খেলাঘরখেলাঘর

এই সময়ে একের পর এক বড়দিনের ছুটি, নতুন বছরের ছুটি। বাইরে উত্তরের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া, ভোরের কুয়াশা, চামড়ায় টান ধরার অস্বস্তি, নলেন গুড়ের সন্দেশ, বড়দিনের কেক - সবকিছু মিলিয়ে একটা ছুটির আমেজ। এর মধ্যেই যদি ২/৩ দিনের ছুটিতে যদি কোথাও ঘুরে আসতে পার বা বন্ধুবান্ধব আর বাড়ির লোকেদের সাথে কোথাও একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করে ফেলতে পার, তাহলে তো শীতের ছুটির একদম ষোলকলা পূর্ণ। এইরকম একটা ফুরফুরে মেজাজে আজ তোমাকে আমার কিছুদিন আগের একটা ভীষণ মজার বেড়াতে যাওয়ার গল্প বলি।

গল্পটা শুরু করার আগে যে বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম তাদের একটা ভূমিকা দেওয়া দরকার। গত আগষ্ট মাসের মাঝমাঝি - এক বন্ধুর সাথে একটা গানের কনসার্টে গিয়েছিলাম। সেখানে গানবাজনা শুনতে শুন্তেই আলাপ হল মন্টানা থেকে আসা আর কয়েকজনের সাথে - এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কার্ক আর ক্যারোলিন। এদের কথাই পরে আবার বলব। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার মধ্যেই এই মানুষগুলোর দরাজ মন আর মিশুকে স্বভাবের জন্য খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল - মনে হচ্ছিল যেন এদের সাথে বহু বছরের আলাপ আর বন্ধুত্ব। কিন্তু আফসোসের কথা হল, অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমার এই নতুন বন্ধুদের টেলিফোন নাম্বার বা ই-মেইল রাখতেই ভুলে গেলাম। তাই বাড়ি এসে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। যাই হোক, ছুটি কাটিয়ে আবার গতানুগতিক জীবনের সাথে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি। দু'তিন দিন পর অফিসের কাজের ফাঁকে ই-মেইল দেখতে গিয়ে হঠাৎ দেখি ক্যারোলিনের ই-মেইল। আগের খারাপ করা মনটা এক ধাক্কায় অনেকটা ভাল হয়ে গেল। কার্ক আর ক্যারোলিন নাকি দু' দিন ধরে ইন্টারনেটে আমার নাম দিয়ে খুঁজে খঁজে আমার ই-মেইল বের করেছে। এরপর বেশ কয়েকবার ই-মেইল আদানপ্রদানের মধ্যেই ক্যারোলিন আমাকে ওদের থাকার জায়গার অনেক মজার মজার গল্প বলছিল আর আমাকে ওদের ওখানে ঘুরে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করল। আর তার কিছুদিনের মধ্যে ৩ দিনের একটা লম্বা ছুটি চলে আসায় আমিও এই নতুন আর প্রায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথে আবার দেখা করার লোভটা আর সামলাতে পারলাম না।

কার্ক আর ক্যারোলিন থাকে মন্টানা রাজ্যে মিসোউলা শহরের কাছে একটা পাহাড়ের উপরে একটা বড় তাঁবুতে। এই বিশেষ ধরণের তাঁবুর নাম হল "ইয়ার্ট"। এই বিশেষ ধরণের তাঁবু সাধারণত দেখা যায় মধ্য এশিয়া আর মঙ্গোলিয়াতে। এখানকার মানুষেরা অনেক সময়েই ইঁট-কাঠ দিয়ে বাড়িঘর না বানিয়ে এই ধরণের তাঁবুতে বসবাস করে। এর মধ্যে যে সবরকম বন্দোবস্তই থাকে তা নয়, তার সাথে প্রতিকূল আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ইয়ার্টগুলো হয় ইঁট-পাথরের ইমারতের মতই শক্তপোক্ত।

