খেলাঘরখেলাঘর

গ্রীষ্মের বিরতি পেরিয়ে আর কিছুদিনের মধ্যেই আবার শুরু হতে চলেছে ইউরোপের বড় বড় ফুটবল লীগগুলোর নতুন বছর। তার আগে চলছে ক্লাবগুলোর খেলোয়াড় কেনা-বেচার পর্ব, আর অনুশীলন ম্যাচ খেলে নতুন বছরের প্রস্তুতি। তুমিও হয়তো মাঝেমাঝেই খবরের কাগজে আর টেলিভিশনের খেলার চ্যানেলে দলবদলের আর প্রস্তুতিপর্বের ম্যাচগুলোর খবর দেখে নিচ্ছ। ক্লাব ফুটবলের পাশাপাশি খবরের কাগজের খেলার পাতাকে ব্যস্ত রাখছে  আন্তর্জাতিক ফুটবলের নিত্যনতুন খবরও।  কিছুদিন আগেই শেষ হল "কোপা আমেরিকা" টুর্নামেন্ট। ধরো এই পৃথিবীতে যদি দক্ষিণ আমেরিকাই একমাত্র মহাদেশ হত তাহলে কোপা আমেরিকার নাম হত বিশ্বকাপ। মানে এটা হল দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। আর প্রতিবারের মত এবারেও মহাদেশের বাইরের কয়েকটি দেশও আমন্ত্রিত হয়েছিল। এদের মধ্যে স্পেন আর জাপান আমন্ত্রণ রক্ষা করতে না পারলেও টুর্নামেন্টে খেলতে এসেছিল মেক্সিকো আর কোস্টারিকা।

তুমি নিশ্চয়ই খেলা দেখেছ বা খবর রেখেছ কি ভাবে একের পর এক অঘটন ঘটে গেছে এবারের কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে। টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট ব্রাজিল গত বিশ্বকাপের দলে অনেক পরিবর্তন করেও পৌঁছতে পারল না সেমিফাইনালে। একই পরিণতি হল আয়োজক দেশ তারকাখচিত আর্জেন্টিনার। ফাইনালে লুই সুয়ারেজের গোল আর দিয়েগো ফোরলানের জোড়া গোলে প্যারাগুয়েকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল উরুগুয়ে। কিন্তু খেলা দেখে থাকলে হয়তো উপলব্ধি করেছ যে এইরকম একটি মহাদেশ, যেখানে ফুটবল খেলাটা শুধু জনপ্রিয় বললে খুব কম বলা হয়, যে মহাদেশের ব্রাজিল ৫ বার, আর্জেন্টিনা ২ বার আর উরুগুয়ে ২ বার বিশ্বকাপ জিতেছে, সেই মহাদেশের এরকম একটা বড় টুর্নামেন্টে কখনোই দেখা যায়নি প্রত্যাশিত উঁচুমানের ফুটবল। অথচ এই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ের খেলোয়াড়েরাই দাপিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্লাব ফুটবলে। স্বভাবতই আপামর ফুটবলপ্রেমী মানুষের মনে যে প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসে তা হল - তাহলে কি আজকের এই ক্লাব ফুটবলের রমরমার দিনে ধীরে ধীরে তার চিরাচরিত জৌলুস হারাচ্ছে আন্তর্জাতিক ফুটবল? আজ চলো সেই নিয়েই তোমার সাথে একটু গল্প আর আলোচনা করি।

ফুটবল
২০১১ কোপা আমেরিকা জয়ী উরুগুয়ে দল

যদি আর বছরখানেক পিছিয়ে গিয়ে ২০১০-এর বিশ্বকাপ ফুটবলের কথা ভাব, সেখানেও দেখবে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে কিন্তু দেখা যায়নি সর্বোচ্চমানের ফুটবল। ভাল খেলা নিশ্চয়ই দেখেছ, ভাল গোল দেখেছ, নামী-অনামী তারকাদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখছ, কিন্তু সেভাবে দলগতভাবে আকর্ষণীয় বা আক্রমণাত্মক ফুটবল দেখা যায়নি। যেমন স্পেন বিশ্বকাপ জিতলেও যে দলের বেশীরভাগ খেলোয়াড় বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদে খেলেন, সেই স্পেনের খেলা কিন্তু কখনোই ঐ দুটি ক্লাবের খেলার মত উঁচু পর্যায়ে যায়নি। অনেকসময় ভাবলে অবাকই হতে হয় যে এই একই ফুটবলারেরা প্রতি সপ্তাহে ক্লাব ফুটবলে চিত্তাকর্ষক খেলার মাধ্যমে আমাদের আনন্দ দিয়ে থাকে।

