খেলাঘরখেলাঘর

বিশ্বজয়ী ভারত

বিশ্বজয়ী ভারত

কিছুদিন আগেই শেষ হল ক্রিকেট বিশ্বকাপ। নিজের দেশে প্রথমবার আর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জিতল ভারত। একবার তার শুরুর আর শেষের মুহূর্ত দুটো মনে কর তো! প্রথম বলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের খেলায় বীরেন্দ্র সেহওয়াগের বাউন্ডারি আর শেষ বলে শ্রীলঙ্কার সাথে ফাইনালে মহেন্দ্র সিং ধোনীর ওভার বাউন্ডারি। সেদিক দিয়ে দেখলে ভারতের শুরু আর শেষ দুটোই হয়েছে খুব ভালভাবে। বিশ্বকাপ জেতার আনন্দ, সেটাও আবার পরপর অনেকগুলো কঠিন ম্যাচ জিতে। তুমিও নিশ্চয়ই তোমার বাড়ির আর পাড়ার বাকিদের সাথে সাথে খুব মেতে উঠেছিলে ঐ দেড় মাস ধরে আর তারপর পুরোপুরি উপভোগ করেছ জেতার আনন্দ।

এবারের জেতাটাও আসলে ১৯৮৩ সালের সেই প্রথম বিশ্বকাপ জেতার থেকে অনেকটা আলাদা। তোমার তো তখন জন্মও হয়নি, আর আমিও এতটাই ছোট যে খেলা বোঝা তো দূরের কথা, কি নিয়ে আনন্দ করছে সবাই সেটাও বোঝার মত বোধ হয়নি। পরে অবশ্য তা নিয়ে অনেক গল্প পড়েছি। তখন তো আর সবার বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। তাই অনেকেরই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হত রেডিও শুনে আর সংবাদপত্রের খেলার পাতা পড়ে। সেই ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ভারতকে কেউ প্রায় ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিং, বোলিং - সবদিক দিয়েই দুর্ধর্ষ দল। তাদেরই যে ফাইনালে হারিয়ে দেবে ভারত এটা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ছিল। সেইদিক দিয়ে ভেবে দেখলে এবারের জয়টা হয়তো অনেকেই আশা করেছিল। প্রথমতঃ, ঘরের মাঠে খেলা। আর উপরে অভিজ্ঞ আর তরুণ ক্রিকেটারদের মিলিয়ে এবারের ভারতের দলটাও অন্যতম শক্তিশালী দলগুলোর মধ্যে একটা ছিল।

এবারের প্রতিযোগিতার এক বড় চমক ছিল আয়ারল্যান্ড। এখনও অবধি আয়ারল্যান্ড টেস্ট খেলার যোগ্যতা অর্জন করেনি আর এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপের মত বড় আসরে নেমেছিল। সেই অপেক্ষাকৃত অজানা আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল নিয়ে তারা শুধু যে নেদারল্যান্ডের সাথে জিতল তাই নয়, হারিয়ে দিল নিজেদের প্রতিবেশী আর বহুগুণ শক্তিশালী ইংল্যান্ডকেও তাদের গ্রুপ লীগের ম্যাচে। দক্ষিণ আফ্রিকাও এসেছিল খুব শক্তিশালী দল নিয়ে আর প্রতিযোগিতার অন্যতম ফেভারিট হিসেবেই। কিন্তু বরাবরের মত সব ভালভাবে চলতে চলতে তারা প্রথম নক্‌-আউট ম্যাচেই খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গেল নিউজিল্যান্ডের সাথে।

এইবারে ভারতের দলে যেমন ছিলেন শচীন তেন্ডুলকার, মহেন্দ্র সিং ধোনি, যুবরাজ সিং, বীরেন্দ্র সেহওয়াগ, জাহির খান, হরভজন সিং-এর মত অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরা, তার সাথে ছিলেন গৌতম গম্ভীর, সুরেশ রায়না আর বিরাট কোহলির মত তরুণেরা। গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচগুলোতে ভারতের ধারাবাহিকতা ছিল ভাল আর খারাপ মিশিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর বাংলাদেশের সাথে খেলায় জিতলেও একটুর জন্য টাই হল ইংল্যান্ডের সাথে আর কাছাকাছি গিয়েও হারতে হল দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। কিন্তু এই দলটা অনেক ভাল খেলল নক্‌-আউট পর্যায়ে গিয়ে। আর কোযার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল আর ফাইনালে পরপর অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতা তো সত্যিই গর্বের বিষয়। এর মধ্যে অস্ত্রেলিয়া ছিল গত তিন বছরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। যদিও তখনকার দলের তুলনায় তাদের এবারের দলের ধার ছিল অনেক কম, কিন্তু তাও যথেষ্ট লড়াই করেই জিততে হল ভারতকে। আর জিতেই সেমিফাইনালে মুখোমুখি পড়তে হল প্রতিবেশী আর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের।

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ মানেই চিরকাল টানটান উত্তেজনা আর তার উপর এটা আবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। তাই ক্রিকেটপ্রেমী মানুষকেও কোনভাবে নিরাশ হতে হল না। প্রথম থেকে শেষ অবধি চলল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। প্রথমে ব্যাট করে ভারত তাদের ইনিংস শেষ করল ২৬০ রানে। ভারতের সমর্থকরা হয়তো আরও খানিকটা বেশী রান আশা করেছিল - তাই রয়ে গেল একটা চাপা আশঙ্কা। যদিও শেষপর্যন্ত ভারতের বোলারেরা সকলেই খুব ভাল বোলিং করে পাকিস্তানকে অল-আউট করে দিলেন ২৩১ রানে।

