খেলাঘরখেলাঘর

গোল বাঁচাল কালূ মিয়াঁ

মানসদের স্কুলে সেবার নানা ছুটি জুড়েটুড়ে একটা মিড-টার্ম ব্রেক হয়ে গেলো। প্রাণের বন্ধু শুভময়ের আদি বাড়ি তিলডাঙা, ওর দাদু-কাকারা এখনও সেখানে থাকেন – এই মওকায় সে সেখানে ঘুরে আসবে ঠিক করলো। মানসের কোনো প্ল্যান নেই শুনে শুভময় ওকে ধরে ঝুলোঝুলি শুরু করলো সঙ্গে আসার জন্য। শেষ অবধি মা-বাবার হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্ট থেকে অনুমোদন আদায় করা গেলো – অবশ্য “সব সময় সাবধানে থাকবি, যেখানে-সেখানে টো টো করে ঘুরবি না, বোতলের জল ছাড়া খাবি না” হ্যানোত্যানো হাজার শর্তসাপেক্ষে।
নামে যাই হোক তিলডাঙা জায়গাটা কিন্তু বেশ ছিমছাম ছোট্ট একটা শহর। শুভময়দের বাড়ি রেল স্টেশন থেকে গাড়িতে যেতে মিনিট পনেরো লাগলো। তখন সবে সন্ধে, কিন্তু এলাকায় কেমন একটা গা ছমছম ভাব। রাস্তায় বিশেষ লোকজন নেই, বাড়িঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। “তোদের শহর কি এত চটপট ঘুমিয়ে পড়ে? নাকি – কোনো ভয়ডর আছে?” মানস জিজ্ঞেস না করে পারলো না।
“ন্‌-না, তেমন কিছু নয়।” শুভময় জোর করে হাসার চেষ্টা করলো। মনে হলো ও কী যেন চেপে যাচ্ছে।
শুভময়ের বাড়ি ঢুকেও এক চমক। তখন সবে শীতের আমেজ পড়তে সুরু করেছে, কিন্তু সবারই যেন কেমন জবরজং পোষাক – কান-টুপি, মোটা ফুলহাতা গরম জামা, সর্বাঙ্গ ঢাকা চাদর। তার মধ্যে এক ভদ্রমহিলা, সম্ভবতঃ শুভর কাকিমা, একটা ধুনুচি হাতে যেন নেচে নেচে বেড়াচ্ছেন। এতক্ষণে মানসের চোখে পড়লো – অন্যান্যদের হাতে-পায়েও যেন চটুল নৃত্যের ছন্দ।
“সবাই অমন বর্ম পড়ে নাচছে কেন রে?” মানস ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোরা কি শাক্ত? এটা কি কোনো রণনৃত্য?”
“উঁহুঃ – এ হচ্ছে মশক নৃত্য।”
“মশক – মানে, ভিস্তি? ইউ মীন – ফোক ডান্স?” মানস উচ্ছসিত হয়ে ওঠে।
“দুর গাড়ল – মশক মানে মচ্ছর, মানে পাতি মশা। সন্ধেবেলা জানালা-দরজা বন্ধ করে ধোঁয়া না দিলে টিঁকতে দেবে না। আর হাত-পা না নাড়িয়ে একবার দেখ দেখি – কামড়ে গোদা গোদা করে ফুলিয়ে দেবে। বিশেষ করে এই সময়টাই ডেঞ্জারাস। এইডিস, এনোফিলিস, কিউলেক্স যত কিসিমের মশা – এই সন্ধেটাই ওদের শিফট চেঞ্জের সময় কিনা। কে যে কামড়াবে ঠিক নেই – তারপর ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, গোদ, বিষফোঁড়া, কী না হতে পারে!”
