খেলাঘরখেলাঘর

পুরাণকথা

 



দিনেওয়ান , বা এমু পাখি, সবথেকে বড় পাখি ছিল বলে, অন্য সব পাখিরা তাকে রাজা বলে মান্য করত। গুম্বলগাবন , বা বাস্টার্ড পাখিরা, দিনেওয়ান দের হিংসা করত। বিশেষতঃ গুম্বলগাবন মা, দিনেওয়ান মাকে খুব হিংসা করত। দিনেওয়ানেরা খুব জোরে দৌড়াতে পারত, আর অনেক উঁচুতে উড়তে পারত। এইসব দেখে তার আরো হিংসা হত। আর যখন দিনেওয়ান মা, অনেক উঁচু আর দূর থেকে উড়ে এসে তার সামনে নেমে ডানা ঝাপটাত আর গলা ফুলিয়ে খুশিতে ডাক দিত, তখন গুম্বলগাবন মায়ের বিরক্তির শেষ থাকত না।

গুম্বলগাবন মা সবসময়ে বসে বসে ভাবত সে কিরকম ভাবে দিনেওয়ানের আধিপত্য শেষ করতে পারবে। অনেক ভেবে সে ঠিক করল সে যদি দিনেওয়ানের ডানাদুটিকে নষ্ট করে দিতে পারে আর তার ওড়ার ক্ষমতা শেষ করে দিতে পারে, তাহলে দিনেওয়ানের আধিপত্যও শেষ হবে। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছিল না এই কাজটা কি ভাবে করা যাবে। সে জানত দিনেওয়ানের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করতে যাওয়ার চেষ্টা করা মূর্খামি, কারণ বিরাট বড় দিনেওয়ানের সামনে কোন গুম্বলগাবন টিঁকতেই পারবে না। তাকে কোন একটা চালাকির করে কাজটা করতে হবে।

একদিন, যখন গুম্বলগাবন মা দূর থেকে দেখতে পেল দিনেওয়ান মা তার দিকে এগিয়ে আসছে, সে পা মুড়ে বসে এমনভাবে তার ডানাদুটিকে গুটিয়ে নিল  যেন তার কোন ডানাই নেই। দিনেওয়ান এসে তার সঙ্গে গল্পগাছা শুরু করল। খানিক পরে গুম্বলগাবন বলল ঃ তুমি কেন আমার মত ডানাবিহীন হয়ে যাও না? সব পাখিরাই উড়তে পারে। দিনেওয়ানকে যদি পাখিদের রাজা হতে হয়, তাহলে তার ডানা ছাড়াই সব কাজ করতে পারা উচিত। যখন সব পাখিরা দেখবে আমি ডানা ছাড়াই সব কাজ করতে পারছি, ওরা তখন ভাববে আমিই সবথেকে চালাক, আর ওরা তখন একজন গুম্বলগাবনকে রাজা বানিয়ে দেবে।"

"কিন্তু তোমার তো ডানা আছে," বলল দিনেওয়ান।

"না, আমার কোন ডানা নেই।" বলল গুম্বলগাবন। আর সত্যিই তার ডানাগুলি এত ভালভাবে লুকানো ছিল, যে মনে হচ্ছিল তার কথাগুলি সব সত্যি। দিনেওয়ান একটু পরে চলে গেল, আর অনেক সময় ধরে ভাবতে লাগল। তারপরে সে তার সংগী, দিনেওয়ান বাবার সাথে কথা বলল। সব শুনে  দিনেওয়ান বাবাও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারপরে তারা ঠিক করল, তারা কখনই একজন গুম্বলগাবনকে রাজা হতে দেবে না, তার জন্য যদি নিজেদের ডান খোয়াতে হয়, তাও ভাল।

শেষে তারা ঠিক করল, ডানাগুলিকে বিসর্জন দেবে। দিনেওয়ান মা তার সঙ্গীকে বলল একটা পাথরের অস্ত্র দিয়ে তার ডানাদুটিকে কেটে ফেলতে। তারপরে সে তার সঙ্গীর ডানাদুটিকে কেটে ফেলল। ডানা কাটা হয়ে গেলেই দিনেওয়ান মা আর সময় নষ্ট না করে গুম্বলগাবনের কাছে চলে গেল তারা কি করেছে জানাতে। সে ছুটে গেল সেই সমতলে, যেখানে  গুম্বলগাবনের সাথে তার দেখা হয়েছিল । গুম্বলগাবন তখনও সেখানে পা মুড়ে বসে ছিল, তাকে দেখে দিনেওয়ান মা বললঃ দেখ, আমিও তোমার মত করেছি। আমার এখন কোন ডানা নেই। সেগুলি কাটা হয়ে গেছে।"

