু সাব,আরও মারুন আমায়,হাত দিয়ে মারুন,লাঠি দিয়ে মারুন,চাবুক এনে মারুন,কিন্তু বাবু,হাতে মরুন,আমায় ভাতে মারবেন না।আমারও সংসার আছে,বৌ,ছেলে,মেয়ে,আছে। ওদের পেটে লাথি মারবেন না বাবু!
আস্তে আস্তে শান্ত হতে লাগলেন চক্রর বাবা।ভাবলেন,কি হবে গরীবের পেট মেরে। ঘটনা যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে।দারোয়ানকে ছেড়ে দিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকলেন।ছেলে তার মার কোলে কেঁদে চলেছে তখনও,বাবাকে দেখে চক্র আরও ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো।বাবা কোলে তুলে নিলেন ওকে।মুখ দিয়ে তাঁর সম্পূর্ণ কথা সরল না,কেবল,বাবা,বাবা,বলে ডেকে উঠলেন তিনি।
রাত এগারোটা কোথা দিয়ে বেজে গেলো কেউ টের পেল না।ঘটনার উত্তেজনা খুব ধীরে ধীরে হলেও শান্ত হোয়ে আসছিল।চক্র নিজেকে সামান্য সুস্থ অনুভব করছিল। এবার তার পেট খিদেতে মুচড়ে উঠলো।ও ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলো,মা,খুব খিদে পেয়েছে,মা!
মা তাড়াতাড়ি ছেলের খাবার থালে বেড়ে ওর মুখের সামনে তুলে ধরলেন।ছেলের অসুবিধা হবে ভেবে তিনি খায়িয়ে দিতে লাগলেন।খিদে আর সহ্য হচ্ছিল না,খুব তাড়াতাড়ি খেতে থাকলো চক্র।খিদের মুখে তার কাছে সব খাবার খুব ভালো লাগছিলো।মার দেবার আগেই ও খেয়ে নিচ্ছিল।পরের গ্রাসের জন্যে হাঁ করে বসে থাকছিল।গপাগপ সে থালের সমস্ত খাবারগুলি খেয়ে নিল।ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস জল খেয়ে নিল।এবার অনেকটা শান্ত হোয়ে চক্রর মনে পড়ে গেল একটা কথা।ও মাকে ডেকে বলল,মা,আমি আর লচ্ছুকে রাক্ষস বলব না,মা!
মা জিজ্ঞেস করলেন,কেনো,বাবা?
চক্র ধীরে ধীরে বলে উঠলো,আজ আমার এত খিদে পেয়েছিল,মা,দেখলে আমিও না রাক্ষসের মত সব গপাগপ খেয়ে নিলাম--ঠিক লচ্ছুর মত!
তাপসকিরণ রায়
জবলপুর , মধ্য প্রদেশ
বছর ছয়েকের স্যাংপো মা বাবার হাত ধরে লাফাতে লাফাতে চলেছে পার্কে বেড়াতে। আজ রবিবার - মা বাবার ছুটি আর এই দিনটা স্যাংপোর সব থেকে আনন্দের – মা কত কিছু রান্না করে ওর জন্য আর বাবা কত গল্প শোনায় তারপর বিকেলে ওরা তিন জন হাত ধরে বেড়াতে আসে পার্কে। সপ্তাহের বাকি ছয়দিন তো মা বাবার অফিস থাকে বলে একেবারেই সময় পায় না আর স্যাংপোকেও ভোর বেলা উঠে স্কুলের জন্য তৈরি হতে হয় ফলে ওদের দেখা হয় সেই রাত্রে বেলা আর তখন স্যাংপো ঘুমে ঢুলছে – মা খাইয়ে দিতে না দিতেই মার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। রোজ বিকেলেই স্কুলের দিদিমণি ওদের নিয়ে আসেন এই পার্কে খেলার জন্য তবে স্যাংপোর মনে হয় মা বাবার সাথে এলে পার্কটা যেন আরও বেশী ভালো লাগে। পার্কে এসে ওরা নরম ঘাসের কার্পেটেই বসে পড়লো তবে স্যাংপো ঘাসের মধ্যে বার কয়েক গড়াগড়ি দিয়ে মার কোলে মাথা দিয়ে আর বাবার কোলে পা দুটো তুলে দিয়ে আরাম করে শুলো। ‘জানো বাবা, আজ না আমাদের দিদিমণি বলেছিলো চার পাঁচশো বছর আগে মানুষ এই ডোম পৃথিবীতে থাকতো না – ওরা একটা মস্ত বড় পৃথিবীর মাটিতে ঘুরে বেড়াতো – সেটা নাকি লম্বা চওড়াতে হাজার হাজার কিলোমিটার। সেখানে অনেক গাছ পালা, বড় বড় নদী, পাহাড়, জঙ্গল ছিলো। সেই পৃথিবীর ত্রি-মাত্রিক সিনেমাও দেখিয়েছে - কত বিরাট সব বাড়ি – এক একটা মনে হলো আমাদের ডোম থেকেও উঁচু, আর এক একটা পার্ক তো আমাদের এই ডোম থেকেও বড়। খুব সুন্দর ছিলো দেখতে – আমাদের এই ডোমটা কত্তো ছোট আর বাড়ি গুলোও ভীষণ ছোট ছোট। আমরা সেই পৃথিবীতে যেতে পারি না?’ কিঞ্জল হাসলেন, ‘ওই পৃথিবীটা তো হারিয়ে গিয়েছে স্যাংপো – ডুবে গিয়েছিলো সমুদ্রের জলের তলায় – তাই তো আমরা এই ডোম বানিয়ে সমুদ্রের নিচেই থাকি। দাঁড়া, তোকে সেই বিরাট প্লাবন আর বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা গুলো বলি। জানিস তো আমাদের এই ডোম শহরের মত আরো অনেক ডোম শহর আছে জলের নিচে – এই শহর গুলোর সব নম্বর দেওয়া আছে। বল তো আমাদের এই ডোম শহরের নম্বর কত?’ শহরের নম্বর, নিজেদের নম্বর, এই রকম আরো অনেক দরকারি খবর এদের মুখে বোল ফোঁটার সাথে সাথেই একেবারে ঠোঁটের ডগায় – কারণ জন্মের আগেই যে ছোট্ট কম্পিউটার সবার মাথাতে বসিয়ে দেওয়া হয় তাতে এই রকম অনেক দরকারি খবর দেওয়া থাকে ফলে সেগুলো আপনা থেকেই মনে চলে আসে।
‘এই ডোমটা তো ৭২০এ-মেইন আর আমার নম্বর হলো ৭২০এ-এম-৪৮৭৩৬-স্যাংপো - ঠিক কিনা বল?’ ‘ঠিক। ওই পৃথিবীর লোক তো আমাদের মত এত উন্নত ছিল না তাই ওদের শুধু নামই থাকতো আর প্রত্যেকটা দেশেরও আলাদা নাম ছিলো – যেমন ধর চিন, ভারতবর্ষ, অ্যামেরিকা, এই রকম। প্রত্যেক দেশের আবার ভাষাও ছিলো আলাদা এমন কি একটা দেশেই হয় তো কুড়ি পঁচিশটা ভাষা ফলে এই নিয়ে সব সময় গোলমাল লেগেই থাকতো। একুশ শো শতকের সেই সুজলা সুফলা পৃথিবী তো এখন শুধুই কল্পনা – তোরা তো ছবিতেই দেখেছিস সেই সুন্দর পৃথিবীকে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ পৃথিবীর বুকে খুব অত্যাচার করেছিলো – জঙ্গলের সমস্ত গাছ কেটে পরিষ্কার করে দিয়েছিলো, পরিবেশ সংরক্ষণের কথা কখনই ভাবে নি যার ফলে অবাধে মানুষের তৈরি নানা রকমের বিষাক্ত গ্যাস বায়ু মন্ডলকে দূষিত করে আকাশে ওজোনের যে ঘেরাটোপ এই পৃথিবীকে রক্ষা করতো সূর্যের নানা রকম রশ্মী ও গরম থেকে সেটাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিতে থাকে ফলে গরম বাড়তে শুরু করলো সেই সাথে বৃষ্টিও ভীষণ কমে গেলো ফলে ধীরে ধীরে সেই চির সবুজ পৃথিবী হয়ে গেলো একেবারেই নেড়া – শুধু শুকনো মাটি আর পাথর – বৃষ্টির অভাবে নদীগুলোও গেলো শুকিয়ে। তার উপর গরমে সমস্ত উঁচু উঁচু পাহাড় আর দুই মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের জল স্তরকে বাড়াতে লাগলো ফলে সমস্ত সমতল এলাকা ডুবে গেলো সমুদ্রের জলে। তখন সেই সব জায়গার লোকরা কোথায় যাবে? ওরা উঁচু এলাকাতে যাবার চেষ্টা করায় ওখানকার লোকের সাথে যুদ্ধ লেগে গেলো। ফলে বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে দেশে দেশে এই যুদ্ধ মহাযুদ্ধের আকার নিলো – এটাকে পৃথিবীর ইতিহাসে তৃতীয় মহাযুদ্ধ বলে। মহাযুদ্ধের সাথে মহামারি ও সমুদ্রের নোনা জলে সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে খেতে না পেয়ে ধীরে ধীরে সেই পৃথিবীর প্রায় নব্বই ভাগ লোকই মরে গেলো। বাকিরা বাঁচার তাগিদে ভুলে গেলো নিজেদের আলাদা আলাদা ভাষা, ধর্ম, আচার ব্যবহার – বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে তৈরি হলো নতুন পৃথিবীর মানুষ – এদের ভাষা হলো আজকের আমাদের এই আন্তর্জাতিক ভাষা, একমাত্র পরিচয় হলো মানুষ এবং মানবিকতাই একমাত্র ধর্ম।’ ‘আচ্ছা বাবা, সমুদ্রের জল বেড়ে বেড়ে পৃথিবী তো ডুবে যেতে লাগলো তাহলে এই মানুষরা কোথায় থাকতো?’ ‘ওরাই তো আমাদের পূর্বপুরুষ রে – ওরা বানালো সমুদ্রের জলের নিচের এই ডোম গুলো। তুই তো জানিস এই সব ডোম শহরে যে বিশাল কম্পিউটার আছে সেই সামলায় সমস্ত রকম ঝক্কি ঝামেলা যেমন ধর ডোমের ভেতরের আবহাওয়া ঠিক রাখা, সমুদ্রের ঢেউ দিয়ে ভাসমান টার্বাইন চালিয়ে ও ভাসমান সোলার সেল দিয়ে সূর্যের আলো থেকে শহর চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি করা, সমুদ্রের জল শোধন করে খাবার জল সবার বাড়িতে পৌছে দেওয়া, এই রকম হাজারো দৈনন্দিন কাজ। সব থেকে বড় প্রয়োজনীয় ব্যাপার হলো খাদ্য - সমুদ্রের বিশাল খাদ্য ভাণ্ডারকে ব্যবহার করতে আমরা শিখেছি এ ছাড়াও গড়ে তুলেছি আলাদা আলাদা ডোমে ধান, গম, শাক সব্জির চাষ – ওখান থেকেই আমাদের সবার খাবার আসে আর ওই সব ক্ষেত, কারখানার সাথে যোগাযোগ তো টানেলের ভেতর দিয়ে মনোরেলেই হয়। সমস্ত ডোম শহরেই এই রকম ব্যবস্থা আছে। আর এই সমস্ত ডোম শহরগুলোর মধ্যে যোগাযোগও টানেলের ভেতর দিয়ে খুব দ্রুত চলা ট্রেনে। তাছাড়া সমুদ্রের নিচের ধাতু তুলে এনে আমরা আমাদের দরকারের সমস্ত জিনিষই বানাই। তুই তো জানিস তোর মা শাক সবজি উৎপাদনের ওখানে কাজ করে আর আমি কাজ করি ওই ধাতু নিষ্কাশনের কারখানায়। তুই বড় হয়ে কি করবি সেটাও তো ওই বড় কম্পিউটার তোর জন্মের আগে থেকেই ঠিক করে দিয়েছে – তাই না?’ ‘হ্যাঁ বাবা, আমি বড় হয়ে পরিবেশ সংরক্ষণের ওখানেই কাজ করবো। চল না একদিন মনোরেলে করে অন্য ডোম কারখানা গুলো দেখে আসি।’ ‘ঠিক আছে, আমি অনুমতি নিয়ে রাখবো আগামী রবিবার ওখানে যাবার। ওই দ্যাখ আমাদের ডোমের আকাশে সন্ধ্যে হয়ে এলো – আজ তো পূর্ণিমা তাই কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। এবার তো বাড়ির দিকে যেতে হবে।’ ‘জানো বাবা, পুরাতন পৃথিবীতেও এই রকম চাঁদ উঠতো আকাশে – আমরা সিনেমাতে দেখেছ।’ ‘তবে কি জানিস, পুরাতন পৃথিবীর চাঁদটাই হলো সত্যিকারের চাঁদ – চাঁদ তো পৃথিবীর উপগ্রহ। আমাদের ডোমের আকাশে কৃত্রিম উপায়ে সমস্ত কিছুই সেই পুরাতন পৃথিবীর মতই করা হয়েছে যাতে আমরা বুঝতে না পারি যে আমরা সমুদ্রের জলের অনেক নিচে আছি তাই তো আজ পূর্ণিমা বোঝাতে এই গোল চাঁদ উঠেছে ডোমের আকাশে।’
স্যাংপো ও কিঞ্জল যখন নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত তখন শিমরান ভাবছিলেন আজ সকালে আসা মেইলের কথা। বড় কম্পিউটার জানিয়ে দিয়েছে এই ডোম পৃথিবী থেকে ওদের বিদায়ের দিন অবশ্য সেটা আরো পনের বছর পর যখন স্যাংপো নিজের পড়াশুনা শেষ করে কাজ শুরু করবে। জন সংখ্যা ঠিক রাখার জন্য একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর সবাইকেই এই ডোম পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় আর এই বয়স সীমা বড় কম্পিউটার ঠিক করে ঐ ব্যক্তির এই ডোমে প্রয়োজনীয়তার কথা হিসেব করেই। বেশীর ভাগ সময়ই স্বামী স্ত্রী একই সাথে বিদায় নেন – কিঞ্জলরাও তাই ঠিক করেছেন। সেই বিদায়ের দিনকে উৎসবের মতই পালন করা হয় শহরের কম্যুউনিটি সেন্টারে – সেখানে বিদায়ী লোকের পছন্দের খাবার, গান বাজনার ব্যবস্থা থাকে এবং এটা শহর কর্তৃপক্ষই করেন। দেখতে দেখতে পনের বছর কেটে গিয়েছে – স্যাংপো পড়াশুনা শেষ করে নিজের কাজে যোগ দেবার জন্য তৈরি আর কিঞ্জল ও শিমরনের এই ডোম পৃথিবী থেকে বিদায়ের দিনও এসে গেলো। সেদিন সকালে শিমরন সমস্ত বাড়ি পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখলেন এর পর যারা এখানে থাকবে তাদের সুবিধের জন্য – অবশ্য স্যাংপো ঠিক করেছে মা বাবার স্মৃতির এই বাড়িতে নিজেই চলে আসবে। আজ কিঞ্জল ও শিমরনের জন্য দেওয়া হয়েছে ফুল দিয়ে সাজানো বিশেষ গাড়ি - সেই বিশেষ গাড়িতে কম্যুনিটি হলে আসতে ওদের পছন্দের গান বেজে উঠলো – আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা ওদের বরণ করে নিয়ে এলো ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চের উপর - হৈ হৈ করে গল্প ও খাওয়া দাওয়ার মধ্যে দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো সেটা ওরা জানতে পারলেন যখন বেজে উঠলো ওদের বিদায়ের গান – দরজায় এসে দাঁড়ালো শেষ বিদায়ের গাড়ি। সবার সাথে আলিঙ্গন করে স্যাংপোকে আদরের চুমু দিয়ে শিমরন ও কিঞ্জল উঠে এলেন সেই গাড়িতে – সবার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে বন্ধ হয়ে গেলো গাড়ির দরজা – শেষ হয়ে গেলো এই ডোম পৃথিবীর সাথে সব সম্পর্ক – রওয়ানা হলেন ওদের শেষ যাত্রায়। গাড়ির ভেতরে মৃদু আলো - সেতারে বাজছে বেহাগ – এক ধারে পাতা ধব ধবে সুন্দর বিছানা – তার পাশে সোফা সেট আর টেবিলে সাজানো ওদের পছন্দের নানা ফল, খাবার ও পানীয়। সোফায় বসে সেই প্রিয় পানীয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে দিতে শুরু হলো ওদের ছেলে বেলার গল্প, কত মিষ্টি ঘটনা, স্যাংপোর জন্ম, ওর ছোটবেলার দুরন্তপনা, এ রকম ওদের জীবনের আরো কত ঘটনার গল্প। চোখের পাতা ঘুমে ভারি হয়ে এলে চলে এলেন সেই নরম তুল তুলে বিছানায় – সেখানে কিঞ্জল ও শিমরন ঘুমিয়ে পড়লেন চিরকালের মত। ধীরে ধীরে বিছানা নিচু হয়ে ওদের নামিয়ে দিলো একটা ট্রলিতে যেটা ওদের নিয়ে এলো এক বিরাট রকেটের অনেক ছোট ছোট কুঠরির মধ্যে একটাতে। রকেটের সমস্ত কুঠরি ভরে গেলে সেটা বিদায়ী শহরবাসীদের নিয়ে উড়ে যাবে সূর্যের দিকে।
অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক
খুব শক্ত অসুখ হয়েছিলো তুতুলের। সবে তিন দিন হলো হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। এই ক’দিন এক ছায়া ছায়া ঘুমের দেশে বেড়িয়ে এলো সে। হাতে-পিঠে ছুঁচ, রক্তের বোতল, মুখোশ পরা কারা যেন সব – সমস্ত কিছু ভারী চোখের পাতায় ধোঁয়ার মতো মনে হতো। মা’র জন্য বুক ঠেলে একটা কান্না বেরিয়ে আসতে চাইতো।
অসুখের নামটাও জেনে ফেলেছে সে – লিউকেমিয়া। তুতুল ঘুমিয়েছে ভেবে বাবা আর ডাক্তারবাবু ফিসফিস করে কথাবার্তা বলছিলেন। রেমিশন হয়েছে, পঁচিশ পার্সেন্ট চান্স এইসব শক্ত শক্ত কথা। হুঁ, না হয় তুতুলের মোটে পাঁচ বছর বয়েস হয়েছে, তা বলে কি তাকে ইংরেজী বলে ঠকানো যায়! তুতুল ঠিক বুঝেছে, সে মরে যাবে। তবে এখন নয়, অনেক দিন পর। থুত্থুড়ে বুড়োই হয়তো হয়ে যাবে তদ্দিনে। যাকগে, যা হবেই সে নিয়ে আর ভেবে লাভ কী! তুতুল তাই খাটে বসে জানালা দিয়ে শালিক পাখির ঝগড়া দেখতে থাকে।
“ওকে সব সময় খুশিতে রাখবেন”, বলছিলেন ডাক্তার কাকু। মজা লাগে তুতুলের। এই ঘরে বসে দুপুর বেলা এদিক-ওদিক তাকালে মন তো আপ্সেই খুশিতে ভরে ওঠে! কিছু দূরে প্রবীরদের সাদা ধুমসো বেড়ালটা চোখ বুঁজে তপস্বীর মতো বসে আছে, একটা কাক তার ল্যাজ ধরে দিলো অ্যায়সা টান। একটা বাচ্চা মোষ চার পা তুলে ধুলো উড়িয়ে ছুটে পালাচ্ছে – কই, কেউ তো তাড়া দেয়নি! ঘরের দেয়ালের টিকটিকিটা পুঁচকে পোকাটাকে ধরতে লাফ মেরেই মেঝেতে ধপাস্। মরে গেলো নাতো? একটা কাগজের গুলি পাকিয়ে ছুঁড়ে মারে তুতুল, টিকটিকি অমনি খাটের তলায় সড়াৎ।
অনেক নতুন ছবির বই এসেছে তুতুলের জন্য। ভারী মজার মজার সব ছবি। গল্পও নিশ্চয়ই মজার। কিন্তু কালো কালো অক্ষরগুলো চোখের সামনে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে যায়। আসল ব্যাপারটা শুরু হবার আগেই চোখ ঘুমে ভেঙে আসে। এবার নকশা কাটা জার্মান সিলভারের গ্লাসটার গায়ে চোখ রাখে তুতুল। একটা দারুণ সুন্দর ট্রেন দাঁড়িয়ে। প্ল্যাটফর্মে কেউ নেই, খালি ফুলের বাগান। ট্রেনের জানালায় আলখাল্লা পরা ওটা কি সেই গল্পের চিনা বুড়োটা, নাকি তার বন্ধু সৌরভ? ঠিক আছে, আজকের মতো অনেক হলো – কাল বাকিটা দেখা যাবে।
মা ঘরে ঢোকেন। চোখ ফোলা ফোলা, মুখে কান্নার গন্ধ। “মা গো, তুমি কাঁদছো কেন? সোনালীর অসুখ করেছে বুঝি?” অবাক তুতুল প্রশ্ন করে। সোনালী ওর ছোট বোন, মাসীমণির মেয়ে।
ঠোঁট কামড়ান মা। “কই সোনা, কাঁদিনি তো, কিচ্ছু হয়নি তো!” তিনি তুতুলকে বুকের কাছে টেনে আনেন। লজ্জা পায় তুতুল। আবদারের সুরে বলে, “একটা গল্প বলো না, মা।”
“গল্প? বেশ – কিন্তু ঘুমোবে তাহলে?”
“সত্যি বলছি মা, তোমার পাশে শুয়ে ঘুমোব।” তুতুল আলগোছে মা’র আঁচল চেপে ধরে।
“এক দেশে এক রাজা ছিলো। সে ছিলো ভীষণ দুষ্টু –”
“মা, রাজারা খালি দুষ্টুই হয়, তাই না? আমার বন্ধু রাজা কিন্তু একটুও দুষ্টুমি করে না।” বাধা দিয়ে বলে তুতুল।
“তাই বুঝি? তা, এই রাজাটার দুষ্টুমিতে কিন্তু দেশের লোকের প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। কেউ হয়তো ইয়া বড়ো এক কুমড়ো ফলিয়েছে, রাজা অমনি এসে হাজির। ‘দিস্ তো পাঠিয়ে – রানি কুমড়োর ছক্কা বানিয়ে দেবে, খাবো’, বলে হুকুম ঝেড়ে চলে যেতো। কুমোর মাটির গামলা বানিয়েছে, ‘আরে, আমার গরুকে খাওয়াতে লাগবে’, বলে ট্যাঁকে করে হাওয়া। কারো গাছে হয়তো কলা ধরেছে, ‘ইস, হাতি বেচারা আমার না খেয়ে মরছে’, বলে নিমেষে ঝাড়কে ঝাড় সাফ!
“তবু মানুষ কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাচ্ছিলো। কিন্তু সেবার হলো ভীষণ জলের কষ্ট। প্রচণ্ড গরমে নদী-নালা শুকিয়ে গেলো। তেষ্টায় মানুষের বুকের ছাতি ফাটতে লাগলো। সবাই তখন দল বেঁধে রাজার কাছে গেলো।
“মহারাজ, তেষ্টায় যে মরে গেলাম!” কেঁদেকেটে বলে তারা।
“রাজা এর মধ্যেই পুকুর, কুয়োর যা জল ছিলো তুলে এনে জমিয়েছে প্রাসাদের সব বিরাট বিরাট স্ফটিকের চৌবাচ্চায়। তাই সে চোখ ঘুরিয়ে বললো, ‘যা যা, জল নেই তো আমি কী করবো?’
“মহারাজ, কয়েকটি গভীর দীঘি কাটান – তবে জলকষ্ট ঘুচবে”, বলে এক বুড়ো প্রজা।
“ফুঃ, দীঘি কাটাবে! আমার সোনার পিকদানিটা ভেঙে গেছে, তাই সারাবার পয়সাই জুটছে না, আর ওনাদের যতসব উটকো আবদার!” রেগেমেগে বলে রাজা।
“সুজন নামে এক চাষীর ছেলে ছিলো। সে তখন এগিয়ে এসে বললো, ‘বেশ মহারাজ, তাহলে আমরা নিজেরাই শাবল, কুড়ুল, কোদাল যা পাই তাই দিয়ে দীঘি খুঁড়বো।’
“মুখের ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে রাজার মেজাজ গেলো গরম হয়ে। ‘যা, তাহলে মর গে!’ বলে সে গটমটিয়ে উঠে চলে গেলো।
“লোকজন সবাই কিন্তু সত্যি সত্যিই হৈ-হৈ করে কাজে নেমে পড়লো। কয়েক দিনের মধ্যেই তারা খুঁড়ে ফেললো এক বিরাট দীঘি, তাতে ভরা টলটলে নীল জল।
“সবার মুখে খুশির হাসি। কিন্তু দেখতে না দেখতে তা মিলিয়ে গেলো – যখন লোকলস্কর নিয়ে রাজা এসে সেখানে হাজির হলো।
“অ্যাই ভাগ, ভাগ! আমি রাজা, এই জল আমার।” বলে সব্বাইকে হঠিয়ে দিলো সে। হাতি নামিয়ে দিলো জলে। তীরে বসালো পাহারা। মুখ চূণ করে ফিরে গেলো প্রজারা।
“কাণ্ড দেখে মাটির ভীষণ রাগ হলো। রাজার দুষ্টুমির সাজা দেবার জন্য সে রাতারাতি দীঘির সব জল লুকিয়ে ফেললো। পরদিন সকালে রাজা এসে দেখে – ও মা, সব যে আবার শুকিয়ে খটখট! অনেক তর্জন-গর্জন করলো সে, কিন্তু করেই বা কী ফল!