“ঢপ দিস না – মশা কামড়ালে বিষফোঁড়া হয় না।”
“ওই হলো। যাক গে চল – দুটো মুখে দিয়ে স্থির হয়ে বসবি।”
“স্থির হয়ে বসতে দেবে, বলছিস? না, আমি ওই লাইনেই নেই – নাচতে পারবো না, সুতরাং সোজা মশারির তলে।”
‘দুটো’ মুখে দিয়েই অবশ্য মানসের দিল খুশ। ঘরে তৈরি মোয়া, নাড়ু, ক্ষীরের সন্দেশ – এনি ডে ম্যাকডোনাল্ড-কেনটাকিকে পেঁদিয়ে সমুদ্দুর পার করে দেবে। এরপর রাত বাড়ার সাথে সাথে উড়ন্ত খুদে দুশমনদের বিমান হানা যেন একটু স্তিমিত হয়ে এলো, সাথে সাথে মানুষগুলোও ধীরে ধীরে ‘ছন্দে’ ফিরতে লাগলো। একটু পরেই মানস বুঝতে পারলো, এরা লোক খুব ভালো।
একই কথা শুভও বললো। তবে সাথে কী যেন যোগ করতে যাচ্ছিলো, কাকু এসে পড়ায় থেমে গেলো।
অমন টিফিনের পর রাতের খাওয়া যেন অধিকন্তু হয়ে যায়। তার মধ্যেও মাছটার স্বাদ মানসের মুখে লেগে রইলো। “মাছটা কী ভালো রে!” সে উচ্ছসিত হয়ে বললো।
“ছিলো, এখন আর নেই!” শুভ হাত চাটতে চাটতে উদাস ভঙ্গীতে বললো, “ভালো মাছ আর ভালো মানুষরাই তাড়াতাড়ি চলে যায়।”

পরদিন ভোরে সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে জড়ো হয়েছে। একটু আগেই সুযোগ পেয়ে শুভ কাল রাতের সেই না-বলা ‘কী যেন’টা শুনিয়ে দিয়েছে – দাদু সম্বন্ধে একটু সাবধান। উনি এমনিতে লা-জবাব লোক। শুধু ফিলজফি নিয়ে একবার চড়ে গেলে বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন। মানস ইশারায় জানিয়েছে, ঠিক ম্যানেজ করে দেবে।
যেখানে বাঘের ভয়! ওরা সবে অমলেটে কামড় বসিয়েছে, এমন সময় কী একটা প্রসঙ্গ থেকে যেন দাদু মুডে এসে গেলেন। মাতব্বরি হেসে শুভকে বললেন, “কী রে ছোঁড়া, তোরা নাকি খুব লেখাপড়া শিখছিস, বিজ্ঞান-ফিজ্ঞান ঝাড়ছিস – সৃষ্টিরহস্য কী, জানিস?”
“জানি না, তবে শিগগিরই জেনে নেবো – এখনো বাচ্চা আছি কিনা!” শুভ ভয়ে ভয়ে বলে।
হা-হা হেসে দাদু বললেন, “দু’দিনের ছোঁড়া, তোরা জেনে যাবি – পণ্ডিতরাই যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে ভেবে বের করতে পারলো না ডিম আগে, না মুরগি আগে?”
“সে প্রশ্নের ফয়সালা তো হয়ে গেছে দাদু!” মানস জ্বলজ্বলে চোখে বললো, “ব্রেকফাস্টে অমলেট আর লাঞ্চে চিকেন কারি।”
দাদুর গলায় অমলেট আটকে গেলো। কাশতে কাশতে সভয়ে মানসের দিকে তাকাতে তাকাতে তিনি টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন। পরে নাকি শুভময়কে বলেছিলেন, “কী জিনিস এনেছিস, শুভ! এ যে দেখি পকেট ডায়নামাইট!” তবে লাঞ্চে যাতে চিকেন হয়, তার ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন।
একটু পর সব পড়শি মহিলারা এসে ভিড় জমাতে আরম্ভ করলেন। “কী গো দিদি, শুনলাম তোমার নাতি এসেছে? তাই দেখতে এলুম।” ঠাকুমার কাছ এসে বিগলিত হেসে তাঁরা আর্জি পেশ করলেন।
শুভ বিড়বিড় করে বললো, “এই এক জ্বালা। দেখতে এসেছে না কচু, কলকাতা থেকে এলে প্রত্যেকের জন্য কিছুমিছু না এনে উপায় নেই। সেই খোঁজে এসেছেন।”
মানস এতক্ষণে বুঝলো, ভালো কাকিমা অর্থাৎ শুভময়ের মা টুকিটাকি ভর্তি একটা ব্যাগ শুভময়ের হাতে তুলে দেবার সময় কেন অত গজগজ করছিলেন। শুভকে সান্ত্বনা দিয়ে সে বললো, “যাক গে, হাজার হলেও এরা তো তোদের neighbor –”
“এভার নেবার – নেভার দেবার!” বলতে বলতে শুভ ঘাড় গোঁজ করে ব্যাগটা বের করে ঠাকুমার হাতে তুলে দিলো। তারপর মানসের দিকে চেয়ে বললো, “চল, ক্রিকেট খেলবি?”
