খেলাঘরখেলাঘর

ঘুরে বেড়াতে কার না ভালো লাগে বলো? আর সেই সঙ্গে যদি কিছু জানতে পারা যায়, তাহলে তো কথাই নেই। কাজে কর্মে এদিক ওদিক চষে বেড়িয়েছি অনেক। আর সেই সঙ্গে গপ্পের স্টকও জমেছে বিস্তর। সেই সব অসংখ্য গল্পের মধ্যে একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে ইংল্যান্ডের একটি শহর - বৃস্টল। আজ সেই শহরের কথাই বলব ঠিক করেছি। বৃস্টল শহরটা কেন বিখ্যাত বাঙালীদের কাছে জানো কি? বাংলার নবজাগরনের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি আছে এই শহরে। বৃস্টলে আমি গিয়েছিলাম দুবার, প্রথমবার ২০০৭ এ। কিন্তু আফশোসের বিষয়, সেবার কাজ শেষ হতে হতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। ফলে আমি যখন রামমোহনের সমাধিতে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন গেট বন্ধ হয়ে গেছে। আশ্চর্যের বিষয়, সেই শহরটাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুজোগ এসে গেল আবার – ২০০৯ সালের অগস্ট মাসে।

বৃস্টল
বৃস্টল শহরের একটি পাড়া, রাস্তার পাশেই আপেলগাছ

বৃস্টল শহরটা লন্ডনের বেশ কাছেই। খুব বেশী হলে আড়াই ঘণ্টার মত লাগে ট্রেনে। এমনিতেই দেশটা ছোট, ফলে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ট্রেনেই যাতায়াত করা যায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে। শহরটা অনেক ছড়ান। প্রথমেই যেখান গেলাম সেই জায়গাটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির বাগানে একটা করে আপেল গাছ – আর গাছ ভর্তি লাল আপেল, কেবল পেড়ে নেওয়ার অপেক্ষা। এই জায়গাটার আবার আরেকটা গুরুত্ব ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানেই ছিল একটি আপৎকালীন রানওয়ে। এখন সেই রানওয়ে কিছুটা হলেও আছে। তবে সেখান থেকে প্লেন ওড়ার আর সুযোগ নেই। তার বদলে শনিবার শনিবার হাট বসে।

বৃস্টল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রানওয়ে

সে হাটও বিচিত্র রকমের। সেখানে যে যার গাড়ি করে বেচার জিনিস নিয়ে আসে। বেশীর ভাগই পুরনো ব্যবহৃত জিনিস বিক্কিরি হয় সেখানে। এটা অবশ্য বৃস্টল না – ওদেশের অনেক শহরেই চলে যেখানে লোকে এসে তার অপ্রয়োজনীয় জিনিস বেচে, আর যার দরকার সে সস্তায় কিনে নিয়ে যায়।

পৌঁছেছিলাম সকাল সকাল। তবু প্রথমেই ছুটলাম রামমোহন রায়ের সমাধির দিকে। রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি রয়েছে এমন এক অভিজাত সমাধিস্থলে যেখানে রয়েছেন ইংল্যান্ডের অনেক বরেন্য মনীষী। ভাবতেই অবাক লাগছিল যে এর মধ্যে রয়েছেন রাজা রামমোহনের মত এক অবিস্মরনীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর সমাধিতে হাত রেখে মনে হল ইতিহাসকে ছুঁলাম আমি।

বৃস্টল

এখানে একটা কথা না বললে ইতিহাসের গল্প অসমাপ্ত থেকে যাবে। আমি ছোটবেলায় কেবল এইটুকুই পড়েছিলাম যে রামমোহন সরকারি কাজে আসেন ইংল্যান্ডে কিন্তু ফিরে আসতে পারেন নি। সমাধিতে লেখা ইতিহাস থেকে জানতে পারি তিনি এসেছিলেন রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের অভিষেক অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে। মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি দেওয়া হয় স্টেপলটন গ্রুভে – আরো অনেক সাধারন মানুষের সাথে। পরে ১৮৪২ সালে তাঁর বন্ধু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংল্যানে এসে এই অভিজাত সমাধিস্থলে স্থানান্তরিত করেন এবং শুধু তাই নয় – এই ছবিতে যে মন্দির দেখছি সেটি নির্মান করিয়ে দেন।

বৃস্টল

এই প্রসঙ্গে সেই শ্বেত পাথরের ফলকটির ছবিও এখানে দিলাম যেখান থেকে এই ঘটনা জানতে পারি। এখন আবার সেই সমাধিটি যত্ন সহকারে মেরামত করে রাখা হয়েছে।

বৃস্টল

বৃস্টল শহরের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো এই ব্রিজ – যার নাম ক্লিফটন ব্রিজ। দুই পাহাড়ের মাথায় যোগাযোগ করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্রিজের যে দুটি স্তম্ভ দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে গভীরে নেমে আসা যায় সিঁড়ি বেয়ে আর এই ব্রিজ, নিচের নদী, গভীর খাদ সব দেখা যাবে পাহাড়ে গায়ের একটি ফোকর থেকে।

বৃস্টল

বৃস্টল শহরটা কিন্তু দেখতে গেলে লন্ডনের চেয়ে কম পুরনো নয়। তবে এক কালে যে শহরের এত নামডাক ছিল বন্দরের কারনে, আজ সেই বন্দর অতীত গৌরব কিছুটা হলেও হারিয়েছে। সেটা হয়তো সামগ্রিকভাবে জাহাজে যাতায়াতের প্রয়োজন কম হওয়াতে। নইলে বৃস্টলের বন্দরের কথা পুরনো গল্প উপন্যাসে হামেশাই ফিরে আসে। বৃস্টল শহর থেকে ঘুরে এসেছি সেই কবে, তাও যে দুটো ছবি  এই শহরের কথা বার বার মনে করিয়ে দেয়, তা যদি না দেখাই তাহলে এই গল্পই অসমাপ্ত থেকে যাবে।

বৃস্টল

বৃস্টল

ছবি দুটো কেমন লাগল, আমাকে জানিও কিন্তু।

 

 

 

লেখা ও ছবিঃ
অভ্র পাল
কলকাতা