“দেশের লোক ওদিকে তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ। কত ছোট্ট সোনা ঠোঁট চাটতে লাগলো, কত দাদু-ঠাকুমা মরেই গেলো – তবু না হলো একছিটে বৃষ্টি, না পেলো কেউ একফোঁটা জল।”
তুতুলের চোখ ছলছল। তাই দেখে মা গল্পের গতি বাড়িয়ে দেন,
“এমন সময় একদিন এক বুড়ো এলো সেই দেশে। লাঠিতে ভর দিয়ে চলছে, শনের নুড়ির মতো চুল ফুরফুর করে হাওয়ায় উড়ছে।
“আমায় কিছু খেতে দেবে গো?” এক চাষীর দোরে এসে হাঁক পাড়ে সে।
“খেতে হয়তো কষ্টেছিষ্টে দিতে পারি, কিন্তু জল মিলবে না।” কান্না-কান্না মুখ করে বলে চাষী।
“ও, তাই বুঝি!” গম্ভীর চালে মাথা নাড়ে বুড়ো। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে তার গায়ে একটু জোর ফিরে এলো। তখন সে ধীরে ধীরে বললো, “শুনেছি, জীয়ন ঝর্ণার জল আছে রামধনুর দেশে। আকাশের ঐ পারে যেখানে রামধনুটা মাটিতে গিয়ে মেশে, সেখানে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ছে এক মিষ্টি জলের ঝর্ণা। সেই জল এক বোতল যদি কেউ নিয়ে আসতে পারে, তবে তা ছিটিয়ে দিলে মরা মানুষ সব আবার বেঁচে উঠবে, শুকনো খাল-বিলও ভরে উঠবে জলে।
“তবে এ কাজে ঝামেলাও যে নেই, বলবো না। এক বিরাট দৈত্য আছে নাকি সে দেশে। সারা দিনরাত সে ঝর্ণা পাহারা দেয়। তার ভয়ে কেউ ওমুখো হয় না।”
“মা, রাজকন্যার গল্প নয় কিন্তু! ওসব সোনালীর মতো বাচ্চারা শোনে।” তুতুল বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গীতে বলে।
মায়ের মুখ এক সুন্দর হাসিতে ভরে যায়। “ও, তাই নাকি – বুঝতেই পারিনি আমাদের তুতুলবাবু কত বড় হয়ে গেছে!” বলে তিনি আবার শুরু করেন,
“তাই শুনে এগিয়ে আসে চাষীর ছেলে সুজন। টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলে, ‘দাদু, কেউ না যায় আমি যাবো সেই জল আনতে। তুমি শুধু বলে দাও সেখানে যেতে হলে কী কী করতে হবে।’
“বুড়োর মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সুজনের পিঠ চাপড়ে বলে, ‘তোমার মতো সাহসী ছেলেই পারবে সে জল আনতে। তবে কয়েকটা কথা মনে রাখবে।
‘প্রথম কথা – দৈত্যকে মারতে তলোয়ার চাই। আজই কামারভাইকে দিয়ে বানিয়ে নাও এক ধারালো তলোয়ার।
‘দ্বিতীয় কথা – যখন পথ চলবে, চোখকান খোলা রাখবে। অসহায় জীবের প্রতি দয়াধর্ম করবে।
‘আর শেষ কথা – এই জীয়ন ঝর্ণার জল অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে, মরা মানুষকে প্রাণ দেয়। কিন্তু হুঁশিয়ার – কোনো মানুষ যদি দুষ্টু হয়, লোক ঠকিয়ে খায়, তবে এই জল তার গায়ে ছিটিয়ে দিলে সে উলটে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।’
“মা, আমি আর চিনি চুরি করে খাবো না।” তুতুল মা’কে আঁকড়ে ধরে।
“ওমা, তুতুল তো আমার লক্ষ্মী সোনা – সে আবার দুষ্টু হলো কবে!” তুতুলকে একটা চুমো দিয়ে মা আবার গল্প শুরু করলেন,
“তারপর বুড়ো তো লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে চলে গেলো। আর কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে সুজন তৈরি হলো রামধনুর দেশে যাবার জন্যে।
“রাজার চর কিন্তু খবরটা রাজার কানে তুলে দিলো। আর যায় কোথায় – সেপাই এসে সুজনকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেলো রাজার কাছে।
“কিরে, আমায় না জানিয়ে পালাচ্ছিস যে বড়ো?” রাজা তর্জন করে। কী আর বলবে, সুজন চুপ করেই থাকে।
“যাক, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আসার সময় আমার জন্য সেখান থেকে সোনার ফুল, হীরের পাখি আর মণি-মানিকের গাছ নিয়ে আসবি। নইলে তোর ঘাড়ে মাথা থাকবে না।”
“রাজার কথা শুনে সুজন কাঁচুমাচু মুখে ঘাড় নাড়ে। তারপর গুটিগুটি পায়ে ফিরে আসে।
“কিন্তু রামধনুর দেশের রাস্তা খুঁজে পাওয়া কি সোজা কথা! এক বছরের ওপর বৃষ্টি হয় না, লোকে শেষ কবে রামধনু দেখেছে তাও ভুলে গেছে। তবু ভেবেচিন্তে একটা দিক ঠিক করে এগোয় সুজন। চলতে চলতে নাহয় একে-ওকে জিজ্ঞেস করে পথ চিনে নেওয়া যাবে।
“চলেছে তো চলেছে, হঠাৎ এক জায়গায় দেখে মহা শোরগোল। ‘আমাকে বাঁচাও’ বলে একটা বাঁদর ছুটে এসে সুজনের পায়ে পড়ে। পেছনে লাঠি নিয়ে ধেয়ে আসছে একদল লোক।
“আমাদের ফলের বাগান আস্ত রাখে না, আজ মেরেই ফেলবো ওকে”, বলে তারা।
“কী করবো, খিদে পায় যে!” কিচ কিচ করে বলে বাঁদর।
“আচ্ছা, ও আর বাগান নষ্ট করবে না। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি”, বলে সুজন। বেশ তো – রাজি হয় সবাই।
“প্রাণ বাঁচিয়ে তুমি আমার প্রাণের বন্ধু হলে। কোথায় চলেছো, ভাই?” জিজ্ঞেস করে বাঁদর।
“চলেছি রামধনুর দেশে, জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে। চেনো নাকি রাস্তা?”
“ও বাবা, সেখানে তো বিরাট দৈত্য থাকে। তা, কিছুদূর অবধি চিনি। আর বন্ধু যখন বলেছি তখন চিনিয়ে নিয়েও যাবো”, বলে বাঁদর।
আবার চলেছে, চলেছে, এবার বাঁদরও আর রাস্তা চিনতে পারছে না। এমন সময় শোনে ঝোপের পাশে মিঁউ মিঁউ কান্না। ভালো করে খুঁজেপেতে দেখে, এক থলের মধ্যে বাঁধা এক সুন্দর সাদা বেড়াল।
“তেষ্টায় দুধ চুরি করে খেয়েছিলাম দেখে আমাকে এভাবে ফেলে রেখে গেছে”, কাঁদতে কাঁদতে বলে বেড়াল।
“ইস, বেচারা! এক্কেবারে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে!” থলের বাঁধন খুলতে খুলতে বলে সুজন।
“প্রাণ বাঁচিয়ে আমার প্রাণের বন্ধু হলে। কিন্তু চলেছো কোথায়?” জিজ্ঞেস করে বেড়াল।
“চলেছি রামধনুর দেশে, জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে। চেনো নাকি রাস্তা?”
“বাপ রে, দৈত্যের দেশে! তা, বন্ধু বলে যখন ডেকেছি – চলো, যদ্দুর চিনি দেখিয়ে দিই।”
“চলছে তো চলছেই তিন বন্ধু। কত বনবাদার, মাঠঘাট পেরিয়ে গেলো। এবার বেড়ালও আর পথ চেনে না। এমন সময় সামনে পড়লো ছোট্ট মিষ্টি জলের এক খাল। চকচক করে জল খেলো সবাই। খিদে-তেষ্টা দুই-ই যেন তখনকার মতো দূর হলো।
“বাঁচাও, বাঁচাও!” চিঁ-চিঁ করে চ্যাঁচায় কে? দেখাই তো যায় না! ও মা, স্রোতে ভেসে যাচ্ছে এক মৌমাছি। দৌড়ে গিয়ে একটা গাছের পাতা এনে ধরে সুজন, তাই আঁকড়ে কোনমতে উঠে আসে মৌমাছি।
“প্রাণ বাঁচিয়ে প্রাণের বন্ধু হলে। কিন্তু কে গো তুমি? চলেছো কোথায়?” বলে মৌমাছি।
“তিন বন্ধু চলেছি রামধনুর দেশে, জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে। চেনো নাকি রাস্তা?”