মানস তো একপায়ে খাড়া। পাড়ার ছেলেগুলো অবশ্য চমৎকার। ক্যাম্বিস বল আর কাঠির উইকেটে মিঠে রোদের মধ্যে দারুণ একখান টি-টুয়েন্টি হলো। ক্যাম্বিস বলেও স্রেফ পেস বদলের যাদুতে প্রতিপক্ষকে চার ওভারে পনেরো রানে বেঁধে রেখেও মানস পারলো না, কিছু এলোপাথারি শট নিয়ে ওরা দু’ বল বাকি থাকতে রানটা তুলে দিলো। তবে খেলার শেষে সবাই এসে মানসের সাথে হাত মেলালো আর বিকেলে ফুটবল খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানালো।
ফেরার সময় মানসের চোখে পড়লো, শহরের উত্তরে কিছু দূরে এক জংলা এলাকা। একটু উত্তেজিত হয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, “জন্তু-জানোয়ার আছে নাকি রে?”
“এককালে ছিলো, চোরাশিকারিদের দৌরাত্মে এখন দু-একটা শেয়াল-ফেয়াল ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা যায় না।” শুভ তাকে আশ্বস্ত করলো। তারপর যোগ করলো, “তবে ওদিকে না যাওয়াই নিরাপদ। পুলিশের তাড়া খেয়ে ক্রিমিনালরা মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে গা ঢাকা দেয়।”
মানস-শুভ ‘কলকাতার বাবু’ বলে দুপুরে পুকুরের বদলে ওদের ধরা জলে স্নান করতে হলো। দুপুরের খানাটা বলা বাহুল্য বেশ ভারী হলো, তবে খেলাধূলায় চনমন শরীরে সেসব কোথায় তলিয়ে গেলো। বিকেলে ফুটবল। মানস যথারীতি তেকাঠির নীচে, অর্থাৎ গোলি। সে একটা ‘ডাইভিং সেভ’ করার পর মাঠ জুড়ে পটাপট হাততালি। এতক্ষণে মানসের চোখে পড়লো, চারপাশ দর্শকে ভরে গেছে। কলকাতার ছোঁড়াদের খেলার কথা শুনে বোধহয় অনেকে হুজুগে হাজির হয়েছে।

সেই দর্শকদের মধ্যে ছিলো পচা মন্টু, ল্যাংড়া যতে আর হুব্বা পাঁচু। এটা ওদের বেপাড়া। কিন্তু একটা ‘কেস’ করার পর আপাতত পাড়ায় যাবার উপায় নেই। কিছুদিন কাছাকাছি কোনো শহরের একটা হোটেলে লুকিয়েছিলো। কিন্তু কাগজে ওদের ফোটো বেরিয়ে হাওয়া গরম হয়ে যাবার পর বাধ্য হয়ে সে আস্তানা ছেড়ে জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে হয়েছিলো। এখন আবার হাওয়ায় ‘কেসের’ গন্ধ পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।
“আমার খবর ভুল হয় না।” মন্টু ফিসফিসিয়ে বলছিলো, “ঐ যে ছেলেটা গোলে খেলছে, ওর বাপই কলকাতার মস্ত ডাক্তার – এবেলা ওবেলা রোগীর পেট কাটছে। একবার তুলতে পারলে বাপকে রগড়ে কোন না চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ!”
“সাথে লোকাল ছোঁড়াটাকেও ফাউ হিসেবে তুললে হতো না? যা পাওয়া যায়।” পাঁচু জিজ্ঞেস করলো।
“ধুর, ওসব ফালতু পার্টি। এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে একখান বাড়ি আছে বটে, কিন্তু সব পাতি চাকরি করা পাবলিক। ওতে খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি হয়ে যাবে।”
“বেশ, এবার তুমি কী প্ল্যান ছকেছো, বলো।”
“বলছি, কিন্তু আগে সাইডে আয়।” মন্টু চেলাদের একটু দূরে টেনে আনে।

“দেখছিলি, ছোঁড়াগুলো কেমন ফুটবল খেলছিলো? তোরা কেউ কখনো খেলেছিস?”