২০০৩ সালের পর ৮ বছর পর আবার বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছল ভারত। সেবার ফাইনালে হারতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সাথে। আর এবার মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা। এই সেই শ্রীলঙ্কা যাদের কাছে ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে হেরে গিয়েছিল ভারত। এইবারের শ্রীলঙ্কা দলটাও, বিশেষতঃ তাদের ব্যাটিং ছিল খুবই শক্তিশালী। ২রা এপ্রিল মুম্বাই শহরের ওয়াঙখেড়ে স্টেডিয়ামে আয়োজিত হল ফাইনাল। তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ এই ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে মানুষের আবেগ আর উত্তেজনা। পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেটারদের পোস্টার আর পতাকা তো ছিলই, তার সাথে বিভিন্ন মন্দিরে চলছিল ভারতের জেতার কামনায় মানুষের পূজা-প্রার্থনা।

ভারতের বোলারেরা ভাল বোলিং করে শ্রীলঙ্কাকে আটকে রাখলেন ২৭৪ রানে। রান হয়তো আর খানিকটা কম হতে পারত, কিন্তু শেষের দিকে দুর্ধর্ষ ব্যাটিং করে জয়বর্ধনের ৮৮ বলে অপরাজিত ১০৩ রানের সুবাদে ফাইনাল ম্যাচ ঝুলে রইল এক জমজমাট আর উত্তেজক সমাপ্তির জন্য। দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটাও ভাল হল শ্রীলঙ্কার। ৩১ রানের মধ্যেই তারা আউট করল দুই বিপজ্জনক ওপেনার সেহওয়াগ আর তেন্ডুলকারকে। এরপর যখন শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের হাতছানি পেতে শুরু করেছে, সেই সময়েই খুব সাহসিকতা আর ঠান্ডা মাথায় ব্যাটিং করে শ্রীলঙ্কার সব আশায় জল ঢেলে দিলেন গম্ভীর, কোহলি, ধোনি আর যুবরাজ। এর মধ্যে গম্ভীর আর ধোনির নাম তো বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। গম্ভীর যদিও ৩ রানের জন্য ফাইনালে সেঞ্চুরির থেকে বঞ্চিত হলেন, কিন্তু ধোনি সত্যিকারের ক্যাপ্টেনের মত শেষ অবধি ৯১ রান করে ভারতকে এনে দিলেন দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ। জয়ের শেষ রানটাও এল ধোনির ব্যাট থেকেই, লং-অনের উপর দিয়ে ওভার বাউন্ডারির মাধ্যমে।

জয়ের মূহুর্তে
জয়ের মূহুর্তে যুবরাজ সিংহ আর মহেন্দ্র সিং ধোনি

তারপরের কথা তো আর তোমাকে আলাদা করে বলার কিছু নেই। নিজেই দেখেছ কত মানুষ রাস্তায় নেমে জায়গায় জায়গায় জেতার আনন্দে মেতে উঠেছে। সেই সময়ে তুমিও কি স্থির হয়ে বসে থাকতে পেরেছিলে? কি করলে জেতার আনন্দে? ফাইনালের ম্যান-অফ্‌-দ্য-ম্যাচ হলেন ক্যাপ্টেন ধোনি আর প্রতিযোগিতার অনেকগুলো ম্যাচ ভাল খেলার সুবাদে ম্যান-অফ্‌-দ্য-টুর্নামেন্ট হলেন যুবরাজ সিং।

শচীন
সহ খেলোয়াড়দের কাঁধে চেপে শচীন তেন্ডুলকর

তবে এই জয় মনে হয় সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে রইল শচীন তেন্ডুলকারের জন্য। ১৯৯২ থেকে শুরু করে এই নিয়ে ষষ্ঠবারের জন্য টুর্নামেন্টে নেমেছিলেন। ২১ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনে প্রায় কোন সাফল্যই অধরা থেকে যায়নি। বাকি ছিল শুধু বিশ্বকাপ জেতা। তাই চেপে রাখতে পারলেন না জয়ের আবেগের অশ্রু। আর তাঁকে কাঁধে চাপিয়ে সারা মাঠ ঘুরে তাঁর সহ-খেলোয়াড়েরা দিলেন যথাযোগ্য সম্মান। সেইসাথে সকলের ধন্যবাদ কুড়োলেন কোচ গ্যারি কার্স্টেনও।

বড় হলেও দেখবে এই জেতার টুকরো স্মৃতিগুলো বহুদিন রয়ে যাবে তোমার মনে। আশা রাখি, আমাদের জীবনকালে আমরা আরও দেখব ভারতের বিশ্বকাপ জয়। কিন্তু নিজেদের দেখা এই প্রথমবারের আনন্দ চিরকাল গেঁথে থাকবে সুখস্মৃতি হয়ে।

 

 

লেখাঃ
পাভেল ঘোষ
হিলস্‌বোরো, ওরেগন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র

ছবিঃ
ইন্টারনেট

পাভেল ঘোষ পোর্টল্যান্ড, ওরেগন এর বাসিন্দা। কম্পিউটার এর খুঁটিনাটি নিয়ে পড়াশোনা ও কাজকর্ম করার ফাঁকে ফাঁকে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন; আর্সেনাল ক্লাব-এর একনিষ্ঠ ভক্ত।