আজ থেকে যদি বেশ কিছু বছর পিছিয়ে গিয়ে ভাবতে শুরু করি, যখন স্যাটেলাইট টেলিভিশন ঘরে ঘরে আসেনি, যখন আমাদের প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন ফুটবল লীগের খেলা দেখার সুযোগ ছিলনা, যখন ইন্টারনেটের কল্যাণে সবকিছুর এত খুঁটিনাটি খবর রাখাও সম্ভব ছিলনা, তখনও কি আজকের প্রশ্নটা আমাদের অতটাই নাড়া দিত? তোমার কি মনে হয়? আমার তো মনে হয়না। তখন তো দেশের বাইরের ফুটবল দেখার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হত যে কবে হবে বিশ্বকাপ বা ইউরো কাপ বা এশিয়া কাপ বা কোপা আমেরিকা। তার সাথে খবরের কাগজ আর খেলার ম্যাগাজিনে জানা যেত তারকা ফুটবলারদের গল্প। কখনও কখনও কদাচিত টেলিভিশনে দেখাও যেত বিভিন্ন খেলার টুকরো টুকরো অংশ। এই সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বকাপ বা কোন বড় টুর্নামেন্টের প্রাক্‌কালে আমাদের উত্তেজনা পৌঁছত চরমে আর কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা টুর্নামেন্টের খেলা টেলিভিশনে দেখে আমাদের সেই উত্তেজনার প্রশমন আর মনের তৃপ্তি ঘটত। ফুটবলের গুণগত মান যা দেখতাম তা ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা দেখে অভ্যস্ত তার থেকে অনেকগুণ উঁচুমানের। তাই সেই মুগ্ধতার বাইরে সমালোচনা করার আর খুব একটা সময় থাকত না। এখন আমরা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের দৌলতে বিভিন্ন দেশের আর বিভিন্ন লীগের খেলা প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন চ্যানেলে দেখতে পারি। আর তাছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইটে খুঁটিনাটি খবরাখবর আর খেলার বিশ্লেষণ তো হাতের নাগালে আছেই। এখন তাই আমরা সর্বোচ্চমানের খেলার স্বাদ পেয়ে তার সমতুল্য কিছু না হলেই সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠি। কিন্তু আন্তর্জাতিক ফুটবল আর ক্লাব ফুটবলের গুণগত মানের যে তারতম্য এই কারণটা কি? একটু ভাবলেই একটা জিনিস খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে। এই ধরো ক্লাবে যে ফুটবলারেরা একসাথে খেলে, তারা বছরের পর বছর ধরে একসাথে প্রতিদিন ওঠাবসা করে। এই দীর্ঘসময় একসাথে খেলার জন্য নিজেদের মধ্যে একটা সুন্দর বোঝাপড়া তৈরী হয়। আর তারই প্রতিফলন দেখা যায় দলের খেলায়। তাই ক্লাবের হয়ে খেলার সময় দেখলেই মনে হয় তাদের ভাবনাচিন্তাগুলো যেন এক সুতোয় বাঁধা। এই জিনিসটাই দেশের হয়ে খেলার সময় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রুপায়ণ করাটা খানিকটা অসাধ্যই বটে।

ফুটবল
মেসি এখনও অবধি বার্সেলোনায় তার খেলা আর্জেন্টিনার হয়ে খেলতে পারেননি

 

ফুটবল
ওয়েন রুনি ইংলিশ লীগের সাফল্য এখনও অবধি ইংল্যান্ডের হয়ে দেখাতে পারেননি


আন্তর্জাতিক ফুটবলের ক্ষেত্রে কোন বড় প্রতিযোগিতার আগে হয়তো বড়জোড় ৩/৪ সপ্তাহের প্রস্তুতি থাকে। সেই সময়ের মধ্যে ঐ মানের বোঝাপড়া তৈরী করা কখনোই সম্ভব না। আর এটা গড়ে ওঠার আগেই টুর্নামেন্টই শেষ হয়ে যায়। দলের কোচদের কাজটাও তাই একটু আলাদা থাকে। ক্লাব ফুটবলে যেমন একজন কোচের কাছে একটা খেলার ধরণ স্থাপন করার মত সময় বা স্বাধীনতা থাকে, আন্তর্জাতিক ফুটবলে কোচেরা সেই সুযোগ পায়না। তাদের মুখ্য কাজ থাকে প্রথমে দলের রক্ষণ সামলে আক্রমণে ওঠা, নিজের দলের সেরা ফুটবলারদের থেকে যতটা সম্ভব ভাল খেলা বের করে আনা, সবাইকে খুশি রেখে দলে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়া তৈরী করা, আর খুব গুরুত্বপুর্ণভাবে প্রত্যাশিত ফলের জন্য সঠিক দল নির্বাচন করা। তাই এরকম রাশিরাশি উদাহরণ পাবে কিছু কোচ শুধু ক্লাবের ফুটবল কোচিং-এই বেশী সাবলীল, আর কিছু দেশের ফুটবল কোচিং-এ।

ফুটবল
মিরোস্লাভ ক্লোসে অন্যদিকে জার্মানীর হয়ে খেলায় সাংঘাতিক সফল - কিন্তু ক্লাব ফুটবলে সেইভাবে নন

এবারে হয়তো খানিকটা বুঝতে পারছ এই তারতম্যের কারণ। তবে তাই বলে যে আন্তর্জাতিক ফুটবলের আকর্ষণ কমে যাবে তাও ঠিক নয়। কারণ শুধুমাত্র ফুটবল ছাড়াও তার সাথে জড়িয়ে থাকবে সেই দেশের দর্শকদের সমর্থনের মত্ততা, তাদের সংস্কৃতি। আর সব মিলিয়ে তা পেয়ে যাবে একটা অন্য আমেজ। তাই দুটোর মধ্যে তুলনা না করে আমরা বরং শুধু আনন্দটাই উপভোগ করি। আর এর মধ্যে তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে পরবর্তী আড্ডায় আসর জমজমাট করে তোলার একটা আলোচনার বিষয় তো পেয়েই গেলে।


লেখাঃ
পাভেল ঘোষ
হিলস্‌বোরো, ওরেগন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র

ছবিঃ
বিভিন্ন ওয়েবসাইট

 

পাভেল ঘোষ পোর্টল্যান্ড, ওরেগন এর বাসিন্দা। কম্পিউটার এর খুঁটিনাটি নিয়ে পড়াশোনা ও কাজকর্ম করার ফাঁকে ফাঁকে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন; আর্সেনাল ক্লাব-এর একনিষ্ঠ ভক্ত।