“কী যে বলো গুরু – নইলে এই ঠ্যাংটা এমন অষ্টাবক্র হলো কীভাবে?” যতে দাঁত বার করে।
“হলো কেন, জানিস? তুই ডিফেন্সকে টপকাতে পারিসনি, তাই আটকে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙেছিস।  ডিফেন্সের অনেকগুলো ভাগ থাকে – হাফ লাইন, তারপর ডীপ ডিফেন্স, তারপর –”
“সে যাক, এবার বলো তুমি সেগুলো টপকাচ্ছো কীভাবে ।” পাঁচু ধৈর্য রাখতে না পেরে বললো।
“বলছি। প্রথম কথা – দিনেমানে এখন কোনো কেস করা যাবে না। পাবলিক যেমন তেড়িয়া হয়ে আছে, ধরা পড়ে গেলে থানায় যাবার আগেই গণধোলাইয়ে কম্মো শেষ। তাই কাজ নামাতে হবে রাতে।”
“সে আর বলতে। তারপর?”
“তবে আমার খবর – আশেপাশে কেস হবার পর এখানে ছেলেরা রাতপাহারা দেয়। এটাই হচ্ছে এক্ষেত্রে হাফ লাইন।”
“ফুঃ, লাঠি হাতে কতগুলো ডরপোক ছোকরা – দু’মিনিটে উড়িয়ে দেবো।”
“অত সহজ নয়। ওরা দলে অনেক, চোরাগোপ্তা অস্তর-শস্তরও থাকতে পারে। শুধুমুধু প্রাণের ঝুঁকি নেবো কেন?”
“তাহলে ওদের কাটাবে কীভাবে?”
“স্রেফ ধোঁকা দিয়ে, ভুলিয়ে।” মন্টু গোঁফে তা দিয়ে বললো, “এই ব্রেনে যে কত আইডিয়া খেলে, তা যথাসময়েই জানতে পারবি।”
“নইলে কি আর তোমায় গুরু মানি?” যতে গড় করলো।
“তারপর ব্যাক লাইন হচ্ছে সরকার বাড়ির দরজা-জানালা। ওগুলো খুব শক্তপোক্ত। ভাঙতে সময় লাগবে, খুটখাট আওয়াজও হতে পারে। এখানেও লোকজন উঠে গেলে কাজটা ঝামেলার হয়ে যাবে। ফটাফট টেলিফোনে ডেকে লোক জড়ো করবে, পুলিশে খবর দেবে। তাই সব চুপিসারে নামাতে হবে।”
“কীভাবে?”
একগাল হেসে মন্টু বললো, “কীভাবে আবার, ঐ ফুসফাসে।”
“এস্প্রে?” পাঁচু হেসে বললো, “তা, যদি জানালা বন্ধ করে ঘুমোয়?”
“এ তো আর কাঁচের ফেরেঞ্চ জানালা নয়, ফাঁক দিয়ে ঠিক গ্যাস ঢুকে যাবে। তারপর দশ মিনিটের মধ্যেই নিদুলি মন্তরে বাড়ি অচেতন। এবার গোটা দুই দরজা ভাঙো। তারপর দোতলার উত্তর-পুব কোনের ঘরটায় ঢুকে মাল তুলে নিয়ে বেরিয়ে এসো, ব্যস।”
“তুমি এত জানলে কীভাবে?”
“গুরুদের জানতে হয়। তবে ভুল করে সরকার বাড়ির ছেলেটাকে তুলিস না। ওই যে শুঁটকো-লম্বাটা গোলে খেলছে, ভালো করে দেখে নে। অন্ধকারেও তাহলে ঠাওর পাবি। কী রে, কিছু বাকি রইলো নাকি?”
“না, গুরু!” বিগলিত হেসে বললো দুই সাকরেদ।

কালু মিয়াকে হতাশার রোগে ধরেছে। বেশ কিছুদিন ধরে ছোট-বড় কোনো পার্টির ঘাড় ভাঙতে পারেনি, এখন গোটা পরিবারের সামনে অনাহারের হাতছানি। শেষ অবধি কি ঘাসপাতা খেয়ে থাকতে হবে নাকি? স্বীকার করো মিয়া, গতরটা বড় হলেও তোমার বয়েস হয়েছে। কিন্তু সেকথা কি পোড়া পেট মানে?