“ওমা, চিনবো না! রামধনুর দেশেই তো আমার বাড়ি। দুষ্টুমি করে বাবা-মা’র কথা না শুনে অ্যাদ্দুর উড়ে এসেছিলাম, তারপর দম ফুরিয়ে এই অবস্থা। কিন্তু বুকের পাটা আছে তো তোমাদের! দৈত্যের কাছ থেকে চলেছো জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে?”
“আনতে না পারি, প্রাণ তো দিতে পারবো”, বলে সুজন। তিন বন্ধু চলতে থাকে, আর তাদের মাথার ওপর উড়ে উড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে মৌমাছি বন্ধু।
“কত পাহাড় পেরিয়ে, নদী-নালা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলে তারা। চলে, চলে, চলে, পথ আর ফুরোয় না। শেষ পর্যন্ত একদিন এক ঘন জঙ্গল ভেঙে বেরিয়ে এসে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
“এক ঝলমলে আলোর দেশ তাদের সামনে। আকাশ সুন্দর সাতটা রঙে উজ্জ্বল হয়ে আছে। দূরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আনন্দে খেলা করে বেড়াচ্ছে। আর কী সব অপূর্ব পাতাবাহারী গাছে, রঙবাহারী ফুলে ভরে আছে চারদিক – কোথায় লাগে তার কাছে সোনা, হীরে, মানিকের ছটা! এক মিষ্টি গানের সুরে ভরে উঠছে বাতাস। দূরে দেখা যায় এক বিরাট পাহাড়, সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে তার গা। আর সেখান থেকে ঝির ঝির ঝরে পড়ছে এক ঝর্ণা – জীয়ন ঝর্ণা!
“সবাই সেদিকে চেয়ে আছে, কারো মুখে কথা জোগায় না। শেষ অবধি সুজনই বলে, ‘তাহলে মৌমাছি বন্ধু, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বাঁদর আর বেড়াল বন্ধু, তোমরা এখানে একটু বসো। আমি যাচ্ছি ঝর্ণার দিকে। যদি আর না ফিরি, আমার জন্যে দুঃখ করো না। পারো তো গাঁয়ে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিও – সুজন শেষ অবধি জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে পারেনি বটে, কিন্তু চেষ্টার কসুর করেনি।
“কী আর করে, চোখের জল ফেলে সবাই সুজনকে বিদায় জানায়। ‘বিপদ হলে মনে মনে আমায় ডেকো’, বলে বাড়ির দিকে উড়ে যায় মৌমাছি।
“বুকভরা সাহস নিয়ে এগিয়ে চলে সুজন। গাছের পাতারা বলে, আমাদের ধরো। ছোট শিশুরা বলে, আমাদের কোলে নাও। রঙীন আকাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে – ওগো, দু’দণ্ড থেমে আমাদের গান শুনে যাও। কিন্তু কোনোদিকে না তাকিয়ে সুজন সটান এগিয়ে চলে জীয়ন ঝর্ণার দিকে।
“ও মা – কোথায় রঙ, কোথায় শিশু, কোথায় গান – সব মুহূর্তে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেলো। তালগাছের মত বড় এক দৈত্য যেন আকাশ ফুঁড়ে এসে হাজির। সুজনকে দেখে তার ভাটার মত চোখ রাগে ঘুরতে থাকে।
“দুধের বাচ্চা, সাধ করে মরণের মুখে পা বাড়িয়েছিস। ভালোয় ভালোয় প্রাণটা নিয়ে এখনো ফিরে যা”, বাজের মত হেঁকে বলে দৈত্য।
“হয় জল নেবো, নয় প্রাণ দেবো।” তলোয়ার খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সুজন। ঝড়ের বেগে এসে দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর।
“বীরের মত লড়ে সুজন – কিন্তু ঐ ধুমসো দৈত্যের সঙ্গে পারবে কেন! কিছুক্ষণের মধ্যেই দৈত্য তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে রেখে হাসতে হাসতে চলে যায়।”
তুতুলের ঠোঁট কাঁপে, গলার শুকনো ডেলাটা আর ভেতরে থাকতে চায় না। কিন্তু অ্যাদ্দিনে কি আর ওর মা’কে চিনতে বাকি আছে! তাই চুপচাপ আবার শুনতে থাকে –
“সারারাত ধরে সেখানে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে দুই বন্ধু বাঁদর আর বেড়াল। তারপর একসময় ভোর হয়। লাল টুকটুকে সুয্যিমামা যাবার পথে এই দৃশ্য দেখে থমকে থেমে যান। তাঁর মন কেঁদে ওঠে। কী করেন, কী করেন – শেষে এক ফুঁয়ে জীয়ন ঝর্ণার খানিকটা জল আকাশে উড়িয়ে দিয়ে মেঘ করলেন। একটু পর ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে সেই মেঘ জল ঢাললো সুজনের গায়ে।
“ঊঃ, বড্ড ঘুমিয়েছি!” আড়মোড়া ভেঙে উঠে বলে সুজন। জলের ছোঁয়ায় তার শরীর আগের চেয়ে বড় হয়েছে, শক্তিও হয়েছে আগের চেয়ে বেশি।
“হ্যাঁ, দিব্যি ঘুম মেরেছো, বন্ধু!” মুখ টিপে হাসে বাঁদর-বেড়াল, খুলে আর কিছু বলে না।
“খবর পেয়ে আবার ধেয়ে আসে দৈত্য। দাঁত কড়মড় করতে করতে বলে, “মানুষের বাচ্চা, এবার দেখি তুই কী করে বেঁচে উঠিস।” সে যা ভয়ানক লড়াই হয়! দৈত্যের একটা হাতও কাটা যায়। কিন্তু হলে হবে কী, দৈত্য আবার সুজনকে মেরে ফ্যালে। তারপর সে সুজনের শরীরটা ভালো করে মাটিতে পুঁতে রেখে জীয়ন ঝর্ণার দিকে এগোয়। সেখানে গিয়ে ঝর্ণার খানিকটা জল লাগিয়ে কাটা হাত আবার জুড়ে নেয়।”
“আচ্ছা মা, দৈত্য তো দুষ্টু। তবে জীয়ন ঝর্ণার জল লেগে ছাই হয়ে গেলো না কেন?” – তুতুলকে ফাঁকি দেওয়া কি অত সোজা!
এই রে! অলক্ষ্যে জিভ কাটেন মা। তারপর ভেবেচিন্তে বলেন, “দৈত্য কি মানুষ? দুষ্টু মানুষ তো ছাই হয়ে যাবে, তাই বললো না বুড়ো?”
“বুঝতে পেরেছি, এবার বলো তারপর কী হলো।” তুতুল আবার গুটিসুটি মেরে বসে।
“কী হবে, কী হবে – দুই বন্ধুর তো মাথায় হাত! কাল সকালে এসে সুয্যিমামা যে সুজনকে খুঁজে পাবেন না! কী করে তাকে বাঁচাবেন তবে?