ইয়ার্ট
ইয়ার্ট


মিসোউলা শহরটা আমার বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ মেইল দূরে। গাড়ি চালিয়ে পৌঁছলাম প্রায় ৯/১০ ঘন্টা পরে। আমি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ী রাস্তা চিনে যেতে পারব না ভেবে কার্ক আর ক্যারোলিনই শহরে চলে এসেছিল। মিসোউলা শহরটা ছোট হলেও বেশ ছিমছাম-সাজানো গোছানো। দু'দিকের পাহাড় আর মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা নদী শহরের শোভা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওদের সাথে কিছুক্ষণ হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে অদের অনসরণ করেই পৌঁছলাম একটা পাহাড়ের মাথায় ওদের তাঁবুতে। শহর থেকে এটা প্রায় ২৫০০ ফুট উপরে। বনের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে আসার সময় মুগ্ধ হলাম এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে, মনটা আনন্দে নেচে উঠল যখন আমার খুব কাছ দিয়ে একদল বন্য হরিণ দৌড়ে পালিয়ে গেল, আর এদিক-ওদিক থেকে দেখতে আর শুনতে পেলাম নানাজাতের নাম না-জানা পাখী আর তাদের ডাক। কার্ক আর ক্যারোলিনের কাছেই পরে শুনেছিলাম যে ভাগ্য ভাল থাকলে এই রাস্তাতেই অনেক সময় অনেক প্রজাতির পাহাড়ী সাপ আর ভালুকও দেখা যায়। আর মানুষ তাদের বিরক্ত না করলে তারাও সাধারণত মানুষকে অগ্রাহ্য করেই চলে।

পাহাড়ের মাথায় এসে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে চারিদিকের বন আর পাহাড়গুলোর গাম্ভীর্য আর নির্জনতার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। কার্ক আর ক্যারোলিনের ইয়ার্ট খুব পাকা শিল্পীর মত সুন্দর করে সাজানো। তার ভিতরে যেমন আছে রান্নাঘর, খাবার জায়গা, স্নানঘর, আবার একদিকে রয়েছে একটা বেশ বড় বসার জায়গা আর অনেক বিষয়ের উপর বিভিন্ন বইয়ের একটা বিরাট সংগ্রহ। পাহাড়ের উপর আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন উপাদান - টেলিভিশন, ইন্টারনেট - এগুলোকে ওরা ইচ্ছা করেই অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছে। ওদের অবসর সময়ের সঙ্গী হল ওদের সংগ্রহের বই। তাতে বিভিন্ন বিষয়ে ওদের জ্ঞানের পরিধি যেমন বড় হয়েছে আর তার সাথে ওদের মনটাও অনেক খোলামেলা আর উদার হয়েছে।

তা ছাড়াও ওদের অবসর সময় কাটে ওদের ২টো পোষা বিড়াল, একটা পোষা কুকুর আর একটা পোষা সাপের সাথে। যে কোন সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর প্রতিই আমার একটা অস্বস্তি আছে বলে (যদিও এই সাপটা বেশীরভাগ সময়ে কাঁচের ভিতরেই থাকে আর একেবারেই নিরীহ), সাপটাকে আমি শুধু কাঁচের বাইরে থেকেই দেখেছিলাম, কিন্তু অন্য পোষা প্রাণীগুলোর সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল এই ২/৩ দিন থাকার সময়ে। ওদের তাঁবুতে আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছিল অদের শোওয়ার জায়গাটা। তাঁবুর মাথায় একদম মাঝখানে একটা জায়গা দিয়ে আলো আসার ব্যবস্থা আছে। এখান দিয়ে সূর্যের আলো তো বটেই, তাছাড়া শুক্লপক্ষের রাতে চাঁদের আলো ঢুকে বেশ সুন্দর দেখতে লাগে। মাটি থেকে একটু উপরে মই দিয়ে উঠে এই আলো ঢোকার জায়গার নীচেই হল ওদের শোওয়ার ব্যবস্থা।

স্কাইলাইট
স্কাইলাইট

আরেকটা জায়গা যেটা খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল এই দু'দিনে সেটা হল তাঁবুর পিছনে। তাঁবুর পিছনে পাহাড়ের খাত যেখান থেকে শুরু হয়েছে তার মাঝে একফালি জায়গা। সেখানে পাতা আছে কয়েকটা চেয়ার আর মাঝে রয়েছে সিমেন্ট আর মাটি দিয়ে তৈরী করা একটা চিমনী। সন্ধ্যের পর যখন বাইরে একটু ঠান্ডা থাকে তখন পাহাড়ের বন থেকে কেটে আনা কাঠ চিমনীর নীচে জ্বালালে যেমন বসে আগুন পোহাতে খুব ভাল লাগে, তার সাথে চারিদিকের ঘন অন্ধকারে চিমনীর মাথা দিয়ে ওঠা আগুনের শিখা একটা মায়াবী সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে।