ভাবতে ভাবতে খেয়াল করেনি সে পায়ে পায়ে কখন শহরের দিকে এগিয়ে এসেছে। শহর তার পক্ষে নিরাপদ নয়। কিন্তু জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে থেকেই বা লাভটা কী হচ্ছে? যাক, রাত হয়েছে – এখন লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতটা ঘুরেফিরে কিছু সুবিধে না হলে ভোরবেলা আবার বেরিয়ে পড়া যাবে। তারপর – নাঃ, আর সে ভাবতে চায় না!
ছোট শহর, রাতে রাস্তাঘাটে তেমন আলো নেই। শুধু এই বড় রাস্তাটা নিরাপদে পেরিয়ে যেতে পারলেই হলো। পেরোতে গিয়ে মনে হলো, দূর থেকে কারা যেন আসছে। দু লাফে রাস্তাটা পেরিয়েই কালু খিঁচে দৌড় লাগালো। আর ভয় নেই – এবার দুধারে প্রায় নিটোল অন্ধকার। আর বয়েস হলেও কালুর সাথে দৌড়ে পাল্লা দেয় কার সাধ্যি! ছুটতে ছুটতে একসময় সে একটু দম নেবার জন্য থামলো। পাশেই একটা তিনতলা বাড়ি। বিশেষ আলো দেখা যাচ্ছে না, মনে হয় দু-একটা রাতবাতি জ্বালিয়ে সবাই ঘুমোচ্ছে। নীচের তলায় একটা গাড়িবারান্দার মতো জায়গা, তার এক পাশে অন্ধকারে কুঁকড়ে শুয়ে পড়লো কালু।

“কে যেন রাস্তাটা পেরিয়ে গেলো না, সুধীরদা?”
রাতপাহারার লীডার সুধীরদা একটু ভেবে বললেন, “ঠিক বুঝলাম না। একটা কালো ছায়া যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো। সত্যি, না চোখের ভুল কে জানে। চলো, একটু কাছে গিয়ে দেখা যাক।”
দেখেশুনেও অবশ্য কিছুই বোঝা গেলো না। ভুলই দেখেছেন তাহলে। আবার সবাই এগিয়ে চললেন। কিন্তু একটু পরেই বোঝা গেলো, আজকের রাতটা উত্তেজনায় ভরা। হঠাৎ মনে হলো, দূরে জঙ্গলের ধারে সাদামতন কী একটা নড়ছে। জায়গাটা অন্ধকার, শুধু চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট আবছায়া তৈরি হয়েছে। ওরা এগোবে কিনা ভাবছে, এমন সময় যেন শোনা গেলো একটা বাঁশির আওয়াজ – নাকি চাপা আর্তনাদ?
ছেলেদের চোখে ভয়ের ছায়া। একজন বললো, “চলুন, সুধীরদা – মানে, রাতে-বিরেতে, যদি তেনারা কেউ হন?”
“তুমি না সাইন্স পড়ছো?” লীডার এক ধমক দিয়ে বললেন, “চলো, দেখে আসা যাক।”
“কিন্তু – যদি মানুষ, মানে গুণ্ডা-ডাকাত হয়?”
“এটুকুতে ভয় পেলে চলবে? আমরা প্রায় পনেরো জন। আর আমাদের কাছে দু-একটা জিনিসও আছে। চলো স্কোয়াড, দ্বিধা ফেলে এগিয়ে চলো।”
সুতরাং দ্বিধা ফেলে বা না ফেলে স্কোয়াড এগিয়ে চললো – এই পরিস্থিতিতে দলছুট হয়ে পেছনে থেকে যাবার ঝুঁকিই বা কে নেবে? কাছাকাছি এসে মনে হলো, সত্যিই একটা মানুষ গুড়ি মেরে বসে। হঠাৎ মনে হলো, কিছু ফিসফাস কথাবার্তার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে।
অসমসাহসী সুধীরদা এরপর নিজে সামনে দাঁড়িয়ে “এই, খবরদার, নড়বি না” বলে বিকট চিৎকার করেই সরাসরি গিয়ে চার্জ করলেন। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা গেলো, একটা নিশ্চল মূর্তি গাছতলায় বসানো। আর একটু দেখে বোঝা গেলো, একটা কাকতাড়ুয়া-গোছের জিনিসের ওপর সাদা চাদর জড়ানো হয়েছে। তার পাশে একটা বড় বাঁশের বাঁশি এমন কায়দা করে বসানো যে তার মধ্য দিয়ে হাওয়া বইলেই এক বিকট আওয়াজ হচ্ছে।
কিন্তু ফিসফিস কথাটা? হঠাৎ যেন সেটা আবার শোনা গেলো না? ফের তদন্ত করে সুধীরদা আবিস্কার করলেন একটু দূরে ঘাসের মধ্যে লুকোনো একটা টেপ রেকর্ডার অনবরত বেজেই চলেছে।
“কেউ আমাদের বুদ্ধু বানিয়েছে। কিন্তু কেন?”