“দাঁড়াও, আমি দেখি চেষ্টা করে।” বলে বেড়াল। তারপর সে নখ দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। খুঁড়ছে তো খুঁড়ছেই, মাটি তুলছে তো তুলছেই, শরীর আর চলে না! ভোর প্রায় হয়ে আসে। এমন সময় শেষ অবধি তার নখে ঠেকে সুজনের শরীর। চটপট আঁচড়ে-পাঁচড়ে তার ওপরের মাটিটুকু সরিয়ে দেহটা খোলা জায়গায় টেনে আনে দুই বন্ধু।
“সকালবেলা সুয্যিমামা আবার বাঁচিয়ে দিলেন সুজনকে। আরো বড় হয়ে গেলো সুজন, গায়ে হলো আরো জোর। আবার ধেয়ে এলো দত্যি।
“আরো জোরদার লড়াই হলো এবার। দৈত্যের একটা পা গেলো উড়ে। কিন্তু এবারও শেষ অবধি তারই হলো জয়। সুজনকে মেরে ফেলে সে এবার দেহটা একটা কাপড়ের পুঁটলিতে পাকিয়ে রেখে দিয়ে এলো এক্কেবারে উঁচু সেই পাহাড়ের মাথায়, গাছপালার আড়ালে। “দেখি এবার শেয়ালে-কুকুরে কী করে তোর দেহ খুঁড়ে তোলে!” হা-হা করে হেসে বলে দৈত্য। তারপর ঝর্ণার জলে পা-টা জুড়ে আবার ঠিক আগের মতন।
“রাত্তির হতেই বাঁদর হুপহাপ গাছে গাছে লাফিয়ে চলে। পাহাড়ের মাথা – সে কি এখানে! তবু হাল ছাড়ে না বাঁদর। শেষ অবধি সুয্যিমামা যখন উঠি-উঠি করছেন, সে খুঁজে পেলো সুজনের শরীর। পুঁটলি খুলে দেহটা বের করে ফেলে রাখলো খোলামেলা জায়গায়।
“এবার বেঁচে উঠে আরো বড় হয়েছে সুজন। আবার আসে দৈত্য। সে যা একখান লড়াই হয়, সবার অনেকদিন মনে থাকবে। এবারেও জেতে দৈত্য। তবে সে টলছে, ভালো করে চলতে পারছে না। তার সারা শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে।
“দেখি, এবার কোন পশু-পাখি তোকে বাঁচায়!” বলে সে ঝর্ণার পাশে নিয়ে যায় সুজনের শরীরটা। তারপর তাকে আড়াল করে নিজে সটান শুয়ে পড়ে।
“বাঁদর-বেড়ালের তো মাথায় হাত! ঐ পাহাড়ের মত দেহের আড়ালে কী করে সুয্যিমামার চোখ পৌঁছোবে! তাহলে কি আর সুজন বাঁচবে না? চোখের জলে ভাসে তারা। শেষে কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে আকূল হয়ে মৌমাছি বন্ধুকে স্মরণ করে।
“এসে গেছি, বন্ধু!” গুনগুন করতে করতে ছুটে আসে মৌমাছি। বেড়াল, বাঁদর সব খুলে বলে তাকে। “হুঁ, এই ব্যাপার! দাঁড়াও, পাজি দৈত্যের জারিজুরি বন্ধ করছি”, বলে উড়ে ফিরে যায় মৌমাছি।
“ভোর হবো হবো করছে। মজাসে ঘুমোচ্ছে দৈত্য। এমন সময় লাখ লাখ মৌমাছির এক ঝাঁক তাকে আক্রমণ করে। কামড়ের পর কামড়, কামড়ের পর কামড় – হুলের জ্বালায় দৈত্য অস্থির হয়ে ওঠে। শেষ অবধি আর থাকতে না পেরে উঠে জঙ্গলের দিকে দৌড় লাগায়।
“সুয্যিমামা তখন উঠে পড়েছেন। তাঁকে দেখে আনন্দে নাচতে থাকে জীয়ন ঝর্ণা। আর তার একটা বড়সড় জলের ঝাপটা এসে আবার সুজনকে জাগিয়ে তোলে। বাড়তে বাড়তে এতদিনে দৈত্যের প্রায় সমান হয়ে উঠেছে সুজন। শক্ত হাতে তলোয়ার ধরে এবার সে শেষ লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়।
“দৈত্য আসে। তারপর চলে সেই লড়াই যা আগে কেউ কখনো দেখেনি, পরেও কখনো দেখবে না। তিনদিন, তিনরাত সমানে যুদ্ধ চলে। দেখেশুনে সুয্যিমামাও যেন পূব আকাশে উঁকি মারতে ভয় পান। তারপর একসময় সুজনের তলোয়ারের কোপে দৈত্যের মাথাটা ছিটকে যায়।
“বনজঙ্গল ভেঙে হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দৈত্যের পেল্লায় লাশ। তারপর আর কী? নিশ্চিন্তে ঝর্ণার জল ভরে নেয় সুজন। হঠাৎ দেখে, আলোয় আলো হয়ে উঠেছে চারদিক। আবাক হয়ে সবাই ওপরে তাকায় – দেখে, আকাশ জুড়ে আবার দেখা দিয়েছে এক সাতরঙা রামধনু।
“গাঁয়ে ফিরে চলে সুজন। ‘চলো, তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’ সাথে সাথে চলে তিন বন্ধু।
“খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে আসে রাজা। ‘দাঁড়াও, একটু মজা করা যাক’, বুদ্ধি-পরামর্শ করে তিন বন্ধু। তারপর মৌমাছি সাজে সোনার ফুল, বেড়াল হীরের পাখি আর বাঁদর মণি-মানিকের গাছ।
“কী রে, এনেছিস আমার জিনিস – আরে, ঐ তো!” লোভে রাজার চোখ জ্বলে ওঠে। সব কিছু ভুলে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। আর তখন সুজন তার গায়ে ছিটিয়ে দেয় জীয়ন ঝর্ণার জল। মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যায় দুষ্টু রাজা।
“তারপর আর কী! সারা রাজ্যে নদী-নালা-পুকুর-মাঠে জীয়ন ঝর্ণার জল ছিটিয়ে দেয় সুজন। বেঁচে ওঠে শুকিয়ে মরে যাওয়া যত মানুষ। আর তারপর আকাশ কাঁপিয়ে নামে তুমুল বৃষ্টি। নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর সব জলে থৈ-থৈ করতে থাকে। সবুজ সবুজ গাছপালায় চারদিক ছেয়ে যায়। ধানে মাঠ ভরে ওঠে।”
বড় আনন্দ! এতক্ষণের চেপে রাখা কষ্টটা এবার একটু একটু করে গলে বেরিয়ে আসে। দু’চোখ ঝাপসা হয়ে যায় তুতুলের। ভেজা চোখের পাতায় সে দূর আকাশের রামধনু দেখে।
“মা, বড় হয়ে আমি জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে যাবো।” ফিসফিসিয়ে বলে তুতুল।
“যেও, সোনা।” হঠাৎ বালিশে মুখ লুকিয়ে ফ্যালেন মা। তুতুল তাঁর কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে মায়ের চুল থেকে। জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় তুতুল। স্বপ্নে এক টুকরো ছোট্ট হাসি তার মুখে লেগে থাকে।
অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র
১
ঘড়ির দিকে আরেকবার তাকালাম। প্রায় সাড়ে সাতটা। ইতিহাসটা নিয়ে বসেছি বটে, কিন্তু চোখদুটো খুব বেশিক্ষন বইয়ের পাতার দিকে থাকছে না। অন্যান্য দিন ইতিহাস পড়তে বসলে এই সময়ে রানা প্রতাপের চৈতক লাফ দিয়ে পেরিয়ে যায় দুই পাহাড়ের মধ্যের গভীর খাদ বা পৃত্থীরাজের ঘোড়া টগবগিয়ে পিছনে ফেলে দেয় পিছু নিয়ে আসা সৈন্যের দল নাহলে কখনো কখনো দুই দলে লেগে যায় প্রচন্ড লড়াই। যাদের কথা বইতে পড়ি, তাদের সব্বাইকে যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে গল্পের মত। আজকে শিবাজীর গল্প পড়ছিলাম। কি দারুনভাবে শিবাজী পালিয়ে যাবেন ফুলের টুকরিতে লুকিয়ে। কিন্তু সেই দৃশ্যটা সিনেমার মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে না। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে পড়ায় মন নেই। আজকে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যে আমি আর টুবলু দুজনেই বেশ কিছুটা চমকে গেছি। এমনিতে কোন ব্যাপারেই আমাদের জুড়ি মেলা ভার। আমরা খেলাধুলোয় চ্যাম্পিয়ন, কোন কিছুতে ভয়ও পাই না, পড়াশুনোয় যে একেবারে ধ্যাদ্ধেড়ে এমনও নয় কিন্তু তা সত্তেও এমন একটা ঘটনাবে যে আমরা এক্কেবারে চুপসে যাব, তা কক্ষনও ভাবিনি। চোখ বারবার চলে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটার দিকে। আটটা কতক্ষনে বাজবে কে জানে?
এই সবের মূলে আছে বিন্তি, আমার পিসতুতো বোন। আমাদের চেয়ে এক ক্লাস নিচুতে পড়ে। ওকে দেখতে খুদে এইটুকুন হলে কি হবে, ওর চোখেমুখে কথার খই ফোটে। প্রতিবারই পিসিরা যখন ছুটিতে আমাদের বাড়ি আসে, তখন কিছু না কিছু করে আমাকে চমকে দেয়। এবারে আমি আর পিন্টু দুজনেই ঠিক করে রেখেছিলাম, যে বিন্তি যাই করুক না কেন, ওকে আমাদের টেক্কা দিতে দেওয়া চলবে না। সে গুড়ে বালি। আজকে বিকেলে খেলে যথারীতি নোংরা হয়ে ঘামে ভিজে আমরা বাড়ি ফিরছি, এমন সময় দেখি ও একটা অদ্ভূত চশমা পরে আমাদের বাগানে ঘুরছে - তাও আবার একা একা। অদ্ভূত বললাম এই কারনে, যে চশমাটা ওর চোখের তুলনায় বেশ বড় আর ওর তো চোখ খারাপ নয় যে চশমা পড়বে।
আমার বা টুবলুর কারোরই চশমা নেই। তাই একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে, তুই অত্তবড় একটা চশমা নাকের ওপর চড়িয়েছিস কেন?”
