খেলাঘরখেলাঘর

ক্যালেন্ডার

ক্যালেন্ডার

ইংরেজি ক্যালেন্ডার আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ। তবে এই ক্যালেন্ডারের প্রবর্তক কোন ইংরেজ নয়। ষোড়শ শতকে পূর্ববর্তী জুলীয় ক্যালেন্ডারকে বিজ্ঞানীদের সুপারিশ অনুসারে সংস্কার করে ইতালির পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী এই ক্যালেন্ডার চালু করেন। তাই এই ক্যালেন্ডারকে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার বলাই যুক্তিসঙ্গত।

বাংলা ক্যালেন্ডারের ব্যবহার বড় একটা দেখা যায় না আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। তবুও আমাদের একটা ক্যালেন্ডার আছে। সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষের দি্নটিতে (১৪/ ১৫ই এপ্রিল) আমরা মন্দিরে পুজো দিতে যাই, পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাই। ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা খোলেন। বছরের কিছু কিছু দিন বাংলা তারিখেই আমাদের কাছে সুপরিচিত, যেমন পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, বা এগারোই জ্যৈষ্ঠ। গ্রেগরীয় ক্যালন্ডারের বছর সংখ্যা থেকে ৬০০ বিয়োগ করে ৭ যোগ করলে , ওই বছরের বেশি সময় জুড়ে যে বাংলা বছর, তার সাল জানা যায়। যেমন, এই বছর হল (২০১১-৬০০)+৭= ১৪১৮ বঙ্গাব্দ।

বাংলা ক্যালেন্ডার কে প্রথম চালু করেন তাই নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন মুঘল সম্রাট আকবর, আবার কেউ বলেন বাংলার রাজা শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। কারো হাতেই সুনিশ্চিত কোন প্রমাণ নেই। তাই এই প্রশ্নটা আপাতত শিকেয় তোলা থাক।

সূর্য পৃথিবীর ওপরে আকাশের একদিক থেকে অন্যদিকে যাতায়াত করছে - পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এইরকমই মনে হয় ( যদিও আমরা জানি আসলে ব্যাপারটা অন্যরকম)। বছরের বিভিন্ন সময়ে মহাকাশে সূর্যের অবস্থান বদলায়। এইসব অবস্থানগুলি নিয়ে একটি কাল্পনিক বৃত্তাকার পথ পাওয়া যায়। এই পথকে সমান বারোভাগে ভাগ করলে এক একটি ভাগে বিভিন্ন নক্ষত্র নিয়ে সিংহ, ভেড়া, বিছে ইত্যাদির ছবি পাওয়া যায়। সেই অনুযায়ী এদের নাম হয়েছে সিংহ রাশি,মেষ রাশি, বৃশ্চিক রাশি ইত্যাদি। মহাকাশের পটে আঁকা মানুষের এইসব কাল্পনিক ছবির সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্য, চাকরি, পরীক্ষা, বিয়ে, ব্যবসা ইত্যাদির কোন সম্পর্ক নেই।

মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ, মীন - এই বারোটি রাশির এক একটিতে সূর্য বাংলা বছরের এক একটি মাস কাটায় (অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দেখলে তাই মনে হয়)। কোন রাশিতে সূর্য কতদিন থাকবে সেই হিসাব বছর বছর বদলায়। তাই বাংলা মাসগুলিতে দিনের সংখ্যা প্রতি বছর এক হয় না।

পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। তাই বছরের বিভিন্ন সময়ে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বাড়ে কমে। আমাদের, অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল তখন পৃথিবী সূর্যের থেকে দূড়ে থাকে। কেপলারের সূত্র অনুসারে এই সময়ে পৃথিবীর গতিবেগ কমে যায়। তাই মনে হয় সূর্য যেন দীর্ঘসময় ধরে অবস্থান করছে মেষ, বৃষ, মিথুন ও কর্কট রাশিতে। সূর্য যথাক্রমে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে থাকে এই চারটে রাশিতে। এই চারমাসে তাই দিনের সংখ্যা বেশি হয়। কোন কোন মাসে ৩২ দিনও থাকে। আবার আমাদের যখন শীতকাল, তখন উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবী সূর্যের কাছে চলে আসে। পৃথিবীর গতিবেগ যায় বেড়ে। তাই, পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে মনে হয় সূর্য যেন দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর ও কুম্ভ রাশি। কার্তিক থেকে ফাল্গুন - এই পাঁচ মাসে তাই দিনের সংখ্যা কম। কোন কোন মাসে ২৮ দিনও থাকে।

প্রাচীন জ্যোতির্বিদেরা বাংলা মাসের নামকরণ করেছিলেন বছরের বিভিন্ন সময়ে চাঁদের অবস্থান অনুযায়ী। বছরের প্রথম মাসে পূর্নিমার রাতে চাঁদকে তুলা রাশির পটভূমিকায় দেখা যায়। এই রাশির বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে বছরের প্রথম মাসের নাম দেওয়া হয়েছিল বৈশাখ। বছরের দ্বিতীয় মাসে পূর্নিমার রাতে চাঁদ থাকে বৃশ্চিক রাশিতে। এই রাশির জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের থেকেই, দ্বিতীয়া মাসের জৈষ্ঠ নামটি এসেছে। এইভাবে বছরের বিভিন্ন মাসে পূর্নিমার রাতে চাঁদের কাছে কোন নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে সেই অনুযায়ী মাসগুলির নামকরণ করা হয়েছিল , যেমন শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, চিত্রা থেকে চৈত্র ইত্যাদি।

