খেলাঘরখেলাঘর

ডঃআনন্দ কুমার
ডঃআনন্দ কুমার

ডঃ আনন্দ কুমার (পুরো নাম Dr. Trichynopoly Chelvaraj Ananda Kumer) ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। মানুষের প্রজনন-সংক্রান্ত গবেষণায় তাঁর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
নারীদেহের জরায়ুতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনে যে কোষ তৈরি হয় সেটাই বারবার বিভাজিত হয়ে একটি শিশুর দেহ গঠন করে। কোন কারণে যদি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন সম্ভব না হয় তাহলে সন্তানলাভ সম্ভব হয় না। সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তান লাভে সাহায্য করতে বিজ্ঞানীরা নানা কৌশল অবলম্বন করেন। তার মধ্যে একটি হল নারীর দেহ থেকে ডিম্বাণু ও পুরুষের দেহ থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করে গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশে তাদের মিলন ঘটিয়ে উৎপন্ন কোষটিকে আবার জরায়ুতে ঢুকিয়ে দেওয়া। এই পদ্ধতিতে যে শিশু জন্ম নেয় তাকে বলা হয় টেস্ট টিউব বেবি।

টেস্ট-টিউব শিশুর দল
টেস্ট-টিউব শিশুর দল

পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সাফল্যের সাথে একটি টেস্ট টিউব বেবি সৃষ্টি করার জন্য ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী ডঃ রবার্ট জিওফ্রে এডওয়ার্ডস ২০১০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।

ডঃ রবার্ট জিওফ্রে এডওয়ার্ডস
ডঃ রবার্ট জিওফ্রে এডওয়ার্ডস

ভারতে প্রথম এবং পৃথিবীতে দ্বিতীয় টেস্ট-টিউব বেবি সৃষ্টি করেন কলকাতার স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডঃ সুভাষ মুখার্জি। স্বল্প ব্যয়ে, সামান্য উপকরণের সাহায্য নিয়ে তিনি একটি ডিম্বাণুর সঙ্গে শুক্রাণির মিলন ঘটাতে সমর্থ হল। ফলে ১৯৭৮ সালের ৩রা অক্টোবর এক দম্পতি একটি কন্যা সন্তান লাভ করেন।

ডঃ সুভাষ মূখার্জি
ডঃ সুভাষ মুখার্জি

দুঃখের বিষয় ডঃ মুখার্জির গবেষণা স্বীকৃতি লাভ করেন নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিয়োজিত এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দল তাঁর দাবীকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয়। সরকারী চাকরির নিয়ম কানুন ঠিক মত না মানার জন্য ডঃ মুখার্জিকে ভর্ৎসনা করা হয়। বিদেশে গিয়ে নিজ্ঞানীদের সম্মেলনে নিজের গবেষণাপত্র পড়ার অনুমতিও তাঁকে দেওয়া হয় নি। হতাশা ভারাক্রান্ত মনে ১৯৮১ সালের ১৯শে জুন , মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে কলকাতায় নিজের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী।
এরপর মুম্বইয়ের ইন্‌স্‌টিটিউট ফর রিসার্চ অ্যান্ড রিপ্রোডাকশন Institute for Research and Reproduction গবেষণা গারে ডঃ আনন্দ কুমার আর একটি টেস্ট টিউব বেবি সৃষ্টি করেন। ফলে ১৯৮৬ সালের ১৬ই আগস্ট একটি ছেলের জম্ন হয় এবং তাঁর গবেষ্ণা যথাযথ স্বীকৃতি লাভ করে। এদেশে প্রথম টেস্ট টিউব বেবি তৈরি করার কৃতিত্ব লাভ করেন তিনি। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি নিজেই নিশ্চিত ছিলেন না। বিজ্ঞান কংগ্রেসের একটি অধিবেশনে যোগ দিতে  তিনি কলকাতা যান এবং ডঃ মুখার্জির গবেষণা সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করেন। এইসব কাগজপত্র খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তিনি ঘোষণা করেন যে ডঃ সুভাষ মুখার্জি-ই ভারতে প্রথম টেস্ট টিউব বেবির স্রষ্টা। ডঃ মুখার্জির গবেষণার ফলে যে মেয়েটি জন্ম নিয়েছিল , পঁচিশ বছর বয়স পুরো হলে সে নিজের জন্মের পশ্চাৎপটে ডঃ মুখার্জির অবদানের কথা ঘোষণা করে। মরণোত্তর স্বীকৃতি ও সম্মানে ভূষিত হন ভাগ্যবঞ্চিত বিজ্ঞানী।

ডঃ এডওয়ার্ডস-এর সাথে ডঃ আনন্দ কুমার
ডঃ এডওয়ার্ডস-এর সাথে ডঃ আনন্দ কুমার

World Foundation প্রকাশিত Dictionary of Medical Biography তে মাত্র তিন জন কলকাতার বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্থানলাভ করে তাঁর নাম। এ সবই সম্ভব হয়েছে ডঃ আনন্দ কুমারের দুর্লভ সততার জন্য। দেশজোড়া যশ ও খ্যাতির প্রলোভন অস্বীকার করে তিনি নিজে যে ভাবে উদ্যোগী হয়ে ডঃ মুখার্জিকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দান করেন, আজকের এই হিংস্র পেশাদারিত্ব এবং চূড়ান্ত মূল্যহীনতার যুগে তা সত্যিই বিস্ময়কর। ২০১০ সালের ২৬শে জানুয়ারি ২৪ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। বিজ্ঞান চর্চায় মানবিক মূল্যবোধের যে অসামান্য নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন তার জন্য ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম।

লেখাঃ
ডঃ মাধব চট্টোপাধ্যায়
সেন্টার ফর সেল্যুলার অ্যাণ্ড মলিক্যুলার বায়োলজি
হায়দ্রাবাদ, অন্ধ্রপ্রদেশ
ছবি সৌজন্যঃ
ডঃ রাজভি মেহতা  ও ডঃ মাধব চট্টোপাধ্যায়