“এ নিশ্চয়ই তপনদার দলের কাজ, সুধীরদা। ওরা আমাদের দেখতে পারে না, তাই নাকাল করে মজা দেখছে।”
“হলেই ভালো।” গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে সুধীরদা বলতে লাগলেন, “নাকি, কারণ আরো গুঢ় – কেউ আমাদের এভাবে সরিয়ে এনে সেই ফাঁকে কোনো বদ মতলব হাসিল করতে চায়? নে, তাড়াতাড়ি চল। দেখেছিস, টানে টানে আমরা শহর ছেড়ে কদ্দুর চলে এসেছি?”
সুধীরদা এবার জোরকদমে শহরের দিকে চললেন। তারপর কী ভেবে মোবাইলে স্থানীয় থানার ও-সি সীতেশ বড়ুয়াকেও একটা খবর দিয়ে রাখলেন।

এদিকে মন্টুর দলও জোরকদমে চলেছে। তাদের লীডারের মুখে ফিচেল হাসি। “দেখেছিস তো, হাফ লাইনকে কেমন ডজ মারলাম? রাতপাহারার দল এতক্ষণে পেট ভরে জঙ্গলের হাওয়া আর জঙ্গুলে মশার কামড় খাচ্ছে।”
“তোমার জুড়ি নেই, গুরু।” বলতে বলতে চেলারা সাথে সাথে ছুটছে। দেখতে দেখতে তারা সরকার বাড়ি এসে গেলো।
“এবার ডীপ ডিফেন্স।” বাড়ির কাছে এসে মন্টু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর স্কোয়াডকে কয়েকটা ফাঁক ফোকর দেখিয়ে দিলো। দেখতে না দেখতে সরকার বাড়ির ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো এক অদৃশ্য ঘুমপাড়ানি গ্যাস। বাড়িতে অবশ্য প্রায় সবাই অলরেডি গভীর ঘুমে। শুধু দাদুর সবে ঝিমটি ধরেছিলো, ঘুম আসেনি। তিনি টেরও পেলেন না কখন গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেলেন। আর মানস একটা রহস্য উপন্যাসের শেষ পর্বে। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছে, শেষ করে তবে শোবে। হঠাৎ কেন যেন চোখের পাতা ভীষণ ভারি হয়ে উঠতে লাগলো। আর এক পাতা এগোবার আগেই বই টুপ করে হাত থেকে খসে নীচে পড়ে গেলো।
“ডীপ ডিফেন্সও কিলিয়ার।” এবার অ্যাকশনের জন্য রেডি হ। নাকি কিছু ভুলে গেলাম?”