এমনিতে বিন্তি খুব ছটফটে, হাসিখুশি। কিন্তু আজ সে মুখ গম্ভীর করে বলল, “তোরা বুঝবি না।”
বুঝব না? এই কথা শুনলে কার না রাগ হয়। আমি চোখের ঈশারায় একবার টুবলুর সাথে কথা বলে নিলাম। তারপর কোন রকমে রাগ চেপে বললাম - “বুঝব না মানে? তুই আমার ছোটবোন হয়ে বুঝবি আর আমরা বুঝব না?”
-“না, মানে বুঝতে না পারলে আমায় বলতে আসিস না। এ অনেক জটিল ব্যাপার।”
-“তা শুনি কিরকম জটিল ব্যাপার?”
-“এ যে সে চশমা নয়। এটা স্পেকট্রোস্কোপ”
একটু থমকে গেলাম। স্টেথিস্কোপ, টেলিস্কোপ, পেরিস্কোপ শুনেছি। স্পেকট্রোস্কোপটা আবার কি? আমি আর টুবলু আবার চোখাচোখি করলাম। ও ও জানে না। কিন্তু একটু কটমট করে তাকালো, যার মানে হচ্ছে এত সহজে ব্যাপারটা মেনে নিলে চলবে না।
একটু ঢোক গিলে বললাম, “স্পেকট্রোস্কোপ আবার কি?”
-“সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াবি তো আর জানবি কি করে। এটা একটা যন্ত্র। এটা দিয়ে ভূত দেখা যায়”
টুবলু এতক্ষন চুপ করে ছিল। এবার একটু গাঁইগুই করে বললে, “ভূত বলে কিছু নেই।”
-“আচ্ছা, তাই নাকি? কে বলেছে যে ভূত নেই?”
টুবলু বলল, “বেশ তো, আছেই যদি তবে দে দেখি তোর চশমাটা, আমরাও দেখি।”
-“প্রথম কথা এটা চশমা নয় একটা যন্ত্র। আর দ্বিতীয়তঃ তোদের চিল্লামিল্লিতে ভূত পালিয়ে গেছে।”
-“বাহ, তাহলে প্রমান হবে কি করে?”
-“প্রমান হবে। আজ রাত আটটায়।”
ঠিক কি করে প্রমান হবে জানতে চাইছিলাম, তার আগেই বিন্তি আর কিছু না বলে একছুটে বাড়ির মধ্যে পালাল।
টুবলু খানিক দাঁড়িয়ে, মাথা চুলকে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দেওয়ার আগে আমার দিকে ভ্যাবলার মত চাইল। এমনিতে আমাদের দুজনের মধ্যে ও-ই একটু বেশি ওয়াকিবহাল সব বিষয়ে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি যে এবারে বেড়াতে এসেও বিন্তি বেশ একচোট নিয়ে গেল দেখে ও মনে মনে একটু দমে গেছে। আর কিছু না বলেই টুবলুও নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল। ভাবখানা এই যে - “আমি তো আর রাত আটটার সময় এইখানে থাকতে পারব না। তুই কিন্তু চোখ কান খোলা রাখিস।” কিন্তু আমি তো আর সর্বজ্ঞ নই। এমনিতেই টুবলু পাশে না থাকলে আমার সাহস কমে আসে। এখানে অবশ্য সাহসের প্রশ্ন না। চোখা কান খোলা রাখতে হবে আর কি।
২
বাড়ি ঢুকে যথারীতি মার কাছে রোজকার বরাদ্দ একটু বকুনি খেয়ে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসেছি। পিসিরা এসেছে বলে যে আমার পড়ার ছুটি তা নয়। মা’র কড়া শাসন - অন্ততঃ দুঘন্টা পড়তেই হবে, নইলে কপালে দুঃখ আছে। আগে যে কয়েকবার সে দুঃখ আমায় পেতে হয়েছে তা ভুলিনি। পিঠটা বেশ চড়চড় করে উঠেছিল। এখন পিসিরা এসেছে। এর মধ্যে বিন্তি যদি শোনে আমি মার খেয়েছি না পড়ার জন্য তাহলে যেটুকু প্রেস্টিজ আছে তার আর ছিঁটেফোটাও বাকী থাকবে না। কাজেই রোজকার মত টেবিল চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছি আর ভাবছি কি করে সময়টা কাটানো যায়। পড়ার জন্য বরাদ্দ এই দুঘন্টা শেষ হবে সাড়ে সেই আটটায়। মা গরম দুধের গ্লাসটা দিয়ে গেছে টেবিলে। সেটা ঠান্ডা হলেও শেষ হয়নি। আরো কিছুক্ষন পঁয়ষট্টি পাতায় আটকে রইলাম। ইচ্ছে করেই ইতিহাসটা নিয়ে বসেছি। কারন কেউ জিজ্ঞেস করলে তালে গোলে একটা কিছু বলে দেওয়া যায়। নিদেন পক্ষে আগের চ্যাপ্টারটাই বলে দেওয়া যাবে। অঙ্ক নিয়ে বসলে যদি খাতা সাদাই থেকে যায়, তাহলে মুশকিল।
এদিকে মুশকিল হচ্ছে আমার টেবিলে কোন ঘড়ি নেই। সেটা আছে পিছন দিকে, মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি কটা বাজল। শেষ পনেরো মিনিট যেন কাটতেই চাইছে না। মনে মনে ভাবছি কি করেই বা প্রমান হবে। বিন্তি আটটার সময় ঠিক কি করবে? আর যদি প্রমান করেই দেয় - তার মানে কি এই যে আমাদের বাড়ির চারপাশে জলজ্যান্ত সব ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে? আমরা তো আবার খালি চোখে ওদের দেখতে পাই না। তার মানে কি এরকম হতে পারে এই ঘুরে বেড়াচ্ছি আর একটা ভূতের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল, তাহলে কি আমরা বুঝতে পারব? না কি পারব না? এতদিন কেটে গেছে কিন্তু আমরা ভূতেদের সম্পর্কে কত কম জানি। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একবার জানলার বাইরের দিকে চোখ গেল। মনে হল অন্ধকারে কি যেন একটা নড়ে গেল। শিউরে উঠলাম। গল্পে যে বলে ভূত নাকি অন্ধকারেই থাকতে ভালোবাসে। ঐ ভূতুড়ে চশমার টানে ওরা এসে এই বাগানের গাছ গুলোতে জটলা পাকিয়েছে কিনা কে জানে? আবার একটা লেবু গাছও আছে। কথাটা ভাবতেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন যেন শিউরে উঠল একটু। ভূত আছে কি নেই সেই প্রমানটা না নিলেই নয়? উফফ! এই সময় যদি টুবলুটা পাশে থাকতো।
এমন সময় বারান্দার ঘড়িটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজল।
শিবাজীর রাজ্যবিস্তার আর পড়া হল না। আরো খানিকক্ষন এদিক ওদিক করে বই ফেলে উঠে পড়লাম। বাইরের ঘরে আড্ডা বসেছে। বড়রা সবাই, বিন্তিও আছে সেখানে। আমিও পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। সবাই না না রকম কথা বলছে। কিন্তু সেদিকে আমার কান যাচ্ছে না। পিসেমশাই বলছিলেন যে বিন্তি কিরকম ভালো পড়াশোনা করছে, আবৃত্তিতেও প্রাইজ পাচ্ছে। এসব তো আমি জানিই। আমিও প্রত্যেক বছর এক আধটা প্রাইজ পেয়েই যাই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় - সেকথা কেউ তুললোই না।
ঘন্টাখানেক চলার পর মা এসে সবাইকে খেতে ডাকতে সব্বাই উঠে পড়ল। আমি আর বিন্তি পাশাপাশিই বসেছিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে কি রে প্রমানটা কি হল?
বিন্তি বললে, “প্রমানের আর কি আছে, সেটা তো প্রোফেসর শঙ্কুই করে দিয়েছেন। তবে আমি একটা ছোট্ট প্রমান দিচ্ছি তুই আজকে দুঘন্টা ধরে বসে কেবল পঁয়ষট্টি পাতা ওলোট পালোট করেছিস। কিচ্ছু পড়িস নি।” প্রোফেসর শঙ্কুর নামটা কোথাও যেন শুনেছি। পেটে আসছে মুখে আসছে না। আর ও জানলোই বা কি করে যে আমি পড়তে বসেও পড়িনি। সব মিলে কিন্তু কিন্তু করছি এমন সময় বাবা আমাদের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, “কিসের প্রমান নিয়ে কথা হচ্ছে শুনি?”