"হা!হা!হা!" হেসে উঠল গুম্বলগাবন, আর তড়াক্‌ করে লাফিয়ে উঠে আনন্দে নাচতে লাগল, কারণ তার দুষ্টবুদ্ধি সফল হয়েছে। নাচতে নাচতে সে তার ডানাদুটিকে ছড়িয়ে দিল, সেগুলিকে ঝাপটাল, আর বললঃ "এইবার, এইবার তোমাকে বাগে পেয়েছি। আমার ডানাদুটোতো ঠিকই আছে। তোমরা দিনেওয়ানেরা, কি বোকা, যা শোনো, তাই বিশ্বাস কর ! তোমরা আবার রাজা হতে চাও! হা! হা! হা! " এই ভাবে উপহাস করে, গুম্বলগাবন নিজের ডানাদুটিকে দিনেওয়ানের নাকের সামনে ঝাপটিয়ে  দিল। দিনেওয়ান তাকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য শাস্তি দিতে এগিয়ে এল, কিন্তু গুম্বলগাবন উড়ে পালিয়ে গেল, আর দিনেওয়ান - হায়! ডানাবিহীন দিনেওয়ান আর তার পিছু নিয়ে উড়তে পারল না।

নিজের ভুল বুঝতে পেরে, দিনেওয়ান মা ফিরে গেল, আর ভাবতে লাগল কিভাবে এর প্রতিশোধ নেবে। কিভাবে? সে আর তার সঙ্গী বেশ কিছুদিন ভেবেও কোন উপায় খুঁজে পেল না। কিন্তু তারপরে, দিনেওয়ান মায়ের মাথায় একটা বুদ্ধি এল, আর সে সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজ করার জন্য বেরিয়ে পড়ল। সে দু'টি বাদে, তার বাকি সব সন্তানদের একটা বড় কাঁটাঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখল। তারপরে সে সেই সমভূমিতে নেমে গেল, সাথে তার দুটি ছানা। গিরিখাতের ওপর থেকে নামতে নামতে সে দেখতে পেল, গুম্বলগাবন তার বারোটা ছানাকে খাওয়াচ্ছে।

সেখানে পৌঁছে, গুম্বলগাবনের সাথে এটা ওটা হাবিজাবি কথা বলে,  দিনেওয়ান মা তাকে বলল ,"  তুমি আমাকে নকল করে শুধুমাত্র দুটি সন্তান রাখ না কেন? বারোটা ছানাকে খাওয়ানো কি সোজা কথা ! এতগুলো বলেই , তোমার ছানারা কোনদন দিনেওয়ানদের মত বড় হয়ে উঠবে না। যে খাবারে দুটো বড় পাখি তৈরি হতে পারে, বারোটা পাখির তো তাতে খিদেই মিটবে না ।"  গুম্বলগাবন মা কিছু বলল না, কিন্তু মনে মনে ভাবল, এটা ঠিক কথা হতেও পারে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে দিনেওয়ান ছানারা গুম্বলগাবন ছানাদের থেকে অনেক বড় আকারের হয়। মনের মধ্যে অশান্তি নিয়ে গুম্বলগাবন মা হেঁটে চলল, আর ভাবতে থাকল, সত্যিই কি তার সন্তানেরা সংখ্যায় বেশি বলে আকারে দিনেওয়ানদের থেকে অনেক ছোট? দারুণ ব্যাপার হবে, সে ভাবল, যদি তার সন্তানেরাও দিনেওয়ানদের মত বড় বড় হয়। কিন্তু তার মনে পড়ল, সে মা দিনেওয়ানের সাথে কি চালাকি করেছিল, আর তার সন্দেহ হল- এবার হয়ত মা দিনেওয়ান তাকে বোকা বানাতে চাইছে। দিনেওয়ানেরা যেখানে ঘুরে ঘুরে খাচ্ছিল, সেইদিকে ফিরে তাকাল সে , আর সে দেখতে পেল দিনেওয়ানের ছানাদুটি তার ছানাদের থেকে কতটা বড়, আর অমনি তার মন আবার প্রবল হিংসায় ভরে গেল। সে ঠিক করল সে কিছুতেই হেরে যাবে না। দরকার পড়লে সে দুটি বাদে তার বাকি সব ছানাদের মেরে ফেলবে। সে বলল, "দিনেওয়ানেরা কিছুতেই সমভূমির রাজা হতে পারবে না। তাদেরকে সরিয়ে দেবে গুম্বলগাবনেরা। তারা দিনেওয়ানদের মত বড় হবে, আর তাদের ডানাও থাকবে আর তারা উড়তে পারবে, যা এখন দিনেওয়ানেরা পারেনা। "
গুম্বলগাবন মা সোজা গিয়ে দু'টি বাদে তার বাকি সব সন্তানদের মেরে ফেলল। তারপরে সে চলল সেই জায়গায় যেখানে দিনেওয়ানেরা খাচ্ছিল। দিনেওয়ান মা যখন তাকে আসতে দেখল, সাথে মাত্র দুটি ছানা নিয়ে, তখন সে হেঁকে বলল ঃ "তোমার বাকি ছানাগুলি কোথায়?"