ইসলামধর্মীরা পুরোপুরি চান্দ্র ক্যালেন্ডার মেনে চলেন। এক চান্দ্র বছর মানে ৩৫৪ দিন। এক একটি পালা পার্বণ আসে এক চান্দ্র বছর পরে, অর্থাৎ সৌর ক্যালেন্ডারে দিনটা আসে ১০-১১ দিন আগে। সৌর ক্যালেন্ডার ধরে ক্রমাগত এগিয়ে চলে চান্দ্র ক্যালন্ডার। তাই আমরা দেখি বছরের বিভিন্ন ঋতুতে পাওয়া যাচ্ছে ঈদ বা মহরমের ছুটি।

হিন্দুদের যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানও চান্দ্র ক্যালেন্ডার মেনেই হয়। কিন্তু বছরের নির্দিষ্ট ঋতুতেই পড়ে এক একটি উতসব। কখনই শীতকালে দুর্গাপুজো বা গ্রীষ্মকালে সরস্বতীপুজো হতে দেখা যায় না। তার কারণ প্রতি ৩২-৩৩ মাসে সৌর ও চান্দ্র ক্যালেন্ডারের পার্থক্য গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় একমাস। এই বাড়তি মাসটাকে 'মলমাস' বা শুভকাজ বর্জিত মাস হিসাবে চান্দ্র ক্যালেন্ডারে ঢুকিয়ে যাবতীয় পালা পার্বণ প্রায় একমাস করে পিছিয়ে দেওয়া হয়। তাই আমরা দেখি কোন বছর অক্টোবরের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে পুজো পড়লে, তার পরের দুইবছর পুজো এগোতে এগোতে চলে আসে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। কিন্তু তারপরের বছর ঈদ বা মহরমের পর পুজো ণা এগিয়ে বরং পিছিয়ে যায় প্রায় একমাস। এইভাবে হিন্দুরা চান্দ্র ক্যালেন্ডার মেনেও নির্দিষ্ট ঋতুতে এক একটা উতসব পালন করতে পারেন।

পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে দিন রাত্রি হয়, বার্ষিক গতির ফলে বছর বদলায়। এছারা পৃথিবী নিজের অক্ষের অভিমুখ ঘুরছে, এর নাম অয়ন গতি।  এখন আমরা ধ্রুবতারাকে উত্তর মেরুর ঠিক ওপরে দেখি। এর পরে অন্যান্য নক্ষত্রকেও ওই জায়গায় দেখা যাবে। অয়ন গতি খুব মন্থর। ২৫৮০০ বছর লেগে যায় এক একটি আবর্তন সম্পূর্ন করতে। কিন্তু বর্ষগণনায় অয়ন গতির একটা ভূমিকা আছে। বাংলা বর্ষগণনার পদ্ধতি যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা এই ব্যাপারটাকে হিসেবের মধ্যে ধরেন নি। তাই বঙ্গাবদ হল নিরয়ন বর্ষ, এবং প্রতি ৬০ বছরে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের তুলনায় একদিন করে পিছিয়ে পড়ছে বাংলা ক্যালেন্ডার। এই ত্রুটি সংশোধন করা না হলে কয়েক হাজার বছর পরে ঋতুচক্রের সঙ্গে বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গতি থাকবে না, অর্থাৎ তখন বৈশাখ মাসে গ্রীষ্মকাল পড়বে না, বা মাঘ মাসে শীতকাল পড়বে না।

বাংলাদেশে যে বাংলা ক্যালেন্ডার মানা হয়, তার প্রথম পাঁচ মাসে ৩১ দিন আর বাকি সাত মাসে ৩০ দিন করে ধরা হয়। যে ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯ দিন পড়ে তার সংলগ্ন ফাল্গুন মাসে বাড়তি একদিন যোগ করে ওই বাংলা বছরটিকে লিপ- ইয়ার ধরা হয়। যেমন, ফেব্রুয়ারি ২০০৪ এ ছিল ২৯ দিন । ওই ফেব্রুয়ারির সঙ্গে পড়েছিল ১৪১০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস। তাই ১৪১০ বঙ্গাব্দ ছিল লিপ -ইয়ার। ভারতে/ পশ্চিম বঙ্গে আমরা এখনও আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কার করে উঠতে পারি নি। আমাদের ক্যালেন্ডারটাকে বিজ্ঞান সম্মত করে তোলার চেয়ে আকবর না শশাঙ্ক - এই বিতর্ক নিয়েই আমাদের উতসাহ বেশি।



মাধব চট্টোপাধ্যায়
হায়দ্রাবাদ, অন্ধ্র প্রদেশ

ছবিঃ ক্যালকাটাওয়েব