চিমনি
চিমনি


হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে ১০ ঘন্টা যাত্রার ধকল একটু সামলে ওঠার পর কার্ক আর ক্যারোলিন আমাকে নিয়ে গেল ওদের বাগান আর গ্রীনহাউস দেখাতে। তুমি কি কখনও গ্রীনহাউসের কথা শুনেছ? ভিতরটা দেখতে এমনিতে সাধারণ বাগানের মতই। কিন্তু বাইরের চারিদিক আর উপরের দিকে কাঁচ বা প্লাস্টিকের স্বচ্ছ আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। ফলে দিনের সূর্যের তাপ এর মধ্যে ঢুকে আটকা পড়ে থাকে - তাই সবসময়েই ভিতরটা বেশ ঊষ্ণ আর আর্দ্র থাকে। যে ধরণের গাছপালা আর সব্জি ঠান্ডা বা শুষ্ক আবহাওয়াতে ভাল বড় হয়না, তাদের জন্য বিশেষভাবে এই ব্যবস্থা। এ সবই ওদের নিজেদের হাতে তৈরী। তার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের গাজর, মূলো, বীট, লঙ্কা, টম্যাটো, বীন আর নানারকমের শাক এত হয় যে বেশীরভাগ সময়েই ওদের আর বাজার থেকে শাকসব্জি কেনার প্রয়োজন হয়না।

টমেটো
গ্রীনহাউসে টমেটো


এর একটু দূরেই রয়েছে দুটি কাঠের বাক্স যার মধ্যে মৌমাছিরা এসে মৌচাক বানায়, আর তার মধু কার্ক আর ক্যারোলিন বাড়ির কাজে ব্যবহার করে। ভালুকের হাত থেকে মধু বাঁচানোর জন্য এর চারপাশ ঘেরা রয়েছে সরু ইলেকট্রিকের বেড়া দিয়ে। এর বিদ্যুৎ আসে তারের সাথেই লাগানো একটা সোলার প্যানেল থেকে। এছাড়াও রয়েছে আরও দুটো বেশ বড় সোলার প্যানেল। ওদের বাড়ির ইলেকট্রিসিটির বেশীরভাগই ওই দুটো সোলার প্যানেল থেকে তৈরী হয়। আর বাকিটা তৈরী হয় জেনারেটর থেকে। আশেপাশের দু-তিনটে পাহাড়ে কার্ক আর ক্যারোলিন ছাড়াও আরো ২/৩ টি পরিবার বাস করে। পাহাড়ের একটা কুয়ো থেকে পাম্পের সাহায্যে বাড়িতে জল আসে। তাই জলের অপচয় ওদের কাছে একটা বিলাসিতা।

সোলার প্যানেল
সোলার প্যানেল


গল্পগুজব করতে করতেই সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির বাগান আর গ্রীনহাউসের সবজি আর বাজার থেকে কিনে আনা মাংস দিয়ে রাতের খাবার শেষ হল। বাগান থেকে হাতে তোলা সবজি খাওয়ার যে কি মজা সেটা দারুণভাবে উপভোগ করলাম। খাওয়ার পর আরো কিছুক্ষণ গল্প চলল। শুনছিলাম ওদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা, আর ওরাও শুনছিল আমার কথা। ওদের তাঁবুর পাশেই আমার জন্য একটা ছোট তাঁবু টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল কার্ক আর তার ভিতরে তোশক, কম্বল আর বালিশ পেতে দিয়েছিল। ওদের আতিথেয়তাতে ততক্ষণে আমি পুরোপুরি মুগ্ধ।

পাভেল ঘোষ পোর্টল্যান্ড, ওরেগন এর বাসিন্দা। কম্পিউটার এর খুঁটিনাটি নিয়ে পড়াশোনা ও কাজকর্ম করার ফাঁকে ফাঁকে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন; আর্সেনাল ক্লাব-এর একনিষ্ঠ ভক্ত।