গুম্বলগাবন মা উত্তর দিল, "আমি তাদেরকে মেরে ফেলেছি, আর মাত্র দুটিকে বাঁচিয়ে রেখেছি। ওরা এখন প্রচুর খেতে পাবে, আর খুব তাড়াতাড়ি তোমার ছানাদের মত বড় হয়ে যাবে।"

"তুমি কি নিষ্ঠুর মা, তুমি নিজের সন্তানদের মেরে ফেললে! তুমি কি লোভী ! কেন, আমারো তো বারোটা সন্তান আছে, আর আমি তাদের সবার জন্য খাবার খুঁজে আনি। আমি কোন কারণেই তাদের একজনকেও মারব না, তাতে যদি আমার ডানা ফিরে আসে, তাহলেও না। এখানে সবার জন্য যথেষ্ট খাবার আছে। দেখ এই বেরি গাছটা কেমন আমার বিরাট পরিবারের সবার জন্য ফলে ভরে আছে। দেখ কেমন করে গঙ্গাফড়িংগুলি লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে, যাতে আমরা ওদেরকে ধরে খেতে পারি আর সবল হতে পারি।"

"কিন্তু তোমার তো মোটে দুটি সন্তান !"

" আমার বারোটা সন্তান আছে। আমি গিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসছি।" এই বলে দিনেওয়ান মা সেই কাঁটাঝোপের দিকে দৌড়ে গেল যেখানে সে তার দশটি সন্তানকে লুকিয়ে রেখেছিল। একটু পরেই তাকে দেখা গেল ফিরে আসতে। তার গলা সামনের দিকে বাড়িয়ে, তার মাথা গর্বে উঁচু করে, তার ল্যাজের পালকগুলি নাড়াতে নাড়াতে সে দৌড়ে আসছিল,   আর অদ্ভূত আনন্দের একটা গান গাইছিল। তার পেছনে পেছনে আসছিল ছোট্ট নরম সাদা কালো পালকে ঢাকা তার সন্তানেরা, নিজেদের মধ্যে কলকল করতে করতে। যখন দিনেওয়ান মা গুম্বলগাবন মায়ের কাছে পৌঁছাল, তখন সে খুব শান্ত গলায় বলল, "এখন তুমি দেখতে পাচ্ছ আমার কথা সত্যি ছিল, আমার বারোটা সন্তান আছে, যেমন আমি বলেছিলাম। তুমি আমার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে নিজের মেরে ফেলা সন্তানগুলির কথা ভাবতে পার। আর এখন আমি তোমার বংশধরদের ভবিষ্যত তোমাকে বলব । তুমি মিথ্যে কথা বলে, চালাকি করে দিনেওয়ানদের ডানা হারাতে বাধ্য করেছ, আর এখন থেকে, যতদিন অবধি দিনেওয়ানেরা তাদের ডানা ফিরে পাবে না, ততদিন অবধি গুম্বলগাবনেরা শুধুমাত্র দুটো করে ডিম পাড়বে, আর তাদের মাত্র দুটো করেই ছানা হবে। আমাদের যুদ্ধের এখানেই সমাপ্তি। তোমার কাছে রইল তোমার ডানা, আর আমার কাছে আমার সন্তানেরা।"

আর সেই সময় থেকেই, দিনেওয়ান, বা এমু পাখির কোন ডানা নেই, আর গুম্বলগাবন , বা বাস্টার্ড পাখিরা, এক ঋতুতে মাত্র দুটো করে ডিম পাড়ে।

অস্ট্রেলিয়ার উপকথা

ভাষান্তরঃ
মহাশ্বেতা রায়
কলকাতা

ছবিঃ
ইন্টারনেট

 

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।