বিন্তিটা এত পাজি দুম করে কথা পালটে ফেলে অন্য একদিন ইস্কুলে কি হয়েছে সেই ঘটনায় চলে গেল। আমি বেগতিক দেখে চুপ করে গেলাম। পড়ায় ফাঁকি মেরেছি এটা যত গোপন থাকে ততই ভালো।
৩
সকাল হতে না হতেই টুবলু এসে হাজির। উত্তেজনার চোটে ও ও নাকি কালকে এক্কেবারে পড়ায় মন বসাতে পারেনি। অঙ্কস্যার এসেছিলেন পড়াতে। তার কাছে দুটো বোকার মত ভুল করে মারও খেয়েছে। যা বুঝলাম তাতে ঘুমও বড় একটা হয়নি।
“প্রোফেসর শঙ্কু? তুই ঠিক শুনেছিস?”
“এক্কেবারে। কে বলতো তিনি?”
“আমার মনে হচ্ছে আমি একটা বইয়ে পড়েছি”
“কি পড়েছিস?”
“উনি মনে হয় একজন বৈজ্ঞানিক।”
“আমারও তাই মনে হয়। কোথাও যেন নামটা শুনেছি”
“কিন্তু তাই বলে ও জানলো কি করে যে তুই পড়তে না বসে ফাঁকি মেরেছিস”
“আরে সেটা আমি কি করে বলব, ওকে জিজ্ঞেস করলে হত না?”
আমাদের আলোচনা হচ্ছিল বাগানের এক কোনে। খানিক বাদে বিন্তিকেও সেদিকে আসতে দেখা গেল। আমি একটু গলাটা পরিষ্কার করে বললাম, “আচ্ছা, কালকে তুই কি করে জানলি যে আমি পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছিলাম?”
বিন্তি অম্লান বদনে বলল, “আমাকে ভূতটা এসে খবর দিয়ে গেল যে”
টুবলু বলল, “কি খবর দিল?”
“এই যে তুই অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের কাছে মার খেলি বা পিন্টু পড়তে বসেছে বটে কিন্তু আদপে পড়ছে না”
“বটে, তা ভূতে আজকাল এইসব খবর দিয়ে বেড়াচ্ছে বুঝি? তাদের আর কোন কাজ নেই?”
“কাজ থাকবে না কেন? তবে ভালো করে ডেকে বললে তারা এইসব করে দিয়ে যায়”
“বেশ তো তা আমাদের একবার চশমাটা দেখা না বাপু। তাহলেই তো সব গোল মিটে যায়”
“উঁহু, সে হওয়ার নয়। চশমাটা আমাকে গিয়েই প্রোফেসর শঙ্কুর কাছে ফেরত দিতে হবে। উনি আমাকে বিশ্বাস করে জিনিসটা দিয়েছেন বটে। তার মানে এই নয় যে আমি সব্বাইকে দেখিয়ে বেড়াব। যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি ওনাকে কি বলব?”
আমরা দুজনেই ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “প্রোফেসর শঙ্কুকে তুই চিনিস নাকি?”
“কেন চিনব না? সারা পৃথিবীর লোক ওনাকে চেনে। উনি এত বড় বৈজ্ঞানিক। আবিষ্কারক। কত দেশ বিদেশের লোক তো ভারতে আসেই কেবল ওনার সাথে দেখা করার জন্য”
আমি বললাম, “তা তোর সঙ্গে কোথায় দেখা হল?”
“কোথায় আবার, গিরিডিতে। উনি তো ওখানেই থাকেন। লোকজনের সঙ্গে বেশী মিশতে চান না। নিরিবিলি পছন্দ করেন। সেবার আমরা যখন গেলাম সেদিন উশ্রী নদীর ধারে মর্নিং ওয়াক করার সময় দেখা হয়ে গেল। আলাপ হওয়ার পর উনি এই যন্ত্রটা আমাকে কদিনে জন্য দিলেন।”
এরপর কিছু কথা বলা চলেনা। বিন্তির সঙ্গে আমাদের সন্ধি হয়ে গেল। আমরা দেখলাম আমরাও ওর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারছি। এইসব বলে বন্ধু মহলে তাক লাগিয়ে দেওয়ার অনেক সুযোগ আছে। তাছাড়া বিন্তি বলে গেল ওর কাছে নাকি প্রোফেসর শঙ্কু একটা ফর্মুলা দিয়েছেন - সেটা দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার ওষুধ তৈরী করা যায়। কয়েকটা কেমিকাল লাগে, তবে ও আমাদের বলে যাবে। তারপর সেটা তৈরী করে নিতে হবে। কয়েকটা দিন হইহই করে কাটল। আর সত্যিই বিন্তি কাগজে করে আমাদের ফর্মুলাটা লিখে দিয়ে গেল।
৪
আমরা দুজনে খেলার মাঠে পিঠে পিঠ টেকিয়ে বসেছিলাম। আজকে মাঠে এসেও খেলিনি।
একটু আগেই বাবাইদাদার কাছে গিয়েছিলাম ফর্মুলাটা নিয়ে। বাবাইদা ডাক্তারি পড়ছে কলকাতায় গিয়ে। আমরা ভাবছিলাম যদি দু একটা করে কেমিকালগুলো এনে দিতে পারে, কিংবা অন্ততঃ যদি উপায়টা বাতলে দিতে পারে। বাবাইদা কাগজটা দেখে আমাদের মুখের দিকে খানিকক্ষন তাকিয়ে তারপর হো হো করে হেসে উঠল। সে হাসি আর থামতেই চায় না। তারপর বললে , “বাবুইয়ের ডিমের সঙ্গে এক্সট্র্যাক্ট অফ গরগনাস? হো হো হো!”
আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি দেখে বাবাইদা খুলে বললো, “ওরে গাধা, প্রোফেসর শঙ্কুর বই থেকে টুকে এনেছিস এইসব? উনি কি আর সত্যি বিজ্ঞানী? উনি তো গপ্পের বিজ্ঞানী রে।”
আমি বললাম, “আমার পিসতুতো বোন যে ওনার সঙ্গে দেখা করে এই ফর্মুলা পেয়েছে বলল?”
“ওরে গাধা কি আর সাধে বলি? তোদের স্রেফ বোকা বানিয়েছে একটা পুঁচকে মেয়ে।”
সেই থেকে আমরা দুজনেই বেশ মুষড়ে পড়েছি। টুবলু অনেকক্ষন চুপ করে বসেছিল। এবার হঠাৎ তুড়ি মেরে লাফিয়ে উঠে বললে, “এইবারে বুঝেছি!”
আমি চমকে বললাম, “কি বুঝেছিস রে?”
“আরে সেদিন চমকে গিয়ে আমরা এক রকম ধরেই নিয়েছিলাম যে বিন্তি ভূতের কাছ থেকে জানতে পেরেছে আমরা সেদিন কি করছিলাম। এখন বুঝতে পেরেছি আসলে কি হয়েছে। মনে আছে তুই আমাকে বলেছিলি যে সেদিন কি যেন একটা জানলার সামনে দিয়ে চলে গেল?”
“হ্যাঁ, কিছু একটা হবে, কেন?”
“আরে ওটা বিন্তিই ছিল, নইলে আর জানলো কি করে যে তুই কত পাতায় কি পড়ছিলিস?”
এতক্ষনে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল। তার মানে আগাগোড়াই আমাদের বোকা বানিয়েছে। কিন্তু তাহলে টুবলুর ব্যাপারটা ও জানল কি করে? টুবলুকে জিজ্ঞেস করতে বলল, “আরে ওটা স্রেফ আন্দাজে ঢিল। সেদিন বিকেলেই বলতে বলতে আসছিলাম না আজকে আবার অঙ্ক স্যার আসবেন? আর ও নিশ্চয় সেটা শুনে নিয়েছিল। এমন একটা গল্প আমাদের শোনালো যে জানতোই পড়ায় আমাদের মন বসবে না। তাহলে এটা আন্দাজ করা আর কি এমন মুশকিল যে স্যারের হাতে ধোলাই খেয়েছি। আর তারপর এক ফাঁকে এসে জানালা দিয়ে দেখে গেল তুই কি পড়ছিস।”
আমিও ব্যাপারটা বুঝে ঘাড় নাড়লাম।
চশমাটাও তিনতলার ঘরে পাওয়া গেছে। সেটা নেহাতই একটা পুরনো চশমা। ভূত টুত দূরে থাক, এমনিই কিছু দেখা যায় না। যাইহোক, প্রথমে ভেবেছিলাম একটা কড়া চিঠি লিখে এক হাত নেবো। কিন্তু শেষমেষ টুবলুই বুদ্ধিটা দিল। বলল, “আমরা যে এক্কেবারে বেকুব বনেছি সেটা আবার লিখে বসিস না যেন। বরং এইরকম লেখ যে তোর কাছ থেকে ফর্মুলাটা পেয়ে দারুন লাভ হয়েছে, আমরা অদৃশ্য হয়ে এখানে দারুন মজা করে বেড়াচ্ছি।” সেই মতই চিঠিটা লিখতে শুরু করেছি। যে কোন দিন পোস্ট করে দিলেই হল।
অভ্র পাল
কলকাতা