 “ন্‌-না। কিন্তু গুরু ব্যাককে কাটালাম, এবার যদি গোলকিপার –”
“গোলকিপার? হা-হা, ভালো জোক করেছিস – সরকার বাড়ির গোলকিপার!” বলে মন্টু যন্ত্রপাতির ব্যাগে হাত দিলো।
কালু মিয়া গাড়িবারান্দার তলায় বসে ছিলো। রাতে তার ঘুম আসে না। কিন্তু হঠাৎ যেন বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। একটা ফুরফুরে আমেজ – নাক ভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে তার প্রায় মৌজ এসে গেছে। এমন সময় সদলবলে মন্টু সেখানে এসে উপস্থিত হলো। অন্ধকারে কালু মিয়া প্রায় ছায়ার মতো মিশে আছে। “নে, এই দরজাটাই ভাঙ”, বলতে বলতে মন্টু তার গায়ের ওপর এসে পড়লো।
“এগুলোর জ্বালায় – পৃথিবীর কোনোখানে শান্তি নেই!” প্রবল আস্ফালনে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো কালু মিয়া, তারপর এক ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়লো।

তারপর যে কী ঘটেছিলো, সেটা স্পষ্ট ধারণা করা শক্ত। কারণ এরপর সব খালি এলোমেলো কথা বা দৃশ্য। শুধু রাতপাহারার দল একটা বিকট আওয়াজ শুনে ঘুরে দেখে, সরকার বাড়ির থেকে তিনটে লোক “বাঁচাও, বাঁচাও” চীৎকার করতে করতে ছুটে আসছে। “ধর, ধর” বলতে বলতেই তারা পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে রাতপাহারার বেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু পেছনেই থানার ও-সি জিপ নিয়ে আসছেন দেখে “বাঁচান, বড়বাবু – খেয়ে ফেললে!” বলে দৌড়ে তাঁর জিপে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলো।
জিপের মধ্যে তিন বন্দুকধারী সেপাই, সুতরাং ও-সি নির্ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোরা কারা?”
“আজ্ঞে, আমরা মন্টু, যতে আর পাঁচু।”
“ওঃ, তোরাই সেই তিন গুণধর, যারা ঘুঘুডাঙায় ব্যাঙ্ক লুটেছিলি?”
“বলে লজ্জা দেন কেন, বড়বাবু!”
“তা, আমার এরিয়ায় কী করতে? মিথ্যে বললে কিন্তু –”
“বলছি হুজুর – দয়া করে নামিয়ে দেবেন না। ঐ সরকার বাড়িতে কলকাতা থেকে আসা ডাক্তারের ছেলেটাকে তুলতে এসেছিলাম। একবার কাজ হাসিল হলে ওর বাপের থেকে মোটা দাঁও মারার ইচ্ছে ছিলো। তাহলে আর অনেকদিন কাজকম্মে নামতে হতো না – মানে আমাদের শান্তি, আপনারও শান্তি।”
“তা, শান্তি স্বস্ত্যয়নটা হলো না কেন? আটকালি কীসে?”
“আজ্ঞে, সরকারবাবু যে ইয়াব্বড় এক কালটে চিতাবাঘকে গোলকীপার রাখবেন, জানবো কী করে? ইস, অমন ওপেন নেট গোলটা! তা, শিগগিরি গাড়ি চালান, বাবু – ঐ এলো বলে, খেলো বলে! আপনার পায়ে পড়ি নামিয়ে দেবেন না, বরং আমাদের হাজতে পুরে দিন।”
“কালো চিতাবাঘ, মানে প্যান্থার? তিলডাঙায়?  কী খেয়ে কাজে নেমেছিলি, বলতো?”
“মা কালীর দিব্যি, বড়বাবু – কাজের দিনে দ্রব্য ছোঁয়া গুরুর নিষেধ।”
“ঠিক আছে, যা বোঝার বুঝেছি। তবে এত করে যখন বলছিস, হাজতেই চল।”

তিলডাঙার বিশেষ কেউও অবশ্য চিতাবাঘের গপ্পে বিশ্বাস করলো না। ডাকাতগুলো কোনো বড় কুত্তা-টুত্তা দেখে আচমকা ভয় পেয়েছিলো বলেই শেষ অবধি সাব্যস্ত হলো। শুধু মানসের ঘুমটা তখনো গাঢ় হয়নি, সে বারবার বলতে লাগলো যে আধঘুমে বাঘের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছে। তার কথাও একমাত্র দাদু ছাড়া কেউ বিশ্বাস করলেন না।
আর দিলু কসাই দিব্যি গেলে বলতে লাগলো যে গত রাতে কোনো একটা বড় জন্তু তার খোঁয়াড় থেকে একটা ছাগল তুলে নিয়ে গেছে। এটা তালেগোলে পঞ্চায়েতের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ছল বলেই সবাই সন্দেহ করলো। শুধু দাদু তাকে ডেকে বললেন – একটা কেন, তোকে আমি দুটো ছাগলের দাম দেবো। ও বাঘ আমার সোনা – আমাদের ধনেমানে বাঁচিয়েছে।  

 

অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।