খেলাঘরখেলাঘর

গের

এই যে বন্ধু , তোমাকে আজ আমি কয়েকটা প্রশ্ন করবো .... দেখি তো তুমি উত্তর দিতে পারো কিনা ...
১. বলো তো কোন দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা কেবল মাত্র একটি শহরে বাস করে ?
২. কোন দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা তাঁবুতে থাকে ?
৩. কোন দেশের রাজধানীকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা রাজধানী বলা হয় ?
কি বললে, জানো না ?
আচ্ছা, তাহলে আমিই নাহয় বলে দিচ্ছি । সেই দেশটার নাম হলো মঙ্গোলিয়া । চীন আর রাশিয়ার মাঝে অবস্থিত এই দেশটি এক সময় চেঙ্গিজ খানের রাজ্যের রাজধানী ছিলো । প্রায় ৭০ বছর রাশিয়ার অধীনে থাকার পর ১৯৯০ সালে মঙ্গোলিয়া স্বাধীনতা লাভ করেছিলো ।
বহু যুগ আগে থেকেই এই দেশের বাসিন্দারা যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত । এখনো এই দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা তাঁবুতে বাস করে । এদের মূল ব্যবসা হচ্ছে পশুপালন । তাছাড়াও এরা ছাগল, ভেড়া বা উটের লোম থেকে উল তৈরী করে । এই দেশের এক বিখ্যাত দ্রব্য হচ্ছে কাশ্মির উল যা এখানকার কাশ্মির ছাগলের লোম থেকে তৈরী হয় । আমাদের দেশে এই উল্‌কে পশমিনা উল বলা হয় ।
কিন্তু আজ আমি তোমাদের এই দেশের প্রধান বাসার কথা বলতে চাই । যেহেতু এই দেশের বেশিরভাগ লোক যাযাবর জীবনযাপন করে, সেহেতু তারা পাকা বাড়ি ঘরে  না থেকে, এক বিশেষ ধরনের তাঁবুতে থাকে । এই তাঁবু কে এরা গের বলে । এটাই এদের ড্রইং রুম, এটাই বেডরুম, আবার এটাই এদের রান্নাঘর । সব কিছুই এই তাঁবুর ভেতরে ।
এই ধরনের তাঁবু মঙ্গোলিয়ার সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায় । এই গোলাকার তাঁবুগুলি সাদা বা ছাই রঙের মোটা উলের কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে । প্রত্যেকটি পরিবারের একটি বা দু-তিনটে গের থাকে । এই তাঁবু গুলি লাগানো খুব সহজ । একটি তাঁবু লাগাতে প্রায় দু ঘন্টা সময় লাগে । আর খুলতে এক ঘন্টা । আমি তোমাকে বোঝানোর জন্য বেশ কয়েকটি ছবি দিলাম এখানে ।

গের


তাঁবুর দেয়ালটা কাঠের ঝাঁঝরি/জাল দিয়ে তৈরি । মাঝখানে একটি গোলাকার বলয় থাকে যা দুটো শক্ত-পোক্ত কাঠের ওপর লাগানো হয় ।

গের


চারপাশের কাঠের জাল আর মাঝের বলয়ের মাঝে থাকে অনেকগুলো লম্বা লম্বা কাঠের ডান্ডা । তোমরা সাইকেলের চাকা দেখেছ তো । সাইকেলের চাকায় যেমন ভাবে স্পোক গুলো সাজানো থাকে, মোটামুটি ঐরকম ভাবে সাজানো থাকে এই ডান্ডা গুলো । তাঁবুর দরজা সব সময় দক্ষিন দিকে থাকে ।

গের


একবার এই ফ্রেম টি তৈরি হয়ে গেলে, তারপর এর ওপর মোটা উলের কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় । এই সব কিছুই মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় যাতে বাতাসে  উড়ে না যায় ।

গের


শীতকালে এখানে তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর নিচে চলে যেতে পারে । তাই শীতের সময় আরও বেশি উলের কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে তাঁবুর ভেতরটা গরম থাকে । গরমকালে তাঁবুর নীচের দিকের কাপড়গুলো উল্টে ওপরে উঠিয়ে দেওয়া হয় যাতে ভেতরে হাওয়া আসতে পারে ।

গের

গের


তাঁবু গুলোকে গরম রাখার জন্য, তাঁবুর মাঝামাঝি জায়গায় একটি করে লোহার চুল্লি রাখা হয় । এতে কাঠের টুকরো, গোবর বা কয়লা জ্বালানো হয় যাতে এটি গরম হয়ে যায় আর তাঁবুকে গরম রাখে । তাঁবুর ভেতরে যাতে ধুঁয়ো না হয় তার জন্য এই চুল্লির ওপরে একটি লোহার পাইপ ফিট করা থাকে যাতে কাঠের ধুঁয়ো তাঁবুর বাইরে চলে যায় ।
তাঁবুতে কোন জিনিষটা কোথায় থাকবে তার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে । তাঁবুতে কোনো অতিথি এলে তাকে তাঁবুর বাঁদিকে বসানো হয় । গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের  তাঁবুর ভেতরের দিকে আর অন্যদের দরজার কাছে বসানো হয় । পরিবারের লোকেরা তাঁবুর ডানদিকে বসে । রান্নাঘরের জিনিসপত্র ডানদিকে রাখা হয় । পূজোর স্থান দরজার ঠিক উল্টো দিকে । বিছানা দরজার বাম এবং ডান দিকে রাখা হয় ।

গের


আজকাল অনেক গেরে আধুনিক সুবিধে সম্পন্ন জিনিসপত্র রাখা থাকে । যেমন কি সোলার পাওয়ার প্যানেল, টিভি, ফ্রিজ, অ্যান্টেনা, ওয়াশিং মেশিন, ইত্যাদি ।

গের


এই ধরণের তাঁবুতে থাকার সুবিধে হচ্ছে যে যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে যাওয়া যায় । শীতকালে এরা ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা জায়গায় তাঁবু পেতে থাকে । আবার গরমকালে তাঁবু গুটিয়ে, ঘোড়াগাড়ী করে পাহাড়ি অঞ্চল ছেড়ে সমতল ভূমিতে চলে আসে যাতে পশুরা (ঘোড়া, উট, ভেড়া, ছাগল, গরু) ঘাস খেতে পায় ।


লেখা ও ছবিঃ
ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য
উলান বাটর, মঙ্গোলিয়া

 

ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য্যি ফলিত ভূতত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পেশায় ভূতাত্বিক হলেও আসল নেশা ফটোগ্রাফি এবং লেখালিখি। কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, অস্ট্রেলিয়া এবং মঙ্গোলিয়ায়। ভূতাত্বিক হওয়ার সুবাদে প্রকৃতির নিত্য পরিবর্তনকে এবং ক্রিয়া-প্রক্রিয়াকে সহজে অনুভব এবং বিশ্লেষণ করেন।